Year-18 # Issue-43 # 11 December 2011


দফায় দফায় বাসভাড়া বাড়লেও বাড়ছে না যাত্রীসেবার মান
হাসান মাহমুদ রিপন
সরকার পরিবহন ভাড়া না বাড়ালেও সম্প্রতি জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে পরিবহন মালিকরা যাত্রীদের কাছ থেকে বিভিন্ন পন্থায় আদায় করছে বাড়তি ভাড়া। আর নিয়ে প্রায়ই পরিবহন শ্রমিক যাত্রীদের মাঝে ঘটছে অনাকাঙ্খিত ঘটনা। জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহনের ভাড়া এক লাফে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বাড়ানো হলেও যাত্রীসেবার মান বাড়েনি একটুও। এর সাথে ভয়াবহ যানজট নগরবাসীর যেন নিত্যসঙ্গী। বাসভাড়ার বৃদ্ধি আর যানজটে নাকাল নগরবাসী। দফায় দফায় বাড়ছে বাসভাড়া কিন্তু ন্যূনতম বাড়ছে না যাত্রীসেবার মান। আর এসব দেখার যেন কেউ নেই। ঢাকা মহানগরীকে যানজটমুক্ত রাখতে পারছে না সরকার। লক্ষ্যে গত তিন বছরে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ আজও কার্যকর হয়নি। ব্যাপারে অভিযানের শুরুটা ঢাকঢোল পিটিয়ে হলেও দিন যেতে না যেতেই তা ঝিমিয়ে পড়ে।
গত এপ্রিল মাসে হঠাকরেই ২১ নম্বর লোকাল বাস হয়ে গেল সিটিং সার্ভিস। পল্টন থেকে মতিঝিল আসতে আগে যেখানে লাগত টাকা সেই ভাড়া এখন টাকা গুনতে হচ্ছে। ১২ নম্বর বাস এখন রাজধানীতে চলছে আর্ক পরিবহন নামে। সিটিং সার্ভিস হওয়ার পর আর্ক পরিহনের মতো অনেক সার্ভিসেরই নাম বদলেছে। কিন্তু সেবার মান তো বাড়েইনি বরং বাড়ছে যাত্রীদের নানা হয়রানি। গত বছরের শেষ দিকে এসে সায়েদাবাদ টু আবদুল্লাপুর বলাকা বাস হয়ে গেল বলাকা সিটিং সার্ভিস। মালিবাগ মোড় থেকে মতিঝিল আগে লোকাল হিসেবে টাকা দিয়েই যাতায়াত করা যেত। কিন্তু সিটিং সার্ভিস বলে বাসে উঠলেই এখন ন্যূনতম টাকা দিতে হয়। এভাবেই নগরীতে এসব লোকাল পরিবহন হঠাকরে নিজেরাই সিটিং সার্ভিস হয়ে গেলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। যার ফলে এখনো এসব লোকাল বাস সিটিং হিসেবে চলাচল করছে। তবে এসব পরিবহনে যাত্রীসেবার মান মোটেও বাড়েনি। এ ব্যাপারে মিরপুর থেকে মতিঝিলের উদ্দেশ্যে যাওয়া যাত্রী জাফর আলম বলেন, ‘আমার মতে বাস ভাড়া বাড়তেই পারে, এতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আমার ক্ষোভের কারণ যে বাসগুলো হঠাকরে লোকাল থেকে সিটিং হয়ে গেল কিন্তু তার সিটগুলো এখনও ভাঙ্গাচোরাই রয়ে গেছে। আর সিটের হেড কভারগুলোও নোংরা হয়ে রয়েছে। ঘামের দুর্গন্ধ থেকে শুরু করে তেল চিটচিটের কারণে বসতেও গা ঘিনঘিন করে। অনেক বাসের জানালার গ্লাস ভাঙা থাকে। বৃষ্টি এলে ভিজতে হয় ব্যাপারে ২১নং বাসের ড্রাইভার শহিদুল বলেন, ‘এসব বিষয় মালিক দেখবে আপনি মালিকদের বিষয়টি জানিয়েছেন কি না প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দেন- ‘ভাই আমরা মাইনক্যা চিপায় আছি। প্রতিদিন যাত্রীদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে কত ক্যাচাল করা লাগে। তার ওপর মালিক পক্ষকে বাসের যতœআত্তি, সার্ভিসিং ইত্যাদি বিষয় বলা হলে তারা উত্তর দেন, এই গাড়ি দিয়েই ড্রাইভারী করতে পারলে কর, না হয় অন্য গাড়ি দেখ
বাসভাড়া এভাবেই হঠাবেড়ে যাওয়ার কারণে সাধারণ যাত্রীরা পরিবহন মালিকদের পাশাপাশি সরকারের সমালোচনা করছেন। বাসভাড়া নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়া একজন যাত্রী  বলেন- ‘বাসের ভাড়া বাড়ানোর আগে সরকারের উচিত ছিল যাত্রীদের কথা চিন্তা করা। অথচ যেভাবে সরকার বাসের ভাড়া বাড়িয়েছে, তাতে শুধু পরিবহন ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা হয়েছে গত সোমবার শাহবাগ মোড়ে গিয়ে দেখা গেল মৌমাছির চাকের মতো গেটেই গাদাগাদি করে ঝুলে আছেন যাত্রীরা। গায়ের জোর খাটিয়ে কয়েকজন তরুণকে উঠতে দেখা গেলেও নারী শিশুরা পড়ছে বিপাকে। হতাশ হয়ে কেবল আরেকটি বাসের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে অপেক্ষমানদের। এভাবে কয়েকটি বাস মিস করা গেণ্ডারিয়ার নুরুন্নাহার জানালেন তার অসহায়ত্বের কথা।ভাই খুব সমস্যায় আছি, রিকশাও যাইতাছে না। সিএনজি ছাড়া এখন আর অন্য কোন উপায়ও নাই। আফনেরা পত্রিকায় তো কতকিছুই লেকতাছেন, কই কোন কাজ অইছে কইতে পারবেন?’
