Year-18 # Issue-38 # 6 November 2011

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তির জয়
প্রতিবেদক
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জবাসী। বিশ্লেষকরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে প্রকৃত অর্থে দুটি পক্ষ ছিলথ একটি শান্তি এবং অন্যটি সন্ত্রাস। স্থানীয় সরকার নির্বাচন সত্ত্বেও সারাদেশে ঝড় তোলা নাসিক নির্বাচনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তির বিজয় এসেছে বলে মনে করেন তারা। নারায়ণগঞ্জের দুদশকের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এ নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ নাসিক নির্বাচনের ফল সম্পর্কে  বলেন, এ নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত, যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আছে তাদের মনোনয়ন না দিয়ে সমাজসেবকদের মনোনয়ন দেওয়া। তাহলে জনগণ তা সাদরে গ্রহণ করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, দল যাকে বলবে, তাকেই মেনে নেবেথ এ ধারণা ভেঙে দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জবাসী। নারায়ণগঞ্জ জেলা সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ভবানী শংকর রায়  বলেন, এবারের নাসিক নির্বাচন হচ্ছে অশুভ এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তি ও শুভবুদ্ধির জয়। এটা শুধু নারায়ণগঞ্জের জন্য নয়, সারাদেশের জন্যই একটা মডেল হয়ে থাকবে। নারায়ণগঞ্জ জেলা নাগরিক কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি রাফিউর রাব্বি বলেন, নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে দেশবাসীকে। এখন জনগণকে ভালোবেসেই নেতা হতে হবে, সন্ত্রাস কিংবা অন্য কোনোভাবে নেতা হওয়া যাবে না। দল ভালো মানুষকে সমর্থন না দিয়ে অভিযুক্ত কাউকে সমর্থন দিলে মানুষ তা গ্রহণ করবে না। নাসিক নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট ১৬৩ কেন্দ্রের মধ্যে ১৪০টিতেই জিতেছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। সাবেক এ পৌর মেয়রের জনপ্রিয়তা এমন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে যে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাবেক সাংসদ শামীম ওসমান তার নিজের কেন্দ্রেও পরাজিত হয়েছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা ঘোষিত চূড়ান্ত ফলে দেখা যায়, শামীম পেয়েছেন ৭৮ হাজার ৭০৫ ভোট। পক্ষান্তরে বিজয়ী আইভী পেয়েছেন ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮ ভোট। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিন হেভিওয়েট প্রার্থী ছিলেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, শামীম ওসমান এবং তৈমুর আলম খন্দকার। নির্বাচনের আগের রাতে নাটকীয়ভাবে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তৈমুর। যদিও শুরু থেকে তিনি সমান গুরুত্ব দিয়েই গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন।
যে কারণে সন্ত্রাস বনাম শান্তির ভোটযুদ্ধ : ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন শামীম ওসমান। নারায়ণগঞ্জের অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের কাছে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ওই সময়টি ছিল দুঃস্বপ্নের শামিল। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শামীম ওসমান শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং ওই রাতেই পালিয়ে যান। পরে পাঁচ বছর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় শামীম নারায়ণগঞ্জে ফেরেননি। বিরোধী দল হিসেবে রাজপথের আন্দোলনে ওই পাঁচ বছর ওসমান পরিবারের কাউকে দেখা যায়নি বলে জানান নারায়ণগঞ্জের অনেক আওয়ামী লীগ নেতা। অথচ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে তার ভাই নাসিম ওসমান মহাজোট প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর শামীম ওসমান আবার ফিরে আসেন। এবার তার ছোট ভাই সেলিম ওসমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের সভাপতি হন। দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ওসমান পরিবার নারায়ণগঞ্জের সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে যায়। তারপর আবার ২০০১-এর আগের চিত্র। আবার টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির দাপট। দেখা যায় বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় যে আওয়ামী লীগ নেতারা রাজপথে ছিলেন, তারা যেন বিরোধী দলে চলে গেছেন শামীমবিরোধী হওয়ার কারণে। একদিকে সন্ত্রাস, অন্যদিকে দল ক্ষমতায় থাকার সময় ত্যাগী নেতাদের বিরোধী পক্ষে রাখার ওসমান পরিবারের এ অপকৌশল সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও অনেক দূরে ঠেলে দেয় তাদের। যে কারণে দল থেকে বহিষ্কারের কঠোর হুশিয়ারি সত্ত্বেও জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এসএম আকরাম, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিএ আরাফাতসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের বড় একটি অংশ সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে কাজ করেন। এ অবস্থায় শামীম এবারের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সমর্থন পেলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। অন্যদিকে ২০০৩ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর টানা আট বছর দায়িত্ব পালনের সময় জনগণের সামনে নিজের ভাবমূর্তি আরও উন্নত করেছেন শিক্ষিত, ভদ্র এবং সদা হাস্যোজ্জ্বল ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। দায়িত্ব পালনের সময় তিনি কোনো ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলেননি। বরং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যমে সুশীল সমাজেরও আদর্শ প্রতীক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা জানান, যেখানেই সাধারণ মানুষের কোনো সমস্যা কিংবা অভাব-অভিযোগের কথা শুনেছেন, সেখানেই ছুটে যেতেন আইভী। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ঠিকাদারদের উন্নয়ন কাজ তদারক করতেন। কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে তা পালন করতেন। কোনো বিষয়ে কাজ করতে না পারলে সে বিষয়টিও কারণসহ ব্যাখ্যা করতেন তিনি। র‌্যালির বাগান এলাকার ব্যবসায়ীরা বলেন, নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে শামীম ওসমানের মুখের ওপর কথা বলতেন একমাত্র আইভী। অন্যরা আড়ালে বলতেন, শামীম ওসমান সন্ত্রাস করছেন। আইভী শামীম ওসমানের দিকে আঙুল তুলে বলেন, এবার সন্ত্রাস ছেড়ে দিন। সন্ত্রাস করে পার পাওয়ার দিন শেষ। শামীম ওসমানের মুখোমুখি দাঁড়ানোর এ সাহসের কারণে আইভীকে অনেকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে ব্যাডা একজনই আছে, তার নাম আইভী।’ আইভীর এ ভাবমূর্তিই এবারের ভোটযুদ্ধে তাকে দারুণভাবে এগিয়ে দেয়।
অন্য প্রার্থী তৈমুর আলমের ভাবমূর্তিও ভোটারদের সামনে পরিচ্ছন্ন ছিল না বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ। তারা বলেন, বিআরটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তৈমুরের নিয়োগ-বাণিজ্যের কথা নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে ওপেন সিক্রেট। ছোট হলেও তারও আছে ক্যাডার বাহিনী। এ কারণে আইভী হয়ে ওঠেন সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শান্তি ও শুভবুদ্ধির প্রতীক। ভোট বিশ্লেষণ : ৬৮ বর্গমাইলের নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন চারটি থানা নিয়ে গঠিত। সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ সদর, বন্দর এবং ফতুল্লা থানা এলাকার ৪ লাখ ৪ হাজার ১৮৮ ভোটারের সমর্থন নিজের অনুকূলে আনতে সচেষ্ট ছিলেন প্রধান তিন প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থী। তাদের হিসাবও ছিল চার থানাকেন্দ্রিক। তাদের নজর ছিল নিজ ভোটব্যাংক অক্ষুণ্ন রেখে প্রতিপক্ষের ভোটব্যাংকে হানা দেওয়া। ভোটের আগে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষও হিসাব কষেছেন কোন এলাকায় কার ভোট বেশি আর কার ভোট কম। রোববারের অভূতপূর্ব নির্বাচন সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। চারটি থানা এলাকায় বিপুল ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সর্বশেষ মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে এক লাখেরও বেশি ভোট পেয়ে দেশের সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে প্রথম নারী মেয়র নির্বাচিত হন আইভী। মেয়র পদে অন্য চার প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমুর আলম খন্দকার, আতিকুল ইসলাম জীবন, আতিকুর রহমান নান্নু মুন্সি এবং শরীফ মোহাম্মদ তাদের জামানত হারিয়েছেন। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকায় ৬৩টি ভোটকেন্দ্রে মোট ভোটার ১ লাখ ৪৪ হাজার ৩৮৬। এর মধ্যে পুরুষ ৭২ হাজার ২৬২ এবং নারী ভোটার ৭২ হাজার ১২৪। সদর থানায় ৪২টি ভোটকেন্দ্রে এবং ফতুল্লা মডেল থানা এলাকায় ১৭টি ভোটকেন্দ্রে মোট ভোটার ১ লাখ ৬২ হাজার ২২১। এর মধ্যে পুরুষ ৮২ হাজার ৮৪৩ এবং নারী ৭৯ হাজার ৩৭৮। বন্দর থানা এলাকায় ৪১টি ভোটকেন্দ্র এলাকায় মোট ভোটার ৯৭ হাজার ৫৮১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪৮ হাজার ২৩৩ এবং নারী ৪৯ হাজার ৩৪৮ জন।
চারটি থানায় ভোটের ব্যবধান সম্পর্কে নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণকারী রাইসুল ইসলাম রুশদ বলেন, ১৬৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ডা. আইভী ১৪০টি কেন্দ্রে বিজয়ী হয়েছেন। শামীম ওসমান ২৩টি কেন্দ্রে বিজয়ী হয়েছেন। তবে সেসব কেন্দ্রে ব্যবধান ছিল খুবই কম। ২ ভোট থেকে সর্বোচ্চ দেড়শ’ ভোট। ডা. আইভী হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে শামীম ওসমানকে পেছনে ফেলেছেন। সিদ্ধিরগঞ্জে ৬৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে শামীম ওসমান মাত্র ২২টি কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ভোট পান। বাকি ৪০টি কেন্দ্রে তিনি ডা. আইভীর তুলনায় খুবই কম ভোট পান। নির্বাচনের আগে ধারণা করা হচ্ছিল, শামীম ওসমান সিদ্ধিরগঞ্জে খুবই ভালো করবেন। অথচ দেখা যায় এ এলাকার ১ লাখ ৪৪ হাজার ভোটের মধ্যে তিনি সাকল্যে ৪০ হাজার ২৮৮ ভোট পেয়েছেন। এ থানা বিএনপির শক্ত ঘাঁটি বলেও বিবেচিত। ধারণা করা হয়েছিল বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার এখানে ভালো ভোট পাবেন। শেষ মুহূর্তে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণে বিএনপির ভোটগুলো ডা. আইভীর পক্ষে গেছে বলে ধারণা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। এ থানায় তৈমুর প্রায় ২ হাজার ভোট পান। সদর থানায় ৪২টি ভোটকেন্দ্রে এবং ফতুল্লা মডেল থানা এলাকায় ১৭টি ভোটকেন্দ্রে মোট ভোটার ১ লাখ ৬২ হাজার ২২১। ফতুল্লা মডেল থানা এলাকায় স্থানীয় সাংসদ কবরী তফসিল ঘোষণার পর থেকেই ডা. আইভীর পক্ষে কাজ করেন।
সদর থানায় শামীম ওসমান তার নিজ ভোটকেন্দ্র বার একাডেমী স্কুলেও পরাজিত হন। চাষাঢ়া এলাকায় তার প্রভাবাধীন দুটি কেন্দ্রে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। মা আমেনা মেমোরিয়াল কিন্ডারগার্টেন স্কুল কেন্দ্রে আট এবং জালকুড়ি পশ্চিমপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে মহিলা ভোটকেন্দ্রে তিনি মাত্র দুই ভোটের ব্যবধানে ডা. আইভী থেকে এগিয়ে ছিলেন। বন্দর থানা এলাকায় ৪১টি ভোটকেন্দ্র এলাকায় মোট ভোটার ৯৭ হাজার ৫৮১। এখানে ডা. আইভী মাত্র একটি কেন্দ্রে শামীম ওসমানের চেয়ে কম ভোট পান। বাকি ৪০টি কেন্দ্রে তিনি শামীম ওসমানকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পেছনে ফেলেন। এখানকার স্থানীয় সাংসদ মেয়র প্রার্থী শামীম ওসমানের বড় ভাই নাসিম ওসমানের বিভিন্ন ব্যর্থতার প্রভাব শামীমের ওপর পড়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ভোটের সব অঙ্ক ওলটপালট হয়ে গেল :মূলত এলাকা ভিত্তিতেই ভোটের অঙ্ক করছিলেন দুই বড় দলের অভিজ্ঞ ও দক্ষ রাজনীতিবিদরা। সে হিসাব করে তারা প্রার্থী মনোনয়নও দেন। স্থানীয়ভাবে অবশ্য নারায়ণগঞ্জের ভোটারদের মধ্যে ছিল অভিন্ন সুর। সন্ত্রাস নয়, দুর্নীতি নয়, একজন ভালো মানুষ চাই। সেই সুরের উন্মাদনাতেই ৩০ অক্টোবরের নির্বাচনে শামীম ওসমানের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায়ও আইভীর চেয়ে বেশি ভোট পাননি শামীম ওসমান। শহরে আগে থেকেই আইভী এগিয়ে ছিলেন। নির্বাচনে সেই এগিয়ে থাকা হাতে-কলমে প্রমাণ হয়েছে। শহর এলাকায় শামীম ওসমান সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছেন। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কারণে বিএনপির ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত কদমরসুলেও একচেটিয়া ভোট পেয়েছেন আইভী। যে কারণে ভোটের ব্যবধান লাখে পৌঁছে। ৩০ অক্টোবরের নির্বাচনে প্রায় ২ লাখ নারী ভোটারের মধ্যে ৬০ শতাংশ ভোট দিয়েছেন। আর ভোটের ফল বলে দেয়, নারী ভোটের অধিকাংশ আইভীর দিকেই গেছে। পারবেন কি আইভী :নির্বাচনের আগে সন্ত্রাস, দুর্নীতি আর অশুভর বিরুদ্ধে আইভীর বক্তব্য নারায়ণগঞ্জবাসীকে তো বটেই, দেশের মানুষকেও মুগ্ধ করেছে। অতীতে দেখা গেছে, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অনেক নেতাই নির্বাচনে জেতার পর ভুল পথে গেছেন। পরের নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে খলনায়কে পরিণত হয়েছেন। যদিও আট বছর পৌর মেয়র থাকার সময় আইভী তার ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছেন এবং উজ্জ্বলতর ভাবমূর্তি নিয়েই নাসিক নির্বাচনের ভোটযুদ্ধে লড়েছেন। প্রলোভন, ক্ষমতার অপব্যবহার না করে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে পরবর্তী পাঁচ বছর তার অবস্থান ধরে রাখতে পারলে তিনি আরও ভালো উদাহরণ জাতির সামনে তুলে ধরতে পারবেনথ এমন অভিমত সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিশ্লেষক, সাধারণ মানুষ ও নারায়ণগঞ্জবাসীর।
ত্যাগ ও আনন্দের উতসব ঈদুল আজহা
মিজান রহমান
সব পালনে বাঙালীদের জুড়ি নেই। আদি যুগ থেকেই মুসলমানদের কয়েকটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। পৃথিবীর মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমে উদযাপন করছেন। আমরা বাংলাদেশীরা বিশেষ করে দুটি ঈদ পালন করে আসছি স্বগৌরবে। এর মধ্যে একটি ঈদ-উল-ফিতর ও অন্যটি ঈদ-উল-আজহা। ঈদ-উল-ফিতর চলে গেছে আসছে ঈদ-উল-আযহা।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে পালিত হবে আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য, ত্যাগের স্মৃতিবিজড়িত ঈদ-উল-আযহা। পশু জবাইয়ের মধ্য দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের  চেষ্টা করা হয় বলেই একে কোরবানি বলা হয়। স্মরণ করা  যেতে পারে, আল্লাহর নির্দেশকে হজরত ইব্রাহিম (আ.) অধিক গুরুত্ব দেন নাকি নিজ সন্তানকে, তা পরীক্ষার জন্যই নিজ সন্তানকে কোরবানির নির্দেশ এসেছিল। সে ঈমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)। যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় প্রত্যেক মুসলমানের ঈমান পরীক্ষার দিন হিসেবে ঈদুল আজহা পালিত হবে ১৭ নভেম্বর ২০১০। এরই মধ্যে মুসলমানরা নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। দূরের কর্মস্থল থেকে আজও অনেকে ছুটে চলেছেন নিজ বাড়িতে আপনজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের জন্য। ঈদুল আজহার দিনে নামাজের পর বিশ্বের মুসলমানরা আল্লাহর নির্দেশ এবং তার সন্তুষ্টির জন্য সাধ্যানুযায়ী পশু কোরবানি দেবেন। এর মাধ্যমে তারা স্মরণ করবেন আল্লাহর প্রতি হজরত ইব্রাহিমের (আ.) শর্তহীন আনুগত্য এবং সুমহান ত্যাগের সেই ঘটনা। অনন্যসাধারণ  সেই দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করার তাগিদ নিয়েই বিশ্ব মুসলিমের সামনে ঈদুল আজহা পালনের নির্দেশ এসেছে। আল্লাহর  নৈকট্য বা সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করার নিয়তে নির্দিষ্ট তারিখে, নির্দিষ্ট নিয়মে, নির্দিষ্ট পশু জবেহ করাই কোরবানি। তবে কোরবানির আধ্যাত্মিক অর্থ আরও গভীর ও তাত্পর্যময়। কেননা, কোরবানি করা পশুর রক্ত-মাংস কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। আল্লাহর কাছে পৌঁছায় বান্দার আত্মনিবেদন। কোরবানির অন্যতম শর্ত হচ্ছে, হালাল অর্থ দিয়ে কোরবানির পশু ক্রয় করা এবং এর গোশত, চামড়া, এমনকি ক্ষুর পর্যন্ত দরিদ্র মানুষের মধ্যে নিয়মানুযায়ী বিতরণ করা। বস্তুত আত্মোৎসর্গের মহান আদর্শই ইসলামের ভিত্তি। ঈদুল আজহা পালনের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা সে শিক্ষাই লাভ করে। এবারে নির্বাচিত সরকার ২ বছর পার করলেও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের দেখা মেলেনি, ডিজিটাল বাংলাদেশকে সামনে রেখে জাতীয় অর্থনীতির উন্নতির ক্ষেত্রে অগ্রগতি কিছুটা হলেও ব্যয় বৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। বাজারে দ্রব্যমূল্যে অস্থিরতা কমেনি। এখন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণের ঈদ আনন্দ ব্যাহত না করলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশে কিছুটা হলেও সমস্যা রয়েছে। এদিকে কোরবানির পশুর হাটে বেচাকেনা এখনও অন্যবারের মতো জমে ওঠেনি। যাদের সামর্থ্য আছে তারা যেন অন্যদের প্রতি সহমর্মিতার হাত আরও কিছুটা প্রসারিত করেন।
ঈদুল আজহার কোরবানির অনুষ্ঠানকে সার্থক ও সফল করে তুলতে হলে বিশেষ করে সব কোরবানিদা তাকে প্রথমত নিজের মন থেকে যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি ও স্বার্থপরতাকে কোরবানি দিতে হবে। তারপর সমাজে বিরাজমান অন্যায়, অবিচার, অসাম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে সফলতা আশা করা যায়। দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, ত্যাগ ও অসংখ্য জীবনের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অর্থবহ ও মজবুত করতে আরও আত্মত্যাগের প্রয়োজন, বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ব্যাপারে ঈদুল আজহার চেতনা তথা মর্মবাণী আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। শুধু ঈদের দিনে নয়, ত্যাগের মহান আদর্শের কথা যেন আমরা বছরের অন্য দিনগুলোতেও স্মরণে রাখি এবং বাস্তব জীবনে তা সমুন্নত রাখি।
আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত এক অনন্য দিন আগামী ৭ নভেম্বর। বিশ্ব মুসলিমের প্রধান দুই ধর্মীয় উৎবের একটি হচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহা। এদিন সকালে ঈদুল আজহার নামাজ আদায়ের পর আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু কোরবানি করবেন মুসলমানরা। ‘ইন্নাসসালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’ অর্থাৎ আমার সব নামাজ ও কোরবানি এবং আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছুই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য। পবিত্র কোরআনের এ আয়াত মুখে ও মনে রেখে ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে দিনটি পালন করা হবে।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে কোরবানির ঈদ হিসেবে পরিচিত ঈদুল আজহায় মুসলমানরা জামাতে নামাজ আদায় করেন এবং সাধ্য অনুযায়ী পশু কিনে কোরবানির মাধ্যমে মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের চেষ্টা করেন। এদিনে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর নির্দেশে তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য হজরত ইব্রাহিম (আ.) পৃথিবীতে তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইলকে (আ.) কোরবানি করতে উদ্যত হয়ে আল্লাহর রাস্তায় আত্মত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে আল্লাহর অসীম ইঙ্গিতে একটি দুম্বা কোরবানির মাধ্যমে সে নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়। এরপর থেকেই মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর নিদর্শন হিসেবে প্রতিবছর গৃহপালিত পশু কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মত্যাগের প্রতীকী পরীক্ষা দেয়ার বিধান চালু হয়। পরবর্তীতে সাইয়েদুল মোরসালিন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মহাপুরুষ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর মাধ্যমে  এ কোরবানি প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়। পবিত্র জিলহজ মাসের ১০ তারিখ এদিনটি পালিত হয়। তবে ধর্মীয় বিধান অনুসারে পবিত্র এই মাসের ১০, ১১ এবং ১২ তারিখের যে কোনোদিনই পশু  কোরবানি দেয়া যায়।
সারাবিশ্বের মুসলমানদের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদা, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ত্যাগের মহিমার মধ্য দিয়ে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। ইতোমধ্যে ঈদের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। তবে কোরবানির পশু কেনা এখনও শেষ হয়নি। অনেক জায়গায় ঈদের দিন সকালেও কোরবানির পশু বেচা-কেনা হয়ে থাকে। বাবা-মাসহ আপনজনদের সঙ্গে মিলে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে রাজধানী ঢাকাসহ প্রধান প্রধান নগরীর অনেক বাসিন্দা নানারকম ভোগান্তি ও দুর্ভোগ উপেক্ষা করে ছুটে চলেছেন নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে। আপনজনদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে আনন্দ ভাগাভাগির চেষ্টা করবেন তারা। রাজধানী ঢাকা অনেকটা ফাঁকা হয়ে আসছে। দেশের সব ঈদগাহ মাঠ ও প্রায় সব মসজিদে ঈদের জামাতের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ঈদের প্রধান জামাত হবে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। জাতীয় ঈদগাহ ঢাকাসহ  দেশের বিভিন্ন ঈদগাহ ও মসজিদে নামাজ পড়ার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে ইতোমধ্যে। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সংসদের বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন। এছাড়াও দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনও বাণী দেন। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, বৃহত্তর স্বার্থে দেশ ও দশের উন্নয়নের জন্য প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করাই এই ঈদের মাহাত্ম্য ও মহান শিক্ষা। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে এই ত্যাগের মহিমায় ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধকে সমুন্নত করবেন এ আমার আশা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, প্রিয়বস্তুকে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎর্গের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি লাভের যে অনুপম দৃষ্টান্ত হযরত ইব্রাহীম (আঃ) স্থাপন করে  গেছেন, তা বিশ্ববাসীর জন্য চিরকালই অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। এই উৎবের মধ্য দিয়ে সামর্থ্যবান মুসলমানগণ কোরবানিকৃত পশু আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে প্রকারান্তরে সবার মধ্যে সমতা প্রতিবিধান এবং পরহিতষ্ণুতার অনুশীলন করে থাকেন। তিনি ঈদুল আজহার মর্মবাণী উপলব্ধি করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে বিভেদ বৈষম্যহীন একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে  তোলার আহ্বান জানান। বিরোধী দলীয় নেতা, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ত্যাগের মহান বার্তা নিয়ে ঈদুল আজহা আমাদের মাঝে সমাগত। কোরবানির মূল শিক্ষা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কোরবানির যে মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, আমাদের সবার জন্য তা অনুসরণীয়। ব্যক্তিগত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে মানবকল্যাণে আত্মনিবেদিত হয়ে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্রতী হওয়া আমাদের কর্তব্য। দেশের বর্তমান অবস্থায় সবার পক্ষে ঈদের আনন্দ যথাযথভাবে উপভোগ করা সম্ভব হবে না। দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি দরিদ্র ও কম আয়ের মানুষকে
চরম দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাই আমি  দেশের সব বিত্তবান ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে আহ্বান জানাই দরিদ্র এবং অসহায় মানুষদের দিকে সাহায্য ও সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করার জন্য। ঈদের আনন্দের দিনে কেউ যাতে অভুক্ত না থাকেন, সেদিকে আমাদের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ঈদুল আযহা উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এছাড়াও প্রতিবছরের ন্যায় রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবনে আলোকসজ্জা করা হবে। এ উপলক্ষে হাসপাতাল, কারাগার ও এতিমখানায় পরিবেশন করা হবে উন্নত খাবার। পত্রিকাগুলো প্রকাশ করবে বিশেষ ক্রোড়পত্র। বাংলাদেশ  টেলিভিশনসহ বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলে ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালাও প্রচার করবে। 

দেশে বিদেশে ঈদুল আজহা
প্রতিবেদক
ঈদুল আজহা দৃশ্যত বধের উৎসব। এই পশুবধ প্রতীকী এবং পোশাকি। ঈদুল আজহার নিগূঢ় ভাব নিহিত মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পশুকে  বধ করা। পরের জন্য, ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য সুন্দরের জন্য, নিজের জীবনকে ত্যাগ করার মানসিকতা অর্জন করা। মানুষ মানুষের জন্য এই উচ্চারণ তখনই সত্যে পরিণত হয় যখন ব্যক্তি মানুষ এবং সামাজিক মানুষ আত্মস্বার্থ কোরবানি করে পরার্থে নিজের ভাবনা ও কর্মকে নিয়োজিত করে। সামাজিক উৎসবে মানুষ ব্যক্তির খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসে। হয়ে ওঠে সমাজের অংশ। ঈদুল আজহা হলো সেই সামাজিক উৎসব যাতে মানুষ, বিশেষত ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা পরস্বার্থে নিজেকে উজ্জীবিত করার দীক্ষা নেয়। এই দীক্ষা না নিতে পারলে আমাদের এই সামাজিক উৎসব কেবলই বধের উৎসব হয়ে থাকবে। যেহেতু ঈদুল আজহার অন্যতম অনুষঙ্গ পশু জবাই সেহেতু পশুবর্জ্য এ উৎসবের একটা বিশেষ সমস্যা। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন সচেতনতা। আমাদের বিশ্বাস সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সামাজিকগণ এ সমস্যা সম্পর্কে সচেতন ও সতর্ক থাকবেন। ধর্মীয় অনুশাসন এক হলেও ঈদুল আজহায় কোরবানি দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। নামেও ভিন্নতা দেখা যায়।  বিশ্বের দেশে ঈদুল আজহা পালনের এমনই কিছু বিচিত্র তথ্য তুলে ধরা হলো
মরক্কো
এদেশে ঈদুল আজহা ‘ইন এল কাবির’ বা ‘বড় ছুটি’ নামেও পরিচিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মরক্কোতে ঈদুল আজহা পালনের রীতিতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখানে অনেকে ঋণ করে কোরবানির পশু কেনেন। কিন্তু অনেকে পশু কোরবানিতে মোটেই আগ্রহী নন। তারা দিনটিকে একটি ছুটির দিন হিসাবে কাটিয়ে দেন।
অনেক মরক্কোবাসী অর্থের অভাবে কোরবানি করতে আগ্রহী হন না। আর নতুন প্রজন্ম এটিকে মনে করে পুরনো প্রথা। পশুর রক্ত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করে তারা এদিন ঘুরে বেড়াতেই বেশি পছন্দ করে। ঈদের আগের দিনই মরক্কোর ঘরে ঘরে মিষ্টি এবং বিস্কুট তৈরি করা হয়। পশু কোরবানির আগে তারা বাসায় ঐতিহ্যবাহী নাশতা সারেন। এই নাশতায় থাকে হেরবেল (গম ও দুধের স্যুপ), হারসা, বেঘরির এবং ক্রাবেল। এরা মাংস দিয়ে তৈরি করেন মেচুই, ম্রৌজিয়া নামের ডিশ। এ ছাড়া মাথা, লেজ, খুর, মগজ, চর্বি ইত্যাদি দিয়েও তারা বিশেষ ডিশ তৈরি করেন।
অস্ট্রেলিয়া
ঈদুল আজহার দিন অস্ট্রেলিয়ায় সরকারি ছুটি থাকে না। তবে ইসলামিক স্কুল, সামাজিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এ দিনটিতে বন্ধ থাকে। অস্ট্রেলিয়ার মুসলিম সম্প্রদায়ের বসবাস প্রধানত সাবার্বান শহরকে কেন্দ্র করে। এখানে প্রত্যেকের আলাদা কোরবানির পশু কিনে লালন-পালন করার জায়গা নেই। তাই কয়েকটি পরিবার মিলে একজনকে দায়িত্ব দেয় পশু কেনার এবং যতœ করার। যারা পশু কেনার টাকা দেন তাদের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে পশুর আকার ঠিক করা হয়।
এদিন সকালে মুসলমানরা মসজিদে নামাজ আদায় করেন। মসজিদের আশপাশে এ সময় যানজট লেগে যায়। গাড়ি পার্ক করার মতো জায়গাও পাওয়া যায় না। এরপর বাড়ি ফিরে তারা কোরবানি করেন। এদিন মুসলমানরা কোরবানির মাংস এবং টাকা গরিবদের দান করেন। দান শুধু মুসলমান নয়, অন্য ধর্মের গরিবদেরও করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার মুসলমানরা এদিন ‘বাকলাঙা’ এবং ‘লোকুম’ নামের দুটি তার্কিশ ডিম রান্না করে।
নাইজেরিয়া
এটি নাইজেরিয়ার অন্যতম উৎসব। এদিন নাইজেরিয়ার মুসলমানরা একে অপরকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন। বিশেষত গরিব এবং অসুস্থ মুসলমানদের সাহায্য করা এখানকার সামাজিক প্রথা। কোরবানির মাংস এবং নতুন কাপড় গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এদিন পরিবারের ছোটদের উপহার দেওয়া হয়। বর্তমানকালে কার্ড আদান-প্রদানের রীতিও যোগ হয়েছে এ উৎসবে।
কাজাখস্তান
এদেশে ঈদুল আজহা ‘কোরবান বায়রামি’ এবং ‘বকরি ঈদ’ নামেও পরিচিত।
মিসর
মিসরের ঈদুল আজহা ‘ঈদুল কিবর’ নামে পরিচিত। সকালে নামাজ শেষ করে তারা গরিবদের মাঝে মাংস বিতরণ করে।
পাকিস্তান
পাকিস্তানে ঈদুল আজহা পালিত হয় চারদিন ধরে। এ সময় বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ থাকে। কোরবানির মাংস গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। অনেকে রাতে রেস্টুরেন্ট বা আত্মীয়ের বাড়িতে খেতে যান।
আলজেরিয়া
আলজেরিয়াতে এ উৎসব ‘ঈদ-এল-কবির’ নামে পরিচিত। চারদিন ধরে এ উৎসব পালিত হয়। চাঁদ দেখে ঈদের দিন নির্ধারণ করা হয়। এদিন সবাই নিজের সেরা কাপড়টি পরেন। সাধ্যমতো কোরবানি দেন।
ভারত
ভারতে পুরুষরা নতুন জামা পরেন এবং মহিলারা নতুন কাপড়ের সঙ্গে গহনা পরেন। অনেকে হাতে লাগান মেহেদি। ঈদের নামাজে দেশ ও আত্মীয়দের জন্য প্রার্থনা করেন। ধনীরা গরু, ভেড়া, উট, খাসি ইত্যাদি কোরবানি দেন। অনেক গরিব বেশ কয়েকজন মিলে একটি ছোট পশু কোরবানি দেন। ঈদের তৃতীয় দিনের সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত ভারতে কোরবানি দেওয়া হয়। ক্ষীর, পায়েস ভারতের ঈদের বিশেষ খাবার।
সুদান
সুদানে প্রধানত কোরবানি দেওয়া হয় উট এবং গরু। ঈদের নামাজকে বলা হয় ‘সালাহ আল ঈদ’। সুদানে ঈদের দিন সরকারি এবং স্থানীয় উদ্যোগে ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। এটি সুদানবাসীর আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ। এ ছাড়া সেখানকার বিভিন্ন আদিবাসী এদিন তাদের ঐতিহ্যবাহী নাচ প্রদর্শন করেন। সবমিলিয়ে কোরবানির পাশাপাশি নানা উৎসবে জমজমাট থাকে সুদানের ঈদুল আজহা।
দুবাই
দুবাইয়ে ঈদুল আজহা পালিত হয় চারদিন ধরে। মুসলিম অধ্যুষিত শহর এবং গ্রামগুলো বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয়। শিশুরা নতুন পোশাক পরে এবং বড়দের কাছ থেকে ঈদের সালামি ‘ঈদিয়া’ পায়। এদিন অতিথিদের দুবাইয়ের স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি এবং ফল দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। যাদের সামর্থ্য আছে তারা কোরবানি দেন। ঈদ উপলক্ষে দুবাই ইভেন্টস অ্যান্ড প্রমোশন এস্টাবলিশমেন্ট শহরে উৎসবমুখর পরিবেশ নিশ্চিত করতে নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এর মধ্যে আছে কনসার্ট, কমেডি শো ইত্যাদি। এদিন দুবাই এয়ারপোর্টে যাতায়াতকারী অতিথিদেরও ঐতিহ্যবাহী কফি এবং মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
আফগানিস্তান
আফগানবাসী এদিন কোরবানি দিয়ে আত্মীয় এবং গরিবদের মধ্যে মাংস বিতরণ করে। এদিন বিচ্ছিন্ন কিংবা সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়া বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনরা সব ভেদ ভুলে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করেন। ঈদ উপলক্ষে আফগানিস্তানের পোশাক, জুতা, ফল, ফার্নিচার ইত্যাদির বাজার জমে ওঠে। ঈদে আফগানরা আবশ্যই তাদের পরিবারের জন্য কিছু কিনতে চেষ্টা করেন। ছোটরা এদিন উপহার পায়। তবে আফগানিস্তানের গরিব মানুষ ঈদে কোরবানি দেওয়ার বা ঈদ উদ্যাপনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর হামলার পর থেকে সেখানে ঈদের আনন্দ নিরাপত্তার অভাবে অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে।
মালদ্বীপ
ঈদুল আজহা মালদ্বীপের অন্যতম উৎসব। এই দিনটি সেখানে ঈদ-এ কোরবান বা কোরবানির ঈদ নামেও পরিচিত। মালদ্বীপে প্রধানত ভেড়া, ছাগল কোরবানি দেওয়া হয়। এছাড়া আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো আর দানের মাধ্যমে মালদ্বীপবাসী ঈদ উদ্যাপন করে।
ঈদ উপলক্ষে এরা তাদের ঘরবাড়ি সুন্দর করে সাজায়, অনেকে সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ছুটি কাটাতে যায়।
কাতার
এদিন কাতারে রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে। কাতারের মানুষ প্রধানত গরু এবং ছাগল কোরবানি দেয়। গরিব আর আত্মীয়দের মধ্যে বিলিয়ে দেয় কোরবানির মাংস। খাবার, প্রার্থনা আর নতুন কাপড় পরে ঈদ উদ্যাপন করে কাতারবাসী।
বাহরাইন
বাহরাইনের অন্যতম উৎসব ঈদুল আজহা। এখানে কোরবানি দেওয়া হয় উট, গরু এবং ভেড়া। এদিন দেশটিতে রাষ্ট্রীয় ছুটি।
বারকিনা ফাসো
আফ্রিকার এ দেশটিতে ঈদুল আজহা তাবাসকি নামে পরিচিত। এ উৎসব এদেশের ভেড়া ব্যবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত ভালো সময়। সামর্থ্যবান সবাই এদিন দান করেন।   

স্রোতের বিপরীতে নান্সি
বিনোদন প্রতিবেদক
এই সময়ের গানে এক বিস্ময় ন্যান্সি। এতো অল্প সময়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছানোর দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই। অন্য অনেকের সঙ্গে কাজ করলেও হাবিবের হাত ধরেই তিনি পেয়েছেন চটজলদি সাফল্য। অডিও, প্লেব্যাক আর স্টেজ নিয়ে এখন ভীষণ সময় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আসুন শুনি, ন্যান্সির সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প।
জন্মসূত্রে যশোরের মেয়ে হলেও ন্যান্সি বেড়ে উঠেছেন সোমেশ্বরী নদীর পাড়ের নেত্রকোনায়। তার পুরো নাম নাজমুন মুনিরা ন্যান্সি। মা জোৎস্না হক ছিলেন শখের শিল্পী। ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটির খেলার সঙ্গী ছিল তার মায়ের হারমোনিয়াম। মায়ের কণ্ঠের গানই ছিল তার ঘুমানোর মহৌষধ। গানের প্রতি এমন আগ্রহ দেখে বাবা-মা তিন বছর বয়সেই আদরের দুলালীকে ওস্তাদ তারাপদ দাসের কাছে তালিম নেয়ার জন্য দিলেন। এরপর পাঁচ বছর বয়সে নজরুলসঙ্গীত ও কাসিক্যাল শেখার জন্য শিশু একাডেমিতে ভর্তি করানো হলো। পাশাপাশি নাচের উপরও তালিম নেন এসএসসি পর্যন্ত। ছোট সেই মেয়েটিই আজ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় গায়িকা ন্যান্সি।
গানের ভুবনে পথচলা শুরুর কথা জানিয়ে ন্যান্সি বললেন, আসলে মায়ের প্রবল ইচ্ছাতেই আজকের এই অবস্থানে এসে পৌছেছি। মা গান গাইতেন। তার গানের মায়াজালেই আমার আজকের ন্যান্সি হয়ে ওঠা।
তবে আজকের ন্যান্সি হয়ে ওঠার পেছনে চমৎকার একটা গল্প আছে। নেত্রকোনায় থাকাকালীন ন্যান্সির বাসায় এক সন্ধ্যায় ঘরোয়া গানের আসরে তার মামা নজরুল ইসলামের সঙ্গে আসেন বিখ্যাত শিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ। সেদিন ন্যান্সির গান শুনে তিনি বেশ খুশি হয়েছিলেন এবং ন্যান্সির মাথা ছুঁয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। ফেরদৌস ওয়াহিদ তখন ঢাকায় এসে ছেলে হাবিবের কাছে ন্যান্সির কন্ঠের স্বকীয়তা ও মাধুর্যের প্রশংসা করেন।
হাবিব ‘ভালবাসবো বাসবোরে ...’ গানটির কোরাসের জন্য সে সময নতুন মেয়ে খুঁজছিলেন। তাই ন্যান্সিকে তিনি তার স্টুডিওতে ডেকে পাঠান। সেবার ঢাকায় এসে ন্যান্সিকে গানটির কোরাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়েছিল। কিন্তু সেদিন হাবিব ঠিকই ন্যান্সির জাতটা চিনেছিলেন। তাই তিনি আবারও ন্যান্সিকে ডেকে পাঠান। এবার হাবিব ন্যান্সিকে দিয়ে করিয়ে ফেলেন ফ্রেশ সয়াবিন তেলের চমৎকার একটা জিঙ্গেল। পুরো মিডিয়া জগতে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় নবীন এই শিল্পীর গায়কী নিয়ে। এরপর আর ন্যান্সিকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জনপ্রিয় অনেক বিজ্ঞাপন, টিভিনাটক আর চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করে ন্যান্সি শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন।
ন্যান্সির গাওয়া গানগুলো গত কয়েকবছরের সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় গানের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। ‘বাহির বলে দূরে থাকুক’, ‘হৃদয়ের কথা’, ‘পৃথিবীর যত সুখ’, ‘এতদিন কোথায় ছিলে’, ‘দুই দিকেই বসবাস’, ‘চাঁদকে যেমন ঘোমটা দিয়ে’, ‘ভালবাসা অধরা’, গানগুলো বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এত জনপ্রিয় গান করেও ন্যান্সি চলছেন গ্রোতের বিপরীতে । বেশি বেশি গান করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন। তাই এখন পর্যন্ত তার একক অ্যালবামের সংখ্যা মাত্র একটি। অডিওতে নিয়মিত হওয়ার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে হাবিব ওয়াহিদের সংগীতায়োজনে নিজের দ্বিতীয় একক  অ্যালবামের কাজ করছেন এ শিল্পী। এর মাধ্যমে তার স্বপ্নও পূরণ হতে চলেছে। কারণ সব সময়ই ন্যান্সির ইচ্ছা ছিল হাবিব ওয়াহিদের সংগীতায়োজনে নিজের অ্যালবামটি করার। অ্যালবামটি আসছে ভালবাসা দিবস উপলে প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছেন হাবিব ও ন্যান্সি।
নিজের দ্বিতীয় একক অ্যালবাম প্রসঙ্গে ন্যান্সি বলেন, আমার এই অ্যালবামটি গত রোজার ঈদেই প্রকাশ করার কথা ছিল। কিন্তু হাবিব ভাই যখন আমার অ্যালবামটি করতে সময় দিতে রাজি হলেন, তখন তারিখ পরিবর্তন করলাম। যত দেরিই হোক, হাবিব ভাইয়ের কম্পোজিশনেই অ্যালবামটি আমি করতে চাই। কারণ হাবিব ভাই আমার কণ্ঠটাকে সবচেয়ে ভালো ব্যবহার করতে পারেন। এ পর্যন্ত ৪টি গান তৈরি হয়েছে। এখন সবকিছু নির্ভর করছে হাবিব ভাইয়ের উপর। বাকি গানগুলোর জন্য তিনি সময় দিতে পারলেই হয়। ভালবাসা দিবসেই আসলে অ্যালবামটি প্রকাশ করতে চাই আমি। রোমান্টিক গান দিয়ে পুরো অ্যালবামটি সাজানো হচ্ছে, তাই ভালোবাসা দিবসে রিলিজ পেলে বেশি ভালো হয়। বাস্তবজীবনে ন্যান্সি বেশ গোছালো ও ধৈর্য্যশীল স্বভাবের মেয়ে। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও পরম মমতায় আগলে রেখেছেন নিজের ঘর সংসার। স্বামী সৌরভ আর তিন বছরের একমাত্র কন্যা রোদেলাকে নিয়ে ন্যান্সির টোনাটুনির সংসার। সাংসরিক জীবনের কথা জানিয়ে  ন্যান্সি বলেন, একটা সংসারে অনেক রকম কাজ থাকে। আমি আর সৌরভ কাজগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছি। আমি যখন সকালে উঠে গানের অনুশীলনে বসি সৌরভ তখন সব দেখাশোনা করে কিংবা বাহিরে যখন বের হই তখন সে আমার সঙ্গী হয়। আবার দূরে যখন থাকি তখন ঠিকই খানিকণ পর পরই ফোনে একে অন্যের খোঁজ-খবর  নিই। আসলে সংসার জীবনে পারস্পারিক সহযোগিতা অনেক বড় একটা বিষয়। ন্যান্সি আধুনিক গান করলেও মনের মধ্যে লালন করেন একটি স্বপ্ন। নজরুল সঙ্গীতের প্রতি তার রয়েছে অসম্ভব দূর্বলতা। স্বপ্ন দেখছেন একটা পূর্ণাঙ্গ নজরুল সঙ্গীতের অ্যালবাম বের করার। তবে ন্যান্সি বর্তমান সময়ে দাড়িয়ে সবচেয়ে বড় যে স্বপ্নটা দেখছেন সেটি হল একটি হাসপাতাল নির্মাণের। দুস্থ, অসহায়, অভাবী মানুষেরা সেখানে বিনা অর্থে চিকিৎসা গ্রহণ করবেন।

কোরবানি ছাড়াই ঈদ পালন করেছে মালদ্বীপের মুসলমানরা
ডেস্ক রিপোর্ট
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুসলমানদের মত মালদ্বীপের মুসলমানরাও পবিত্র ঈদুল আজহা পালন করেছে। তবে অন্যান্য দেশের মতো মালদ্বীপের মুসলমানরা পশু কোরবানি করেনি। স্থানীয় জনগণ ও সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এবারের ঈদে মালদ্বীপে একটি পশুও কোরবানি হয়নি।
আসন্ন সপ্তদশ সার্ক সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়োজিত একজন সরকারি কর্মকর্তা আমির হুসেইন বলেন, আমরা মালদ্বীপবাসী পুরোপুরিই আমদানি করা হিমায়িত মাংসের ওপর নির্ভরশীল। গরু বা ছাগল তো দূরের কথা, আমরা একটি মুরগি পর্যন্ত জবাই করতে পারি না। আগামী ১০-১১ নভেম্বর ছবির মতো সুন্দর এ দ্বীপটিতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমির হুসেইন জানান, মালদ্বীপের শতকরা ১শ’ ভাগ মানুষ মুসলমান এবং তারা পুরোপুরি মুসলিম সংস্কৃতির একনিষ্ঠ অনুসারি। কিন্তু এ দ্বীপ দেশটিতে কোন পশুপালন করা হয় না, তাই এর অধিবাসীরা কোরবানি করতে পারেন না। ভারত মহাসাগরে ১শ’টিরও বেশি দ্বীপ নিয়ে মালদ্বীপ রাষ্ট্র গঠিত। দেশটির মোট আয়তন তিনশ’ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৯৮টি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। দেশটির মোট জনসংখ্যা চার লাখ। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে তিনটি দেশ মালদ্বীপ, সৌদি আরব ও সোমালিয়ার জনসংখ্যার শতকরা একশ’ ভাগ মুসলমান। বাকি দু’টি দেশে অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো পবিত্র ঈদুল আজহার সময় পশু কোরবানি হয়। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে মালদ্বীপ একমাত্র ব্যতিক্রম। কথা প্রসঙ্গে ফাতিমা নামের মালদ্বীপের এক তরুণী জানালেন, স্থানীয় চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সম্প্রতি তার পরিবার হিতাডুতে পশু পালনের একটি উদ্যোগ নিয়েছে। রাজধানী মালে থেকে ৬শ’ কিলোমিটার দূরে এবং ৮শ’ কিরোমিটার দীর্ঘ দ্বীপ রাষ্ট্রের সর্ব দেিণ হিতাডুর অবস্থান। ওই তরুণী বলেন, আগে শুধুমাত্র গবাদি পশুর অভাবে কোরবানি করতে পারতেন না, এমন নয়। বরং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও ছিল খারাপ। এছাড়াও গবাদি পশুর জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় গাছপালা ও অন্যান্য পশু খাদ্যের অভাব ছিল অন্যতম কারণ। তিনি জানান, সম্প্রতি মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অনেক মালদ্বীপবাসী ঈদের সময় আল্লাহকে খুশি করতে কোরবানি করার উদ্দেশ্যে প্রতিবেশী শ্রীলংকা বা ভারত থেকে পশু আমদানি করার কথা ভাবছেন। তিনি আরো জানান, মালদ্বীপের অধিবাসীদের গড় মাথাপিছু আয় বর্তমানে বাংলাদেশের মুদ্রায় ৪০ হাজার টাকা (৮ হাজার রুপাইয়া)। পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসারের ফলে অদূর ভবিষ্যতে এ আয় আরো বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ফাতিমা জানান, মালদ্বীপের কিছু গ্রামীবাসী শখের বশে ও নিজেদের চাহিদা পূরণ করার জন্য হাঁস-মুরগি পালন করে। যখন কোন ছেলে শিশু জš§গ্রহণ করে তখন সেগুলো জবাই করে। কিন্তু মেয়ে শিশু জš§ালে কোন মুরগি জবাই করা হয় না। তিনি বলেন, মালদ্বীপে বর্তমানে পুরুষ ও নারীর সংখ্যার মধ্যে অসাম্য বিরাজ করছে। দেশটিতে পুরুষের সংখ্যা ২ লাখ ৩৪ হাজার এবং বিপরীতে নারীর সংখ্যা ১ লাখ ৬৬ হাজার। মালদ্বীপের জাতীয় আয়ের সিংহভাগই আসে পর্যটন থেকে। দেশটির জিডিপি’র শতকরা ৩০ ভাগ এবং মাথাপিছু আয়ের শতকরা ২৬৫ ভাগ আসে এ খাত থেকে। সার্ক সম্মেলন : বুধবার মালদ্বীপের উদ্দেশে রওয়ানা হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আট জাতি দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো আঞ্চলিক সহযোগিতাকে ত্বরান্বিত করার জন্য পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কৃষি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পণ্য ও সেবার সাধারণ মান, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি সহযোগিতা সম্পর্কিত নতুন চুক্তিতে উপনীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সার্কের ৮টি সদস্য দেশ হলো- আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় সার্কের প্রতিষ্ঠার পর এ বছর তৃতীয়বার মালদ্বীপে সংস্থার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছেন। তিনি বুধবার বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের একটি বিশেষ ফাইটে ঢাকা ত্যাগ করেন। তিনি সার্ক সম্মেলনের পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসবেন। ১২ নভেম্বর তিনি দেশ ফিরবে।
ওর্তেগাকেই বেছে নিলো নিকারাগুয়া
ডেস্ক রিপোর্ট
আবার নিকারাগুয়ার রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন দানিয়েল ওর্তেগা। গত রোববার দেশে ভোট গ্রহণ হয়। ফল প্রকাশের পর দেখা যায় বামপন্থী সানদিনিস্তা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট’র (এফএসএলএন) প্রার্থী ওর্তেগা পেয়েছেন প্রায় ৬৩ শতাংশ ভোট। আর প্রধান বিরোধী জোট ইনডিপেন্ডেন্ট লিবারেল অ্যালাইন্স’র (পিএলআই) প্রতিদ্বন্দ¡ী ফ্যাবিয়ো গাডিয়া পেয়েছেন ৩১ শতাংশ ভোট।
তৃতীয় স্থানে আছে মাত্র ৬.০২ শতাংশ ভোট পেয়ে লিবারেল কনস্টিটিউশনাল পার্টির (পিএলসি) প্রার্থী আরনল্ডো আলেরমান। গত সোমবার মানাগুয়ায় ওর্তেগার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার কথা ঘোষণা করেন দেশের সুপ্রিম ইলেকট্রোরাল কাউন্সিলের সভাপতি রবার্টো রিভাস। তিনি জানান, ওর্তেগা প্রায় ৬৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। এদিকে ওর্তেগার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গেই উৎসবে মেতে ওঠে রাজধানী মানাগুয়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। দানিয়েল কলরবে মুখরিত হয়ে ওঠে মানাগুয়ার রাজপথ। এফএসএলএন’র সমর্থকদের আনন্দে শামিল হতে দেখা গেছে দেশের সাধারণ মানুষকেও। গত পাঁচ বছরে যারা রাষ্ট্রপতি দানিয়েল ওর্তেগার সরকারের জনপ্রিয় কর্মসূচির কারণে উপকৃত হয়েছেন। গরিবীর চরম দুরবস্থা থেকে মাথা তুলে মানুষের মতো বাঁচার সুযোগ পেয়েছেন। তাই এবারের নির্বাচনী সাফল্যের জন্য ওর্তেগার সরকারের গত পাঁচ বছরের কর্মসূচীকেই মনে করা হচ্ছে। এই সময় বিশ্বের একটির পর একটি দেশে যখন অর্থনৈতিক সঙ্কটে জেরবার। তখন অর্থনৈতিক দিক থেকে আরো এগিয়েছে নিকারাগুয়া। ২০১০সালে নিকারাগুয়ার অর্থিক বিকাশের হার ছিল ৪.৫ শতাংশ। ২০১১ সালেও আর্থিক বিকাশের হার বজায় থাকবে বলেই প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হচ্ছে। এই সাফল্যকে মানুষের আর্থ-সামাজিক বিকাশের কাজে লাগিয়েছে ওর্তেগার সরকার। দেশে সামজিক ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নত হয়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা। সমাজের প্রান্তিক অংশও পেয়েছে শিক্ষার সুযোগ। কৃষকদের ভরসা হয়েছে ওর্তেগার সরকার। কৃষকদের সুলভে ঋণ, চাষের সামগ্রী বণ্টনের মতো একগুচ্ছ জনপ্রিয় কর্মসূচী কার্যকর করেছে সরকার। পাশাপাশি শহর এবং গ্রামাঞ্চলের গরিব মানুষ পেয়েছে ক্ষুদ্রঋণের সুযোগ। গ্রামের বহু মানুষ পেয়েছেন সরকারি উপহার হিসেবে গবাদিপশুও। ১৯৪৫ সালের ১১ নভেম্বর নিকারাগুয়ার লা লিবারেটেড চোনটালেসে জš§গ্রহণ করেন জোস দানিয়েল ওর্তেগা সাভেদ্রার। এবার ভোটে জয়ের পর ওর্তেগাই হলেন দেশের ৮৪তম রাষ্ট্রপতি। প্রাক্তন মার্কসবাদী বিদ্রোহী দল সানদিনিস্তার নেতা দানিয়েল ওর্তেগার নেতৃত্বেই দেশে হওয়া বিদ্রোহে ১৯৭৯ সালে নিকারাগুয়ায় সমোজা পরিবারের দক্ষিণপন্থী একনায়কতন্ত্র শাসনের অবসান হয়। গত সোমবার নিকারাগুয়ার রাষ্ট্রপতি হিসেবে জয়লাভের পর ওর্তেগাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন কিউবার রাষ্ট্রপতি রাউল কাস্ত্রো, ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি উগো সাভেজ। ঘটনাচক্রে গত পাঁচ বছরে নিকারাগুয়াকে ধারাবাহিকভাবে অর্থ সাহায্য করে গেছে কারাকাস। দু‘দেশের ভেতর হয়েছে বেশ কিছু দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও। এর ফলে লাভবান হয়েছে নিকারাগুয়া। বছরে নিকারাগুয়াকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সাহায্য ও কম দামে তেল সরবরাহ করেছে ভেনেজুয়েলা। যা এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য ভাঙতে সহায়ক হয়েছে। ২০০৭ সালে নিকারাগুয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দেশে ওর্তেগার (৬৫) জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য এবারও ভোটের ফল প্রকাশের পর নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। আর একে যথাযথভাবেই সঙ্গত দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যদিও দেশের নির্বাচন কমিশন এই অভিযোগকে সরাসরি উড়িয়ে দিয়েছে।
জ্যাকসনের মৃত্যু
ব্যক্তিগত চিকিৎসক দোষী সাব্যস্ত
ডেস্ক রিপোর্ট
যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত পপ সম্রাট মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুর জন্য কনরাড মারেকে (৫৮) দোষী সাব্যস্ত করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত নরহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, মাইকেল জ্যাকসনকে ঘুমের ওষুধ হিসেবে শক্তিশালী চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে তিনি রোগীর প্রতি চরম অবহেলা করেছেন, যা ফৌজদারি অপরাধের শামিল। কনরাড ছিলেন জ্যাকসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আদালত এই রায় দেন। এই অপরাধে কনরাডের সর্বোচ্চ চার বছর কারাদণ্ড হতে পারে। একইসঙ্গে বাতিল হয়ে যাবে তাঁর চিকিৎসার সনদ। কনরাডের এই বিচার চলেছে ছয় সপ্তাহ ধরে। ১২ সদস্যের জুরি বোর্ডের সামনে তিনশো তথ্যপ্রমাণ হাজির করা হয়। সাক্ষ্য দেন ৪৯ জন। শুনানি চলাকালে বাদীর কৌঁসুলিরা বলেন, কনরাড তাঁর কক্ষ থেকে চলে যাওয়ার পরই জ্যাকসন প্রাণঘাতী চেতনানাশক ওষুধ নেন। এই ওষুধ জ্যাকসনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন কনরাডই। তিনি কক্ষ ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে জ্যাকসন মারা যান। কনরাডকে ইতিমধ্যে কারা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। আগামী ২৯ নভেম্বর থেকে তাঁর সাজা শুরু হতে পারে। রায় শোনার পর জ্যাকসন পরিবারের সদস্যরা আদালত কক্ষে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকেন। রায় দেওয়ার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন জ্যাকসনের মা, বাবা, বোন ও পরিবারের অন্য সদস্যরা।
পরে সাংবাদিকদের জ্যাকসনের বোন লো টয়া বলেন, ‘মাইকেলের আÍা আমাদের সঙ্গেই আছে। আদালত যে যথার্থ রায় দেবেন সেটা সে নিশ্চিত করেছে। আসলে মাইকেল ওপর থেকে বসে সব দেখছে।’ পরে তিনি টুইটারে লেখেন, ‘বিজয় সবাইকে ধন্যবাদ আমাদের প্রতি ভালোবাসা ও সমর্থন জানানোর জন্য’। আদালতে রায় পড়ার সময় কে যেন চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু তাঁকে শনাক্ত করা যায়নি। কনরাডকে হাজির করা হয় হাতকড়া পরানো অবস্থায়।
উভয় সঙ্কটে এশিয়া
প্রতিবেদক
আগামী শতকে ভূ-রাজনৈতিক নাটকের পটভূমি হবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির লড়াই। আসন্ন এই লড়াই বিবেচনায় ইতোমধ্যেই অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়েছে এশীয় দেশগুলো। তারা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না, এই দুই বিশ্ব শক্তির কোনটাকে অগ্রাধিকার দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের একটি বিল সিনেটে পাস হতে যাচ্ছে। এখন আমেরিকায় এই সংরক্ষণবাদী পদক্ষেপ যদি কিছু সময়ের জন্য স্থগিতও রাখা হয়, তাহলেও যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বান্দ্বিক মনোভাব চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোকে উভয় সংকটে ফেলবে। চীন এখন জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ দেশেরই সবচে বড় বাণিজ্য অংশীদার। কিন্তু এই দেশগুলোর সঙ্গে এখনও পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। কতো দিন তাদের অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত স্বার্থ এরকম দ্বিমুখী বা নানামুখী থাকবে? এ অবস্থা খুব বেশি দিন থাকবে না। গত সপ্তাহে চীনের সরকারি পত্রিকা পিপলস ডেইলির ওই সম্পাদকীয়তে কিন্তু সেরকম ইঙ্গিতই দিয়েছে। বলা হচ্ছে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য সেই সব দেশ, যারা মনে করে যতোক্ষণ পর্যন্ত তারা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির সহায়তায় চীনের সঙ্গে একটি ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারবে ততোদিন তারা যা করতে চায় তার ব্যাপারে স্বাধীন। এই প্রবন্ধটি খুব সম্ভবত এর আগের দিন জাপান ও ফিলিপাইনের এক বিবৃতির দ্বারা প্ররোচিত। দেশ দুটি দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের নৌ-সহযোগিতা জোরদার করবে। এই অঞ্চলে বিতর্কিত সীমানায় চীন বিস্তৃত অংশ দাবি করে আসছে। তবে চীনের এই সতর্কবার্তা কিন্তু শুধু জাপান-ফিলিপাইনের জন্য নয়, বরং তা ভিয়েতনাম, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং তাইওয়ানের জন্যও। এই অঞ্চলে যারাই বিগত দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরকি সম্পর্ক শক্তিশালী করার জন্য উদ্যোগী হয়েছে তাদের জন্যও। মনে হচ্ছে, চীন চাতুরতাপূর্ণ ধৈর্য্যরে খেলা খেলছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি প্রতিবেশী দেশগুলোকে অপ্রতিরোদ্ধভাবে তার প্রভাব বলয়ের মধ্যে আনবে বলে ভাবছে চীন। এখন এই প্রজাতন্ত্রটি তার ক্ষমতাবহির্ভুত একটি ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে, এবং চীন বিরোধী জোট গঠনকে সে একই সঙ্গে ভয় পাচ্ছে আবার নিন্দাও করছে। অপেক্ষাকৃত ধীরস্থির কৌশল দেখে চীনের ব্যাপারে এমন ধারণা করা যায়, ২০২০ সালের মধ্যে দেশটি বিশ্বের সবচে বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বিশ্বে সবচে কর্তৃত্বশীল সামরিক শক্তি এবং এমনকি এখনও চীনের পেছনের দিকে প্রশান্ত মহাসাগরে এর শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। কিন্তু যেহেতু রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক শক্তিকেই অনুসরণ করে, সেহেতু প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র প্রভাব নিদেন পক্ষে টেকসই হবে না। ঠিক এই বিষয়টির প্রতিই ইঙ্গিত করেছে পিপলস ডেইলি।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার এক ডলার ব্যয় করলে তার মধ্যে ৪০ সেন্টই থাকে ঋণের অর্থ। আর চীন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচে বড় বিদেশি ঋণদাতা। এক দিক দিয়ে বলতে গেলে, প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বে পরোক্ষভাবে অর্থ জোগান দিচ্ছে চীন। যদিও এ অঞ্চলে মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার তালে আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে তারা এই ভেবে ভীত যে, অর্থ সংকটই হয়ত যুক্তরাষ্ট্রকে একদিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্ষীণবীর্য করবে। ঠিক একই সময়ে চীন কিন্তু তার নিজস্ব সামরিক শক্তির উন্নয়ন করছে। আমেরিকার পরিকল্পনাকারীরা চীনের নতুন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত আমেরিকার বিমানঘাঁটি এবং বিমানবাহী জাহাজের জন্য রীতিমতো হুমকি। চীনের প্রতিবেশীরা অবশ্য দেশটির ক্রমবর্ধমান পেশীশক্তি এবং তা বাড়ানোর অদম্য আকাঙ্ক্ষা নিয়েও শঙ্কিত। গত দুবছরে সমুদ্রে বিতর্কিত সীমা নিয়ে ভিয়েতনাম ও জাপানের সঙ্গে চীনের তিক্ততা বেড়েছে। সমুদ্রে এই মুখোমখি অবস্থান তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি ঘটিয়েছে। ভারত বলছে, ভারতীয় সীমান্তে কিছু অংশের দাবির ব্যাপারে চীন দিন দিন আরও বেশি দৃঢপ্রত্যয়ী হয়ে উঠছে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্কের কারণে দক্ষিণ কোরিয়াও চীনের সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারছে না। চীনের কার্যক্রমের একটি ব্যাখ্যা হতে পারে, জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামরিক শক্তি এর নীতি নির্ধারণে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। নতুন প্রজন্ম ক্ষমতায় আসছে। তাদের বুঝানো হচ্ছে, চীন বাইরের শক্তির শিকারে পরিণত হওয়ার কারণেই দূর্বল হয়ে পড়েছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির মধ্যে যে স্পষ্ট বৈপরিত্য সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে করে চীন আরও আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢপ্রত্যয়ী হয়ে উঠছে।
আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে, বিশ্বজুড়ে দেশটির অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিধি বাড়ছে যা সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানোর বিষয়টি তার কাছে অপরিহার্য করে তুলছে। এতে করে সে স্বার্থের ব্যাপারে আরও দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে যাচ্ছে। চীনের দুর্বল দিক হচ্ছে, এর ক্ষুধার্ত অর্থনীতি আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। সেই সঙ্গে  নৌ শক্তিতে অনেকটা অরক্ষিত। বিমানবাহী জাহাজ ও সাবমেরিনের সঙ্কট এবং  জীবাশ্ম জ্বালানি সমৃদ্ধ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাবি জোরদার করা এসব বিষয় চীন সরকারের জন্য একটি আগাম সতর্কবার্তা তাতে সন্দেহ নেই। তবে উপরের ব্যাখ্যাগুলো একেবারে নির্ভুল, তা বলা যাবে না। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের কার্যক্রম এবং মিত্রদের বিপরীত পক্ষে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করার প্রবণতা বাড়ছে। এই সব বিষয়ে পরস্পরের সাড়া দেওয়ার ভঙ্গি আরেক জনের কাছে আগ্রাসন বলে মনে হচ্ছে। এটা অবশ্য বড় শক্তিগুলোর চিরন্তন আচরণ।
অবশ্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে আগামী মাসে চীনসহ এই অঞ্চলে বড় শক্তিগুলোকে নিয়ে একটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ওবামার মাতৃভূমি হাওয়াই দ্বীপে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা শীর্ষক সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হবে। প্রশান্ত মহাসাগরে কৌশলগত ভুল হিসাব কতোটা বিপজ্জনক হতে পারে তা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে ওবামা খুব সম্ভবত পার্ল হারবারে একটা সফর দেবেন।

ঈদে ঘুরে আসুন নিঝুম দ্বীপ
প্রতিবেদক