গত বছর ১৩নং বাসও সিটিং সার্ভিস হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে সেটি আবার ফিরে গেল লোকাল সার্ভিসেই। এখন রাজধানীতে উল্লেখযোগ্য সার্ভিসগুলোর মধ্যে সার্ভিসটিই সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসা। গত মঙ্গলবার শাহবাগ থেকে একটি লোকাল বাসে আসার সময় দেখা গেল, একজন যাত্রী শাহবাগ থেকে পল্টন টাকা ভাড়া দিলে সে ক্ষেপে যায়, সে উচ্চস্বরে বলতে থাকেএর লাইগ্যাইতো সিটিং হয়ে যাওন ভালা, আফনেরার মতন মাইনষের লাইগ্যা আমরাও সিটিং করাম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা সেলের পরিচালক হাসিব মোহাম্মদ আহসান ব্যাপারে বলেন, ‘গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে সরকারের নিস্ক্রীয়তা কেন অবৈধ নয়, তা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের রিট আবেদনে গত ২৩মে সরকারের প্রতি আদেশ দেয়া হয়। রায়ের তিন সপ্তাহের মধ্যে যোগাযোগ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, বিআরটিসির চেয়ারম্যান, বাস মালিক সমিতির সভাপতি/সম্পাদক, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ ১৬ জনকে এর জবাব দিতে বলা হয়। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের ওই আবেদনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ এবং আদায়কারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
ক্রয় নীতিমালা লঙ্ঘন করে খাদ্য অধিদফতরে পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগের চেষ্টা
এইচআর সাগর
সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত নীতিমালা (পিপিআর)-২০০৮ লঙ্ঘন করে খাদ্য অধিদফতরে খাদ্যশস্য পরিবহন কাজ ভাগবাটোয়ারা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরিবহন ঠিকাদার সিন্ডিকেটকে সুযোগ দেয়ার জন্যই এমনটি করা হচ্ছে। ফলে সরকারের খাদ্যশস্য পরিবহন খাতে কোটি কোটি গচ্চা যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
ব্যাপারে খাদ্য দুর্যোগ ব্যবস্থা মন্ত্রণালয়ের সচিব বি ডি মিত্র জানান, খাদ্য অধিদফতরে পরিবহন কাজে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে পিপিআর- কোথাও এমন কথা লেখা নেই। তবে তিনি বলেন, খাদ্য অধিদফতরে অনেক কিছু হয় যা তার নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই ব্যাপারে তার কিছু করার নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন।  
খাদ্য অধিদফতরের চলাচল সংরক্ষণ সাইলো বিভাগের পরিচালক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, পিপিআর- না থাকলেও খাদ্য অধিদফতর ইচ্ছে করলে যেকোনো শর্ত আরোপ করতে পারে। এটা অধিদফতরের নিজস্ব বিষয়।
খাদ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, খাদ্য অধিদফতর গত ১০ অক্টোবর মেজর কেরিয়ার খুলনা, ডিবিসিসি খুলনা-বরিশাল এবং কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন (সিআরটিসি) খাতে ঠিকাদার নিয়োগের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। এর মধ্যে মেজর কেরিয়ার খুলনা, ডিবিসিসি খুলনা-বরিশাল রুটে দরপত্র জমা দেয়ার জন্য ২৭ নভেম্বর এবং কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন খাতে ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে দরপত্রে পরিবহন কাজে খাদ্য বিভাগের পরিবহন কাজে এক বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত আরোপ করা হয়েছে। যা পিপিআর ২০০৮-এর পরিপন্থী বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ রয়েছে, মালবাহী জাহাজ ট্রাক মালিকরা যাতে সরাসরি দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে না পারে এবং খাদ্য বিভাগে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন, মেজর কেরিয়ার খুলনা এবং ডিবিসিসি খুলনা-বরিশাল রুটে কর্মরত ঠিকাদাররা পরিবহন কাজ ভাগাভাগি করে নিতে পারে সে জন্য দরপত্রে ওই বিশেষ শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। অধিদফতরের চলাচল সংরক্ষণ সাইলো বিভাগের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জেনেশুনেই আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য এমনটি করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন। অথচ বেসরকারিভাবে গম, চাল, ডাল, ভুট্টা চিনিসহ দেশে আমদানিকৃত খাদ্যশস্য জাহাজ ট্রাক মালিকরা সরাসরি পরিবহন করেন। শুধু তাই নয়, খাদ্য অধিদফতরের অধিকাংশ ঠিকাদারও ওই জাহাজ ট্রাক মালিকদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে খাদ্যশস্য পরিবহন করে থাকেন। এছাড়া সরকারি আমদানির তুলনায় বেসরকারিভাবে - গুন বেশি খাদ্যশস্য আমদানি হয়ে থাকে। তবে খাদ্য অধিদফতরের ধরনের আচরণের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে অভিযোগ জানিয়েছে মালবাহী জাহাজের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেলস ওনার্স এসোসিয়েশন এবং ঢাকা মহানগর ট্রান্সপোর্ট ওনার্স এসোসিয়েশন। তারা প্রতিযোগিতামূলক দর দেয়ার জন্য লিখিতভাবে খাদ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব, খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অতিরিক্ত মহাপরিচালকের কাছে দরপত্রের ওই শর্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। ব্যাপারে বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেলস ওনার্স এসোসিয়েশনের আইন বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির বলেন, প্রকৃত জাহাজ মালিকরা দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে না পারলে তা প্রতিযোগিতামূলক হবে না। সে কারণেই নিজেদের মতো করে দর দেয়ার জন্য ওই শর্ত দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, অভিজ্ঞতার কথা হিসাব করা হলে খাদ্য অধিদফতরের একজন ঠিকাদার বছরে সর্বোচ্চ দুই হাজার মেট্রিক টন খাদ্য শস্য পরিবহন করে থাকে। অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন পরিবহন ঠিকাদার বছরে কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য পরিবহন করে থাকে। মেহেবুব কবির বলেন, আবেদন নিবেদনের পরও অধিদফতর কোনো ব্যবস্থা না নিলে সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করবেন।
জানা গেছে, সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) থেকে  তৈরি করা স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার সিডিউল আইটিটি ১২. () আইটিটি ১২. (বি) নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সার্ভিস এবং সিমিলার গুডস-এর ক্ষেত্রে কাজের অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওই দুটি শর্তে সরকারি কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এমন কথা বলা নেই। পিপিআর অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরপত্র তৈরি করার কথা। কিন্তু দরপত্র জমা দেয়ার আর কদিন বাকি থাকলেও খাদ্য অধিদফতরের বাইরের কোনো ঠিকাদার গেলে তাদেরকে দরপত্র দেয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, খাদ্য অধিদফতরে খাদ্যশস্য পরিবহনের জন্য বছরে শতকোটি টাকা ব্যয় করা হয়। কিন্তু প্রতিবারই কোনো না কোনো শর্ত দিয়ে প্রকৃত জাহাজ ট্রাক মালিকদের দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয় না। অথচ প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র গ্রহণ করা হলে এবং সবাইকে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিলে পরিবহন দর কম পড়বে। এতে সরকারের প্রচুর অর্থ সাশ্রয় হবে। দরপত্রের ওই শর্তের