নিঝুম দ্বীপ! সে এক অজানা মায়াবী রহস্যের দ্বীপ। ধীরে ধীরে অবগুষ্ঠন খুলে উন্মোচন করছে নিজেকে। দূর সমুদ্র থেকে হাতছানি দেয় সে। চপলা লাস্যময়ীর মতো ইশারায় কাছে ডাকে যেন। সমুদ্রের ডাক শুনতে সবাই ছুটে যায় কক্সবাজার। বাংলাদেশে সমুদ্রসৈকত বলতে আমরা বুঝি কক্সবাজার-টেকনাফ কিংবা কুয়াকাটা। অথচ নিঝুম দ্বীপের বিস্তীর্ণ সমুদ্র ও তার মায়াবী হাতছানি এখনও অনেককে হাতছানি দিয়ে ডাকে। অনেকদিন থেকেই যাব যাব করেও যাওয়া হয় না। একদিন কয়েক বন্ধু মিলে চললাম সেই বিখ্যাত দ্বীপে। এই দ্বীপটিকে অদ্ভুত এক মায়াবী নির্জনতা ঘিরে রেখেছে । সৈকতে দাঁডালে গভীর সমুদ্র থেকে তরঙ্গে ভেসে আসে সমুদ্রের আহ্বান। হৃদয়ে বেজে ওঠে অপূর্ব সুরের মূর্ছনা। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নিঝুম দ্বীপে জনবসতি শুরু হয়। মূলত হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়ন হতে কিছু জেলে পরিবার প্রথম নিঝুম দ্বীপে আসে। নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ইচা মাছ (চিংড়ি) ধরা পড়ত বলে জেলেরা এই দ্বীপের নাম দেয় ইছামতির দ্বীপ। এ দ্বীপের মাটি চিকচিকে বালুকাময়, তাই জেলেরা নাম দিলেন বইল্যারচর বা বালুর চর। এই দ্বীপটিতে মাঝে মাঝে বালির ঢিবি বা টিলার মতো ছিল বিধায় স্থানীয় লোকজন এই দ্বীপকে বাইল্যার ডেইল বলেও ডাকত। বর্তমানে সমগ্র নিঝুম দ্বীপের প্রায় তিন হাজার একরে মানুষের বসতি আছে এবং অবশিষ্ট অংশে ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে।
আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র:
একটি অঘোষিত আকর্ষণীয় লাভজনক পর্যটন কেন্দ্র নিঝুম দ্বীপ যেন স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়েছে। দ্বীপের দক্ষিণ বৃত্তাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে সমুদ্র সৈকত।
চিকচিকে মোটা বালুকাময় এ সৈকত ঢালু হয়ে চলে গেছে সমুদ্রের অভ্যন্তরে। প্রতিদিন জোয়ার ও ভাটায় যেন স্নান করায় প্রকৃতি এ বেলাভূমিকে । আর এ  বেলাভূমিতে সাগরের ফেনিল ঊর্মিমালা আছড়ে পড়ার অপূর্ব দৃশ্য কারও হৃদয় আলোড়িত না করে পারে না। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে সমুদ্র।
আর অমাবস্যার চাঁদে জোয়ার ভাটায় এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এক স্বর্গীয় অনুভূতি সৃষ্টি করে। জোস্নার আলোয় ফেনিল ঊর্মিমালার শীর্ষে শীর্ষে যেন এক একটি মণি মুক্তা জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকে। দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়।
এ দ্বীপকে পর্যটন দ্বীপ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি রেস্ট হাউস করা হয়েছে।
একটি বেসরকারি পর্যটন প্রতিষ্ঠান পর্যটকদের জন্য হাতি, ঘোড়ারও ব্যবস্থা করেছে। যেভাবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পর্যটক এ দ্বীপের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে, এ আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে এখানে গড়ে উঠতে পারে অত্যন্ত আকর্ষণীয় পর্যটন জোন। এ থেকেও আমাদের দেশ উপার্জন করতে পারে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।
ইতোমধ্যে নিঝুম দ্বীপ হয়ে উঠেছে একটি চমৎকার স্বাস্থ্য নিবাস। যে কেউ এখানে এসে সুন্দর সূর্যস্নাত দিনে সমুদ্র অবগাহনে হবেন পুলকিত। বছরের ঝুঁকিপূর্ণ ঝড়ঝঞ্ঝার দিনগুলো বাদে বিশেষ করে শীত-হেমন্তে ভ্রমণ বেশ জমে ওঠে।
এখানে শহরের মতো গাড়ির ধোঁয়া নেই। ধূলি বালির আধিক্য নেই। কান ফাটানো গাড়ির হর্ন নেই। কেবল সমুদ্রের নির্মল বাতাস, শান্তস্নিগ্ধ পরিবেশ, বায়ু পরিবর্তনকারীদের জন্য এ দ্বীপটি এক স্বর্গরাজ্য। মাত্র কয়েক ঘণ্টার অবস্থানেই শরীর ও মন হয়ে উঠবে ঝরঝরে তাজা।
যাওয়ার উপযুক্ত সময়:
শহরের ব্যস্ত ও যান্ত্রিক জীবনে যখন হাপিয়ে উঠেন তখন জীবনকে অর্থবহ করতে নিঝুম দ্বীপে ঘুরে আসতে পারেন। শীত মৌসুমে সাগর শান্ত থাকলেও বছরের যে কোনো সময় এখানে আসা যায়। এপ্রিল থেকে সাগর ধীরে ধীরে অশান্ত হতে থাকে। তখন ঢেউয়ের উচ্চতাও বৃদ্ধি পায়। তখন সাগরে নামলে দুর্র্ধষ অভিযাত্রীর মতো মনে হবে নিজেকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা পিকনিক করতে এসছে এখানে। তাদের মধ্যে হাসান ,রিজন, সেলিম রেজা বলেন,‘এ সময় সমুদ্র পাড়ি দিতে জীবনের রোমাঞ্চকর বুক-কাঁপানো অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে আমাদের। অভিজ্ঞতার পাল্লা ভারি হলে জীবনও হয়ে ওঠে অর্থপূর্ন। আমরা প্রথমে ভয় পাচ্ছিলাম এখানে আসতে । কিন্তু এখন দারুণ লাগছে’।
কোথায় থাকবেন:
নিঝুম রিসোর্ট নামে নিঝুম দ্বীপে থাকার জন্য একটি ভালো মানের রিসোর্ট। নোয়াখালীর হাতিয়ায় নিঝুম রিসোর্টের ইনচার্জ  বাংলানিউজকে জানান, এখানে ২ শয্যার কক্ষ ভাড়া ১০০০ টাকা, ৩ শয্যার কক্ষ ১২০০, ৪ শয্যার কক্ষ ১৮০০ , ৫ শয্যার ডরমিটরির ভাড়া ১০০০  এবং ১২ শয্যার ডরমিটরি ২৪০০ টাকা।
এছাড়াও ঢাকা থেকেও এ রিসোটের বুকিং দেওয়া যায়। ঢাকায় ১৭ নিউ ইস্কাটনের  শামসুদ্দিন ম্যানশন’র ১০ম তলায় অবস্থিত অবকাশ পর্যটন লিমিটেড এ বুকিং দেয়া যাবে। ফোন-৮৩৫৮৪৮৫, ৯৩৪২৩৫১, ০১৫৫২৪২০৬০২ এবং নিঝুম রিসোর্টে ইনচার্জ, নোয়াখালীর হাতিয়া থানায় নিঝুম রিসোর্টে যোগাযোগ করা যাবে। ফোন-০১৭২৪-১৪৫৮৬৪।
তাছাড়া এখানে বন বিভাগের একটি চমৎকার বাংলো আছে। পাশেই আছে জেলা প্রশাসকের ডাকবাংলো। এ গুলোতে আগেভাগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা যায়। এছাড়াও রেড ক্রিসেন্ট ইউনিট ও সাইক্লোন শেল্টারেও থাকার ব্যবস্থা করা যায় বলে স্থানীয়রা জানায়। এ দ্বীপে অনেকেই আছেন খুব বন্ধুবৎসল। পর্যটকদের এরা খুব সম্মানের চোখে দেখেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী কাজল, সাহেদ, অর্থনীতির সাদেক বলেন, স্থানীয়রা পর্যটকদের খুব সম্মানের চোখে দেখেন। যে কোনো অসুবিধা দূর করতে আগ্রহ করে তারা নিজেরাই এগিয়ে আসেন। নিঝুম দ্বীপে হরিণের সংখ্যা অনেক । হরিণ দেখতে হলে এখানে ভ্রমণ কালীন কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। বনে ঢুকলে নিঃশব্দে চলাচল করতে হবে। সামান্য হইচই করলেও এখানে হরিণের দেখা মেলা ভার । নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুতের সরবরাহ নেই। তবে নামা বাজার এলাকায় রাত এগারটা পর্যন্ত জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় লোকজন।
কীভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সহজ রুট সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে হাতিয়ার তমরুদ্দি। এ পথে এমভি পানামা এবং এমভি টিপু-৫ নামে দুটি লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করে। যোগাযোগের ফোন-০১৯২৪০০৪৬০৮ এবং ০১৭১১৩৪৮৮১৩।
ভাড়া ডাবল কেবিন ১২০০ আর সিঙ্গেল ৬৫০ টাকা। ডেকে জনপ্রতি ২০০ টাকা খরচ হবে। ল্ঞ্চগুলো ঢাকা থেকে ছাড়ে বিকেলে আর তমরুদ্দি থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ে দুপুর সাড়ে বারটায়। আর তমরুদ্দি থেকে স্কুটারে বন্দরটিলা ঘাট খরচ হবে ৪৫০-৫৫০ টাকা। আর সেখানে ট্রলারে চ্যানেল পার হলেই বন্দরটিলা । এরপর নিঝুম দ্বীপের নামা বাজার রিকশায় করে যেতে হবে । অন্যদিকে নিঝুম দ্বীপে ভ্রমণ প্যাকেজের আয়োজন করে থাকে লংমার্চসহ বিভিন্ন টুরিস্ট সংস্থা । এই ঈদে আপনিও সবান্ধব ঘুরে আসতে পারেন রহস্যময় এ দ্বীপটিতে।
শিায়তনে নিয়মিত পুলিশপ্রহরার ব্যবস্থা করা দরকার
এমএম নিজামউদ্দীন
গত শনিবার রাজধানীর মিরপুরে বিসিআইসি কলেজের একটি শ্রেণীকে বিস্ফোরণে তিন ছাত্র আহত হওয়ার পর দেশের সব স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। ককটেলের আঘাতে আহত ছাত্র সাইফুর রহমান জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ও রাফসাতজান জাতীয় চু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও রাকিবুল হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। এর মধ্যে শনিবার রাতে রাফসাতজানকে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে চু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসকেরা বলেছেন, রাফসাতজান ও সাইফুরের অবস্থা গুরুতর। সাইফুরকে তত্ত্বাবধানকারী পঙ্গু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ গণি মোল্যা জানান, সাইফুরের ডান হাতে অস্ত্রোপচার করে ধাতবজাতীয় গোলাকৃতির স্পি­ন্টার উদ্ধার করা হয়েছে। তার বৃদ্ধাঙ্গুলটি হারাতে হতে পারে। চু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক মেসবাহুল ইসলাম বলেন, রাফসাতজান ডান চোখে আঘাত পেয়েছে। ওই চোখের ভেতর রত্তরণ হচ্ছে। শনিবার রাতে হাসপাতালে তার চোখ থেকে হলুদ রঙের কিছু কেমিক্যাল ও গুঁড়া উপাদান বের করা হয়েছে। দু-এক দিন চিকিৎসা দেওয়ার পর তার ওই চোখের অবস্থা সম্পর্কে বলা যাবে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাকিবুল চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠবে বলে চিকিৎসকেরা জানান। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা জোরদারে প্রতিটি স্কুল-কলেজে পুলিশপ্রহরার দাবি উঠে এসেছে। দাবিটি অত্যন্ত যৌক্তিক। এটি জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার দাবিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে কোমলমতি শিশুদের নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়ায় অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ সমস্যায় কঠোর হস্তপে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। যদিও ওই ঘটনা তদন্তে বিসিআইসি কলেজের অধ্য হাসিনা খাতুনকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনা নিয়ে শনিবার অধ্য শাহ আলী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। এতে বলা হয়, শনিবার দুপুরে বিকট আওয়াজ শোনার পর কয়েকজন শিক দ্বিতীয় তলার ২০৫ নম্বর কে যান। সেখানে তিন ছাত্রকে গুরুতর আহত অবস্থায় দেখা যায়। পরে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই যে বোমা বিস্ফোরণ হলো তা এখানে কারা ঘটিয়েছে সেটিই প্রথমে উ ঘাটন করা দরকার। বহিরাগত, নাকি ওই ছাত্ররাই এর বাহক ছিল সে বিষয়ে তদন্তের সময় খুব নজর দিতে হবে। কারণ, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। এর আগে পত্রিকায় দেখা গেছে, স্কুলের ছাত্রদের ব্যবহার করছে সন্ত্রাসীরা, অস্ত্র বহনের কাজে। তাই এসব ছাত্র সুস্থ হয়ে উঠলে তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। আর যদি সত্যি সত্যি ছাত্ররাই এর বাহক বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, জাতীয় স্বার্থেই তা ফলাও করে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি সারাদেশে স্কুলে প্রবেশের সময় মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে চেক করিয়ে শিার্থীদের শিায়তনের ভেতরে ঢুকাতে হবে। বিসিআইসি কলেজে বোমা বিস্ফোরণে অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা কী রকম পর্যায়ে পৌঁছেছে তার কিছু এখানে উপস্থাপিত হলোঃ- ‘‘সোমবার মিরপুরের চিড়িয়াখানা সড়কের পাশে অবস্থিত বিসিআইসি কলেজে (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন) শাখার স্কুলের ভেতরে ও বাইরে পুলিশের পাহারা দেখা যায়। শিার্থীরা জানায়, আতঙ্কে অনেক ছাত্রছাত্রী স্কুলে আসেনি। স্কুলের প্রধান ফটকের বাইরে অপেমাণ কয়েকজন নারী অভিভাবক জানান, শনিবারের বিস্ফোরণের পর তাঁরা তাঁদের সন্তানদের স্কুলে রাখতে সাহস পাচ্ছেন না। আরেক অভিভাবক রাইসা চমক বেদ বলেন, ‘অনেক দুশ্চিন্তা ও ভয় লাগছে।’ স্কুলটির প্রধান শিক আবদুল কাদির বলেন, ‘আমার মেয়েও এই স্কুলে পড়ে। আজ সেও স্কুলে আসেনি। সুরতি এই স্কুলে বহিরাগত কারও ঢোকার সুযোগ নেই। স্কুলভবনের প্রধান ফটক ও শ্রেণীকে তালা লাগানো থাকে। স্কুলের কোনো শিার্থী ককটেলটি এনে নিজের কাছে রাখতে পারে বলে তিনি মনে করেন।”
উপরে ঘটনার বর্ণনা পড়ে বোঝা গেল যে, ঘটনার পর নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন স্কুলের অধ্য স্বয়ং। তিনি তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানে তার মেয়েকে আসতে দেননি। তিনি এসেছেন চাকরির প্রয়োজনে। সকল অভিভাবকের অবস্থা এতেই স্পষ্ট হয়ে যায়। পরিস্থিতি অনুধাবনে শিামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ  রোববার সকালে আহত তিন ছাত্রকে দেখতে হাসপাতালে যান। তিনি তাদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। তাদের সুচিকিৎসা দিতে তিনি চিকিৎসকদের নির্দেশ দেন। এর আগে মন্ত্রী মিরপুরের চিড়িয়াখানা সড়কের পাশের বিসিআইসি স্কুলও পরিদর্শন করেন। মন্ত্রী সেখানে বলেছেন, এখন থেকে শিা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেওয়া হবে। স্কুলে আরও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারাই এর সঙ্গে জড়িত, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা মন্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হতে চাই। তিনি যে বলেছেন, নিরাপত্তা জোরদার করা হবে, এটি শুধু ওই স্কুলেই যেন সীমাবদ্ধ না থাকে। এই নিরাপত্তার চাদর বিছিয়ে দিতে হবে দেশের সব শিা প্রতিষ্ঠানে।
 ভূপেন হাজারিকা: যাযাবর কবি-শিল্পী
মোমিন মেহেদী
সত্যি তিনি সময়কে ছুঁয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন সময়। তার প্রমাণ পাওয়া যায় শরৎ বাবু শীর্ষক গানের মধ্যদিয়ে। তিনি গেয়েছিলেন- খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে/  তোমার গফুর মহেশ এখন/ কোথায়  কেমন আছে তুমি জানো না/ হারিয়ে গেছে কোথায় কখন  তোমার আমিনা/ শরৎ বাবু এ চিঠি পাবে কিনা জানি না আমি/ এ চিঠি পাবে কিনা জানি না/  গেল বছর বন্যা হলো এ বছরে খরা  ক্ষেতে ফসল ভাসিয়ে নিলো/ মাঠ শুকিয়ে মরা এক মুঠো ঘাস পায় না মহেষ দুঃখ  ঘোচে না/ তুমি জানো না শরৎ বাবু এ চিঠি পাবে কিনা/ জানি না আমি এ চিঠি পাবে কিনা জানি না/ বর্গিরা আর দেয় না হানা/  নেই তো জমিদার/ তবু  কেন এদেশ জুড়ে/ নিত্য হাহাকার  জেনেছো  দেশ তো স্বাধীন/ আছে ওরা  বেশ  তোমার গফুর আমিনা আর  তোমারই মহেষ/ এক মুঠো ভাত পায় না  খেতে গফুর আমিনা/ তুমি জানো না/ শরৎ বাবু এ চিঠি পাবে কিনা/ জানি না আমি এ চিঠি পাবে কিনা জানি না... ভূপেন হাজারিকার এই চিঠি শরৎ বাবু না পেলেও পেয়েছে লক্ষ-কোটি বাঙালি। যাদের মনের ঘরে বৈষম্য আর বিরোধের বিপরীতের রথযাত্রা উঠে এসেছিল সচেতনতার সুরে সুরে। যে কারণে যুদ্ধাঙ্গনে, সমাধানে উচ্চারিত হয়েছে শরৎ বাবু শীর্ষক এই গান। তিনি কৈশোরকাল  থেকেই গান  লেখা, সুর  দেয়া এবং একই সঙ্গে গাইতে শুরু করেন তিনি। তার কণ্ঠ ছিল  যেমন দরাজ, তেমনি মানুষের প্রতি ছিল গভীর দরদ। সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে  লেখা গানগুলো তাকে গীতিকার হিসেবে  বেশি জনপ্রিয় করে। আমজনতার কথা তুলে ধরায় তার গানের মধ্যে জনগণ বারবার নিজেদের খুঁজে  পেত। হিন্দুধর্মের পবিত্র নদী গঙ্গার কাছে তিনি প্রশ্ন  রেখেছিলেন, দুই পাড়ের অসংখ্য নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের নিষ্ফল-নিষ্কুরুণ জীবনযাত্রা  দেখেও  কেন তার প্রতিক্রিয়া হয় না,  কেন  সে শুধুই বয়ে চলে?’ এই যান্ত্রিক যুগে সহানুভূতি হারিয়ে প্রায় যন্ত্র হয়ে ওঠা মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য/ একটু সহানুভূতি কি মানুষ  পেতে পারে না।’ এই মানবিকতাবোধ তাকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যায়। পরিচিত করে  তোলে স্বতন্ত্র  বৈশিষ্ট্যে। বাংলা, হিন্দি ও অসমিয়া ভাষায় তার এসব গান  শ্রোতাদের হƒদয় স্পর্শ করে যায়, পায় আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। এ ছাড়া তিনি ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় গান  গেয়েছেন। বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা গানের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানটি দখল করে, ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটি। ভূপেন হাজারিকার গাওয়া অজস্র বাংলা গানের মধ্যে ‘দোলা  হে  দোলা’, ‘সাগর সঙ্গমে’, ‘গঙ্গা আমার মা’, ‘একটি কুড়ি দুটি পাতা’ ও ‘এ শহর প্রান্তর’, ‘আমায় ভুল বুঝিস না’, ‘মোর গাঁয়ের সীমানায়’, ‘মেঘ থমথম করে’সহ অসংখ্য গান মানুষের কণ্ঠে গুঞ্জরিত হয়। সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার প্রতিভা ছিল বহুমাত্রিক। ভূপেন হাজারিকার গণসংগীত বিভিন্ন সময়ে মানুষের মনে উদ্দীপনা জুগিয়েছে ঠিক এভাবে- দোলা  হে  দোলা  হে  দোলা/ হে  দোলা আঁকা-বাঁকা পথে  মোরা/ কাঁধে নিয়ে ছুটে যাই/ রাজা মহারাজাদের  দোলা/ ও  দোলা আমাদের জীবনের/ ঘামে  ভেজা শরীরের বিনিময়ে পথ চলে  দোলা/  হে  দোলা হেইয়ানা  হেইয়ানা  হেইয়ানা  হেইয়া/  দোলার ভিতরে ঝলমল করে  যে/ সুন্দর  পোশাকের সাজ/ আর ফিরে ফিরে  দেখি তাই/ ঝিকমিক করে  যে মাথায়  রেশমের তাজ/ হায়  মোর  ছেলেটির/ উলঙ্গ শরীরে একটুও জামা  নেই  খোলা/ দু’চোখে জল এলে মনটাকে  বেঁধে যে/ তবুও বয়ে যায় দোলা  হে  দোলা যুগে যুগে ছুটি  মোরা/ কাঁধে নিয়ে  দোলাটি দেহ  ভেঙ্গে  ভেঙ্গে পরে হো পরে/ ঘুমে  চোখ ঢুলু ঢুলু রাজা মহারাজাদের  আমাদের ঘাম ঝরে পড়ে  হো পড়ে/ উঁচু ঐ পাহাড়ে ধীরে ধীরে উঠে যাই ভালো করে পায়ে পা  মেলা/ হঠাৎ কাঁধের  থেকে পিছলিয়ে যদি পড়ে/ আর  দোলা যাবে নাকো  তোলা রাজা-মহারাজার দোলা/ বড় বড় মানুষের দোলা ও দোলা/ আঁকা-বাঁকা পথে  মোরা কাঁধে নিয়ে ছুটে যাই/ রাজা-মহারাজাদের দোলা হে  দোলা হে দোলা হে দোলা হে দোলা... মানবতায় দোলা দেয়া এই গানের মতো করেই মানুষ মানুষের জন্য উচ্চারণ করেছিলেন মানবতাবাদী চির তরুণ ভূপেন হাজারিকা। আজ যার উত্তরসূরি হিসেবে নিজেদের গর্বিত মনে হচ্ছে। তরুণরাতো সেই তরুণদেরই উত্তরসূরি যারা বয়সের ভারে নুয়ে এলেও মনের দিক থেকে থেকেছেন বরাবরই তারুণ্যময়ী-তারুণ্যজয়ী।  হঠাৎ করেই কিছুদিন আগে তাকে বক্ষ সংক্রমণের জন্য কোকিলাবেন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কয়েকদিন ধরেই তার অবস্থা ক্রমশ আশঙ্কাজনক অবস্থায় গিয়ে  পৌঁছেছিল। তার লিভার দু’টিও অকেজো হয়ে গিয়েছিল।  শেষ পর্যন্ত তিনি বিদায় জানালেন তার প্রিয় সঙ্গীত জগৎকে। আমাদের আগামী গড়ার অনন্য মানুষ ভূপেন হাজারিকার এই চলে যাওয়ায় আমরা হয়েছি বেদনাসিক্ত। সেই বেদনাসিক্ত কণ্ঠেই তার এই গানটি থাকল শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে- মানুষ মানুষের জন্য/ জীবন জীবনের জন্য/  একটু সহানুভূতি কি/ মানুষ  পেতে পারে না ও বন্ধু।/ মানুষ মানুষকে পণ্য করে,/ মানুষ মানুষকে জীবিকা করে,/ পুরোনো ইতিহাস ফিরে এলে/ লজ্জা কি তুমি পাবে না ও বন্ধু।/ বলো কি তোমার ক্ষতি জীবনের অথৈ নদী/ পার হয়  তোমাকে ধরে দুর্বল মানুষ যদি।/  মানুষ যদি  সে না হয় মানুষ/ দানব কখনো হয় না মানুষ/ যদি দানব কখনো বা হয় মানুষ/ লজ্জা কি তুমি পাবে না ও বন্ধু... সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি একাধারে ছিলেন কবি, চলচ্চিত্রনির্মাতা ও সাংবাদিক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে গণযোগাযোগ বিষয়ে পিএইচডি করেন। অভিনয় করেছেন এক পাল নামে একটিমাত্র চলচ্চিত্রে। এ ছবিতে তার অভিনয় অনেক চলচ্চিত্রবোদ্ধার হƒদয় ছুঁয়ে যায়। অসমিয়া ভাষার চলচ্চিত্র এরা বাতার সুর (১৯৫৬) দিয়ে চলচ্চিত্রকার হিসেবে অভিষেক ঘটে ভূপেন হাজারিকার। তিনি ১৪টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। অসমিয়া ভাষায় শকুন্তলা (১৯৬০), প্রতিধ্বনি (১৯৬৪) ও লটিঘটি (১৯৬৭) চলচ্চিত্রে তিনি একই সঙ্গে প্রযোজক, পরিচালক, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। জীবন তৃষ্ণা, জোনাকির আলো, চামেলী  মেমসাহেব, সীমানা  পেরিয়েসহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন তিনি।  ১৯৭৫ সালে চামেলী  মেমসাহেব চলচ্চিত্রে সুরকার ও শিল্পী হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী পুরস্কার’, ভারতীয় চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯২ সালে ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার, ২০০১ সালে লাভ করেন ভারতের রাষ্ট্রীয় উপাধি ‘পদ্মভূষণ’। তবে কয়েক বছর আগে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপিতে  যোগ দিয়ে ভক্তদের কাছে বিতর্কিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে হাজারিকার সঙ্গী ছিলেন চলচ্চিত্রকার কল্পনা লাজমি। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘ভূপেন শুধু গায়ক ছিলেন না, ছিলেন একজন মহান সমাজসংস্কারকও। ভারতের পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন তিনি। মোর গায়ের সীমানার পাহাড়ের ওপারে/ নিশিথ রাত্রির প্রতিধ্বনি শুনি/ কান পেতে শুনি আমি বুঝিতে না পারি/  চোখ মেলে দেখি আমি দেখিতে না পারি/  চোখ বুজে ভাবি আমি ধরিতে না পারি/ হাজার পাহাড় আমি ডিঙুতে না পারি/ হতে পারে কোন যুবতীর  শোক ভরা কথা/ হতে পারে  কোন ঠাকুমার রাতের রূপকথা/ হতে পারে  কোনো কৃষকের বুক ভরা ব্যথা/  চেনা  চেনা সুরটিকে কিছুতে না চিনি/  শেষ হলোু  কোনো যুবতীর  শোক ভরা কথা/  শেষ হলো  কোনো ঠাকুমার রাতের রূপকথা/  শেষ হলো  কোনোু কৃষকের বুক ভরা ব্যথা/  চেনা  চেনা সুরটিকে কিছুতে না চিনি/  মোর কাল চুলে সকালের  সোনাুিল  রোদ পড়ে/  চোখের পাতায়  লেগে থাকা কুয়াশা যায় সরে/  জেগে ওঠা মানুষের হাজার চিৎকারে/ আকাশ  ছোঁয়া অনেক বাধার পাহাড়  ভেঙে পড়ে/ মানব সাগরের  কোলাহল শুনি/ নতুন দিনের  যেন পদধ্বনি শুনি...ভূপেন হাজারিকার এ অনন্য গান আমাদের আলোর পথযাত্রী  হতে উৎসাহিত করে। পাশাপাশি তিনি গেয়েছিলেন ‘আমি এক যাযাবর/ পৃথিবী আমাকে আপন করেছে/ ভুলেছি নিজের ঘর।’ এবার আপন পৃথিবীকেও  ছেড়ে চলে  গেলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার।  ভূপেন হাজারিকা মানেই মানবতাবাদ আর মানুষের রঙধনুময় জীবনের রথযাত্রা। তারুণ্যের জয়গাঁথা কণ্ঠশিল্পী ভূপেন হাজারিকার জš§ ১৯২৬ সালের ৮  সেপ্টেম্বর, ভারতের আসাম রাজ্যে।  আরেকজন ভূপেন হাজারিকা আর কখনো জš§  নেবে না।’ বয়ে চলা সময়ের হাত ধরে এগিয়ে যেতে যেতে তিনি তান ধরেছিলেন- বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার/ বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের/ হাহাকার শুইর/ নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি/ গঙ্গা বইছ কেন/  নৈতিকতার স্খলন  দেখেও/ মানবতার পতন দেখেও/ নির্লজ্জ অলসভাবে বইছ  কেন/ সহস্র বরষার উš§াদনার মন্ত্র দিয়ে/ লক্ষ জনেরে সবল সংগ্রামী/  আর অগ্রগামী করে তুলনা  কেন/ জ্ঞানবিহীন নীরব ঘরের/  খাদ্যবিহীন নাগরিকের/ সহস্র বরষার উš§াদনার মন্ত্র দিয়ে/ লক্ষজনেরে সবল সংগ্রামী/ আর অগ্রগামী করে  তোল না  কেন/ ব্যক্তি যদি ব্যক্তিকেন্দ্রিক/ সমষ্টি যদি ব্যক্তিত্বরোহী/  তবে শিথিল সমাজকে ভাঙ না  কেন/ সহস্র বরষার উš§াদনার মন্ত্র দিয়ে/ লক্ষ জনেরে সবল সংগ্রামী/ আর অগ্রগামী করে  তোলেনা  কেন/  স্রোতস্বিনী কেন নাহি বও/  তুমি নিশ্চই জাহ্ণবী নও/ তাহলে  প্রেরণ দাও না  কেন/ উš§ত্ত ধরার কুরুক্ষেত্রের/শর শয্যাকে আলিঙ্গন করা/ লক্ষ কোটি ভারত বাসীকে/ জাগালে না  কেন... পুরো এই গানের কোথাও তিনি শুধুমাত্র বিনোদন বা আনন্দর কথা বলেননি। বলেছেন সাহসের কথা, বলেছেন জীবন জয়ের কথা। এই কথা বলেছেন বলেই তরুণদের কাছে তিনি হয়ে আছেন চিরপ্রিয়জন। যার প্রতিটি গান বলেছে তারুণ্যজয়ের কথা, তার দিকে ধাবিত হয়েছে মন আর মনের প্রতিটি পর্ব। কেননা, তার কাছে মনে হয়েছে-বিমূর্ত এই রাত্রি আমার/  মৌনতার সুতোয়  বোনা/ একটি রঙিন চাদর।/ সেই চাদরের ভাঁজে ভাজে/ নি:শ্বাসেরই ছোঁয়া।/ আছে ভালোবাসা, আদর।/ কামনার  গোলাপ রাঙা/ সুন্দর এই রাত্রিতে/ নীরব মনের বর্ষা,/ আনে শ্রাবণ, ভাদর।/  সেই বরষায় ঝড়ো ঝরে/ নি:শ্বাসেরই  ছোঁয়া।/ আছে ভালোবাসা, আদর।/ ঝরে পড়ে ফুলের মতো/ মিষ্টি কথার প্রতিধ্বনি, ছড়ায় আতর,/  যেন ছড়ায় আতর।/ পরিধিহীন শংকামুখী নির্মল অধর/ কম্পন কাতর, কম্পন কাতর।/ নিয়ম ভাঙ্গার নিয়ম এ যে,/ নিয়ম ভাঙ্গার নিয়ম এ  যে/ থাক না বাধার পাথর।/  কোমল আঘাত, প্রতি-আঘাত,/  কোমল আঘাত, প্রতি-আঘাত, রাত্রি নিথর কাতর।/ দূরের আর্তনাদের নদীর/ ক্রন্দন  কোন ঘাটের/  দূরের আর্তনাদের নদীর/ ক্রন্দন কোন ঘাটের/ ভ্রƒক্ষেপ  নেই,  পেয়েছি আমি/ আলিঙ্গনের সাগর।/  সেই সাগরের  স্রোতেই আছে/ নি:শ্বাসেরই  ছোঁয়া,/ আছে ভালোবাসা, আদর...তারুণ্যের প্রতিক ভূপেন হাজারিকা জীবিতকালেই কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন গানের আকাশে উড়ে উড়ে। কেননা, তরুণরা তার গানকে পছন্দই শুধু গ্রহণ করতো না, আটকে নিত জীবনের সঙ্গে। আসামের রাজধানী গুয়াহাটির বুকে তার পূর্ণাবয়ব মূর্তি বসেছে তার জীবিতকালেই। ভারতীয় উপ-মহাদেশের  জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ভূপেন হাজারিকা একদিকে ছিলেন অসামান্য গায়ক ও সুরকার, অন্যদিকে চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি ছিলেন একজন কবি এবং সাংবাদিকও। ভূপেন হাজারিকা আর দ্বিতীয়বার জš§  নেবেন না। তিনি নিছক গায়ক বা সুরকার ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক।  তার জন্যই ভারতের পূর্বাঞ্চল এবং বাংলাদেশের নাম বিশ্বে বিশেষ জায়গা  পেয়েছে। দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, পদ্মভূষণের মতো সম্মান  পেয়েছেন তিনি। ২০০৯ সালে তাকে অসমরতœ হিসেবে  ঘোষণা করা হয়েছিল। তার  লোকসঙ্গীতের সুরে তিনি মুগ্ধ করেছিলেন  শ্রোতাদের। বাংলা ও অসমীয় ছাড়াও তিনি বহু ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে তিনি আসামের দ্বিতীয় ছবি  জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালের ‘ইন্দ্রমালতি’তে প্রথম অভিনয় ও গান  গেয়েছিলেন। তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে  মৌলিক শিক্ষা বিষয়ে পিএইচডি লাভ করেছিলেন। তবে পড়াশোনার জগৎ  ছেড়ে তিনি সঙ্গীত নিয়েই  মেতে ছিলেন সারাজীবন। আসামের আরেক জনপ্রিয় গায়ক ও সুরকার  হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন তার গুরু। ভূপেন হাজারিকার গলায়  গলায়  লোকগান এক অন্য মাত্রা  পেয়েছিল। তার গাওয়া বহু গণসঙ্গীত মুখে মুখে গাওয়া হয়। তবে ‘রুদালি’ ছবিতে গানের জন্য তিনি এশিয়া প্যাসিফিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে  শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালকের স্বীকৃতি  পেয়েছিলেন। সঙ্গীতের পাশাপাশি অনেক চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন তিনি। তারই উদ্যোগে অসমীয় চলচ্চিত্র ভারতে একটি বিশেষ আসন করে নিয়েছে। ভালোবাসার কথা বলতে বলতে তিনি উচ্চারণ করেছেন- মোরা যাত্রী একই তরুণীর সহযাত্রী একই তরণীর/ যদি সংঘাত হয় তবে ধ্বংস হবে গর্ব  মোদের প্রগতির/ প্রভু  চোখ  মেলে চাও  দেখ স্বর্গ হতে,/ ও মহাপ্রভু, কী শূন্য সাগর,/ এই তরী পৃথিবীর সারামানব জাতির,/ তাই ঈশ্বর গড়ে দিন মিলনের নৌকো/  চোখ কারও কালো কারও নীল কারও পিঙ্গল,/ তাই  তো  দেখি তোমার আমার/ একই আকাশ একই ধরণী... একই সঙ্গে তিনি শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সাংবাদিক আর সমাজ সংস্কারক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি তিনি ছিলেন যাযাবর কবি। চারণ কবিতার কথাগুলো উঠে এসেছে তার অনবদ্য মানবতাবাদী কণ্ঠের অমিয় ধারায়...।
 সোমালিয়া: দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যুর মোকাবিলা
মনির তালুকদার
১০ কি: ১২ হাজার মানুষ, কি তারও বেশি, পালিয়ে গেছে কেনিয়াতে, ইথিওপিয়া এবং জিবুতিতে। প্রশ্ন হলো, এত হাজার হাজার মানুষ নিজের দেশ ছাড়ল কেন? কোথাকার লোক তারা? তারা আফ্রিকার সোমালিয়ার মানুষ।
একদিকে একটানা দুর্ভিক্ষ, অন্যদিকে সীমাহীন অত্যাচারে সোমালিয়ার মানুষ নিজেদের দেশ ছাড়তে বাধ্য হলো বাঁচার আশায়। গত ৬০ বছর ধরে চলছে এই দুর্ভিক্ষ আর তাতে প্রায় ৩০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ইথিওপিয়া, কেনিয়াও এর থেকে রেহাই পেল না, তবে ওই দুটো দেশে দুর্ভিক্ষ, মহামারী অন্যটির চেয়ে কম। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানিয়েছে, এই বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত ২৯০০০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে যাদের বয়স ৫ বছরও হয়নি। জাতিসংঘের হিসাবে ৬ লাখ ৪০ হাজার সোমালী শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, ফলে শিশু মৃত্যুর হার আরো বাড়বে। প্রতি তিনটি শিশুর মধ্যে একটি করে শিশু মারা যায় খাদ্যাভাবে ও অপুষ্টিতে। শুধু সোমালিয়াতেই নয়, দুর্ভিক্ষের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের অনেক অঞ্চলে। দুর্ভিক্ষ, মহামারী দক্ষিণেও প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। কেনিয়ার প্রায় ৪ লাখ মানুষ অনাহারে আছেন। অনেকেই মনে করছেন, ২০১১ সালের শেষ পর্যন্ত চলবে ওই দুর্ভিক্ষ। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বিভিন্ন দেশের কাছে আবেদন করেছেন। ১২ লাখের বেশি মানুষ সাহায্য প্রার্থী। অবিলম্বে এরা সাহায্য না পেলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত। ৩ দশমিক ২ লাখ মানুষের জন্য অবিলম্বে খাদ্য পাঠানো জরুরি। গত ৬০ বছরের মধ্যে এ রকম মারাÍক মন্বন্তর সোমালিয়াতে আর কখনো হয়নি। গত দুই বছরে এত বৃষ্টি কম হয়েছে যে, জলের অভাবে প্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদন করা মোটেই সম্ভব হয়নি। এতে করে চাষিদেরও মাথায় হাত। একদিকে দুর্ভিক্ষ, অন্যদিকে দেশের মধ্যে দ্বন্দ্বÑসোমালিয়াকে মারাÍক সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। একসঙ্গে এত বড় সংকট পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে দেখা যায়নি। সাহায্যকারী সংস্থা জানিয়েছে, অন্ততপক্ষে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার চলতি বছরেই সাহায্যের প্রয়োজন। দুর্ভাগ্য এই যে আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো তেমনভাবে সাড়া দিচ্ছে না। তবে তাদের দোষ দেয়া যায় নাÑএ কারণে যে, পশ্চিমা দেশগুলো তাদের নিজেদের পাহাড় সমান অর্থনৈতিক সমস্যাই সমাধান করতে পারছে না। প্রয়োজনের এক-পঞ্চমাংশ অর্থ সাহায্য মাত্র পাওয়া গেছে। ২০১০ সালে জাতিসংঘ ৫০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের আবেদন করেছিল পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোর কাছে। খাবার সরবরাহ করার জন্য, তবে আন্তর্জাতিক স্তরে সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল ৪৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক সংস্থা জানিয়েছে প্রয়োজনের মাত্র ২০ শতাংশ সাহায্য পৌঁছেছে ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন সোমালিয়ানদের জন্য।
অক্সফ্যাম-এর অধিকর্তা ফ্রান ইকুইজা জানিয়েছেন, সমবেতভাবে সাহায্যের যে হাত এতকাল অন্য দেশগুলো বাড়িয়েছে সেখানে ঘটেছে ভয়াবহ দুর্যোগ। আন্তর্জাতিক সংস্থা সব জেনেও সাহায্য মঞ্জুর করা এবং সময়মতো পাঠাতে ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করেছেÑপূর্ব আফ্রিকায় সংকট জেনেও।
২০১০ সালে ইউনাইটেড স্টেটস ফান্ডেড ফেমিন আর্লি ওয়ারনিং সিস্টেম, সোমালিযা সরকারকে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে অন্তত ছয়বার সতর্কবার্তা দিয়েছে কিন্তু কেউ তা আমলে নেয়নি। জটিলতা আরো বেড়েছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে তিনগুণ বেশি, যা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৫ লাখ সোমালিয়ান ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জীবন নিয়ে সংশয় আছে-, সেক্ষেত্রে সোমালিয়া সরকার আবেদন জানিয়েছে, আরো ৪০০ মিলিয়ন ডলার যদি সাহায্য পাওয়া যায় তবে ডিসেম্ভর ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশটির অধিবাসীদের খাদ্যের সংস্থান করা সম্ভব হবে। অপরদিকে সাহায্যকারী সংস্থাগুলো বলেছে, যদি আরো ১ বিলিয়ন ডলার সাহায্য পাওয়া যায় তবে চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ মহামারীর হাত থেকে হয়তো সোমালিয়ার মানুষকে বাঁচান যাবে। যদিও সাহায্যকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশেষ করে পশ্চিমা দেশ খুব একটা উৎসাহ দেখাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সংস্থা আপাতত এক- পঞ্চমাংশ অর্থ পেলে কিছুটা সুবিধা হবে এ কথা জানানোর পর সে পরিমাণ অর্থ পাওয়া  গেছে। ইসলামী আন্দোলনের যুব সংগঠন আল সাহবাব আফ্রিকান ইউনিয়নের সেনাদের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে সোমালি সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, কারণ পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সাহায্যকারী সংস্থা সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষের কথা যেভাবে চাউর করেছে সেটা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। অনেকেই মনে করেন ওই যুব সংগঠনটি আল কায়েদার সঙ্গে যুক্ত আছে। এতদিন পর্যন্ত রাজধানী মোগাদিসুর অনেকটা এলাকা এদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। চলতি বছরের আগস্ট মাসের প্রথম দিকে এরা রাজধানী থেকে সৈন্যদের সরিয়ে নিয়ে গেছে। এখন এরা যখন তখন আফ্রিকান ইউনিয়নের সেনাদের আক্রমণ করছেÑ বিশেষ করে যারা শান্তি রক্ষার পক্ষে। তবে বিদ্রোহীদের দখলে আছে দেশটির প্রধান প্রধান শহর এবং তার আশপাশ এলাকা। বিদ্রোহীরা আগের চেয়ে খানিকটা সংযত। তারা এখন সোমালিয়ার দক্ষিণ এবং কেন্দ্রীয় অঞ্চলে খাদ্য দেবার অনুমতি দিচ্ছে তাদের তত্ত্বাবধানে। খাদ্য সংকট এবং অত্যাচারের জন্য কয়েক হাজার সোমালী ইথিওপিয়া, কেনিয়া এবং জিবুতিতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
আল সাহবাব নেতৃত্ব বিদেশি সাহায্য দেবার অনুমতি দিয়েছে একটা শর্তে-Ñতা হলো সাহায্যকারী সংস্থাগুলোর সাহায্যের অজুহাতে এলাকার ওপর দখল প্রতিষ্ঠা করতে না পারে। তবে জাতিসংঘ খাদ্য প্রেরণের অনুমতি দিয়েছে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাইডোয়াত শহরে। অবশ্য বিদ্রোহীরা রেড ক্রসের (আইসিআরসি) সাহায্য তাদের নিয়ন্ত্রিত শহরগুলোতে ঢুকতে দিচ্ছে কোনো ধরনের সমস্যা না করেই। আন্তর্জাতিক কমিটি, রেড ক্রস যেসব অঞ্চলে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে, সে সকল অঞ্চল সবটা ঘুরে দেখে বলেছে সোমালিয়ার নিুসাবেলি অঞ্চলে সব সময়ই খাবার পাওয়া যায় সেখানেও অনেক শিশু, বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে ১১ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছে। অপরদিকে খাবার যারা বণ্টন করছেন তাদের মন্তব্য হচ্ছে, আল সাহবাবদের দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক নয়। তারা বলেছেন, দুর্যোগ যত বেশি হচ্ছে সমস্যা তত বাড়ছে। প্রয়োজনীয় সম্পদ না থাকায় তা বণ্টন করার ক্ষেত্রেও অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে।
আল সাহবাব সংগঠনকে ২০০৮ সালেই “টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন” বা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে চিহ্নিত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওই সংগঠনকে অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে সোমালিয়ার প্রতিবেশী দেশ কেনিয়া ও ইথিওপিয়া। জিবুতিতে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি। সেখান থেকেও অনেক অস্ত্র চোরাপথে সোমালিয়ার প্রায়ই আসে। সেই অস্ত্রের বড় একটি অংশ আল সাহবাবের হাতে পৌঁছে যায়।
অপরদিকে সোমালিয়ার কৃষকরা খাদ্য এবং অর্থ সাহায্য পেয়ে চাষ আবাদ ছেড়ে দিয়েছে। কারণ, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে যতটুকু বৃষ্টি হয় তাতে প্রয়োজন মেটে না। তাছাড়া কৃষকরা এতটা রুগ্ন এবং দুর্ভিক্ষে তারা মৃতপ্রায় যে তাদের পক্ষে চাষ করাও সম্ভব নয়।
যখন সোমালিয়া শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ ছিল, কেন্দ্রীয় সরকার দক্ষতার সঙ্গে তার মোকাবিলা করেছে। অনেকেরই অভিমত দীর্ঘকালের গৃহযুদ্ধ প্রধানত বছর বছর দুর্ভিক্ষ এবং এত শিশু মৃত্যুর জন্য দায়ী।
১৯৭৪-৭৫ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে সোমালিয়া সরকার ১ লাখ ৫০ হাজার দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষকে সোমালিয়ার কেন্দ্র থেকে জুবা এবং সাবেল্লি নদীর কাছে পাঠায়, আর তাদের মাছ ধরা শিক্ষা দেয়া হয়। এরপর নতুন সরকার এসে মোগাদিসুর বাইরে কোথাও দৃষ্টিপাত করেনি। এরপর ইসলামিক কোর্ট ইউনিয়ন (আই সিইউ) যুদ্ধের চক্রান্তকারীদের ২০০৬ সালে পরাজিত করেÑ ফলে একটানা ১৫ বছরের যুদ্ধের শেষ হয়।
মাত্র ছয় মাস ওই অবস্থা চলল। এরপর জর্জ বুশ প্রশাসন ইথিওপিয়ান উত্তেজিত করল সোমালিয়াকে আক্রমণ করার জন্য এবং আইসিইউকে সরাবার জন্য।
আশ্চর্য ব্যাপার হলো সাইক শরিফ সাইক আজাদ যিনি ছিলেন আইসিইউর প্রধান, তিনি এখন সোমালিয়ার রাষ্ট্র প্রধান। আল সাহবাব এখন লড়ছে আই সি ইউর বিরুদ্ধে। সোমালীয়ারা কেনিয়া ও ইথিওপিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে। এতে করে ওই দুটি দেশ সোমালিয়ার ওপর খুশি নয়। তাই সমস্যার সমাধান সহজ নয়। দুর্ভিক্ষ, মৃত্যু এবং গৃহযুদ্ধ সোমালিয়াতে যে সংকট তৈরি করেছেÑ তাতে মনে হয় শান্তি দূর অস্ত।


ইসলামে ইয়াতীম ও মিসকিনদের অধিকার
জি এম মুজিবুর রহমান
ইসলামী রীতিনীতি সুস্পষ্ট, সুদূর প্রসারী ও সর্ব শ্রেণীর মানুষের কল্যানে প্রণীত। সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি অনন্য ধর্ম ইসলাম। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, জাতীয় ও বিশ্বব্যাপী সুশৃংখল পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় ইসলাম শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ ও সাম্য-সম্প্রীতি বজায় রাখতে ইসলামের নির্দেশনা অপরাজেয়। মানুষে মানুষে বিভেদ বিস্মৃত হয়ে মনূষ্য সমাজের জন্য কল্যানকর ও সহমর্মিতাপূর্ণ অবিচ্ছেদ্য-সুদৃঢ় প্রাসাদ গড়তে ইসলামের ভূমিকা অটুট। যুগে যুগে মহা মানবগণ সেই আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস সংগ্রাম করে এসেছেন। পূত-পবিত্র ও নির্ভূল সে আদর্শ আজও বিশ্ব দরবারে উড্ডীন রয়েছে, কিন্তু মানুষ বিপদগামী ও পথভ্রষ্টতায় পর্যবসিত হয়ে সে আদর্শ থেকে নিজেদেরকে ভিন্নমুখী করায় বিশ্ব সমাজ সমস্যা-সংকুল হয়ে পড়েছে। ইসলামের বিধান ও রীতিনীতি মেনে চললে আজকে দৃশ্যমান দুর্গতি আমাদেরকে গ্রাস করতে পারতো না। পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছোট্ট একটি বাণী,
“মু’মিনগণ পরস্পর ভাই ভাই; সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও।” (সুরা হুজ্বরাত/১০)
সৃষ্টি কর্তা মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলে মানুষের উপর অবধারিত কর্তব্য বর্তায় যে, পরস্পরের মধ্যে সহ-মর্মিতা, সহনশীলতা বজায় রাখা, সমাধিকার প্রতিষ্ঠা ও নিজের জন্য যেটি পছন্দ করা হয় অন্যের জন্যও তেমনটি পছন্দ করা এবং ব্যক্তি স্বার্থ ও লোভ-লালসার উর্ধ্বে থেকে সমাজের জন্য নিজেকে সম্পৃক্ত করে নেয়া অপরিহার্য। আর এটা করতে পারলে আল্লাহর অনুগ্রহ প্রাপ্ত হওয়া যাবে। আল্লাহর অনুগ্রহ ব্যতীত ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও বিশ্ব সমাজ সঠিক পথের অধিকারী হতে পারেনা। নিজ সুখ-চিন্তায় বিভোর না হয়ে সৃষ্টির প্রতি সদয় আচরণ করতে শিখতে হবে। ইসলাম ধর্ম সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে সদাচারের শিা দিয়ে থাকে। বিশেষ করে যারা অসহায়, যারা অনন্যোপায় হয়ে অন্যের করুণা পেতে অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকে তাদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখতে হবে। এটি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সমাজে যারা ইয়াতীম, অসহায়, দুস্থ ও অত্যাচারিত, তাদেরকে সহায়তা দানে ইসলাম ধর্মে সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
“আপনি কি সে ব্যক্তিকে দেখেছেন, যে পরকালের পুরস্কার ও শান্তিকে অস্বীকার করে। সে সেই লোক যে ইয়াতীমকে ধমক দেয়, আর মিসকীনকে খাবার দিতে উৎসাহিত করে না।....... আর সাধারণ প্রয়োজনের জিনিস দেয়া হতে বিরত থাকে।” (সুরা আল-মাউন)
পবিত্র কুরআনে অন্যত্র বলা হয়েছে,
“আর যারা আল্লাহর ভালবাসায় মিসকীন, ইয়াতীম ও কয়েদীকে খাবার খাওয়ায়, এবং বলে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি, আমরা তোদের নিকট হতে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও চাই না। ........ পরিণামে আল্লাহ তাদেরকে রা করবে সেই দিবসের অনিষ্ট হতে এবং তাদেরকে দিবেন উৎফুল্লতা ও আনন্দ।” (সুরা দাহর/ ৮-১১)
মুসলমান হিসাবে জীবন গড়তে হলে সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত ও ুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। নিজ-মতা মতো সহযোগিতা দান করতে হবে। এটাকে সব সময় দান হিসাবে ভাবলে চলবে না, বরং আমাদেরকে মনে রাখতে হবে আমাদের সম্পদে তাদের অধিকার রয়েছে। এ অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা দান নয়; এর প্রতিদান প্রত্যাশা বা কৃতজ্ঞতা পাওয়ার ন্যুনতম চিন্তার উদ্রেক হলে চলবে না। আর সেটি করতে পারলে মহা প্রভু আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন; রা করবেন ক্বিয়ামতের কঠিন সেই দিনের মসিবত হতে। পরহিতকর একাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি অন্যকেও উৎসাহিত করতে বাস্তব ভূমিকা রাখতে হবে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন,
“মানুষ তো এরূপ যে, তার প্রতিপালক যখন তাকে পরীা করেন সম্মান ও অনুগ্রহ দান করে, তখন সে বলে, আমার প্রতিপালক আমাকে সম্মানিত করেছেন। আর যখন তাকে পরীা করেন তার রিয্ক সংকুচিত করে, তখন সে বলে, আমার প্রতিপালক আমাকে হীন করেছেন। না কখনো না। বস্তুত তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান কর না, এবং তোমরা অভাবগ্রস্তদেরকে খাদ্যদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না, এবং উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য সম্পদ সম্পর্ণরূপে ভণ করে ফেল, এবং তোমরা ধন-সম্পদ অতিশয় ভালবাস, ইহা সংগত নয়।” (সুরা ফাজর/ ১৫-২১)
অসহায় ইয়াতীমদেরকে দুঃখ-দুর্দশামুক্ত করতে সহযোগিতা দানে কার্পণ্য করা যাবে না। ধন-সম্পদ আল্লাহই দিয়ে থাকেন। ধন-সম্পদ অর্জন ও বিয়োজন আল্লাহর তরফ থেকেই হয়ে থাকে। এটি আল্লাহর প থেকে দুনিয়াবী জীবনের জন্য পরীা স্বরূপও বটে। অসহায় ইয়াতীমদেরকে ঘৃণা করার সুযোগ নেই, বরং তাদের অসহাত্বকে সম্মানের সাথে দেখে মতা অনুযায়ী পাশে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য। সম্মান প্রাপ্যতা তাদের অধিকার। যারা দুনিয়ার জীবনে ইয়াতীম, মিসকিন ও বন্দীদের সাহায্য করে মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের চিরসুখের জান্নাতে এর প্রতিদান দেয়ার ওয়াদা দিয়েছেন। ইয়াতীম-মিসকিনদের সহায়তা করা মু’মিনের পরিচয়, জান্নাতি মানুষের স্বভাব।
ইসলাম অসহায় ও দুস্থ মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ প্রত্যাশা করে। উন্নত ও মানবীয় ব্যবহার প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ করে। ইসলাম মানুষকে শিা দেয় পরস্পরকে ভালবাসতে। কেউ যেন কোনভাবে অন্যকে কষ্ট না দেয়, কারো তিসাধন না করে, কারো প্রতি যেন জুলুম-অত্যাচার না করে সেজন্য সাবধান বাণী শুেিনয়েছে ইসলাম। ইয়াতীম, অসহায় ও মজলুম মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করার ফজিলত সম্পর্কে হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (দ.) বলেন,
“যে ব্যক্তি কোন মু’মিনের পার্থিব দু:খ-কষ্ট দূর করবে আল্লাহ তার কিয়ামতের দু:খ-কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি ইয়াতীম, অসহায় ও সঙ্কটাপন্ন ব্যক্তির প্রয়োজন ও সঙ্কট নিরসন করবে আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় সঙ্কট নিরসন করবেন। আর আল্লাহ তায়ালা ততণ মানুষের সাথে থাকেন যতণ মানুষ ইয়াতীম-মিসকিন, অসহায় ও মজলুম মানুষের সাহায্যরত থাকে।” (বুখারি-মুসলিম)
হাদীছ শরীফে অন্যত্র বলা হয়েছে, সাহল (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন,
“আমি ও ইয়াতীমের প্রতিপালনকারী জান্নাতে এমনভাবে নিকটে থাকব। একথা বলে তিনি শাহাদাত ও মধ্যমা আঙ্গুল দু’টি দ্বারা ইশারা করলেন এবং এ দু’টির মাঝে কিঞ্চিত ফাঁক রাখলেন।” (বুখারী, হা/৫৩০৪)। অন্যত্র বর্ণনায় আছে, তিনি আঙ্গুল দু’টি মিলিয়ে দিলেন। (আবু দাউদ, হা/৫১৫০)
অর্থ-সম্পদ পৃথিবীতে চিরস্থায়ী ভাবে কেউ রাখতে পারে না। আজ যে রাজা কাল সে ফকিরÑ এটি চিরাচরিত নিয়ম হয়ে গেছে। সুখ-শান্তি ও সম্মান-মর্যাদা অর্থ দিয়ে বিচার হয় না। সম্পদশালী হলে সম্মানিত হবে এমন নয়। সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি মান-সম্মানের মানদণ্ড হতে পারে না। ধনী ব্যক্তি অসম্মানের কাজ করলে মানুষ ঘৃণা করে আবার গরীবজন গর্হিত কিছু করলে মানুষ তাকেও অপছন্দ করে। কেবল ধন-সম্পদের পিছু ছুটা নয় বরং ভালকাজের পুজারী হওয়া চাই। মানুষের পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দূর করলে আল্লাহ আমাদের পরম প্রত্যাশিত কিয়ামতের দিনে সহায় হবেন এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া, বড় সম্মানের। একাকিত্ব ও অভিভাবকহীন অসহায় জীবন-যাপনে কারো পাশে দাঁড়ালে সে কতটুকু খুশি হয় ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এজন্য ইয়াতীম ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে ইসলাম তাগিদ দিয়েছে। পবিত্র হাদীছে আছে, আবু দারদা (রা.) বলেন,
“একজন ব্যক্তি নবী করিম (দ.)-এর নিকট এসে তার অন্তরের কঠোরতার অভিযোগ করল। নবী করীম (দ.) বললেন, তুমি কি তোমার অন্তর নরম হওয়া চাও এবং তোমার প্রয়োজন পুরণ হওয়া চাও? তাহলে তুমি ইয়াতীমের প্রতি দয়া কর, তার মাথায় হাত ফিরাও, তোমার খাদ্য তাকে খেতে দাও। ফলে তোমার অন্তর নরম হবে, তোমার প্রয়োজন পুরণ হবে।” (সহীহ জামে’, হা/৮০)
সরলতা, দয়াদ্রতা ও নমনীয়তা একটি অনন্য গুণ। এসব গুণে গুণানি¦ত হতে পারলে মানুষের চরিত্রে মানবতার প্রস্ফুটন ঘটে থাকে। অহমিকা বর্জিত, কঠোরতা রুদ্ধ অন্তরে মানব কল্যাণে কর্ম উদ্দীপনা সমাহার বিরাজ করে। সেখানে থাকেনা দূরভিসন্ধি, খুঁজে পাওয়া যাবেনা প্রতিদান প্রাপ্তির প্রত্যাশা। মানব সমাজের কল্যাণের ধর্ম ইসলাম। মানবতার মুক্তি, সুন্দর, সুশৃ´খল, সাম্য-সম্প্রীতিময় সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম ধর্ম বিশ্ব দরবারে সম্মানিত হয়ে আছে। নবী ও রসূলগণ (দ.) মানবতার ধর্ম ইসলামের প্রচার করে, উন্নত আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ব সমাজে সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ইসলাম শিা দেয় মানুষ ও মানবতার কল্যাণে কাজ করলেই সবার মুক্তি ও সফলতা আসবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজে কোনো বিশৃ´খলা থাকবে না। ইসলামী বিধান মেনে সম্পদশালীরা তাদের অর্জিত সম্পদের যাকাত প্রদান করলে দারিদ্রের কষাঘাত থেকে মুক্তি পাবে কোটি কোটি দারিদ্র্য নিপীড়িত মানুষ। যাকাত আদায় ও মানবিক কর্তব্য পালন করলে সমাজে দরিদ্র মানুষ থাকবে কিন্তু বিনা চিকিৎসায়, সমাজে অমানবিক কষ্ট নিয়ে ও না খেয়ে মানুষ মরবে এমনটা ঘটবে না। আজ লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে রাস্তায় ঘুমায়। মানুষের জানমালের নিরাপত্তার অভাব, মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে শিা-দীাসহ সামাজিক অধিকার থেকে। গ্রাস করে নিচ্ছে মতাধররা অসহায়, দুর্বলদের সম্পদ। নির্মম নির্যাতন চলছে দুর্বল ও অসহায় মজলুম মানুষের ওপর। চলছে অন্যায়-অবিচার, মানুষের চোখে-মুখে হতাশা, হাহাকার। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
“মানুষকে খুবই সংকীর্ণমনা, ছোট আÍার অধিকারী করে সৃষ্টি করা হয়েছে। তার উপর যখন বিপদ আসে, তখন হতাশ হয়ে যায় এবং যখন সচ্ছলতা আসে তখন সে কৃপণতা করে।” (সূরা মা’আরিজ/ ১৯-২১)
মানুষ অর্থলোভি। অর্থকে আকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। কৃপণতা সৎ কর্ম থেকে মানুষকে পিছিয়ে রাখে। কেবল অর্থের পিছে না দৌড়িয়ে বরং মানুষের কল্যাণে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাদের কাজ করা দরকার। ভাল ও নেক কাজ করে শেষ করা যায়না। নেকীর কোন শেষ নেই। যত করা যাবে ততই করতে ইচ্ছে হবে। মহৎ উদ্যোগ নিয়ে ইসলামের পতাকাতলে আমাদের আশ্রয় নেয়ার অনন্ত প্রচেষ্টা থাকা দরকার। সময় শেষ হয়ে গেলে তখন আর উপায় থাকবে না। মুহাম্মাদ ইবনু উমায়রাতা নামক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (দ.)-এর একজন ছাহাবী বলেন, রসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন,
“কোন বান্দা যদি জন্ম থেকে শুরু করে মরণ পর্যন্ত সিজদায় পড়ে থাকে এবং রসূলুল্লাহ -এর পূর্ণ আনুগত্যে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়, তবুও সে ক্বিয়ামতের দিন তার সকল পূণ্যকে তুচ্ছ ও সামান্য মনে করবে। তার একান্ত ইচ্ছা হবে যে, যদি সে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে আরো অনেক পূণ্য সঞ্চয় করতে পারত।” ইবনু কাছীর, হা/৭২৭৬)
পরকালে অনেক নেকীর প্রয়োজন হবে, সৎ কর্মের প্রয়োজন অনুভব করবে মানুষ। তখন পৃথিবীর নোংরা ও অহেতুক কর্মকাণ্ড মানুষকে কত অসহায় করে দিয়েছে অনুধাবন করা যাবে। কিন্তু তখন করার কিছুই থাকবে না। সময় থাকতে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, অন্যায় থেকে বিরত থাকা, অসহায়, ইয়াতীম, মিসকিন ও দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার কাজ করার মানষিকতা তৈরি করা প্রয়োজন।
লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আরব বসন্তের সুবাতাসে তিউনিশিয়ায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা
মুহম্মদ আলতাফ হোসেন
ভূমধ্যসাগরের তীরে এবং আলজেরিয়া ও লিবিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিশিয়া। প্রাচীন কার্থেজ নগরী এখানেই অবস্থিত। এই দেশের ঐতিহ্যের কথা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জনপ্রিয়।
খৃষ্টপূর্ব ১২ শতকে ফিনিশীয়রা উত্তর আফ্রিকার সমুদ্র উপকূলে  বেশ কয়েকটি বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তুলেছিল। আজকের তিউনিশিয়ার অধিকাংশ অংশ খৃষ্টপূর্ব ৬ শতকে কার্থেজ রাজ্যের অংশ ছিল। ১৪৬ সাল  থেকে তিউনিশিয়া  রোমান শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। ৭ শতকে মুসলিম বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত  রোমান আধিপত্য বজায় থাকে। এটি ১৫৭৪ সালে তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৮৩ সালে দেশটি ক্রুসেডীয় ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে যায়। ১৯৫৫ সালে স্বায়ত্তশাসন লাভ করে এবং ১৯৫৬ সালে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৫৬ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর রাষ্ট্রপতি হাবিব আবু রাকিব এখানে একটি এক দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
১৯৫৬ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার আগে তিউনিশিয়ায় কঠোরভাবে  সেক্যুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ছাড়া স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ও দীর্ঘদিনের  প্রেসিডেন্ট হাবিব আবু রাকিব ছিল মনেপ্রাণে  সেক্যুলার এবং সে ইসলামকে রাষ্ট্রের জন্য একটা বড় হুমকি মনে করত।
এরপর ১৯৮৭ সালে যখন বিন আলী সাবেক  প্রেসিডেন্ট হাবিব আবু রাকিবকে ক্ষমতা  থেকে সরিয়ে নিজে ক্ষমতা দখল করলেন তখন তিনি কারাগার  থেকে ইসলামী আন্দোলনের বহু  নেতাকে সাময়িকভাবে মুক্তি দিলেন এবং তাদের নির্বাচনে অংশ  নেয়ার সুযোগ দিলেন। অবশ্য পরের ঘটনা ভিন্ন রকম। নির্বাচনের ফলাফলে বিন আলী অবাক হলেন এবং ইসলামপন্থিদের প্রাপ্ত  ভোটে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিউনিশিয়ার সবচেয়ে বড় ইসলামী দল আননাহদাহ ( রেনেসাঁ বা নবজাগরণ) পার্টি সরকারিভাবে  ভোট  পেল শতকরা ১৭ ভাগ এবং  দেশটিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। এর অবস্থান দাঁড়াল ক্ষমতাসীন দলের পরেই। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে সরকারের পক্ষ  থেকে ব্যাপক কারচুপি করা হয়। এ কারণে  সে সময় আননাহদা দলের  ভোট শতকরা ১৭ ভাগ  ােনো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসলামী এ দলটির প্রাপ্ত  ভোটের পরিমাণ শতকরা ৩০  থেকে ৩৫ ভাগ ছিল। অথচ ওই নির্বাচনে  সেক্যুলারপন্থি সব বিরোধীদলের সম্মিলিত  ভোট ছিল শতকরা মাত্র তিন ভাগ।
১৯৮৭ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরপরই বিন আলী তার নীতি পরিবর্তন করলেন। আবার আননাহদাহ নিষিদ্ধ  ঘোষণা করা হলো এবং সমর্থকদের ধরে ধরে  জেলে পুরা হলো। এছাড়া ইসলামের প্রতি যারাই একটু সহানভূতি  দেখালেন তাদের ওপর চলল ভয়াবহ দমন-পীড়ন।  সে বছরই আননাহদাহ দলের  নেতা  শেখ রশিদ ঘানুচিকে লন্ডনে নির্বাসনে পাঠানো হলো।
তিউনিশিয়ায় প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন বিন আলির পতনের পর  সে  দেশে গত ২৩ অক্টোবর  রোববার প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে  প্রতিদ্বন্দ্ব^ী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা  শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে এবং মধ্যপন্থি ইসলামী দল আননাহদাহ সর্বোচ্চ সংখ্যক আসন  পেয়ে বিজয়ী হয়েছে। ২১৭ আসনের পার্লামেন্টে সাবেক  স্বৈরশাসক  বেন আলির শাসনামলে নিষিদ্ধ থাকা এই দলটি ৯০টি আসন (৪১ শতাংশের  বেশি  ভোট)  পেয়েছে। গত  রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কংগ্রেস ফর দ্য রিপাবলিক বা সিপিআর ৩০টি আসন (১৪ শতাংশ  ভোট)  পেয়ে দ্বিতীয় এবং আত্তাকাতোল পার্টি ২১টি আসন (১০ শতাংশ  ভোট)  পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। তিউনিশিয়ার নির্বাচন কমিশনের প্রধান কামাল  জেন্দুবি গত বৃহস্পতিবার রাতে তিউনিশে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের এ ফল  ঘোষণা করেন।
 সেক্যুলার মানসিকতাসম্পন্ন দু’দল সিপিআর ও আত্তাকাতোল নির্বাচনে তাদের পরাজয়  মেনে নিয়েছে এবং স্বীকার করেছে, তিউনিশিয়ার জনগণ ইসলামী শাসন চায়। নির্বাচনের ফল  ঘোষিত হওয়ার পরপরই সারাদেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। রাজধানী তিউনিশসহ সারাদেশের প্রতিটি শহরের জনতা রাস্তায়  নেমে উল্লাস প্রকাশ করে।
 দেশটিতে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে গত জানুয়ারি মাসে ২৩ বছর ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা  প্রেসিডেন্ট বিন আলির পতন ঘটে। সাবেক স্বৈরশাসক বিন আলি ক্ষমতা ও  দেশ ছাড়ার দুই মাস পর গত মার্চে আননাহদাহ আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
গত রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পরপরই  ভোটার জরিপে ইসলামপন্থি দলটি এগিয়ে যাওয়ার পর দলের প্রধান রশিদ ঘানুচি বলেছিলেন, তিনি আগামী এক মাসের মধ্যে একটি  জোট সরকার গঠন করতে পারবেন। এছাড়া বৃহস্পতিবার রাতে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল  ঘোষিত হওয়ার পর ঘানুচি বলেছেন, সাম্প্রতিক গণবিপ্লবের লক্ষ্য বাস্তবায়নে তার দল সচেষ্ট থাকবে এবং নতুন সরকার তিউনিশিয়ার  প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রক্ষা করবে।
আননাহদা দল  জোট সরকার গঠনের জন্য এরই মধ্যে সিপিআর ও আত্তাকাতোলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। আননাহদার মহাসচিব হামাদি  জেবালিকে দলের পক্ষ  থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন  দেয়া হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ৬৩ বছর বয়সী হামাদী জেবালি দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও
তিউনিশিয়ার বর্তমান পার্লামেন্ট একটি অন্তর্বর্তী সরকার ও একজন  প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। এছাড়া আগামী এক বছরের মধ্যে  দেশটির জন্য সংবিধান প্রণয়ন করাই হবে এ পার্লামেন্টের প্রধান দায়িত্ব। এ কারণে নির্বাচন কমিশন আসন্ন  জোট সরকারে সর্বোচ্চ সংখ্যক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, এর ফলে নয়া সংবিধানে সবপক্ষের মতামত প্রতিফলিত হবে।
এদিকে তিউনিশিয়ার নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচনে চতুর্থ স্থান লাভকারী ‘পপুলার লিস্ট পার্টি’র কয়েক নির্বাচিত প্রার্থীর সদস্যপদ বাতিল করার পর দলটির কয়েকশ’  নেতাকর্মী বিক্ষোভ করেছেন। আর্থিক অনিয়মের দায়ে এসব প্রার্থীর সদস্যপদ বাতিল করা হয়।
লন্ডনভিত্তিক ব্যবসায়ী হাচেমি হামদির  নেতৃত্বাধীন পপুলার লিস্ট পার্টি সিদি  বৌজিদে  বেশ কিছুসংখ্যক আসন জিতেছে। কয়েকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারীরা শহরটিতে এন্নাদাহ পার্টির দফতরে চড়াও হয়ে দরজা-জানালা ভাঙচুর করেছে এবং টায়ার পুড়িয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শহরটিতে রাতে কারফিউ জারি করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া  গেছে।
 রোববারের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পার্লামেন্ট তিউনিশিয়ার জন্য একটি নয়া সংবিধান প্রণয়ন করবে। আননাহদাহ পার্টি বলেছে, তারা ক্ষমতায়  গেলে  দেশে শরীয়াহ বা ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করবেন। এখন পার্লামেন্টে সর্ববৃহৎ দল হিসেবে আননাহদাহ স্বাভাবিকভাবেই  দেশটির সংবিধান প্রণয়নে প্রধান ভূমিকা রাখবে। তাই ধারণা করা হচ্ছে,  দেশটিতে পরবর্তীতে সংবিধান ইসলামী আইন অনুযায়ী প্রণীত হতে যাচ্ছে। তিউনিশিয়ায় আননাহদাহ পার্টির এ বিজয় মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার গণআন্দোলন সফল হওয়া অন্য  দেশগুলোর ইসলামপন্থি দলের বিজয়ের সম্ভাবনাকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তিউনিশিয়ার আগে তুরস্কেও ইসলামপন্থিদের বিরাট বিজয় সূচিত হয়। এ বিজয় নামধারী মুসলমানদের গৃহীত নীতি ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে। তুরস্কে অতীতে  সেক্যুলার সরকারের আমলে তুরস্কের  সেনাবাহিনীতে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে চরম বিদ্বেষী ও শত্র“তামূলক আচরণ করা হয়েছে  সে সময়  সেনাবাহিনীতে কর্মরত ইসলামপন্থিদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি অভিযান চালানো হতো। এসব অভিযান চালিয়ে কারো বাড়িতে  কোরান শরীফ পাওয়া  গেলে কিংবা কারো স্ত্রী অথবা আত্মীয় স্বজনের মধ্যে  কেউ হিজাব বা পর্দা করলে অথবা  কেউ নামাজ-রোজা করলে বা ইসলামী অনুশাসন  মেনে চললে তাদের  সেনাবাহিনী  থেকে বহিষ্কার করা হতো। এসবই করা হতো সংবিধানের  দোহাই দিয়ে। কারণ  সে সময় তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান বলবৎ ছিল।