কারণে কেবল মাত্র খাদ্য অধিদফতরের পরিবহন ঠিকাদার ছাড়া অন্য কোনো পরিবহন ঠিকাদার দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। ফলে খাদ্য অধিদফতরে কর্মরত ঠিকাদাররা সিন্ডিকেট করে দর প্রদানের সুযোগ পাবে। এতে পরিবহন দর বৃদ্ধি পাবে, সরকারের কোটি কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হবে। ত্র জানিয়েছে, সিন্ডিকেটের কারণে ২০০৬ সালে বেসরকারি নৌপরিবহন খাতে ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রতিটন সাড়ে তিনশটাকা এবং সড়ক পরিবহন খাতে ছয়শটাকায় খাদ্যশস্য পরিবহন করা হতো। কিন্তু একই সময় খাদ্য অধিদফতর নৌপরিবহন খাতে তিনশকিলোমিটার পর্যন্ত ৭৫০ টাকা এবং সড়ক পরিবহন খাতে এক হাজার ৩৫০ টাকায় খাদ্যশস্য পরিবহনের জন্য তাদের নির্ধারিত সিন্ডিকেটের সঙ্গে দুই বছরের চুক্তি করে। চুক্তিপত্রে নবায়নের কথা না থাকলেও নতুন করে দরপত্র আহবান না করে তাদেরকে দিয়েই গত বছর ধরে খাদ্য শস্য পরিবহন করানো হচ্ছে। তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে এবছর জুন মাসে আগের পরিবহন দরের সঙ্গে প্রতি টনে শতকরা পাঁচ ভাগ বাড়িয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে বেসরকারিভাবে নৌপরিবহন খাতে তিনশকিলোমিটার পর্যন্ত পাঁচশএবং সড়ক পরিবহন খাতে এক হাজার দুইশটাকায় খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য মালামাল পরিবহন করা হচ্ছে।
এক বছরে ৬৪ জেলায় জনসভা করবেন প্রধানমন্ত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদক
আগামী এক বছরে দেশের ৬৪ জেলায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ  নেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জেলায়  জেলায় সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প উদ্বোধনের পাশাপাশি জনসংযোগমূলক কর্মসূচিতেও অংশ নেবেন। আগামী নির্বাচনকে সামনে  রেখে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সফলতা জনগণের কাছে তুলে ধরতে প্রধানমন্ত্রীর জেলায় জেলায় যাওয়া মূল উদ্দেশ্য বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন। খবর বাংলা নিউজ। এরই অংশ হিসেবে শেখ হাসিনা জেলা সফরের কর্মসূচি শুরু করে দিয়েছেন। কয়েকটি জেলায় তিনি সরকারি প্রকল্প উদ্বোধনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় অংশ নিয়েছেন। আগামী ১১ ডিসেম্বর প্রধানম্ন্ত্রী নাটোর যাচ্ছেন। সেখানে তিনি একটি ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুপাদন কেন্দ্রের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবেন। বিকেলে জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক হানিফ আলী শেখের স্মরণ সভায় যোগ দেবেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী রাজশাহীর শারদায় পুলিশের বার্ষিক প্যারেড অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। নাটোর জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত প্রয়াত নেতার স্মরণসভার কর্মসূচি নেয়া হলেও দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এটি বিশাল জনসভায় রূপ নেবে বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন। নাটোরের থানাইখালী ময়দানে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে। স্মরণ সভায় বিপুল জনসমাগম ঘটানোর জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। দীর্ঘ দিন পর  শেখ হাসিনা নাটোর যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাটোর আগমণকে কেন্দ্র করে এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাহ প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে বলে রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের  কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জানান।
এদিকে চলতি মাসেই প্রধানমন্ত্রীর আরও দুটি জেলায় যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দুটি জেলা হচ্ছে বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট। আগামী জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই জয়পুরহাটে প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আবু সাঈদ জানান। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম তুলে ধরতে এবং বিরোধী দলের রাজপথের আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কর্মসূচিগুলোতে অংশ নিচ্ছেন।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি রাজপথের আন্দোলনের কর্মসূচিতে নেমেছে। বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া রোডমার্চ কর্মসূচি দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণসংযোগে নেমেছেন। এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  জেলা সফর বিরোধী দলের কাউন্টার শো ডাউন হিসেবেও দেখছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই জনসভা, সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর এসব কর্মসূচিতে বিপুল জনসমাগম হচ্ছে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচিকে সফল করতে দলের নেতা-কর্মীরাও সাংগঠনিকভাবে পর হয়ে উঠছেন। বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে আগামীতে প্রতিটি জেলায় পর্যায়ক্রমে ধরনের কর্মসূচিতে প্রধানমন্ত্রী অংশগ্রহণ করবেন বলে দলের নেতারা জানান। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায়ও জেলায় জেলায় ধরণের কর্মসূচির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর যাওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তাছাড়া মন্ত্রী পরিষদের এক সভায়ও প্রধানমন্ত্রী জেলায় জেলায় উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করার জন্য মন্ত্রীদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সরকারের গৃহীত এসব প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন।  পাশাপাশি ওই সব এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জনসভার আয়োজন করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।  ইতোমধ্যেই নীলফামারী, লালমনিরহাট, চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, গাজীপুর, গোপালগঞ্জ কক্সবাজারে ধরনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন তিনি। এসব স্থানে বিভিন্ন প্রকল্প উদ্বোধনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী সরকারের উন্নয়ন সাফল্য তুলে বক্তব্য রাখছেন।
নেরিকা ধানের বাম্পার ফলন
এইচআর সাগর, মধুপুর (টাংগাইল) থেকে ফিরে :
বন্যা পরবর্তী সময়ে নাবী আমন  হিসেবে নেরিকা ধানের চাষ করে বাম্পার ফলন পেয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থা (বিএডিসি) আমন মৌসুমে স্বল্পজীবনকালের নেরিকা ধানের বাম্পার ফলন খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশের বন্যা কবলিত এলাকায় বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর যেসব এলাকায় আমন ধান রোপনের সময় পার হয়ে যায় অথবা প্রচলিত আমন ধানের চারা থাকে না তখন নেরিকা ধানের চাষ আর্শীবাদ হতে পারে। ইতোমধ্যে কৃষকদের মাঝে নতুন ধান জাতটির খবর ছড়িয়ে পড়ায় তারাও সাহী হয়ে উঠেছেন চাষে।
চলতি বোরো মৌসুমে কৃষক পর্যায়ে ধানের চাষ শুরু করার পরিকল্পনা নিয়েছে বিএডিসি। স্বল্প জীবনকাল, প্রতিকূল সহিষ্ণু এবং বছরের যেকোনো সময় চাষ করার উপযোগিতার কারণে নেরিকা ধান চাষে কৃষক আগ্রহী হবেন বলে আশা করছেন কৃষিবিদরা। বিএডিসির চেয়ারম্যান . এস এম নাজমুল ইসলাম বলেন, হাওর দক্ষিণাঞ্চলসহ দুর্গত এলাকায় চাষের জন্য নেরিকা ধান জাতটি খুবই উপযোগী। অল্প সময়ে ধান ঘরে তোলা সম্ভব হবে। বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ধান রক্ষা পাবে। বিরূপ জলবায়ু আবহাওয়ায় ধান সফলভাবে চাষ করা যাবে। যা আগামী দিনে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা দারিদ্র দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মো. হাবিবুর রহমান বলেন, নতুন নেরিকা ধান জাতটি খরা সহিষ্ণু, রোগ পোকা মাকড় প্রতিরোধী। রোগ-বালাইর প্রাদুর্ভাব খুবই কম। খরা সহিষ্ণু বিধায় ধান চাষে দাঁড়ানো পানি বা অতিরিক্ত সেচের প্রয়োজন হয় না। এটি পরিবেশ উপযোগী। ধানের অন্যতম বিশেষত্ব হল অনুর্বর জমিতেও চাষ করা যায়। এর ফলন প্রচলিত জাতের তুলনায় এক থেকে দেড় টন বেশি। সার কীটনাশক তুলনামূলক কম প্রয়োজন হয়। বিএডিসির সদস্য পরিচালক (বীজ উদ্যান) মোঃ নুরুজ্জামান জানান, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় নতুন নেরিকা ধান জাতটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। নিবিড় তদারকির মাধ্যমে বিএডিসি সফলভাবে বীজ পাদন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিকূল সহিষ্ণু নেরিকা ধানের রয়েছে কয়েক প্রজাতির জাত। এর মধ্যে ৯০-১০০ দিনের মধ্যে নেরিকা-১০ পাদন হয়ে থাকে। ৯৫-১০০ দিনের মধ্যে নেরিকা- নেরিকা- পাদন হয়। এই ধান খরা সহিষ্ণু। বৃষ্টি নির্ভর উঁচু জমিতে চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত। এই ধানের জাত নেরিকা- থেকে ১৮ পর্যন্ত। আলোক সংবেদনশীল বিধায় আমাদের দেশে আউশ আমন বোরো তিন মৌসুমেই চাষাবাদের উপযোগী। এক মৌসুমের ফসল কেটেই সেই বীজ দিয়ে পরবর্তী মৌসুমের ফসল আবাদ করা যায়। এই ধান পোকা সহিষ্ণু। এই ধান গাছের শেকড় মাটির গভীরে এক মিটার পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে। ফলে গাছ খুব শক্ত, মজবুত এবং মাটির গভীর থেকে খাদ্য পাদন পানি সংগ্রহ করতে পারে। ধান ঝড়ে পড়ে না। ফলে কাটার সময় ফসলের কোন ক্ষতি হওয়ার আশংকা নেই। এই ধানের চালে রয়েছে দশমিক ৫১ ভাগ থেকে ১১ দশমিক ৮১ ভাগ উচ্চ মাত্রার প্রোটিন। ভাত সুস্বাদু। ২৩ ভাগ থেকে ২৭ দশমিক আট ভাগ পর্যন্ত এমাইজোল বেশি হওয়ায় ভাত হয় ঝরঝরে। এক হাজার ধানের ওজন ২৬ থেকে ৩৬ গ্রামের বেশি। লবণাক্ত মাটিতে এই ধানের চাষ সম্ভব। ধান কাটার পর মাত্র তিন দিনের মধ্যে আবারো বীজ বোনা যায়। সরাসরি ধান ছিটিয়ে কিংবা বীজতলায় চারা তুলে এই ধান চাষ করা সম্ভব। নেরিকা- হেক্টর প্রতি সাড়ে মেট্টিক টন, নেরিকা- প্রতি হেক্টরে পাঁচ মেট্টিক টন এবং নেরিকা-১০ হেক্টর প্রতি মেট্টিক টন পাদন সম্ভব। ব্রিধান-২৮ ব্রিধান-২৯ পাকতে ১২৫-১৩০ দিন লাগলেও নেরিকা ধান মাত্র ৯০ দিনে পেকে যায়। জাতটির চালে পুষ্টিমানও বেশি। প্রোটিনের পরিমান প্রায় ১০ শতাংশ। এশিয়ার অন্য ধানের জাতে প্রোটিন প্রায় শতাংশ।
বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ৬০ গ্রাম বীজ দিয়ে আমাদের দেশে নেরিকা জাতের ধানের পরীক্ষামূলক চাষাবাদ শুরু হয়। ২০১০ সালে এই ধানের ৪৫ মেট্রিক টন বীজ পাদন হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নেরিকা- জাতের দুই মেট্রিক টন এবং নেরিকা-১০ এক মেট্রিক টন ধান বীজ উগান্ডা থেকে আমদানি করা হয়। এর পর পরই বিএডিসি বিভিন্ন বীজ পাদন খামার এবং চুক্তিবদ্ধ চাষী জোনের মাধ্যমে ২০১০-১১ বোরো মৌসুমে প্রায় ১৮০ মেট্রিক টন বীজ পাদন করে। ২০১১-১২ সালে বিভিন্ন খামার চুক্তিবদ্ধ চাষী জোনের মাধ্যমে আউশ মৌসুমে ৮৪ মেট্রিক টন নেরিকা ধানের বীজ পাদন হয়। দুই বছরে প্রায় ৫শ মেট্রিক টন বীজ পাদন করেছে বিএডিসি।
বোরো মৌসুমে জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রয়ারি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে নেরিকা ধানের বীজ রোপন করা হলে ভাল ফসল পাওয়া যাবে। বোরো মৌসুমে নেরিকা ধানে খুব বেশি সেচের প্রয়োজন নেই। উঁচু জমিতেও এই ধান চাষ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত নেরিকা আউশ ফসল হিসেবে চাষ করেও পরবর্তী আমন পাদন সঠিক সময়ে সম্ভব হবে। আমন মৌসুমে বন্যার কারণে আমন চাষ করা সম্ভব হয় না। পানি নামতে নামতে চাষের সময় শেষ হয়ে যায়। এসময় নেরিকা ধান কাদাময় জমিতে ছিটিয়ে দিলে ভাল ফলন পাওয়া যাবে। বন্যা পরবর্তী সময়ে আগস্ট মাসের শেষে এমনকি সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতেও কাদাময় জমিতে এই ধান ছিটিয়ে দিলে নভেম্বরের মধ্যে ফসল পাদন কাজ শেষ হবে। নেরিকা ধান স্বল্প জীবনকাল হওয়ায় আউশ মৌসুমে চাষের পর আমন ফসল চাষাবাদ করা যাবে। পাহাড়ি এলাকা পতিত জমিতেও এই ধান চাষ করার উপযোগী। বর্তমানে বিএডিসি ২৩টি খামারে নেরিকা- ১০ জাতের ধানের চাষ চলছে। এছাড়া মধুপুর বীজ পাদন খামারে বন্যার পর ৯০ একর জমিতে ছিটিয়ে নেরিকা ধানের চাষ করা হয়।
টাংগাইল জেলার মধুপুর বীজ পাদন খামারে গত নভেম্বর সরেজমিনে দেখা গেছে নেরিকা ধানের বাম্পার ফলন। যত দূর চোখ যায় মৃদু শীতের হিমেল বাতাসে দোল খাচ্ছে পাকা ধানের শীষ। ধানের ভারে শীষগুলো যেন নববধূর মত ঘোমটা দিয়ে মাথা নত করে আছে। চোখ জুড়িয়ে যায় মাঠ ভরা সোনালী ধান দেখে। এখন ধান কাটার উপযুক্ত সময়। বিএডিসির কর্মকর্তারা জানালেন, খামারে চাষ করা নেরিকা- ১০ জাতের ধান ৯০ একর জমিতে চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০ একর জমিতে নেরিকা- ৭০ একর জমিতে নেরিকা-১০ জাতের ধানের চাষ করা হয়েছে। বাম্পার ফলন হয়েছে পরীক্ষামূলক বীজে। উচ্চ ফলনশীল এই ধান চাষ করে সন্তুষ্টির হাসি হাসলেন চুক্তিভিক্তিক চাষীসহ সাধারণ চাষীরাও। উচ্চ ফলনশীল এই নেরিকা জাতটি সম্পর্কে কৃষকদের অবহিত সাহিত করার জন্য নভেম্বর মধুপুর খামারে মাঠ দিবস চাষি সমাবেশের আয়োজন করে বিএডিসি। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন নকলা-নালিতাবাড়ি আসনের সাবেক এমপি মিজানুর রহমান, বিএডিসি চেয়ারম্যান . এম এম নাজমুল ইসলাম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হাবিুবুর রহমান, বিএডিসির সদস্য পরিচালক (বীজ উদ্যান) মো. নুরুজ্জামান, মহাব্যবস্থাপক (সার ব্যবস্থাপনা) . আতিকুর রহমান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (ময়মনসিংহ) এস এম আফাজ উদ্দিন, মধুপুর বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রের যুগ্ম পরিচালক সুলতান গিয়াসসহ বিএডিসি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন জেলা উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং চাষী মন্নাফ খান আশরাফুল আলমসহ এলাকার চাষীরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং বিএডিসি চেয়ারম্যান নিজের হাতেই কাটেন পাকা নেরিকা ধান। এতে হেক্টর প্রতি ফলন পাওয়া গেছে দশমিক ৮১৭ টন।
বিএডিসি মাঠে ২২ বছর কৃষিকাজ করছেন কৃষক মোঃ আতাব আলী। তিনি জানান, ২২ বছরে নতুন প্রজাতির যেসব ধানের পরীক্ষামূলক চাষাবাদ করেছেন পাদনের দিক থেকে নেরিকা সবচেয়ে সেরা। অর্থাউচ্চ ফলনশীল। তিনি জানান, এই ধান ৯০দিনের মাথায় কাটা হলো। অন্য জাতের ধান কাটার উপযোগী হতে সময় লাগে চার মাস অর্থা১২০ দিন। বিএডিসি লেবার সর্দার মনদের আলী জানান, এই প্রকল্পে ৩০০ শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। নেরিকা চাষ ছিল তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই প্রকল্পে ৫০০ একর জমি রয়েছে বলে জানান তিনি। মোঃ আশরাফুল আলম মান্নান খান এরা দুজনেই বিএডিসি চুক্তিভিক্তিক কৃষক। নেরিকা কাটার পর পাদন ভালো হওয়ায় তারাও সাধারণ কৃষকদের প্রতি এই ধান চাষাবাদের আহ্বান জানান।
বিশ্বমানবের হƒদয়ে মানবাধিকার কতটুকু
সৈয়দ সাইফুল করিম
আজ বিশ্বমানবাধিকার দিবস। আজ থেকে ৬২ বছর আগে, ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়েছিল মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র। আজ পর্যন্ত এই ঘোষণাপত্রটি মানবেতর ইতিহাসে সর্বজনীন গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। জš§গতভাবে প্রতিটি মানুষ যে স্বাধীন এবং তাদের মর্যাদা ও অধিকার যে সমান মানবাধিকার দিবস সোচ্চারভাবে তা মনে করিয়ে দেয়। ভরসা যোগায় অধিকার বঞ্চিত কোটি কোটি মানুষকে। দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে এই দলিল প্রণয়ন ও গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এর মূল্য লক্ষ্য ছিল ক্রমবর্ধমান অশান্তি ও হানাহানির অবসান ঘটিয়ে বিশ্বে স্বাধীনতা ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি মজবুত ভিত্তি রচনা করে। এটা সত্য যে, এখনো বৈষম্য হতে মুুক্তি মেলেনি। অবসান হয়নি ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার। বিশ্বের দেশে মানুষে এখনো ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো মারাÍক সব বৈষম্য রয়ে গেছে।
মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে জীবন ধারণ, স্বাধীনতা ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকারের কথা বলা থাকলেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনাগুলো প্রমাণ করে আমাদের সমাজে নিপীড়ন ও নির্যাতন প্রতিনিয়ত ঘটছে। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারীরা এর নির্মম শিকার হচ্ছে। জীবন ধারণ, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে বরং তাদের প্রতি প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সারা বিশ্বে লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার, পদদলিত হচ্ছে মৌলিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা ব্যহত হচ্ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন মাত্রাতিরিক্ত এবং বিশ্ব রেকর্ডের পর্যায়ে পৌঁছেছে।
আমাদের সংবিধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলগুলোতে নির্যাতনকে একেবারেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তথাপিও এই নির্যাতনকে অনুশীলন করা হয়েছে লাগামহীনভাবে।
সমাজে ‘মানুষ’ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য একজন মানুষের যা যা প্রয়োজন, যার অভাবে মানুষ হয়ত প্রাণে বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু তার মর্যাদা বিকাশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সৃজনশীলতা বিকশিত হতে পারে না সেই সব প্রাপ্যসমূহকে মানবাধিকার বলা যায়। মানবাধিকার হচ্ছে সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের বা তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে কিংবা অন্য মানুষের কাছে একজন মানুষের প্রয়োজনমাফিক কিছু বৈধ দাবি যা তাকে স্বাধীন সৃজনশীল ও মর্যাদাসম্পন্নভাবে বিকশিত হতে সহায়তা করে। নাগরিকদের জীবন ও জীবিকার অধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকারগুলো অবজ্ঞা করে চলেছে, যা আজ সক্রিয়  অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। মানবাধিকার বিভিন্ন সংগঠন বলছে, দেশে বিদ্যমান আইন থাকা সত্ত্বেও গ্রামের শত শত মানুষের সামনে ফতোয়ার নামে দোররা মারা ও তওবা পড়া, এক ঘরে করে রাখাসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানবিক শাস্তি দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৪টি দৈনিকের পত্রিকায় নারী নির্যাতনের প্রকাশিত ঘটনার প্রেক্ষিতে এ বছর ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত  ৩৩টি ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে ৫ হাজার ৮৩৯ জন। ১০ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৬৭ জন নারী, গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪৫ জন, যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ২৯৪ জনকে, গৃহপরিচারিকা হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪৮টি। গণতন্ত্রের জবাবদিহিতা ও ভোটারদেরকে দেয়া ওয়াদা পালন অত্যাবশ্যক মাত্র। কিন্তু এ চর্চা, চিন্তা-চেতনা এবং মনমানসিকতা আমাদের দেশে প্রায় সর্বক্ষেত্রে নাজুক। তাই দেশের এমন এক পরিস্থিতিতে আরো বেশি করে জনগণের কথা বলতে হবে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার দলিলের এক অংশে লিখেছে।
* মানুষের মর্যাদা ও মূল্য এবং নারী ও পুরুষদের সমঅধিকার মৌল অধিকারসমূহের প্রতি সর্বজনীন শ্রদ্ধা ও মান্যতা বৃদ্ধি অর্জনে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
* সকল জাতি ও জনগোষ্ঠীর অগ্রগতির একটি সাধারণ মানদণ্ড হিসেবে মানবিক অধিকারসমূহের এই সর্বজনীন ঘোষণাপত্র জারি করা হয়েছে।
* রাজনৈতিক বা নাগরিক অধিকারের পাশাপাশি মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের সংমিশ্রণ ঘটান ও একে উন্নত বিশ্বে, ধনী ও উন্নয়নশীল বিশ্বের দরিদ্র, উভয়ের কাছে সত্যিকার অর্থে সর্বজনীন করে তোলে।
* ধনী-শ্রেণীর কিছু লোক বা প্রতিনিধি দরিদ্রতা দূর করার জন্য, অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বেশ জোরেশোরে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য দিবসসহ বিভিন্ন কার্যাদি ও উদ্যাপন করে আসছে। এই প্রয়াস কিন্তু দয়া নয়, দায়বদ্ধতা।
সুতরাং মানুষের জš§গত অধিকারই হচ্ছে মানবাধিকার। আর এই অধিকারগুলো যখন বঞ্চিত হয় তখন পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায়ক বোধ করে বঞ্চিত মানুষেরা। এখন সময় এসেছে অধিকার আদায়ের। গোটা বিশ্বই অধিকার সচেতন হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে ও অন্যান্য দেশে বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের প্রতিষ্ঠিত হোক এই প্রত্যাশা আজকের দিনে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ফিরিয়ে দাও অরণ্য
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
স্বাধীনতার ৪০ বছরে রাজধানী ঢাকা শহরটিকে আমরা কি বানিয়েছি? একে কঠিন ইট পাথরের তৈরি বস্তি ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে। অপরিকল্পিত নগরায়নের যাঁতাকলে পিষ্ট ঢাকার আজ নিশ্বাস রুদ্ধ। শহরের সমস্ত গাছপালা কেটে ফেলার চলছে মহোৎসব। পাল্লা দিয়ে রাতারাতি উঠছে সুরম্য অট্টালিকা, সুউচ্চ এপার্টমেন্ট। কেউ  কোথাও  এক  ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে দিতে চায় না। লাগাতে চায় না একটি গাছ। বরং একটি বেড রুম বেশি বা ড্রইং স্পেসটা আরো প্রশস্ত হলে তারা খুশি হন। রাস্তার ওপর ঝুলে থাকা সরু ব্যালকনিতে কাপড় শুকানো হয় সেখানে শোভা পায় না একটি ফুল ফোটা গাছের টব। অন্ধকার বন্ধ ঘরে আনন্দে মাতোয়ারা বিত্তবান মানুষের ঢল। এদের কেউ মাটিতে পা রাখতে চায় না। তাই ঢাকার মানুষের নিশ্বাসে অক্সিজেন নেই, আছে কার্বন আর সিএফসি গ্যাস। একদিন টিভি সাক্ষাৎকারে এক ভদ্রমহিলা তো বলেই ফেলেছিলেন, তার সন্তান পার্কের সবুজ ঘাসের গালিচায় খালি পায়ে হাঁটতেই পারে না। প্রখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ দ্বিজেন শর্মা আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ষাটের দশকের শুরুতে তিনি আমাদের উদ্ভিদ বিজ্ঞান পড়াতেন। ক্লাসে পাঠদান করে তিনি শুধু শিক্ষার্থীদের মনজয় করেননি, গোটা বিএম কলেজকে সাজিয়ে ছিলেন মনের মতো করে। নানা প্রজাতির গাছপালা, ফুলে ফলে শোভিত করেছিলেন কলেজ চত্বর। ঢাকার নটর ডেম কলেজে গিয়ে আরো বৃহত্তর পরিসরে তার উদ্ভিদ প্রেমের স্বাক্ষর রেখে যেতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়েছেন। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নে দীর্ঘকাল অবস্থানকালে সেখান থেকে নানা বিরল প্রজাতির গাছ-গাছালি, লতাগুল্ম এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্কসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লাগিয়েছেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়,  বিবর্ণ রাজধানী  শহরে সামান্য যতটুকু  নৈসর্গিক সৌন্দর্য চোখে পড়ে তার পেছনে রয়েছে দ্বিজেন শর্মার উদ্ভিদপ্রেম ও নিরলস শ্রম। সম্প্র্রতি শর্মা স্যার বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বিভিন্ন মিডিয়ায় আজকাল তাকে দেখা যায়, তার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। এসবে তিনি যত না খুশি তার চেয়ে অনেক বেশি তৃপ্ত হতেন দেশটাকে সবুজ শ্যামলে ভরে দিতে তার দেয়া পরামর্শের  কিছুটা কার্যকর হলে। বিরাট মাপের, নিবেদিতপ্রাণ, মহৎ, সাদা মনের মানুষ দ্বিজেন শর্মার দেশের প্রকৃতির জন্য কিছু করার দুর্নিবার ইচ্ছা পূর্ণতা পায়নি।
অথচ বৈচিত্র্যময় এ জীবজগতে মানুষসহ সকল প্রাণী-উদ্ভিদবৈচিত্র্যের সহায়তা নিয়ে বেঁচে থাকে। পরিবেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্ভিদ ও প্রাণী একে অপরকে সহযোগিতা করে। প্রাকৃতিক পরিবেশের স্থিতিশীলতাও জীববৈচিত্র্যের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল।  মানবসভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে প্রাণী ও উদ্ভিদ মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। জীববৈচিত্র্য পৃথিবীর খাদ্যচক্রকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের আশ্রয়, খাদ্য, পুষ্টি এবং ভেষজ ওষুধের যোগান দিয়ে থাকে প্রকৃতির অফুরন্ত গাছপালা। জীবজগতের অস্তিত্ব  রক্ষায় পরিবেশের  একান্ত বন্ধু গাছপালা, বৃক্ষরাজির গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষরাজি প্রাণীর জীবন বাঁচাতে অক্সিজেন সরবরাহ করে। প্রাণিজগতের জন্য খাদ্যের যোগান দেয়। প্রচুর গাছ-গাছালিসমৃদ্ধ বনাঞ্চল বৃষ্টিপাতের প্রধান সহায়ক শক্তি। বৃষ্টি বাতাসকে আর্দ্র রেখে বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ হ্রাস করে। পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে ঝড়-বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে। বনভূমি বিশেষভাবে পাহাড়ি এলাকায় পানি প্রবাহের চাপ কমায়, ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস থেকে দেশকে বাঁচায়। গাছপালা প্রাণীর আশ্রয় এবং খাদ্য চাহিদা পূরণ করে প্রাণিবৈচিত্র্যের বিকাশ লাভে সহায়তা করে। ফলে প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্মিলিতভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করে মানুষের জন্য বাসযোগ্য এক পৃথিবী উপহার দেয়। এক সময় সারা বাংলাদেশে প্রচুর গাছপালা ও বনাঞ্চল ছিল। বিশ্বের অন্যতম বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে প্রচুর সুন্দরী গাছসহ  উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্যে ছিল ভরপুর। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে নানা ধরনের বৃক্ষ পাওয়া যেত। দিনাজপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলেও  ছিল  উল্লেখযোগ্য  কিছু  বনভূমি। এসব বন থেকে আহরিত গাছপালা  মানুষের জ্বালানি চাহিদা মিটিয়ে বাড়িঘর নির্মাণসহ নানা কাজে ব্যবহƒত হতো। কিন্তু কালক্রমে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নগরায়ন, শিল্প-কারখানা স্থাপনে ক্রমাগত বৃক্ষ নিধন শুরু হয়। বনাঞ্চল হতে থাকে উজাড়। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার জন্য যেখানে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন সেখানে বাংলাদেশে রয়েছে ১০-১২ শতাংশ। তাই দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য আজ হুমকির সম্মুখীন। দেশ এগিয়ে চলছে মরুময়তার দিকে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের কোটি মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় বনজ সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশ সুরক্ষা ছাড়াও দেশের অর্থনীতি  প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও বনাঞ্চলের রয়েছে কার্যকর ভূমিকা। দেশের পতিত জমি, ঘরের আঙ্গিনা, রাস্তা ও নদীর পাড়ে প্রচুর পরিমাণে পরিবেশবান্ধব বনজ ও ফলদ বৃক্ষ লাগিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাসহ সার্বিক সমৃদ্ধি লাভ করা সম্ভব। উপকূলীয় বনায়ন সৃষ্টি করে দেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। পুরনো বন সংরক্ষণ, নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ হতে পারে প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার। এ লক্ষ্যে বৃক্ষ নিধন ও বনাঞ্চল ধ্বংসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা জরুরি। কাঠের পরিবর্তে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগ খুঁজে বের করা দরকার। পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও সরকারি পর্যায়ে বৃক্ষরোপণের ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া অত্যাবশ্যক। আষাঢ়, শ্রাবণ মাসে গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়। এ সময়ে বৃক্ষরোপণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ জোরদার করা দরকার। শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জে বৃক্ষমেলার আয়োজন করা আবশ্যক। স্বল্পমূল্যে গাছের চারা বিতরণ, বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার ওপর দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ ও প্রশিক্ষিত করে তোলা বিশেষ জরুরি। বৃক্ষরোপণের সুফল সম্বন্ধে জনগণকে সচেতন করে তুলতে নিতে হবে  ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার উদ্যোগ। এ লক্ষ্যে   বন ও পরিবেশ  মন্ত্রণালয়  এবং  কৃষি বিভাগের  কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবেÑ বৃক্ষ শুধু আমাদের বন্ধুই নয়, পরিবেশ সুরক্ষার প্রধান নিয়ামক শক্তি। তাই দেশের আপামর জনগণকে  পরিবেশবান্ধব বৃক্ষরোপণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সবুজ-শ্যামল গাছপালা ছাড়া মানুষসহ কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই আমরা শুধু ইট-পাথরের বস্তি গড়ে তুলে নগর সভ্যতার প্রতিযোগিতায় মেতে না উঠে দেশকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। বুক ভরে নির্মল নিশ্বাস নিতে বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলি। বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ জলবায়ু পরিবর্তন আর পরিবেশ দূষণে বিশ্ববাসীর প্রাণ আজ ওষ্ঠাগত। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে চলছে একর পর এক সম্মেলন। নগর সভ্যতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে আজ সর্বত্র স্লোগানÑ আজ আমরা যে ফিরে পেতে চাই অরণ্য।
লেখক: গল্পকার ও প্রাবন্ধিক
ঢাকা ভাগ আর ডিসিসি ভাগ এক কথা নয় অথচ এটাকেই ইস্যু করা হচ্ছে 
মাহবুবুল আলম