উল্লেখ্য, ধর্মনিরপেক্ষতা  যে কত নিকৃষ্ট ও নির্মম ধর্মহীনতা হতে পারে তার বড় উদাহরণ তুরস্ক ও তিউনিশিয়া। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট প্রতিভাত হয়েছে, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের  দেশে কখনো ধর্মনিরপেক্ষতার স্থায়ী আসন গড়ে উঠতে পারে না।
(মুহম্মদ আলতাফ হোসেন, বার্তা সংস্থা এফএনএস’র প্রধান সম্পাদক)
 লিবিয়ায় একি আরব বসন্ত
ইসমাঈল হোসেন দুলাল
লিবিয়ার মিসরাতা শহরের এক হিমায়িত মাংসের দোকান। অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত লিবিয়ার একটি শহরে হঠাৎ এক মাংসের দোকানে এত ভিড় জমে উঠল কেন? আকাশ থেকে কি টাকা ছিটানো হয়েছে, আর সেই টাকা কুড়িয়ে নিয়ে সবাই ছুটেছে মাংসের দোকানে? না। সে রকম কিছু নয়। বরং অতিশয় অস্বাভাবিক আর নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক একটি দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে ওই মাংসের দোকানে: সস্তা চাটাইয়ের ওপর পড়ে আছে রক্তমাখা একটি মানবদেহ, পরণে শুধু খাকি ট্রাউজার, পা দুটি খালি। মাথার বাম পাশে ক্ষতচিহ্ন বুলেটের। বুক ফুটো করে দিয়েছে আরেকটি বুলেট, সেই ফুটো থেকে চুইয়ে আসা লাল রক্ত শুকিয়ে গিয়ে এখন কালচে।
প্রহরীদের অনুমতিক্রমে কয়েকজন মানুষ ঢুকছে দোকানটির ভেতরে। ক্ষতবিক্ষত দেহটির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে তারা, ক্যামেরার সামনে হাত তুলে দুই আঙুলে বানাচ্ছে বিজয়চিহ্ন, আর শ্লোগান দিচ্ছে: আল্লাহু আকবর।
স্বৈরশাসকের চূড়ান্ত পতন ‘উদযাপনের’ সুযোগ করে দিতে এই আয়োজন করেছে লিবিয়ার বর্তমান কর্তৃপক্ষ। কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির রক্তমাখা ক্ষতবিক্ষত প্রাণহীন দেহটি এখন এক ঐতিহাসিক স্মারক। সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সিরত শহরে গাদ্দাফিকে আটক করে জীবিত অবস্থায়, তারা তাকে টেনেহিঁচড়ে তোলে একটি ট্রাকে। প্রথমে তার ওপর নির্যাতন চালায়, তারপর খুব কাছ থেকে গুলি করে তাকে হত্যা করে।
সিরত গাদ্দাফির জšে§র শহর, তিনি শেষ আশ্রয়ের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ওই শহরকে, যেখানে তার অনেক জ্ঞাতিগোষ্ঠীর বাস। তার সঙ্গে ছেলে মুতাসিমকেও হত্যা করেছে বিদ্রোহীরা। তারপর গাদ্দাফির মৃতদেহ নিয়ে গেছে মিসরাতা শহরে, সেখানে প্রকাশ্যে ‘বিজয়-প্যারেড’ করেছে তারা। বিজয়ের প্রমাণ হিসেবে প্রদর্শন করেছে গাদ্দাফির মৃতদেহ। গাদ্দাফির জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোকজন গাদ্দাফি ও তার ছেলের লাশ চেয়েছিল ইসলামি পন্থায় সিরতেই কবর দেয়ার জন্য। কিন্তু লাশ তাদের দেয়া হয়নি। তারা জাতিসংঘ, ওআইসি আর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছেও আবেদন জানিয়েছে।
কিন্তু লিবিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন শাসকেরা, স্বঘোষিত ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের নেতারা গাদ্দাফির আÍীয়স্বজনের আবেদন-নিবেদনের প্রতি কর্ণপাত না করে মাথা ঘামাতে লাগলোÑএই লাশ নিয়ে কী করা যায়। একটা সিদ্ধান্তে সবাই অটল, গাদ্দাফি বা তার ছেলে মুতাসিমের লাশ তার আÍীয়স্বজনের কাছে দেয়া হবে না। তাহলে লাশ নিয়ে কী করা যায় ত্রিপোলি তাড়াতাড়ি ওই ল্যাঠা চুকিয়ে ফেলতে চায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল ছুটে গেলেন মিসরাতা শহরে, সেখানকার ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করতে। মিসরাতার নেতারা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তারা নিজেদের শহরে স্বৈরশাসকের কবর দিতে দেবে না।  যা শোনা যাচ্ছিলো তাতে মনে হচ্ছিলো, গাদ্দাফিকে ভূমিতে কবর দেয়া হবে না, সাগরে ফেলে দেয়া হবে তার লাশ, ওসামা বিন লাদেনের বেলায় যেমনটি করা হয়েছিল বলে শোনা যায়। জীবিত অবস্থায় নির্যাতন, নিরস্ত্র ও বন্দী অবস্থায় খুন এবং প্রাণহীন অবস্থায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির দেহটিকে যেভাবে লাঞ্ছিত-অপমানিত করা হয়, পশ্চিমের সভ্য দুনিয়ার লোকেরা তা উপভোগ করেছে, যেমন করে তারা উপভোগ করেছিল হলিউডের হরর মুভি। লিবিয়ার শুকনো মাটি মুয়াম্মার গাদ্দাফির রক্তে ভিজে ওঠে। পশ্চিমা শক্তিগুলো আর তাদের সমর্থনপুষ্ট লিবীয় বিদ্রোহীরা মেতে ওঠে বিজয়ের উল্লাসে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বললেন, ‘লিবিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়ের অবসান হলো।’ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সমর্থক-বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, ‘ওবামা ডকট্রিন’-এর আরেকটি বিজয় অর্জিত হলো লিবিয়ায়।
ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করতে হলো না, শত শত মার্কিন সেনাকে প্রাণ দিতে হলো না, লিবীয় বিদ্রোহীদের দিয়েই পতন ঘটানো গেল গাদ্দাফির, করে ফেলা হলো ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা সরকার পরিবর্তন। এমনই কেউ কেউ বলছেন, আরব বসন্তের সবচেয়ে বড় ফলটি সবার আগেই ফলেছে লিবিয়ায়, যেখানে বসন্ত এসেছে সবার পরে। কিন্তু গাদ্দাফির লিবিয়ায় আসলে আরব বসন্তের হাওয়া লাগেনি। ওই দেশে সেই বসন্ত আসেনি, যা এসেছে তিউনিসিয়ায়, মিসরে, সিরিয়ায়, জর্ডানে; এমনকি পেয়েছে ইয়েমেনের মতো দেশও। তিউনিসিয়ায় ও মিসরে যে বিপুল গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে, তাতে অংশ নিয়েছে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। বিশেষত, মিসরে মোবারকবিরোধী বিক্ষোভ-প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন অনেক নারী। আন্দোলনকারীদের হাতে অস্ত্র ছিল না, তারা সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হননি। তারা শান্তিপূর্ণ পন্থায় মোবারক সরকারের বিরুদ্ধে তাদের অনাস্থা প্রকাশ করেছেন, মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে দিন-রাত অবস্থান করেছেন কায়রোর তাহরির স্কয়ারে।
কিন্তু লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একদম শুরু থেকেই দেখা গেছে ভারি আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। তিউনিসিয়া বা মিসরের মতো শান্তিপূর্ণ জনসমাবেশ বা মিছিল দেখা যায়নি লিবিয়ার কোনো শহরে, দেখা যায়নি কোনো নারীকেও। সামাজিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হলে অবশ্যই নারীদের অংশগ্রহণ থাকত, যেমনটি দেখা গেছে তিউনিসিয়ায় ও মিসরে। প্রতিবাদী ব্যানার-ফেস্টুন নয়, একে ৪৭ রাইফেল আর রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেডের মতো ভারি ও স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গাদ্দাফিবিরোধী একদল যুবক ‘বিদ্রোহ’ শুরু করে দেয় বেনগাজি শহর থেকে। এই যুবকেরা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ কোথায় পেয়েছে? লিবিয়ার মতো কঠোর পুলিশি রাষ্ট্রে, যেখানে গাদ্দাফির সমালোচনা করে একটা শব্দ উচ্চারণ করতেও লোকে ভয় পেত, সেখানে হঠাৎ করে বেশ কিছুসংখ্যক তরুণ-যুবকের হাতে ভারি আগ্নেয়াস্ত্র এসেছিল কোথা থেকে?
এত দিনে আর কোনো সন্দেহ নেই যে পশ্চিমা বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে, ভূরাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমধ্যসাগরের ওপারের দেশ ফ্রান্সের একটা বড় হাত ছিল একদম গোড়া থেকেই। ব্রিটিশরাও এসে ফ্রান্সের সঙ্গে হাত মেলায়। আর আটলান্টিকের ওপারের বড় সর্দার যুক্তরাষ্ট্র তো রয়েছেই। তারা লিবিয়ার ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর উদ্দেশ্যে বিদ্রোহীদের আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, গোয়েন্দা তথ্য ও কৌশলগত পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে থাকে। কিন্তু গাদ্দাফির বিপুল ও শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা যখন পেরে উঠছিল না, তখন ন্যাটো জোটের মাধ্যমে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো দেশটিতে আগ্রাসন শুরু করে দেয়। লিবিয়ার বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদের দিকে তাদের বড্ড লোভ। তিউনিসিয়া-মিসরে যে আরব বসন্ত এসেছে, লিবিয়ায় তা আসবে না জেনে দেশটিতে তারা কালবৈশাখীর আয়োজন করেছিল।
স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র রফতানির নামে লিবিয়ায় একদল মানুষের হাতে অস্ত্র, গোলাবারুদ, টাকাপয়সা আর কূটবুদ্ধি দিয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো লিবিয়ায় যে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড ঘটিয়ে দিল, তার পরিণতি কী হতে পারে? অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগের সঙ্গে জানিয়েছে, গাদ্দাফির অনুসারীদের ওপর বর্বরতা শুরু হয়েছে। লিবিয়া বহু গোত্রে বিভক্ত একটি দেশ, যেখানে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণাটি এখনো স্বচ্ছ নয়। গণতন্ত্র, আইনের শাসনÑএ ধরনের পশ্চিমা ধারণার প্রেক্ষাপটে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করা যাবে না। ইতিহাসের কোনো কালেই সেখানে গণতন্ত্র ছিল না। কোনো রাজনৈতিক দলও দেশটিতে নেই। যারা গাদ্দাফিকে হটিয়ে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছে, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ গুণ্ডাপাণ্ডা ধরনের মানুষ। বিভিন্ন অঞ্চল বিভক্ত বিভিন্ন গোত্রে। মানুষের হাতে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। আর রাজনৈতিক ওলট-পালটের ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। এসব দেখেশুনে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পরের কথা, আগে কীভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়, সেটাই ভাবনার বিষয়। গাদ্দাফি জবরদস্ত স্বৈরশাসক ছিলেন বটে। কিন্তু তিনি বহু গোত্রে বিভক্ত লিবীয় সমাজকে একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন; লৌহদৃঢ় শাসনদণ্ড ব্যবহার করে হলেও জনজীবনে মোটামুটি শান্তি আনতে পেরেছিলেন।
   লেখক: কলামিস্ট 
হাতেনাতে দুর্নীতি ধরে নমুনা নিয়ে এলেন কর্মকর্তা
আশরাফুল হক রাজীব
খাদ্য বিভাগের ৯১টি গুদাম নির্মাণে অর্থ লুটপাট চলছে প্রকাশ্যে। খোদ সরকারি প্রতিবেদনেই এই নির্মাণ কাজ সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘সরকারি অর্থ তছরুপের এক মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’ প্রায়  সোয়া ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন গুদামগুলো অল্প দিনেই দেশের সম্পদ থেকে সমস্যায় পরিণত হবে বলে প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
অর্থ লুটপাটের অভিযোগ পেয়ে একপর্যায়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ও তদন্তে নামে এবং তাদের তদন্তের অভিযোগগুলোর প্রমাণ মেলে। মন্ত্রণালয়ের তদন্তে বলা হয়েছে, ‘গুদাম নির্মাণ কাজে ব্যবহƒত হচ্ছে অত্যন্ত নিম্নমানের ইট। এসব ইট হাতে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে চার-পাঁচ টুকরো হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা ছাড়াই নির্মাণ কাজে রড ব্যবহার করা হচ্ছে। মেঝেতে বালুর বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে মাটি।’ এই অবস্থায় তদন্ত কমিটি গাঁথুনি ভেঙে নতুন করে গাঁথুনি দেয়ার সুপারিশ করেছে। সেই হিসাব মতে সরকারের ৬৫ কোটি টাকা পানিতে গেছে।
সরকারি প্রতিবেদনে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তদন্তে তার সত্যতা মিলেছে কি-না জানতে চাইলে খাদ্য বিভাগের সচিব বরুণ  দেব মিত্র গত ২ নভেম্বর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এখনো তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাইনি। তাই এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারছি না।’ খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আহমদ হোসেন খানের কাছে জানতে চাইলে একই ধরনের মন্তব্য করেন তিনি। এই প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে নাকি? আমার কাছে আসেনি  তো!’
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক খাদ্য বিভাগের উপসচিব  মোঃ শহিদুল হক ৩ নভেম্বর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।’
জানা গেছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ১৬ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত করার গুদাম রয়েছে। এ ক্ষমতা বাড়িয়ে পর্যায়ক্রমে তা ২২ লাখ টনে উন্নীত করার জন্য বর্তমান সরকার চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে গুদাম নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু এসব গুদাম নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এরই প্রতিধ্বনী শোনা যায় খাদ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোঃ এনায়েত হুসাইনের প্রতিবেদনে। সরকারের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এ কর্মকর্তা গত ১০  সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সিএসডি ক্যাম্পাসে নির্মাণাধীন খাদ্য গুদামগুলো পরিদর্শনে যান সেখানে ২১৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে ৯১টি গুদাম নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে এক হাজার টন ধারণক্ষমতার ৭৭টি এবং ৫০০ টন ধারণক্ষমতার গুদাম ১৪টি। এসব গুদামে ৮৪ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত করা যাবে। গুদামগুলো ২৩টি প্যাকেজে ভাগ করে ২৩ জন ঠিকাদারকে নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়। ইতোমধ্যে গুদামগুলোর ২৫  থেকে ৩০ শতাংশ নির্মাণ কাজ  শেষ হয়েছে। সেই হিসেবে কাজ হয়েছে প্রায় ৬৫  কোটি টাকার।
খাদ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এনায়েত হুসাইন তাঁর প্রতিবেদনে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি হাতেনাতে ধরে দুর্নীতির কিছু নমুনা সঙ্গে করে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। গত ১০  সেপ্টেম্বর এনায়েত হুসাইন হালিশহর গুদাম নির্মাণ স্থানে  পৌঁছে দেখতে পান, লাখ লাখ ইট স্তূপ করে রাখা হয়েছে নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য। বিবর্ণ লালচে ইট দেখে উপস্থিত কর্মকর্তাদের কাছে হাতাশা প্রকাশ করেন তিনি। এই ইট দিয়েই গুদাম নির্মাণের কাজ চলছে।  বেশির ভাগ গুদামের দেয়াল তোলা হচ্ছিল। ওই দিন কিছু গুদামের মেঝের উচ্চতার লেবেল নির্মাণের কাজও চলছিল। সব কাজেই ব্যবহার করা হচ্ছিল ওই নিম্ন মানের ইট। এই পর্যায়ে এনায়েত হুসাইন কিছু ইট হাতে নেন। সঙ্গে সঙ্গে ইটগুলো ঝুরঝুর করে খসে পড়ে। উপস্থিত কর্মকর্তাদের কাছে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে রফিকুল ইসলাম নামে একজন সাইট ইঞ্জিনিয়ার এগিয়ে আসেন। তিনি এনায়েত হুসাইনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, সামনে ১৭ নম্বর প্যাকেজের গুদামের জন্য ভালো মানের ইট রয়েছে। সেই ইট হাতে নিয়েও হতাশ হন এনায়েত হুসাইন। সেগুলোও একই রকম নিম্নমানের।
এসব স্তূপ থেকে চারটি ইট নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। ঢাকায় এসে অতিরিক্ত মহাপরিচালক তার প্রতিবেদনে গুদাম নির্মাণে নিম্নমানের ইট ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে গত ১৩ সেপ্টেম্বর খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘হালিশহর প্রকল্প বাস্তবায়ন এলাকায় যতগুলো ঠিকাদার কাজ করছেন তাদের সবার সাইট পরিদর্শনে তারা একই ধরনের নিকৃষ্টমানের ইটের সমারোহ ঘটিয়েছেন দেখা গেল। কোনো ঠিকাদারের খামালে উৎকৃষ্টমানের (১ম শ্রেণীর) ইট দেখা  গেল না। প্রকল্প সাইট থেকে নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করে আনা ইটগুলো ১১/৯/২০১১ তারিখ মহোদয়কে আপনার দফতরে দেখানো হয়েছে। ১২/০৯/২০১১ তারিখ পর্যন্ত ইট চারটি অক্ষুণœ থাকলেও ১৩/০৯/২০১১ তারিখ নিম্নস্বাক্ষরকারীর অফিসে প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখা অবস্থায় এদের মধ্যে একটি ইট ধরার সঙ্গে সঙ্গে আপনা আপনি চার-পাঁচ টুকরা হয়ে ভেঙে গিয়েছে।’
প্রতিবেদনে অতিরিক্ত মহাপরিচালক জানিয়েছেন, বড় বাজেটের কাজ হলেও প্রকল্প পরিচালক ও অন্য কর্মকর্তারা নিয়মিত প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করছেন না। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যয়বহুল এ প্রকল্পে তদারকির অভাব রয়েছে। লোহার রডের মান যাচাইয়ের কোনো যন্ত্র না থাকায় তিনি কোনো মন্তব্য করতে পারেননি। তিনি আরো জানিয়েছেন, গোডাউনগুলোর মেঝে নির্মাণের জন্য নিচের মাটি অপসারণ করে সেখানে বালু দিয়ে ভরাট করার প্রয়োজন থাকলেও ঠিকাদার মাটি অপসারণ না করেই মাটির ওপরে সামান্য বালু দিয়ে মেঝে নির্মাণ করেছেন, যা অদূর ভবিষ্যতে দেবে গিয়ে গোডাউনের স্বাভাবিক ব্যবহারে বিঘœ ঘটাতে পারে।
প্রতিবেদন জমা দেয়ার আগেই এনায়েত হুসাইনের কাছে ছুটে আসেন প্রকল্প পরিচালক এ কে এম মাহবুব আলম। এ সময় তাদের মধ্যে বাদানুবাদ হয় বলে জানা যায়। একপর্যায়ে প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতা এবং তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগসাজশে প্রকল্পের কাজে পুকুর চুরির মাধ্যমে সরকারি অর্থের লুটপাট হচ্ছে উল্লেখ করে প্রতিবেদন জমা দেন এনায়েত হুসাইন। এর কিছুদিন পর প্রকল্প পরিচালক গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রতিবেদন দেয়ার পর খাদ্য অধিদফতরে  হৈচৈ শুরু হয়। বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়া হয় না। এ ধরনের প্রতিবেদন দেয়ায় অধিদফতরের অনেক কর্মকর্তা এনায়েত হুসাইনকে ভর্ৎসনা করেছেন। দুর্নীতি ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কারের পরিবর্তে তাকে তিরস্কার করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে খাদ্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে।
অতিরিক্ত মহাপরিচালকের প্রতিবেদনের বিষয়টি খাদ্য মন্ত্রণালয়কে জানানোর পর খাদ্য বিভাগের উপসচিব মোঃ শহিদুল হককে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তদন্ত করতে চট্টগ্রামে যাওয়ার আগেই ঠিকাদারদের কাছে বিষয়টি ফাঁস করে দেন খাদ্য অধিদফতরের অসাধু কর্মচারী-কর্মকর্তারা। এ কারণে তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থলে গিয়ে নষ্ট ইটের স্তূপ দেখতে পায়নি। কিন্তু গুদাম নির্মাণে তারা নিম্নমানের ইট ব্যবহারের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, নিম্নমানের ইট ব্যবহারের বিষয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালকের অভিযোগ তদন্ত কমিটির কাছেও সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। অতিরিক্ত মহাপরিচালকের প্রতিবেদন দেয়ার পর পরই ঠিকাদাররা ইট সরিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের পক্ষে দেয়ালে ব্যবহার করা ইট সরানো সম্ভব নয়। এ অবস্থায় তদন্ত কমিটি গুদাম নির্মাণে ব্যবহƒত ইটের মান পরীক্ষার জন্য ইটের কম্প্র্রিহেনসিভ স্ট্রেংথ পরীক্ষার সুপারিশ করেছে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে ইটের গাঁথুনি ভেঙে উৎকৃষ্ট মানের ইট দিয়ে নতুন করে গুদাম নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। নিম্নমানের ইট ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরও কেন ইটের কম্প্র্রিহেনসিভ স্ট্রেংথ পরীক্ষার সুপারিশ করা হলো জানতে চাইলে খাদ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত দলে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন কাউকে সংযুক্ত করা হয়নি। অন্যদের পক্ষে ইটের কারিগরি বিষয়টি শতভাগ বোঝা সম্ভব নয়।
একই সঙ্গে গুদামের মেঝেতে মাটির বদলে ভিটি বালু দিয়ে ভরাট করার বিষয়টিও নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটি ভিটি বালু ছাড়াই গুদামের ভেতরের মাটি ছড়িয়েই নির্মাণ কাজ করার প্রমাণ পেয়েছে। অথচ অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী গুদামগুলোর গ্রাউন্ড লেবেল থেকে মেঝে পর্যন্ত ভিটি বালু দিয়ে পূর্ণ করার কথা। কমিটি সরজমিনে তদন্তের সময় ভিটি বালুর পরিবর্তে হলুদ আঠালো মাটি দেখতে পায়। নিম্নমানের ইট ব্যবহারের কারণে তদন্ত প্রতিবেদনে ১৭ নম্বর প্যাকেজের ঠিকাদারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রকল্পের সুষ্ঠু মনিটরিং নিশ্চিত করার জন্য প্রকল্প পরিচালক, উপপরিচালককে প্রকল্প এলাকায় অবস্থানেরও সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য নেয়া ইট, রড, বালু, সিমেন্ট ও পাথর নিয়মিত পরীক্ষা করানোর সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসবের নমুনা পাঠানোর সময় প্রকল্প পরিচালক বা উপ-পরিচালককে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকার কথা বলা হয়েছে। কোনো কারণে তা সম্ভব না হলে নমুনা স্বাক্ষরসহ সিলগালা করে পাঠানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। প্রতিটি গুদামে একাধিক গ্রেড বিম রয়েছে। এসব  গ্রেড বিম নিচের দিকে আনুমানিক সাড়ে তিন ফুট পর্যন্ত নিম্নমানের ও অসম ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি প্রমাণ পেয়েছে। তদন্ত কমিটির কাছে ঠিকাদাররা আগের নিম্নমানের ইটের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ভালো মানের ইট দিয়ে অবশিষ্ট কাজ করার সুযোগ দাবি করেন। কিন্তু তারা নতুন করে যে ইট সংগ্রহ করেছেন, সেগুলোও নিম্নমানের বলে উল্লেখ রয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। তদন্ত কমিটির সামনে গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, গুদাম নির্মাণের জন্য অন্যান্য উপকরণের মান যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকলেও ইট কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া তদন্ত কমিটি মনে করে, হালিশহর সিএসডি কম্পাউন্ড এলাকায় প্রকল্পের সব গুদাম নির্মাণ কাজ চলার কারণে প্রকল্পের দফতর ওই কম্পাউন্ডেই স্থাপন করা দরকার ছিল। অথচ প্রকল্পের অফিস ঢাকায়। প্রকল্পের পরিচালক ও সহকারী পরিচালকের সেখানেই অবস্থান করা বাঞ্ছনীয় বলে মন্তব্য করা হয়। প্রকল্পের মনিটরিং দুর্বল বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
টেন্ডার সিডিউলে পাইলিং নির্মাণে ৬০ হাজার পিএসআই  গ্রেডের রড ব্যবহার করার কথা রয়েছে। কিছু গুদামে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের রড ব্যবহার করা হলেও অনেক গুদামে ব্র্যান্ডবিহীন রড ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যবহারের জন্য নির্মাণ স্থানে নেয়া সব চালানের রড কারিগরি পরীক্ষা করা হয় না। এ ছাড়া কিছু পিলারের রড নির্ধারিত মাত্রার ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে তদন্ত দলের সন্দেহ দেখা দেয়ার কথা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে সিমেন্ট ও পাথরের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো নমুনার সঠিকতা সম্পর্কেও সন্দেহ পোষণ করা হয়। খাদ্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, একটি সিন্ডিকেট ৯১টি গুদামেই তাদের সরবরাহ করা ইট ব্যবহারে বাধ্য করছে। একজন মন্ত্রী, যার বাড়ি চট্টগ্রামে, তিনি এ সিন্ডিকেটের প্রধান। তার লোকজনই একটি নির্দিষ্ট ইটখোলা থেকে এসব নিম্নমানের ইট সরবরাহ করছে।
একজন প্রকৌশলী তদন্ত কমিটিকে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, ‘বঙ্গ নামক সরবরাহকারী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সব ঠিকাদারকে ইট গ্রহণ করতে হবে মর্মে সরবরাহকারী সিন্ডিকেট জানিয়ে দিয়েছে। তাই সব ঠিকাদারের ইট একই ইটখোলার এবং একই মানের।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা ড. এ এম এম শওকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা  স্রেফ তদারকির অভাবে হচ্ছে। গুদাম নির্মাণে দুর্নীতি বর্তমান সরকারের কাছ থেকে কেউ প্রত্যাশা করে না। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উচিৎ শক্ত হাতে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা। খাদ্য অধিদফতর ও গণপূর্ত অধিদফতরের যেসব কর্মকর্তা এ দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।’ 


জাল টাকা নিয়ে আতংকে আছি
মোঃ তবিউর রহমান
নানা উদ্যোগ আর ব্যবস্থা নেয়ার পরও জাল টাকার ছড়াছড়ি রোধ করা যাচ্ছে না। আরামের ঘুম হারাম করে কিংবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা রোজগারের পর যদি দেখা যায়Ñ সে টাকা জাল তবে আফসোসের আর সীমা-পরিসীমা থাকে না। প্রযুক্তির অপব্যবহার করে জাল টাকা তৈরি এখন বেশ সহজ হয়ে গেছে। একই মূল্যমানের নোট বিভিন্ন রকম হওয়ার কারণেও সাধারণ মানুষের পক্ষে জাল টাকা শনাক্ত করা বেশ কঠিন হয়ে গেছে। একই নোটে বিভিন্ন প্রকার রঙ/বর্ণের প্রিন্ট হওয়ার কারণে জাল টাকার লেনদেন বেশ সহজ হয়ে গেছে। কারণ জালিয়াত চক্র যেটা সহজে পারছে নকল করছে। তাই যে কোন প্রকার নোটের মাত্র একটি প্রিন্টই বাজারে রাখা উচিত। এক্ষেত্রে এক থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত প্রতিটি নোটই ক্রমান্বয়ে বড় সাইজের করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আসল টাকা চেনার কিছু কলাকৌশল সংবলিত একটি বিজ্ঞপ্তি দেশের প্রায় সব দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বা হচ্ছে। সমস্যা হল, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এসব বিষয় মনে রাখা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাছাড়া যখন অনেক বেশি টাকা আদান-প্রদান হয় তখন এভাবে খুঁটে খুঁটে প্রতিটি নোট চেক করা সময় সাপেক্ষ এবং প্রায় অসম্ভব।
জাল টাকা নিয়ে সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েন। জাল মুদ্রার কারবারের সঙ্গে যুক্ত এ দেশের অসাধু ব্যক্তিরা অনেক আগে থেকেই সক্রিয় থাকলেও ঈদ সামনে রেখে এদের উৎপাত অনেকগুণ বেড়ে গেছে। আসন্ন কোরবানির ঈদে জালিয়াত চক্র কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। সাধারণত কোরবানির ঈদের আগে পশু কেনা-বেচা উপলক্ষে বিশাল অংকের টাকা হাতবদল হয়। বিক্রেতার কাতারে যারা থাকেনÑ তাদের অধিকাংশই গ্রামগঞ্জের কৃষক বা পাইকার শ্রেণীভুক্ত। এরা কোন টাকার ভেতর কী ধরনের সূক্ষ্ম জালিয়াতি ঘাপটি মেরে আছে তা বুঝতে অনেকটাই অপারঙ্গম। আর এ সুযোগটাই গ্রহণ করে থাকে জালিয়াতরা। সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে তারা হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। সন্দেহ নেই, এতে ব্যক্তিগতভাবে মানুষ যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হয়, পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতেও এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে মনে রাখা দরকার, মুদ্রা জালিয়াতির সঙ্গে কেবল দেশীয় প্রতারক দলই সম্পৃক্ত নয়, এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রও সংশ্লিষ্ট। কাজেই বিমানবন্দর অথবা অন্য কোন চ্যানেলে দেশে জাল মুদ্রার প্রবেশ রোধে কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা থাকা উচিত। পাশাপাশি জেলা পর্যায়ে জাল টাকা উদ্ধার ও এর সরবরাহ বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া উচিত। দেশের সীমান্ত জেলাগুলোয় জাল টাকার লেনদেন বেশি হয়। জেলা পর্যায়ে জাল টাকার গতি রোধ করতে পারলে সুফল পাওয়া যাবেÑ তাতে কোন সন্দেহ নেই।

স্বাধীনতার প্রতীক প্রতিষ্ঠান বিদেশি পণ্য ছোঁয়ায় অপবিত্র হবে কেন?
ড. ইশা মোহাম্মদ
সংসদে বিছানোর জন্য বিদেশি কার্পেট কেনা হবে। দরপত্র জমা দেয়া নিয়ে হাঙ্গামা হয়েছে। হাঙ্গামা হয়েছে বলেই বিদেশি কার্পেট কেনার জন্য অনেক টাকার টেণ্ডার জটিলতার খবরটি সাধারণ মানুষ জেনেছে পত্র-পত্রিকার কল্যাণে। পত্রিকাতে হাঙ্গামা না হলে আবার এ জাতীয় খবর খবর হয়ে আসে না। তাই বলতে হবে ‘হাঙ্গামা’ সাধারণ মানুষের জন্য মঙ্গলকর হয়েছে। তারা প্রশ্ন করেছে, স্বদেশী সংসদে বিদেশি কার্পেট কেন?
বাংলাদেশের সংসদ বাঙালি জাতির গর্বের বিষয় বিভিন্ন কারণে। বাংলাদেশের শেরেবাংলা নগরের সংসদ ভবনে ইংরেজ সাংসদরা বসে নাÑএ কারণে বাঙালি জাতি গর্ববোধ করে। বাংলাদেশের সংসদ ভবনে পাকিস্তানি হানাদাররা বসে নাÑ এ কারণে সংসদ ভবন বাঙালিদের কাছে বড় আপন মনে হয়। সংসদ ভবনে বসে বাঙালিরা এবং স্পিকারও একজন বাঙালি। সরকার দলীয় নেত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীও বাঙালি। কিন্তু এগুলো ছাপিয়ে যে দুঃসংবাদ বাজারে রটেছে সেটি কিন্তু বাঙালির হাতের না, দেশীয়ও না একে বলে খাঁটি বিদেশি। দেশীয়রা যেখানে বলাবলি করে দেশের কল্যাণে মঙ্গলে অংশগ্রহণ করেন এবং মূল্যবান খরচ ব্যয় করে বহুবিধ কসরত করে তাদের মহামূল্যবান সময় নষ্ট করে দু’চারখানা যে আইন পাস করেন তার জন্য তাদের অনেক কিছু ‘বিদেশি’ প্রয়োজন হয়, তা সাধারণ মানুষ জানত না। তারা হাঙ্গামার কারণে জেনেছে যে, বাংলাদেশের সংসদে বিদেশি কার্পেট প্রয়োজন হয়েছে। বিদেশি কার্পেট  না হলে তাদের আইন প্রণয়ন বিষয়ক জটিলতা ‘কাঠিন্য’ অনুভব করছে। তবে এ কাঠিন্যকে কোষ্টকাঠিন্য ভেবে ভুল করা ঠিক হবে না। এটা অন্য জাতীয় কাঠিন্য হতে পারে।
পৃথিবীতে গরিব কেবলমাত্র বাংলাদেশই নয় অনেক গরিব দেশ আছে। গরিব দেশগুলো এক জাতীয় মনোকষ্টে ভোগে। সব সময়ই ভাবেÑ তাকে বুঝি গরিবের মতো দেখাচ্ছে। যে জাতি অন্য জাতিকে অনুকরণে অভ্যস্ত তারা অনেকটা অনুকরণপ্রিয়তার কারণে মাঝে মধ্যে বাঁদরামী করে ফেলে। বাঁদরদের অনুকরণের ঐতিহ্য আছে। এটি তাদের জন্য প্রশংসার। মানুষদেরও অনুকরণ প্রবণতা আছে। এটি ভদ্রলোকদের জন্য নিন্দার। অনুকরণ করে কোনো জাতিই মৌলিক অগ্রগতি অর্জন করতে পারে না। কিন্তু তারপরও দেখা যায় কোনো কোনো জাতি অনুকরণ করে সভ্য দুনিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ জাপানের কথা বলা যায়। আধুনিক ইউরোপকে অনুকরণ করে তারা সম্ভ্রান্ত জাতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সমাজবিশারদরা নিছক অনুকরণ করেই যে তারা সমৃদ্ধি অর্জন করেছে তা স্বীকার করে না। তাদের কারোর কারোর ধারণা, জাপানিরা কেবলমাত্র অনুকরণ করেনি, তারা আÍস্থ করেছে এবং নতুনত্ব আরোপ করেছে। এ নতুনত্ব একরকম  সৃষ্টিশীলতা। তারপরও যদি ধরেই নেই যে, জাপানিরা অনুকরণ করে তবুও খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের সংসদে বিদেশি ‘অলংকার’ নেই, বিদেশি ‘আভরণ’ নেই। উঠতি জাতি হিসেবে নাম করেছে গণচীন। খোঁজ নিলে দেখা যাবেÑ তাদের সংসদেও বিদেশি কার্পেট নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিংবা রাশিয়ার সংসদে বিদেশি কার্পেট না থাকলে সেটি আলোচ্য হবে না। কেননা, তারা খুবই ভালো কার্পেট বানাতে পারে। পাশের দেশ ভারত। সেখানকার সংসদ ভবনে বিদেশি কার্পেটের ওপর তাদের স্বদেশী সাংসদরা হাঁটা-চলা করে জ্ঞানকাণ্ড বাড়ায় কিনা তা ভালোভাবে জানা হয়নি। তবে এটি ধারণ করা যায় যে, স্বদেশী কার্পেটই স্বদেশী সংসদে স্বদেশী সাংসদদের হাঁটা-চলার জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক হয়। সংসদ ভবনকে কেউই স্বাধীনতার প্রতীক ভাবে না। কিন্তু গণশিশুদের মানসচক্ষে  ওই ভবনটি স্বাধীনতার ঠিকানা হিসেবে প্রতিভাত হয়। যে জাতি বারংবার বিদেশিদের সঙ্গে সংগ্রাম করে বহু বছরের সাধনায় স্বাধীনতা অর্জন করে তারা বিদেশি পছন্দ করে না। তাদের কাছে ‘দেশীর’   জনপ্রিয়তা বর্তমান। অনেক আগে থেকেই বলাবলি হয়েছিল, কোন্ কোন্ জিনিসপত্র বাংলাদেশে তৈরি হয়  এবং তার বিদেশেও বাজার আছে। যেমন পাটজাত দ্রব্যাদি। পাটের কার্পেট বা অন্য কিছু মিশাল দিয়ে পাটজাত কার্পেট অতি প্রাচীনকালেও বিদেশে ভালো বাজার পেয়েছে। বর্তমানেও পাটের কার্পেট নাকি খুবই উন্নতমানের তৈরি হচ্ছে, বাংলাদেশেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বাংলাদেশের ধনীরা কিংবা সরকারি অফিস-আদালতে পাটের কার্পেট খুব একটা পাত্তা পায় না। কারণটি সম্ভবত মনস্তাত্ত্বিক। বাংলাদেশের ধনীক শ্রেণী সব সময়েই বিদেশি ঘেঁষা। তারা বিদেশি ‘সারবস্তু’ দেখলেও মনে হয় হামলিয়ে পড়বে, অম্লানবদনে অতি আগ্রহে হাত বাড়াবে। কিন্তু স্বদেশী খাঁটি সোনার প্রতিও তাদের আগ্রহ থাকে না সন্দেহ থাকে। বাঙালিদের হাতের তৈরি বলেই মনে হয় সব সময়েই থার্ড ক্লাস মনে হয়। অথচ এমন সময়ও গিয়েছে যখন বিদেশিরা বাংলার জিনিস হাতে পেয়ে গর্ববোধ করত।
বাংলার সুতি বস্ত্র না হলে তাদের আভিজাত্য প্রমাণিত হতো না। দু’শ’ বছরের ইংরেজের গোলামি করার পর বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণীর বিশ্বাস টলে গেছে। তারা নিজেদের প্রতি বিশ্বাস হারানোর সঙ্গে সঙ্গে জাতির প্রতি, জাতীয় পণ্যের প্রতিও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। আর সম্ভবত এ কারণেই মনে হয় জাতির স্বাধীনতার প্রতীক ভবন জাতীয় সংসদকে তারা বিদেশি বস্তুর ছোঁয়া লাগিয়ে স্বাধীনতার সঙ্গে যে মনস্তাত্ত্বিক অস্তিত্ব আছে তাকে মলিন করতে চাচ্ছে। হয়ত এবারই প্রথম নয়- এর আগেও হয়ত বিদেশি বস্তুর ছোঁয়া ছুঁয়ি সংসদে বর্তমান ছিল। হয়ত দেখা যাবে সংসদ সদস্যরা যে কাপে চা খায়, সেটিও বিদেশি। হয়ত দেখা যাবে, সংসদ সদস্যরা যে চামচ দিয়ে চা চেখে দেখে সেটাও বিদেশি। তবে তাদের কাপড়-চোপড়  যে বিদেশি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দু’চারজন ভদ্রমহিলা সম্ভবত দেশি কাপড় পরে সংসদে আসেন, বসেন। অন্যদের ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় যে তাদের অধিকাংশই বিদেশি পণ্যঘনিষ্ঠ এবং এটি তাদের জন্য আবার গর্বের।
সম্ভবত শেখ হাসিনা সংসদে বিদেশি কাপড় পরে আসেন না। তিনি কিংবা  কয়েকজন বোদ্ধা ও বিদগ্ধ সাংসদ যখন দেশি পোশাক পরেন তখন, যদি শেখ হাসিনার পোশাককে কেউ ঘৃণা না করেন, তবে তারাও দেশি পোশাক পরেই সংসদে আসা-যাওয়া করতে পারেন। তাদের দেখাদেখি অন্যরা শিখবে এবং একই সঙ্গে স্বাধীনতার মনস্তাত্ত্বিক ঠিকানাকেও ‘বিদেশি পণ্য স্পর্শমুক্ত’ করার উদ্যোগ নেয়া যাবে। স্বাধীনতার সঙ্গে যে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো আছে সেগুলোকে অমলিন রাখার সর্বাÍক প্রচেষ্টা নেয়া উচিত। যেহেতু বাঙালি জাতি নানান বিভ্রান্তিতে ভুগছে এবং জাতিগত বিভক্তিও বর্তমান তাই যে কোনো বিভ্রান্তির উšে§ষকালীন শর্ত পূর্বাহ্নেই নির্মূল করতে হবে।
বাংলাদেশ মহামন্দার আক্রমণে আহত হবেই। মন্দাক্রান্তরা সাধারণত জাতি গঠন প্রক্রিয়া পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জাতি যথেষ্ট এগিয়ে গেছে। তার অগ্রগমন অব্যাহত রাখতেই হবে এবং এ কারণেই প্রয়োজন অর্থনৈতিক নিরবচ্ছিন্ন স্বস্তি।
অর্থনৈতিক বিশাল বিস্তৃতি সম্ভব নয়।কিন্তু স্বস্তি সম্ভব। স্বস্তি থাকলেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামাজিক ক্ষেত্রে অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকবে। মন্দায় বাংলাদেশের সর্বস্ব লুট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। মন্দা মোকাবিলায় সাম্রাজ্যবাদীরা তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক আকর গ্রাস করছে পররাজ্য দখল করে। এই দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে না। হয়ত এমনও হতে পারে যে, মধ্যপ্রাচ্য থেকেই তাদের লেজ গুটিয়ে পালাতে হবে। সেক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদীরা বাংলাদেশের মতো নির্ভরশীল দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ‘ভালোবাসা’ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। যুদ্ধ এবং লুট ছাড়া মন্দা মোকাবিলার তাদের আর কোনো রাহা নেই। সে জন্য বাংলাদেশকে পূর্ব প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই।
সকল বিদেশি পণ্য বর্জনের প্রবণতা তৈরি করতে হবে। সামাজিক মনস্তত্ত্ব তৈরি করতে হবে, দেশীয় পণ্য ক্রয়ের জন্য। দেশি উদ্যোক্তাদের সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে মন্দায় টিকে থাকার যোগ্যতাসম্পন্ন করতে হবে। দেশি শিল্পকে বাঁচানোর জন্য ‘আপনবাজার’ তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে বাজার অর্থনীতির বাতাস অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে হলেও দেশি পণ্যের আপনবাজার দেশীয়দের জন্য নিশ্চিত আশ্রয়ে পরিণত করতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন উদ্বুদ্ধকরণ। যদি স্বাধীনতার প্রতীকসমূহ বিদেশি ছোঁয়া লেগে অপবিত্র হয়ে যায় তবে উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া অকার্যকর হয়ে যায়। প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন এবং অফিস- আদালতও পণ্যের ছোঁয়া পবিত্র করতে হবে। বাংলাদেশের কোনো সরকারি কার্যালয়েই বিদেশি পণ্য থাকবে না। তবে যেগুলো বাংলাদেশে তৈরি হয় না, যেমন জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ইত্যাদি, সেগুলো নিদান হিসেবে সীমিতভাবে নেয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, দেশিরাই দেশ বাঁচাবে ভীনদেশিরা  নয়, বিদেশিরা নয়। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক মূলত শোষণ সম্পর্ক। শোষণ যত কম হবে, দেশের সমৃদ্ধিও তত বেশি হবে। সামনে এক দুর্দিন আসছে। সাবধান না হলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতেই হবে। শেখ হাসিনা অনেক কাজই ভালো করেছেন। তার অর্থ এ নয় যে, বাতির নিচে অন্ধকার থাকবে। আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অন্যরে- বাংলাদেশে এ কথাটি অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। জাতের মেয়ে কালোও ভালো এবং নদীর জল ঘোলাও ভালো। এ কথাটিও বেশ চলে। আমাদের মহানবী মিষ্টি খাওয়া কমিয়ে বালককে মিষ্টি কম খাওয়ার সৎ পরামর্শ দিয়েছিলেন। এসবই আমরা জানি। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে আমরা নিজেরা এর কোনোটিই প্রতিপালন করি না। কেন?
মূলত জাতির প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবেই এ রকম হয়। যাদের নিজ জাতির প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস আছে তারা উন্নতি করবেই। ভারত এবং জাপান কদাচিৎ বিদেশি গাড়ি ব্যবহার করে। সে দেশে বিদেশি গাড়ি ব্যবহারে কোনো  নিষেধাজ্ঞা নেই। তারপরও মানুষজন দেশি গাড়ি ব্যবহার করা পছন্দ করে। তাদের শিল্প সমৃদ্ধি আজ গল্পকথায় পরিণত হয়েছে। আমরা কি দেখেও শিখব না। আশা করি প্রধান নেতৃত্ব জাতিগত মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার প্রকৃতি অনুধাবন করবেন এবং বাংলাদেশে সব এ দেশি পণ্য ব্যবহার করার বিষয়ে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবেন এবং প্রথমেই স্বাধীনতার প্রতীক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেশি পণ্য সংযুক্ত করে অন্যদের দেখাবেন, শেখাবেন এবং একই সঙ্গে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা অক্ষুণœ রাখবেন।   লেখক: কলামিষ্ট