নভেম্বরের শুরু থেকেই কথাটা শোনা যাচ্ছিল যে বর্তমান সরকার প্রায় পৌনে দুই কোটি জনসংখ্য অধ্যুষিত বিশ্বের অন্যতম মেগাসিটি হিসেবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দু’ভাগে ভাগ করতে যাচ্ছে। এরপর ১৭ নভেম্বর ২০১১ ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দু’ভাগে ভাগ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। নাগরিক পরিসেবা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, ভোগান্তি কমানো, ডিসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ সর্বোপরি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাসহ  বিভিন্ন কারণে ডিসিসি ভাগের এ সিদ্ধান্তটি মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদনের পর এ সংক্রান্ত বিলটি সংসদে পাস হয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইতোমধ্যে আইনে পরিণত হয়েছে। আইনের বিধান অনুযায়ী বিলটি  আইনে পরিণত হওয়ার নব্বই দিনের মধ্যে ৯২টি ওয়ার্ডের ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে ডিসিসি উত্তর ও ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে ডিসিসি দক্ষিণ এই দুটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এই             অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে দুই ভাগে দু’জন প্রশাসক নিয়োগ করবেন এবং নির্বাচিত মেয়র দায়িত্ব বুঝে নেয়ার আগ পর্যন্ত তিনি তার কাজ চালিয়ে যাবেন। এই দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়ররা একজন প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।
এই হলো মোটামুটি ডিসিসিকে ভাগ ও এর কার্যপরিধির একটা কাঠামো। কিন্তু কেউ কেউ বুঝে হোক বা না বুঝে হোক ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দু’ভাগে ভাগ করাকে ঢাকাকে ভাগ করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কথা বলছেন। প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন টকশোতে ঢাকাকে ভাগ করা হয়েছে এমন অপপ্রচার ও গুজবের ডালপালা বিস্তার করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে একটি মহল। বিএনপির গর্জন সিংহের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলে দাবিদার ব্যক্তিরাও এ ধরনের কথা বলে টকশো মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এর পরিষ্কার জবাব দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যাও দেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘অনেকে বলছেন ঢাকাকে দু’ভাগ করা হচ্ছে। আমরা কিন্তু তা করছি না। অনেক জ্ঞানিগুণী টিভিতে  বসে ঢাকা ভাগ করা হচ্ছে বলে চিৎকার করেন। এখনো উত্তরার লোকেরা বলে তারা ঢাকা যাচ্ছেন। গুলশান আগে একটা গ্রাম ছিল। জনসংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। মশা নিধন, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করা হয় না। তিনি বলেন জনগণকে ঠিকমতো সেবা দেয়ার জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।’ ঢাকাকে ভাগ করা হয়েছে কোনো কোনো মহলের এ ধরনের প্রচারণা প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক বলেছেন, ‘...বাস্তবতা হলো ঢাকাকে ভাগ করা হয়নি। ভাগ করা হয়েছে সিটি কর্পোরেশনকে। এর মাধ্যমে দুটি কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বিশাল ঢাকা এখন গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ গিয়ে ঠেকেছে। একটি সিটি কর্পোরেশন দ্বারা নাগরিক পরিসেবার মানোন্নয়ন ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেবাদান সম্ভব হয়ে উঠছে না। নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার জন্যই ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
কিন্তু ডিসিসি ভাগ নিয়ে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ নিয়ে হঠাৎ করেই দেশের ঝিমিয়ে পড়া রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে ইস্যু খরায় ভুগতে থাকা বিএনপি-জামায়াত জোট ডিসিসি বিভক্তিকরণ ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টায় হরতাল পর্যন্ত পালন করেছে, যদি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের খবর ও সচিত্র প্রতিবেদন দেখে মনে হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অন্য দশটা হরতালের মতো এ হরতালটিও সুপার ফ্লপ হয়েছে। সেই নিরিখে বলা যেতে পারে যে, ডিসিসি ভাগ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতালে ঢাকার নাগরিকরা সারা দেয়নি। এর মূল কারণ হতে পারে ঢাকার নাগরিকরা বিশেষ করে বাসা-বাড়ি-ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানসহ এর জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষ ডিসিসির বিভিন্ন সেবা-পরিসেবা পেতে যে ভোগান্তি ও বিরম্বনার শিকার হয়েছে, ডিসিসি ভাগ হলে তাদের সে সব ভোগান্তি ও বিরম্বনা অনেকাংশেই কমবে বলে হয়ত তারা মনে করেছেন। এখানে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে উত্তরা থেকে একজন নাগরিক তার নিজের প্রয়োজনে সিটি কর্পোরেশনে আসতে যেতেই যানজটের কারণে পুরো দিনটাই মাঠে মারা যায়। এই বিবেচনায় তারা হয়ত মনে করেছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে ভাগ করা ঠিকই হয়েছে। তাই তারা হরতালে সাড়া দেয়নি।
পাঠকদের জন্য ডিসিসি ভাগ নিয়ে যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে তার ওপর কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। প্রথমেই আমি যারা ডিসিসি বিভক্তিকরণের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীসহ উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নেতা পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়ার ওপর আলোকপাত করব। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার,  পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও নগরবাসীর সেবা নিশ্চিত করাই হচ্ছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দু’ভাগে বিভক্ত করার মূল উদ্দেশ্য। এখানে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই।  আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘বিশাল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত বর্তমান সিটি কর্পোরেশন নাগরিক সেবা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। নাগরিক সেবা নগরবাসীর দোগোড়ায় পৌঁছে দিতেই দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে।’ এ প্রসঙ্গে বর্তমান মহাজোট সরকারের প্রধান অংশীদার জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলু তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘রাজধানী ঢাকায় এখন প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। একজন মেয়রের পক্ষে বিশাল এ জনগোষ্ঠীর সেবা নিশ্চিত করা কঠিন। তাই আমরা মনে করি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত জনগণের সেবাকে আরো সম্প্রসারিত করতে সাহায্য করবে।’
এ তো গেল ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে বিভক্তিকরণের পক্ষে প্রতিক্রিয়া। আসুন এর বিপক্ষে অবস্থানকারী রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের প্রতিক্রিয়ার ওপর কিছুটা আলোকপাত করি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর ওরফে গর্জন সিংহ স্বভাবসুলভ গর্জনের মাধ্যমে সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ‘আমাদের প্রিয় ঢাকাকে কিছুতেই দু’ভাগ করতে দেয়া হবে না। সরকার যদি ঢাকাকে দু’ভাগ করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসে তবে আগামীতে লাগাতার আন্দোলনের মাধ্যেমে আমরা এক দফার আন্দোলন শুরু করব।’ মির্জা ফকরুলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গণফোরমের সভাপতি ড. কামাল হোসেনও বলেছেন, সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ঢাকাকে দু’ভাগ করছে। এর প্রতিবাদে সোচ্চার হতে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিৎ।’ ইতোমধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিযোগিতামূলকভাবে আয়োজিত টকশোতে টকশো গোলটেবিল বৈঠক আইকন! হিসেবে পরিচিতি পাওয়া টকশো ব্যক্তিত্ব ড. আকবর আলী খান এ প্রসঙ্গে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘সরকারি সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক। তিনি ঢাকাকে ভাগ করার সরকারের সিদ্ধান্তকে উদ্ভট বলেও অভিহিত করেন।’
সুশীল সমাজের ড. আকবর আলী খান সাহেবদের এ ধরনের বক্তব্যের মোক্ষম জবাবটিই দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩ ডিসেম্বর ২০১১ ওসমানী মেমোরিয়াল মিলনায়নে তিন দিনব্যাপী সামাজিক দর্শনের ওপর    আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের ১০তম সম্মেলনের উদ্বোধনকালে শেখ হাসিনা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি পরিচয়দানকারী ব্যক্তিদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘স্বপ্নের জগতে বিচরণ না করে গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করুন। তিনি আরো বলেন, সিভিল সোসাইটির নামে এমন কিছু লোক আছেন যাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নেই।’ এসব ব্যক্তির কর্মকাণ্ড এবং তাদের বক্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বানও জানান।’
যাক ডিসিসি বিভক্তিকে যারা ঢাকাকে ভাগ করার কথা বলে অপপ্রচার চালাচ্ছেন তাদের স্বরূপ উšে§াচন ও পাঠকদের অবগতির জন্য বলছি যে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ভাগ আর ঢাকা ভাগ এক কথা নয়, ঢাকা বলতে পুরো ঢাকা জেলাকে বোঝায়। ঢাকা জেলার আয়তন ১৪৩৬.৬০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ঢাকা জেলার অন্তর্গত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আয়তন হলো ৩৬০ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ মোটামুটি ঢাকা জেলার চার ভাগের ১ ভাগ অংশ নিয়ে হলো ঢাকা সিটি কর্পোরেশন।  সুতরাং যারা ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ভাগকে ঢাকাকে ভাগ বলে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করছেন, জেনে শুনেই এটা তারা করছেন। মানুষের মাঝে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সৃষ্টি করে ফায়দা লোটার এটা এক ধরনের হীন প্রচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। এ বিষয়টিকে ইস্যু করে আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকার মানুষকে যদি ক্ষেপিয়ে তোলা যায় তা হলে সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নামবে। আখেরে তাদের আন্দোলনের স্বপ্নের ছিঁকে ছিঁড়লেও ছিঁড়তে পারে এমনতর চিন্তা ও কুমতলব থেকেই ডিসিসি ভাগকে ঢাকা ভাগ বলে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই বড় বড় সিটিগুলো কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত ও এর উন্নতি সাধন করা হয়েছে। এ পর্যায়ে আমি বিশ্বের কয়েকটি বড় সিটি ভাগ করে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করব। বৃটেনের বিশাল সিটি লন্ডনকে ইস্ট লন্ডন ও ওয়েস্ট লন্ডন দু’ভাগে ভাগ করে ভাগ করে ৩৭ জন মেয়রের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করে উন্নত নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। আমেরিকার বিশাল সিটি নিউইয়ার্কও পাঁচটি পৌর বা প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করে ৫ মেয়রের ওপর সেই সিটির ৮০ লাখ নাগরিকের সেবার মানোন্নয়ন করা হয়েছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচে পুরনো নগরী রোমের দীর্ঘ আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস সবচে বড় সাক্ষী। ইতালির রাজধানী রোমের ২৭ লাখ ৫৪ হাজারের কিছু বেশি নাগরিকের এই নগরীকে ২০টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের মাধ্যমে নাগরিক সুবিধা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনের রাজধানী বেজিং শহরের এক কোটি ৯৬ লাখ মানুষের সেবার মান নিশ্চিত করার জন্য বেজিং মেট্্েরাপলিসকে ১৫টি শহর ও উপশহরে ভাগ করা হয়েছে। প্রিয় পাঠক, এই যদি হয় পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলো প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের চিত্র; তা হলে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে কয়টি ভাগে ভাগ করা উচিৎ তার বিচারের ভার আপনাদের ওপরই রইল।
দীর্ঘদিন থেকেই একটা বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, আমাদের দেশে যে কোনো ভালো কাজ করার নিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই পক্ষ-বিপক্ষ দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে যায় দেশের পত্র-পত্রিকা, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা। ডিসিসি ভাগ নিয়েও তাই দেশ দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে। ভাগ হয়ে গেছে পত্র-পত্রিকা, সাহিত্যিক-সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। এক পক্ষে সরকার মহাজোটের অংশীদার রাজনৈতিক শক্তি আর অন্য পক্ষে বিএনপি-জামায়াত ঘরানার রাজনীতিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ। এই বুদ্ধিজীবীরা সব সময় নিজেদের নিরপেক্ষতার খোলসের লুকিয়ে রাখেন। তারা নিজেদের বিএনপি ঘরানার পরিচয়ে পরিচয় দিতে না চাইলেও আওয়ামী লীগের বিরোধিতার বেলায় নিজেদের সুশীল সমাজ বলতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন। এদের মধ্যে কে আসল বুদ্ধিজীবী আর কে নকল বুদ্ধিজীবী তা দেশের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন না। তাদের জ্ঞানগর্ব! কথাবার্তায় মানুষ যেমন বিভ্রান্ত হন তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের গণতন্ত্র, জাতীয় ঐক্যের ধারণা। এদের মধ্যে অনেক পেইড বুদ্ধিজীবীও আছেন বলে মূর্খ লোকেরা বলে থাকে। দেশে গণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় থাকলে এরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করলেও অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় আসার পরই এ মুখচেনা গোষ্ঠীটি উট পাখির মতো বালিতে মাথা গুজে রাখেন। জিয়ার আমল, এরশাদের আমল সর্বশেষ ওয়ান ইলেভেনের ‘তিন ম’-এর সেনাশাসিত জরুরি শাসন বোবা সেজে বসেছিলেন। যারা রাজনীতি সচেতন একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন ওই সব অগণতান্ত্রিক শাসন অবসানের পর পর দেশে যখন গণতন্ত্রের বাতাস বইতে শুরু করেছে তখনই সুশীল সমাজের প্রতিনিধি পরিচয় দানকারী উট পাখি বুদ্ধিজীবীরা বালির ঢিবি থেকে মাথা তুলে গণতান্ত্রিক সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। পরিশেষে বলতে চাই ঢাকা মহানগরীর সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চাইলে ডিসিসির বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজন রয়েছে। ডিসিসি বিভক্ত আর ঢাকাকে ভাগ করা এক কথা নয়। বিষয়টি পরিষ্কার জেনেও যারা ডিসিসি ভাগকে ঢাকাকে ভাগ বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত তাদের সম্মন্ধে সজাগ হওয়ার এখনই সময়।  

লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট