Year-18 # Issue-42 # 4 December 2011


দুর্নীতির ধারণা সূচকে এক ধাপ উন্নতি বাংলাদেশের
নিজস্ব প্রতিবেদক

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ‘দুর্নীতির ধারণা সূচকঅনুযায়ী বাংলাদেশে গত বছরের তুলনায় দুর্নীতি কমেছে। তবে দুর্নীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকা থেকে বাংলাদেশ বের হতে পারেনি। বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থার ২০১১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দশমিক স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এবার নিুক্রম থেকে ত্রয়োদশ। গতবারের তালিকায় বাংলাদেশ ছিল দ্বাদশ অবস্থানে। স্কোর ছিল দশমিক ৪। গত বৃহস্পতিবার বার্লিন থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে এই ধারণা সূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স- সিপিআই) প্রকাশ করে টিআই। আর ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এই প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা উদ্বেগজনক। আমাদের অবশ্যই স্কোর - পৌঁছাতে হবে। স্কোর এর নিচে থাকায় বাংলাদেশ দুর্নীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকা থেকে বের হতে পারেনি বলে জানান ইফতেখারুজ্জামান। টিআই-এর এবারের তালিকায় দুর্নীতির শীর্ষে রয়েছে সোমালিয়া উত্তর কোরিয়া। তাদের পয়েন্ট ১। দশমিক পয়েন্ট নিয়ে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে আছে আফগানিস্তান মিয়ানমার। অন্যদিকে . স্কোর নিয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হয়েছে নিউজিল্যান্ড।
কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে রয়েছে- ডেনমাক ফিনল্যান্ড (.), সুইডেন (.), সিঙ্গাপুর (.), নরওয়ে (), নেদারল্যান্ড (.), অস্ট্রেলিয়া সুইজারল্যান্ড (.), কানাডা (.), লুক্সেমবার্গ (.) হংকং (.) সার্ক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভূটান (.), আর সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত আফগানিস্তান (.) বাংলাদেশের চেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় পাকিস্তান (.) নেপালে (.) ভারত (.), শ্রীলংকা (.বাংলাদেশের চেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এবার ১৮২টি দেশের মধ্যে তালিকা প্রণয়ন করা হয়।

এই সূচক অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবি কোনো ভূমিকা পালন করে না। এমনকি টিআইবির গবেষণা থেকে পাওয়া কোনো তথ্য বা বিশ্লেষণ সিপিআইÑ পাঠানো বা বিবেচনা করা হয় না। দুর্নীতি প্রতিরোধে রাজনীতিবিদদের দেওয়া প্রতিশ্রতি, তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন তথ্য কমিশন গঠন, মানবাধিকার কমিশন গঠনের ফলে বাংলাদেশ এবার এক ধাপ এগিয়েছে বলে মনে করে টিআই। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সরের সূচকে ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের তথ্যের প্রতিফলন ঘটেছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রায় সবগুলো তথ্য সূত্রের মেয়াদ ২০১০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। অর্থাএবারের সূচকে ২০১০ পরবর্তী সময়ের দুর্নীতির অবস্থার প্রতিফলন পাওয়া যাবে না । দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের সংশোধন, সংসদ বর্জন, বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া, বিটিআরসির ক্ষমতা খর্ব করা এবং বিভিন্ন নিয়োগে দলীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এই সূচক নির্ধারণে বিবেচনায় এসেছে বলে জানান ইফতেখারুজ্জামান। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তথ্যের সময়সীমা অনুযায়ী পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অভিযোগসহ ২০১১ সালের দুর্নীতি সংক্রান্ত ঘটনা প্রবাহের প্রতিফলন সূচকে ঘটেনি। সংসদ এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে কার্যকর করা, দুর্নীতি দমন কমিশন নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেওয়া, দেশে বিচার ব্যবস্থা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতিবাজদের আইনের মাধ্যমে শাস্তি দিতে পারলে সূচকে আরো উন্নতি করা সম্ভব বলেও মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান। সিপিআই ২০১১ সালে ১৩টি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত ১৭টি জরিপের ওপর নির্ভর করে এই সূচক তৈরী করে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র হিসেবে ৯টি জরিপ ব্যবহƒ হয়েছে বলে জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল সাবেক চেয়ারম্যান এম হাফিজ উদ্দিন খান সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সারা বিশ্বের দেশগুলোর দুর্নীতির পরিস্থিতি নিয়ে প্রতি বছর এই ধারণাসূচক প্রকাশ করে টিআই। সংস্থাটির দাবি, এই সূচক প্রামাণ কোনো বিষয় না হলেও এতে দুর্নীতির বিস্তারের একটি ধারণা পাওয়া যায়।
প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ২১ শতাংশ
চলতি অর্থবছরের ৫ মাসে রফতানি আয় ১০১৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে
সিদ্দিকুর রহমান
বাংলাদেশের রফতানিতে গত অর্থবছরে যে তাৎপর্যপূর্ণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল সে ধারা চলতি অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই ৫ মাসে রফতানি আয় হয়েছে ১০ হাজার ১৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। আর এ ৫ মাসে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মোট রফতানির লক্ষ্যমাত্রা হলো ২৬ হাজার ৫শ’ মিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে ১৮ হাজার ৫শ’ মিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২২ হাজার ৯২৪ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন ডলার আয় এবং ৪১ দশমিক ৪৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। চলতি  অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে যেসব পণ্য রফতানি করে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক/নীটওয়্যার, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, ফুটওয়্যার, হিমায়িত খাদ্য, প্লাস্টিকজাত পণ্য, সিমেন্ট, রাসায়নিক পদার্থ, সার, ইঞ্জিনিয়ারিং ইকুইপমেন্ট, সি ভেসেল (সমুদ্রগামী জাহাজ), বাইসাইকেল ও কম্পিউটার সার্ভিসেস। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো- ইপিবি সূত্রে গতকাল সোমবার এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রটি থেকে বলা হয়েছে, নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্য রফতানির পারফরমেন্স রিপোর্ট তৈরির পথে। আগামী সপ্তাহ নাগাদ পূর্ণাঙ্গভাবে এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। তবে আগেই অক্টোবর পর্যন্ত পারফরমেন্স রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। এ রিপোর্টে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮৮৬ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলার। আর এ মাসে রফতানি হয়েছে ১৯৫৪ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন ডলার। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রফতানি বৃদ্ধির হার হলো ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। গত অর্থবছরের অক্টোবরে রফতানি আয় হয়েছিল ১৬৯৩ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পারফরমেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী ৪ মাসে রফতানি আয় হয়েছে ৮১১৮ দশমিক ৫১ মিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে রফতানি আয় হয়েছিল ৬৭২১ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে রফতানি আয় প্রবৃদ্ধির পরিমান হলো ২০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এ সময়ের মধ্যে যেসব পণ্য রফতানি করে বেশি  আয়  হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে হিমায়িত খাদ্য রফতানি থেকে ২৫৩ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। কৃষিজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ১৫২ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ২৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ। পেট্রোলিয়াম বাই প্রোডাক্টস রফতানি করে আয় হয়েছে ১০৯ মিলিয়ন দশমিক শূন্য ৭ মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৫২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। প্লাস্টিকজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ২৯ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৫৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। চামড়া রফতানি করে আয় হয়েছে ১১০ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৩৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। ফুটওয়্যার রফতানি করে আয় হয়েছে ১৩৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৩৩৭ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। নীটওয়্যার রফতানি করে আয় হয়েছে ৩৩৭৫ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ১৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ওভেন গার্মেন্টস পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ২৯৩৯ দশমিক ২৬  মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ২৫ দশমিক ১০ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল রফতানি করে আয় হয়েছে ২৪৯ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৪১ দশমিক ৭২ শতাংশ। ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোডাক্টস রফতানি করে আয় হয়েছে ১১৮ দশমিক ৭১ মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ২৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ওষুধ রফতানি করে আয় হয়েছে ১৬ মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ১২ দশমিক ৯১ শতাংশ। জাহাজ রফতানি খাতে আয় হয়েছে ২২ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৯০ শতাংশ। সার রফতানি করে আয় হয়েছে ১৮ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ২৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।
এদিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর দায়িত্ব গ্রহণকারী নতুন ভাইস চেয়ারম্যান শুভাশীষ বসু বলেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় যেখানে বিভিন্ন দেশের রফতানি আয় কমে গেছে সেখানে বাংলাদেশের রফতানি আয় বেড়ে চলেছে। চলতি অর্থবছরেও বাংলাদেশ তার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারবে। চলতি অর্থবছরের ৫ মাসে যে রফতানি আয় অর্জিত হয়েছে তা খুবই সন্তোষজনক। রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে।
 

৪ বছরে বিএডিসির বীজ সরবরাহ বেড়েছে দ্বিগুন
বোরো বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে ৬৫ শতাংশ
এইচআর সাগর
সরকারি পর্যায়ে কৃষকদের মাঝে ভাল ও মানসম্মত বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধান, দানাশস্য, ডাল, তেল ও সবজি জাতীয় বীজ সরবরাহের পরিমাণ গত ৪ বছরে বেড়েছে প্রায় দ্বিগুন। তবে এরমধ্যে ধানবীজ সরবরাহে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এবছর প্রায় ৬৫ শতাংশ বোরো ধানবীজ সরবরাহ করা হচ্ছে। বীজ সরবরাহের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের এ সফলতা অর্জন করছে। বিএডিসির বীজের উন্নতমান এবং এর ফলন ভাল হওয়ায় কৃষকের মাঝেও ফেলেছে ব্যাপক সাড়া। বাড়ছে চাহিদা। বিএডিসির সদস্য পরিচালক (বীজ ও উদ্যান) মো. নুরুজ্জামান বাংলাদেশ সময়কে বলেন, উচ্চমানসম্মত হওয়ায় আমাদের বীজ কৃষকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বীজের দামও কৃষকদের ক্রয়সীমার মধ্যে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তিনি বলেন, বিএডিসি দেশে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে মানসম্মত বীজ সরবরাহের মাধ্যমে একটি ভাল ভূমিকা রাখছে। বীজের চাহিদা বাড়ায় খামারে জমির পরিমাণও বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সরকারের রূপকল্প-২০২১ অর্জনে বিএডিসি দশ বছর মেয়াদী বীজ উৎপাদনে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে দেশে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের আউশ, আমন ও বোরো ধান বীজের চাহিদা ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ১২১ মেট্রিক টন। বিএডিসি সরবরাহ করে ৫৪ হাজার ৩৭৯ মেট্রিক টন। এরমধ্যে শুধু বোরো বীজ সরবরাহের পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৫২৫ টন বা ৩৯ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থ বছরে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৩৭৫ টন চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয় ৭৯ হাজার ৫২৭ টন। অর্থাৎ চাহিদার সাড়ে ৩৩ শতাংশ যোগান দেয়া হয় বিএডিসি থেকে। চলতি বছরে (২০১১-১২) বীজ সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চাহিদার সাড়ে ৩৮ শতাংশ-৯১ হাজার ৮২১ টন। এরমধ্যে বোরো বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে ৬৩ হাজার ৮২৬ টন, আমন ২৬ হাজার ২২৭ টন এবং আউশ ১ হাজার ৫৪ টন। অবশ্য এবছর বোরো বীজ সরবরাহের পরিমাণ ৬৪ শতাংশেরও বেশি। চলতি বছরে ৪৮ লাখ হেক্টর বোরোসহ ৯৮ লাখ ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে ধান বীজের চাহিদা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৩৭৫ টন। সংস্থাটি ইতোমধ্যে বোরো ধান বীজ সরবরাহ শুরু করেছে। তবে এই সময়ে আউশ ধানবীজ সরবরাহের পরিমাণ কমেছে। ২০০৯ সালে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ আউশ বীজ সরবরাহ করা হলেও এবছর সরবরাহের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ।  আর আমন বীজ সরবরাহের পরিমাণ সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশ। বেড়েছে দানাশস্য গম ও ভূট্টা বীজ সরবরাহের পরিমাণও। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে ৬৩ হাজার ৭৫০ টন গম ও ৬ হাজার ২৫০ টন ভূট্টা বীজ চাহিদার বিপরীতে বিএডিসি সরবরাহ করেছে যথাক্রমে ১৯ হাজার ৯৭১ টন (৩১.৩ শতাংশ) ও ৮৩ টন (১.৩ শতাংশ)। এ বছর ৬২ হাজার ২৫০ টন ও ৭ হাজার টন গম এবং ভূট্টা বীজ চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে  যথাক্রমে ২৭ হাজার ৩০৪ টন ( ৪৩.৯ শতাংশ) ও ২৯৬ টন (৪.২ শতাংশ)। এছাড়া নতুন করে এবছর যব, কাউন ও চিনা বীজ সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
চার হাজার টন পাট বীজের চাহিদার বিপরীতে এবছর সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৮৯ টন। যা চাহিদার ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে পাট বীজ সরবরাহের পরিমাণ ছিল ৯১৪ টন বা ২২ দশমিক ৯ টন। গেল বছর পাট বীজ সরবরাহ করা হয়েছে ৮৫৭ টন। ৪ বছরে বীজ আলু সরবরাহের পরিমাণ বেড়েছে মাত্র এক শতাংশ। ২০০৮-০৯ সালে ৬ লাখ টন বীজ আলু চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছিল ১৩ হাজার ৪৬২ টন। আর এবছর সরবরাহের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২০ হাজার ৪৪২ টন (৩.৪ শতাংশ)। এছাড়া এবছর (২০১১-১২) ডাল, তেল, সবজি ও মসলা জাতীয় বীজ সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ৪২৬ টন (৬.২ শতাংশ), ১ হাজার ৯২ টন (৬.২ শতাংশ), ১২০ টন (৪.৩ শতাংশ) এবং ১০৭ টন দশমিক ১ শতাংশ)। বিএডিসি ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ডাল জাতীয় বীজ সরবরাহ করেছিল ৮৪৩ টন (৩.৬ শতাংশ), তেল বীজ ৯০৬ টন (৫.২ শতাংশ), সবজি বীজ ৫৮ টন (২.১ শতাংশ) এবং মসলা জাতীয় বীজ ৩১২ টন (দশমিক ২ শতাংশ)। দেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যশস্য উৎপাদন যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে মানসম্পন্ন বীজের চাহিদাও। এই মানসম্পন্ন বীজের বড় একটি অংশ যোগান দিচ্ছে বিএডিসি। সরকারি এ সংস্থাটি শুরু থেকেই নিজস্ব খামারে আধুনিক প্রযুক্তিতে উন্নতমানের ভিত্তি বীজ উৎপাদন এবং সরবরাহ করে আসছে। ভিত্তি বীজ উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সংস্থাটির ২৩টি খামারে আউস-আমন-বোরো ধান, গম, ভূট্টা ও আলু বীজ এবং হাইব্রিড ধান বীজ উৎপাদন করছে । বিএডিসি সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএডিসির ৫ হাজার ৫৫৪ দশমিক ৫৪ একর আয়তনের ২৩টি বীজ উৎপাদন খামার রয়েছে। এসব খামারে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৪ হাজার ৪৫০ দশমিক ৪১ একর। খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষির উৎপাদন বাড়াতে বিএডিসি প্রতিষ্ঠা করা হলেও দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে এর কার্যক্রম সংকুচিত করা হয়। একেবারে পঙ্গুত্ব বরণ করে সংস্থাটি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএডিসিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। মহাজোট সরকার এসেও সংস্থাটির কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে। ২০০৯ সালে বীজ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে সংস্থাটি। এ লক্ষ্যে দক্ষিণাঞ্চলে পটুয়াখালীর দশমিনায় প্রায় ৪ হাজার একর জমিতে আড়াইশ কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে বীজ উৎপাদন খামার স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এটি হবে দেশের সর্ববৃহৎ বীজ বর্ধন খামার।  

দেশের কৃষক ও মাটি জৈব রাসায়নিক সার ‘সুফলা’ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে
এইচআর সাগর 
দেশের কৃষক ও মাটি জৈব রাসায়নিক সার ‘সুফলা’ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ মহলের প্রভাবে অযৌক্তিকভাবে কৃষি মন্ত্রণালয় প্রায় ৮ বছর ধরে এই সারের অনুমোদন প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখেছে। যা অনুমোদিত হলে রাসায়নিক সার আমদানিতে বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছেন সুফলার আবিষ্কারক ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) তথ্যমতে, ১৯৮০ সাল থেকে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক নির্ভর নিবিড় চাষাবাদের শুরু হয়। আর ওই সময় থেকে ‘জৈব উপাদানের স্বল্পতা’ আশঙ্কাজনকহারে কমতে শুরু করে। এর ফলে দেশের মাটির উর্বরাশক্তি আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে মাটিতে ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ ভাগ জৈব উপাদান প্রয়োজন। সেখানে অনেক স্থানে শূন্য দশমিক ৫ ভাগের কম জৈব উপাদান রয়েছে। এর কারণ হিসেবে এসআরডিআই’র বিজ্ঞানীরা সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে নিবিড় চাষাবাদ সম্ভব বলে উল্লেখ করেছেন। এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য তারা জৈব সার ও জৈব রাসায়নিক সার ব্যবহারের ওপর জোর দেন। যেগুলোয় ৮ থেকে ২৪ ভাগ জৈব উপাদান থাকে। ‘সুফলা’ ঠিক তেমনি একটি সার যেখানে ১৬ থেকে ২৪ ভাগ জৈব উপাদান রয়েছে। ১৯৯০ সালে মাগুরার মো. আব্দুর রহমান ও তার প্রতিষ্ঠিত স্বদেশ ফার্মিং কমপ্লেক্স এই সার উদ্ভাবন করেন। যার কাঁচামাল হিসেবে ছাই, চালের কুড়া ও চিটাগুড়ের মত অপ্রচলিত পণ্য ব্যবহার করা হয়। এই সারের উদ্ভাবক বিজ্ঞানী আব্দুর রহমান বলেন, দেশে সহজলভ্য এসব উপাদান দিয়ে প্রায় ৩৪ লাখ টন জৈব রাসায়নিক সার উৎপাদন করা সম্ভব। যার মধ্যে ২৪ লাখ টন দেশে ব্যবহার করে বাকি ১০ লাখ টন রফতানি করা যাবে। এর মূল্য রাসায়নিক সারের চেয়ে অনেক বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) অধীনে ১৯৯১ সাল থেকে তিনি মাঠ পর্যায়ে এই সারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। ডিএইর হিসেব মতে, দেশের কৃষকরা প্রায় ১৪ লাখ টনের ওপরে টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সার ব্যবহার করেন। এর  ৯৫ ভাগ আমদানি নির্ভর। সুফলা সার ব্যবহার করলে ৩৩ ভাগ টিএসপি এবং ডিএপি সার সাশ্রয় সম্ভব হবে। এ সার ব্যবহার করা হলে এমওপি সারের প্রয়োজন হবে না বলে আব্দুর রহমান জানান। কৃষি প্রকৌশলী ইফতেখারুল আলম জানান, এই পরিমাণ সার যদি আমদানি করতে না হয় তাহলে তিন হাজার কোটি টাকার উপরে খরচ সাশ্রয় হবে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রাসায়নিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দীন আহম্মেদ বলেন, জৈব রাসায়নিক সারের বাণিজ্যিক উৎপাদনের অনুমোদনের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়। চিঠি পাওয়ার পর কৃষি মন্ত্রণালয় ৪টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরমানু কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট ও মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনষ্টিটিউটকে এই সার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বলে। ৪টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই সারের বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু এই সার উৎপাদনের অনুমতি ব্যতিরেকেই ২০০৬ সালে সার ব্যবস্থাপনা আইন-পাশ হয়। এরপর ২০০৮ সালে পুনরায় প্রজ্ঞাপন জারি করে বৈধতা দেয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন ও পরীক্ষিত জৈব রাসায়নিক সার সুফলার বৈধতা দেয়া হয়নি। ড. কামাল উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, উদ্ভাবিত জৈব রাসায়নিক সার বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতীয়মান হয় এটা দানাদার ফসলসহ আরো কয়েকটি ফসলের জন্য বেশ উপযোগী। অন্যান্য জৈব সারে ৮ থেকে ১৬ ভাগ উপাদান থাকে। আর এ জৈব রাসায়নিক সারে ১৬ থেকে ২৪ ভাগ উপাদান রয়েছে। বাণিজিক্যভাবে এই সার উৎপাদনে সরকারের অনুমোদন দেয়া উচিত। পরবর্তীতে কৃষকরাই বিচার করবে এটা ব্যবহার তাদের জন্য লাভজনক হবে কিনা। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ইকরামুল হক বলেন, সার অনুমোদন কমিটি যেখানে বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সার উৎপাদনে অনুমোদন দিচ্ছে; সেখানে পরীক্ষিত জৈব রাসায়নিক সারের অনুমোদন ঝুলিয়ে রাখার কোনও যুক্তি নেই। গুনগত ও মানসম্মত এ সার নি:সন্দেহে দেশের কৃষির জন্য সুফল বয়ে আনবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জৈব রাসায়নির সার মিশ্র সার নয়। জৈব রাসায়নিক সারের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ৭০ ভাগ জৈব সারের সাথে ৩০ ভাগ রাসায়নিক সার মিশিয়ে উৎপাদিত সার হচ্ছে মিশ্র সার। আর যে সমস্ত উপকরণ রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানোর পর সারে রূপান্তরিত হতে পারে, এমন উপকরণ নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কৌশলগতভাবে সংযুক্ত করে ব্যবহারের মাধ্যমে জৈব রাসায়নিক সার উৎপাদন করা হয়। জৈব রাসায়নিক সারে টিএসপি উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। টিএসপি বা ফসফরাস ও দস্তা মিশ্রনযোগ্য নয়। কিন্তু জৈব রাসায়নিক সার সুফলায় ফসফরাস ও দস্তার উপস্থিতি বিদ্যমান। টিএসপি উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করার কারণে এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে দেশের মোট টিএসপি চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস পায়। জৈব রাসায়নিক সার গাছের পুষ্টি গ্রহণ ক্ষমতা বাড়ায়। এর ফলে ফসলের ফলন ১৫-২০ ভাগ বৃদ্ধি পায়।
এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ
নিয়োগ পেতে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান
হাসান মাহমুদ রিপন
নিয়মনীতি উপেক্ষা করে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ার পোটেন এন্ড পার্টনার নিয়োগ পেতে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে পোটেন এন্ড পার্টনারকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ করতে দরপত্রে জালিয়াতির অভিযোগে দুদকে (দুর্নীতি দমন কমিশন) অভিযোগ দিয়েছেন মার্কিন কোম্পানি সিএইচ ফোর। দুদক এরই মধ্যে অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে।
সিএইচ ফোর-এর অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদক অনুসন্ধানের স্বার্থে অভিাযোগকারীকে ৪ ডিসেম্বর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে হাজির থাকার জন্য চিঠি দেয়।
জানা গেছে, দেশের গ্যাসের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ১২ জুলাই ড্রিলিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পেট্রোবাংলার অধীনে দেশে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ জন্য ২০১০ সালের ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির তত্ত্বাবধানে পেট্রোবাংলার অধীনে টার্মিনাল নির্মাণের জন্য দরপত্র অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৮টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। সেখান থেকে ৬টি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়। ওই ৬টি প্রতিষ্ঠান থেকে কাজটি পায় মার্কিন কোম্পানি সিএইচ ফোর। আর এ লক্ষ্যে ২০১০ সালের নভেম্বরে পেট্রোবাংলা ও মার্কিন কোম্পানি সিএইচ ফোর-এর মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়। সিএইচ ফোর দুদকে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছে তারা চূড়ান্তভাবে মনোনীত হলেও জালিয়াতির মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি পোটেন এন্ড পার্টনারকে কাজ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। প্রয়োজনে আদালতেও যাবেন বলে জানিয়েছেন কোম্পানিটির বাংলাদেশের প্রতিনিধি রাকিবুল হাসান। কোম্পানিটির দুদকে দেয়া অভিযোগে উল্লেখ করেছে, দরপত্রে বিশ্বের ২৮টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এর থেকে ৬টির কোম্পানির একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়। পরে সিএইচ ফোরকে মূল্যায়ন কমিটি চূড়ান্তভাবে মনোনীত করে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের জন্য চিঠি দেয়। আর সে মোতাবেক বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ২০১০ সালের ১০ নভেম্বরে সিএইচ ফোর ও পেট্রোবাংলার মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। এমওইউ স্বাক্ষরের পরে পেট্রোবাংলা খসড়া চুক্তির কপি দেয় সিএইচ ফোরকে। কোম্পানি পরে সেটি আংশিক সংশোধনের প্রস্তাব দিলে ১৭ মে ২০১১ তারিখে তা গ্রহণ করে পেট্রোবাংলা। এর পরে চুক্তির স্বাক্ষরে দফায় দফায় সময় বাড়ানো হয়। পেট্রোবাংলা সময় বাড়ানোর জন্য মোট ৬টি চিঠি দেয় বলে সিএইচ ফোর দাবি করেছে। অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, সম্প্রতি পেট্রোবাংলা আমাদের সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ ছাড়াই অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি পোটেন এন্ড পার্টনারকে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে জানতে পেরেছি। যা দরপত্র আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একই সঙ্গে আরপি (রিকোয়েস্ট অফ প্রপোজল) ডকুমেন্ট তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান পোটেন এন্ড পার্টনার আইনানুযায়ী এই দরপত্রে কোনোভাবেই অংশ নেয়ার যোগ্যতা রাখেন না, তারপরেও সকল আইন অমান্য করে  পোটেন এন্ড পোর্টনারকে কাজ দিতে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা। এতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, কিউএসবি মোতাবেক সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন দর কোনোটাই গ্রহণযোগ্য হবে না। শুধুমাত্র কারিগরিভাবে সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের দরপত্র খোলা যাবে। এই শর্ত অমান্য করা হলে তা ব্যাপক দুর্নীতি বলে বিবেচিত হবে। যা বিশ্বের সব আদালত কর্তৃক আইনসিদ্ধ। তারপরেও পোটেন এন্ড পার্টনার-এর দরপত্র খোলা হয়েছে। এছাড়া সিএইচ ফোরকে পরামর্শক নিয়োগ দেয়ার জন্য জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া নির্দেশনাও পেট্রোবাংলা মানছেন না বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। দুদকে ২৫ অক্টোবর দাখিল করা সিএইচ ফোর-এর পক্ষে অভিযোগে স্বাক্ষর করেছেন কান্ট্রিডিরেক্টর রাকিবুল হোসেন। অভিযোগে এমওইউ এবং বিভিন্ন সময়ে দেয়া চিঠি প্রমাণপত্র হিসেবে উপস্থাপন করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান করা হয়েছে। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা দুর্নীতির মাধ্যমে পোটেন এন্ড পার্টনারকে কাজ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার একটি সূত্র দাবি করেছে পোটেন এন্ড পার্টনার ২০০৬ সালে পাকিস্তানে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের দায়িত্ব পেলেও এখন পর্যন্ত টার্মিনাল নির্মাণ করতে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি পোটেন এন্ড পার্টনারকে দায়িত্ব দিলে বাংলাদেশেও কাজটি না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও সূত্রটি দাবি করেছে। তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ জানান আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি জ্বালানি মন্ত্রণালয় কাশিমবাজার কুঠিতে পরিণত হয়েছে। এখানে দেশের স্বার্থে কোনো কাজ হয় না। আরো স্বচ্ছতার সঙ্গে চুক্তি হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। দুদকের সহকারী কমিশনার মলয় কুমার সাহা লিখিত অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, তাদের অভিযোগের প্রমাণপত্র যাচাই বাছাইয়ের জন্য ডাকা হয়েছিল। তারা এর স্বপক্ষে তথ্য প্রমাণাদি দাখিল করে গেছেন। পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্লানিং) সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, এরই মধ্যে পোটেন এন্ড পার্টনারকে চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগিরই তারা কাজ শুরু করবে। দুদকে অভিযোগ দাখিলের বিষয়টি তিনি জেনেছেন উল্লেখ করে বলেন, দুদককে সার্বিক সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি আমরা। সিএইচ ফোর-এর সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষরের সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, এমওইউ তো অনেকের সঙ্গে হতে হয়। সব কি চূড়ান্ত করা হয়? পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর কোনো মন্তব্য নেই বলে জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, দেশের বাড়ন্ত গ্যাস সংকট মোকাবেলায় কাতার থেকে দৈনিক ৫’শ মিলিয়ন ঘনফুট
এলএনজি (লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস) আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর আওতায় মহেষখালীতে টার্মিনাল স্থাপন করা হবে। এর থেকে ৮০ কিলোমিটার পাইপ লাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হওয়ার কথা। সে মোতাবেক  ২১ জুন ২০১০ তারিখে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। বিশ্ব ব্যাংকের অনুদানের অর্থে নির্মাণ করার কথা।
এক মাসে গণপিটুনীতে ১৫ জন নিহত
ইকবাল হাসান ফরিদ
দেশে গত এক মাসে গণপিটুনীতে নিহত হয়েছেন ১৫ জন। এছাড়া ছিনতাইকারী ও সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন ১৬ জন, আহত হয়েছেন ৩৩ জন। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নভেম্বর মাসের মনিটরিং রিপোর্টে এ তথ্য জানা গেছে। এতে বলা হয়েছে, গত মাসে দেশে সামাজিক সহিংসতায় ৭৫ জন নিহত ও ৮৭৩ জন আহত হয়েছেন। রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছে ১২ জন এবং আহত হয়েছে ৪৯৮ জন। দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২১৮ জনের। অন্যান্য দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩৬ জনের। দেশে একমাসে যৌতুকের জন্য জীবন দিতে হয়েছে ১২ জন নারীকে। যৌতুকের জন্য নির্যাতনে আহত হয়েছে ৩ জন নারী। পারিবারিক কলহ ও অন্যান্য কারণে নির্যাতিত হয়ে নিহত হয়ে মারা গেছেন ১৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৪ জন নারী। গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনে ৫ শিশু গৃহকর্মী আহত হয়েছে। ফতোয়ার শিকার হয়েছে ১ জন নারী ও ১ জন পুরুষ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ২৬ জন নারী ও ২৪ জন পুরুষের লাশ উদ্ধার হয়েছে। রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে ৪ জন নারীর এবং ২ জন পুরুষের। পাচারকালে উদ্ধার হয়েছে ১ শিশু এবং পাচার হয়েছে ৬ শিশু। বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পেয়েছে ৩ জন কিশোরী। অপহরণের শিকার হয়েছে ৬ জন নারী ও ৮ জন পুরুষ। নির্যাতনে ৮ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। চিকিৎসকের অবহেলায় ৩ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ১০ জন নারী ও ১৫ জন পুরুষ। নভেম্বর মাসে ৫ শিশু এবং ৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১ শিশুকে। ৭ জন নারীর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১ জন নারীকে। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ১২ জন এবং বখাটেদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আÍহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ৩ জন নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় হামলায় আহত হয়েছে ১৫ জন এবং নিহত হয়েছে ২ জন। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ২ জন এবং র‌্যাব- কোস্টগার্ডের যৌথ অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ২ জন। বিএসএফ-এর গুলিতে ১ জন নিহত এবং তাদের নির্যাতনে ২ জন আহত হয়েছে। একই সময়ে সারাদেশে বিভিন্ন কারণে গ্রেফতার হয়েছে ৫২৯ জন এবং জেল হাজতে মৃত্যু হয়েছে ৩ জন পুরুষের।
মেকং উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সার্ক ফোরামের আদর্শ হতে পারে
মনির তালুকদার
দক্ষিণ এশিয়ায় অমিত সম্ভাবনার দ্বার উšে§াচন করতে পারস্পরিক সেতুবন্ধন রচনার অঙ্গীকারের মধ্যে দিয়ে মালদ্বীপের সমুদ্রবেষ্টিত আদ্দু নগরীতে দু’দিনব্যাপী শুরু হওয়া ১৭তম সার্ক শীর্ষ (সাউথ এশিয়ান এসোসিয়েশন অব রিজিওনাল কো-অপারেশন) শেষ হলো ২০ দফা আদ্দু ঘোষণার মধ্যে দিয়ে। ১২ নভেম্বর ২০১১ শীর্ষ সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন সার্কের বর্তমান সভাপতি মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ।
সার্ক সম্মেলনে চারটি চুক্তি হয়। মালদ্বীপের হাভেরু অনলাইন জানায়, চুক্তিগুলো হচ্ছে Ñ(১) প্রাকৃতিক দুর্যোগে দ্রুত সাড়া দান চুক্তি। (২) সাদৃশ্য শনাক্তকরণে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা বিষয়ে চুক্তি। (৩) আঞ্চলিক মান চুক্তি এবং (৪) বীজ ব্যাংক  চুক্তি। মালদ্বীপের আদ্দু সিটির ইকুইটোরিয়াল কনভেনশন সেন্টারে সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশন শুরুর পর প্রথমেই আট সদস্য দেশের পরাষ্ট্রমন্ত্রীরা ওইসব চুক্তি সই করেন। সার্ক তৃতীয় দশকে পা দিলেও দক্ষিণ এশিয়ান ৮টি দেশের ১৫০ কোটি মানুষের কাক্সিক্ষত উন্নয়নের দেখা মেলেনি। সার্ক হয়ে উঠতে পারেনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা কাছাকাছি “আশিয়ান” এর মতো সফল ও কার্যকর অর্থনৈতিক জোট। বিরোধ, সন্দেহ ও অবিশ্বাসকে দূরে ঠেলে উন্নয়নের পথে এক সঙ্গে পথচলাও হয়েছে নানা কারণে বাধাগ্রস্ত। সে ক্ষেত্রে সার্ক-এর ৮টি দেশ তাদের  ব্যাপক দারিদ্র্য পীড়িত জনগণের জীবনমান উন্নয়নে মেকং নদী বিধৌত অঞ্চল থেকে শিক্ষা নিতে পারে। সার্ক অঞ্চলের অব্যবহিত পূর্বে অবস্থিত মেকং নদী বিধৌত ছয়টি দেশ তাৎপর্যপূর্ণ আন্ত-আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক কর্মকাঠামোর মধ্যে থেকে ¯ন্ঠ” অগগডত সাধন করেছে। ভারতীয় উপমহপদেশের চেয়েও সম্ভত এ অঞ্চল অধিকতর দরিদ্র। তবে দারিদ্র্য বিমোচনে মেকং সহযোগিতামূলক র্কম-কাঠামো যথেষ্ট অবদান রাখছে। থাইল্যাণ্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম এবং চীনের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশের সমন্বয়ে “গ্রেটার মেকং সাব-রিজিওনাল” অথবা জিএমএস নামক সংস্থা গড়ে উঠেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)’র সহযোগিতাকে পুঁজি করে জিএমএস সদস্য দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় রক্ষা করে চলেছে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে। জিএমএস কর্মসূচিতে ১০ বছর মেয়াদি যে কৌশলগত কর্মকাঠামো রয়েছে তাতে প্রথমে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর।  জিএমএস দেশগুলোর মধ্যে উন্নত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে সড়ক, রেল, নৌ এবং বিমান যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। এর পাশাপাশি টেলিযোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে সদস্য দেশগুলোর সরকার বিশেষত চীন আন্তঃসংযোগ বৃদ্ধি করার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ানো এবং ছয় জাতির মধ্যে বৃহত্তর সহযোগিতা গড়ে তুলতে। আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যেমনÑপর্যটন এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে শুল্ক প্রথা ও ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। এ অঞ্চলের সড়কগুলোর অবকাঠামো একটি নির্দিষ্টমানে উন্নীত করা হয়েছে। এর ফলে নিকটতম প্রতিবেশী দেশের লোকজন এবং পণ্যের অবাধ যাতায়াত এবং দ্রুত পরিবহন সম্ভব হচ্ছে। সার্ক সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যেমন শক্রতা রয়েছে, তেমনি শক্রতা মাত্র ২৫ বছর আগে ও জিএমএস দেশগুলোর মধ্যেও ছিল। চীন ও ভিয়েতনাম ১৯৭৯ সালে একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। লাওস ও কম্বোডিয়ার মধ্যে অল্প কিছু দিন আগে ও শক্রতামূলক সম্পর্ক ছিল। তা সত্ত্বেও মেকং নদী বিধৌত দেশের নেতারা স্পষ্ট অর্থনৈতিক লাভের জন্য নিজেদের মধ্যে সংযোগ সাধনাকেই শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে। নিজস্ব স্বার্থেই চীন তার নিকটতম প্রতিবেশী দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করার পথ বেছে নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ হিসেবে ভারতের উচিত চীনের পথ অনুসরণ করা। মেকং নদীর নাব্য রক্ষা এবং সড়ক নির্মাণে অর্থায়ন করে চীন প্রতিবেশী দরিদ্র দেশগুলোকে সুযোগ করে দিয়েছে তাদের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ইউনানের বিশাল বাজারে প্রবেশ করতে।
চীন ওইসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে দীর্ঘ মেয়াদি চিন্তা থেকে। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ হচ্ছে, থাইল্যান্ড ও লাওসের মধ্য মেকং নদীতে প্রস্তাবিত একটি সড়ক সেতু ও থাইল্যান্ডের মধ্যে একটি মহাসড়ক নির্মাণের চীন অর্থায়ন করছে। যদিও ওই সেতু ও সড়কটি প্রত্যক্ষভাবে চীন ও থাইল্যান্ডের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তুলবে, তথাপি ওই সেতু নির্মাণে সম্ভব্য ব্যয় ৪০ মিলিয়ন ডলারের এক-তৃতীয়াংশ চীন জোগান দিতে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপনে ওই সড়ক অবদান রাখবে। আর এ সড়কটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে অবদান রাখতে সক্ষম। মেকং অববাহিকার অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর অঞ্চলের সস্তা শ্রমের বাড়তি সুবিধা আদায় করা সম্ভব হবে ওই  সড়কের মাধ্যমে। শুধু সড়কই একমাত্র সংযোগ ব্যবস্থা নয়, যা চীন উন্নয়ন করেছে। কর্দমাক্ত মেকং নদীর নাব্য বজায় রাখা কোনো সহজ কাজ নয়। কিন্তু চীন মেকং নদীর উন্নয়ন এবং নাব্য নিশ্চিত করেছে। এর ফলে চীনের ইউনান থেকে থাই বন্দরÑসিনসায়িনের মধ্যে পণ্য পরিবহনে বর্তমানে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে নৌ বাণিজ্য শুধু দ্রুতলয়েই বৃদ্ধি পায়নি, বরং এ অঞ্চলের যেসব দেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করছে তারা ভোগ করেছে বাণিজ্য উদ্বৃত্তের সুবিধা থাইল্যান্ডের মেকং নদীর প্রবেশ মুখে তৈরি করা সিনসায়িন বন্দরের শুল্ক বিভাগের পরিচালক সু উন বলেন, চীন থেকে আপেল, নাশপাতি এবং সবজি নিয়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ টন পণ্যবাহী জাহাজ এখানে আসছে। পণ্য নামিয়ে ওই জাহাজগুলো প্রাকৃতিক রাবার, শুকনো “লঙ্গনস”  পেট্রোল, ডিজেল, এবং রাবারের তৈরি সামগ্রী নিয়ে ইউনান প্রদেশের উদ্দেশে যাত্রা করে। প্রতিবছর নৌ-বাণিজ্যের পরিমাণ ৩৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। ২০১০ সালে নৌ-বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । জিএমএস যদিও ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তথাপি এটি এ অঞ্চলের প্রকৃত উন্নয়ন সাধন করে ২০০১ সাল থেকে। ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর কম্বোডিয়ার নমপেনে জিএমএস নেতৃবৃন্দ তাদের প্রথম শীর্ষ বৈঠকে এডিবির সহায়তায় ১০ বছর মেয়াদি একটি কৌশলগত কর্মকাঠামো অনুমোদন করেন। ওই কর্মকাঠামোর উদ্দেশ্যে হচ্ছে সুসংহত এবং সমৃদ্ধ মেকং উপ-অঞ্চল গঠন। মেকং উপ-অঞ্চলকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি এবং পরিবেশ রক্ষার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে।
এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ কল্যণের জন্যই পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দারিদ্র্যবিমোচন এবং পরিবেশ রক্ষায় কর্মকাঠামোতে পাঁচটি উন্নয়ন ক্ষেত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। উন্নয়ন ক্ষেত্রগুলো হচ্ছেÑ প্রথমত, অবকাঠামোগত সংযোগ দৃঢ় করা। এক্ষেত্রে সামষ্টিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। দ্বিতীয়ত, আন্তঃ
সীমান্ত বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। তৃতীয়ত- উন্নয়নমূলক কাজে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ এবং তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মান উন্নয়নে কাজ করা। চতুর্থত- মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং উপ-অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা। ৩০০ মিলিয়নের অধিক জনসংখ্যা বিশিষ্ট জিএমএস অঞ্চল এখনো দারিদ্র্য পীড়িত। তা সত্ত্বেও এডিবির মেকং বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল রাজাত এম নাগ বলেন, “জিএমএস কর্মসূচির চালু হবার পর ১৯ বছরে এ অঞ্চলে দৃষ্টি আকষণ করার মতো অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।” নয়াদিল্লিতে মেকং ডেভেলপমেন্ট ফোরামের সভায় তিনি বলেন, ভিয়েতনামে প্রকৃতপক্ষে দারিদ্র্যের মাত্রা গত এক দশকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। জিএমএস-এর সফলতার অন্যান্য মাইলফলকও আছে। ১৯৯২ সাল থেকে জিএমএস সরকারগুলো প্রকল্প বিনিয়োগ হিসেবে ২০১০ সাল পর্যন্ত ২.০১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়ন করেছে। অন্যদিকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জিএমএসর বিনিয়োগ প্রকল্পে এডিবি ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে। যৌথ অর্থায়নকারী হিসেবে এডিবি ৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জোগান দিয়েছে। যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করার ফলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে শুভেচ্ছামূলক মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। আস্থা বৃদ্ধি এবং উন্নত সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ওই মনোভাব কাজ করেছে। মেকং উপ-অঞ্চলের সরকারগুলো বাহ্যিক ও মানসিক বাধা সরিয়ে ফেলতে সম্মত হবার পর থেকে থাই-মিয়ানমার এবং ভিয়েতনাম লাওস সীমান্তে পণ্যের প্রবাহ ও লোকজনের যাতায়াত উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
থাই ও ভিয়েতনামের সরকারি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, জিএমএস কর্মসূচির ফলে যে শান্তির সুবাতাস বইছে তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং দেশগুলোর মধ্যে সমঝোতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এর ফলে মেকং উপ-অঞ্চলে উচ্চ বিনিয়োগ এবং দৃঢ় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে।  তাই সমৃদ্ধি এবং উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে এশিয়ার যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, তা কাজে লাগানোর সবচেয়ে ভালো উপায় আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক একীকরণ। আমাদের প্রত্যাশাÑসার্ক দেশগুলো জিএমএসর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে এবং বহু কাক্সিক্ষত উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।
 দেশেই বিশ্বমানের ড্রেজার
শাহ মতিন টিপু
অনেক দুঃসংবাদের ভিড়ে একটি সুসংবাদ এই যে, স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এই প্রথম বিশ্বমানের তিনটি কম্পিউটারাইজড ড্রেজার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। ড্রেজার তিনটি নেদারল্যান্ডসের  ভোস্টা এলএমজির সঙ্গে  যৌথ অংশীদারিত্বে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স তৈরি করেছে। প্রাথমিক ট্রায়াল সম্পন্ন করে ড্রেজার তিনটি মুন্সীগঞ্জের মাওয়া নৌঘাট ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে পলিমাটি অপসারণে ব্যবহার করা হচ্ছে। নতুন  ড্রেজার ৩টি বিআইডব্লিউটিএর বহরে যোগ হওয়ায়  ড্রেজিং ক্ষমতা আরো ২০ লাখ ঘনমিটার বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৫০ লাখ ঘনমিটারে উন্নীত হয়েছে। ড্রেজার নির্মাণের এমন সংবাদ বাংলাদেশের জন্য চমকই বটে। বাংলাদেশ যে পিছিয়ে নয়, অনেকখানি এগিয়ে গেছে এ খবর তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। এই অগ্রগতি আগামীতে আরো হিরš§য় এক বাংলাদেশেরই ইঙ্গিত। ড্রেজার নির্মাণের এই অগ্রগতির খবরটির জন্য কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের এমডি ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ এমএ রশিদ নিঃসন্দেহে ইতিহাস হয়ে থাকবেন এবং জাতির গর্বিত সন্তান হিসেবে বিবেচিত হবেন। দেশের নদীপথের নাব্য যে অনেক স্থানেই তার চিরায়ত রূপটি হারিয়ে ফেলেছে তা সকলেই জ্ঞাত। নাব্য হারিয়ে নৌপথে নৌযান চলাচলও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ক্রমেই এই দুরবস্থার মাত্রা বেড়েই চলছে। এমতাবস্থায় নদীতে ড্রেজিং হয়ে ওঠে অপরিহার্য। সেক্ষেত্রে দেশেই যদি ড্রেজার তৈরি সম্ভব হয়, তবে আমরা দুরবস্থাটি কাটিয়ে তুলতে অনেকখানি ভরসা পাব। নৌপথের দুরবস্থা নিরসনে-বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সারাদেশে গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট পুনরুদ্ধারে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবেই ড্রেজার সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় বিআইডব্লিউটিএ। ‘অভ্যন্তরীণ নৌপথের নাব্য রক্ষার্থে ২টি ড্রেজার, ক্রেনবোট, ক্রুহাউজবোট ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম সংগ্রহ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ২টি ও বিআইডব্লিউটিএর নিজস্ব অর্থায়নে ১টি; মোট ৩টি ড্রেজার সংগ্রহের জন্য সরকার ও ভোস্টা এলএমজি-কর্ণফুলী জয়েন্ট ভেঞ্চার কনর্সোটিয়াম লিমিটেডের মধ্যে ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী নেদারল্যান্ডসের ভোস্টা-এলএমজির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও কারিগরি নির্দেশনায় চট্টগ্রাম কর্ণফুলী থানা এলাকায় ইছানগরে ড্রেজার ৩টি নির্মাণ করা হয়েছে। যদিও ড্রেজারের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমেরিকা-ইউরোপ থেকেই আনা। তারপরও দেশে নির্মাণ করতে পারাটা হৈ চৈ ফেলে দেয়ার মতোই ব্যাপার বটে। নির্মিত ড্রেজার সম্পর্কে কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ জানায়, ড্রেজার তিনটি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) কে হস্তান্তরের আগে প্রকৌশলীদের দিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। বিআইডব্লিউটিএ জানায়, কম্পিউটারাইজড এ ড্রেজার তিনটি জ্বালানি সাশ্রয়ী। এতে খননের পরিমাণ ও জ্বালানি খরচের পরিমাণ সঠিকভাবে কম্পিউটারে প্রদর্শিত হয়। কিন্তু বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএর দক্ষ লিভারম্যান (ড্রেজার চালক) নেই। গত ৬ সেপ্টেম্বর একটি রো-রো ফেরির আঘাতে ওই নতুন ৩টির মধ্যে কর্ণফুলী নামের ড্রেজারটির স্পাড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবশ্য ড্রেজার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এটি মেরামত করে দেয়ার পর গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কম উচ্চতার ব্রিজের নিচ দিয়েও ড্রেজার নিয়ে যাওয়ার জন্য এ ড্রেজারগুলোতে টাইলটিং সিস্টেমের স্পাড সংযোজন করা হয়েছে। দেশের নদ-নদীগুলোর তীব্র নাব্য সংকট মোকাবিলায় বিআইডব্লিউটিএ তার সীমিত সামর্থ্য দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে নির্মিত ড্রেজার ভালোই সার্ভিস দিচ্ছে, যা আশাবাদী হওয়ার মতো। অপরদিকে ড্রেজার ৩টি পাওয়া পর বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজার বহরের ড্রেজিং ক্ষমতা আরো ২০ লাখ ঘনমিটার বৃদ্ধি পেয়ে মোট ৫০ লাখ ঘনমিটারে উন্নীত হয়েছে। এতে অভ্যন্তরীণ নৌরুট, ফেরি রুট, বেসিন এবং চ্যানেলগুলোর নাব্য বৃদ্ধি পাবে। কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের উপদেষ্টা ক্যাপ্টেন আমিরুল ইসলাম বলেন, ভোস্টা এলএমজির সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স প্রথম বাংলাদেশে কাটার সাকশান ড্রেজার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ভোস্টা এলএমজি একটি পৃথিবীখ্যাত ড্রেজার নির্মাতা; যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। 

যার রয়েছে ৬০টি বিভিন্ন প্রকারের জাহাজ নির্মাণে অভিজ্ঞতা। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ড্রেজার নির্মাণের  ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করবে। ইতোপূর্বেও বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের বিস্ফোরণে ধ্বংসপ্রাপ্ত ১৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার  তেলবাহী জাহাজ বাংলার সৌরভকে পুনর্নির্মাণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড। তারা গর্বের সঙ্গেই মিডিয়াকে জানান, বাংলাদেশে এই প্রথম আমরা ড্রেজার তৈরি করছি। ভুল-ত্র“টি থাকতে পারে। আশা করছি আগামীতে কোনো ভুল-ত্র“টি হবে না। কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের এমডি প্রকৌশলী আবদুর রশিদ বলেন, ১৯৭৪ সালের পর বাংলাদেশে কোনো কাটার সাকশান  ড্রেজার সংগ্রহ করা হয়নি। ৩৫ বছরের পুরনো ড্রেজারগুলো ড্রেজিংয়ের  ক্ষেত্রে চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। নতুন  ড্রেজার সংগ্রহ সময়েরই দাবি। নতুন এ ৩টি ড্রেজার ২০ বছর ভালো সার্ভিস দেবে। দেশে জাহাজ নির্মাণ করে বিদেশে রফতানির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ইতিহাস মাত্র কয়েক বছরের। বাংলাদেশে নির্মিত জাহাজ অন্য দেশের হয়ে বিশাল সমুদ্রপথে বাংলাদেশেরই অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এটা গর্বিত হওয়ার মতোই ব্যাপার। বাংলাদেশে মোটরসাইকেল তৈরিরও কারখানা গড়ে উঠেছে। আর এবার পেলাম ড্রেজার তৈরি হওয়ার মতো সুংবাদ। এসব খবরাখবর আমাদের এটাই  জানিয়ে দিচ্ছে যে বাংলাদেশের নতুন দিনগুলো অনেক সম্ভাবনার, যা আমাদেরকে এক আলোকিত অধ্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। 
 বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর একাল-সেকাল
হাজী মোঃ হায়াতুজ্জামান এমএ
বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী  শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধাই নন, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান অসামান্য এবং ইতিহাস স্বীকৃত। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি হায়ানাদের কবল থেকে সবুজ শ্যামল বাংলা মাকে রক্ষা করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাস্ট্র গঠন করার জন্য জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম ধর্মীযোদ্ধা  এবং সংগঠক। কোনো সেক্টর কমান্ডার না হলেও তার অধীনে হাজার হাজার যোদ্ধা বীরবিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন এবং তার নেতৃত্বে প্রতিটি অভিযানই ছিল সফল। এ কথা বললে খুব বেশি বলা হবে না যে, ’৭১ সালে যুদ্ধের প্রয়োজনে দেশকে যে ১১টি সেক্টরে  ভাগ করা হয়েছিল সে সেক্টরগুলোর ১১ জন কমান্ডারই ছিলেন সামরিক বাহিনীর মেজর কর্নেল পর্যায়ের উচ্চপদস্থ অফিসার। কিন্তু  সে সব প্রশিক্ষিত সামরিক অফিসারের  কমান্ড থেকে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত কাদেরিয়া বাহিনীর অর্জন ছিল অনেক বেশি । কাদেরিয়া বাহিনী কোনে সেক্টর কমান্ডরের অধীনে ছিলেন না বঙ্গবীর আব্দুল কাদেরর নেতৃত্বে ও নির্দেশনা মোতাবেক যুদ্ধ করেছিলেন বলেই তারা কাদেরিয়া বাহিনী নামে পরিচিত ছিলেন এবং দেশবাসী তাদের এ নামেই চিনত। কাদের সিদ্দিকীই  কেবলমাত্র ভিন্নধর্মী যোদ্ধা যিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ শক্রমুক্ত তথা পাকহানাদার বাহিনীর আÍমর্পণের পরও  কোনো সেক্টর কমান্ডার বা অন্য কার কাছে অস্ত্র জমা দেননি। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন যার নির্দেশে অস্ত্র হাতে নিয়েছি তার কাছেই অস্ত্র জমা দেব। যে কারণে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি  পেয়ে ’৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে  আসার পর তার দলবল নিয়ে লংমার্চ করে গার্ড অব অনার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর চরণতলে অস্ত্র সমর্পণ করেন, অস্ত্রের পরিমাণ ছিল ১৫ ট্রাক। (বঙ্গবন্ধু এভিনিউ-এ বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে যুবলীগের এক সভায় তার মুখ থেকে শোনা বক্তৃতা)। দেশমাতৃকার জন্য তার এ মহান অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতি তাকে বাঘা সিদ্দিকী খেতাবে ভূষিত করেছেন। যদি ও তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে বীরউত্তম খেতাব প্রাপ্ত। কিন্তু জনতার দেয়া খেতাবই প্রকৃত  খেতাব । খুনি চক্র ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করার পর তিনিই ছিলেন একমাত্র প্রকাশ্যে প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং খুনের বদলা নেয়ার জন্য প্রতিবাদ করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে চলে গিয়েছিলেন। দেশে প্রত্যাবতন করেছেন ১৯৯০ সালে গণঅনন্দোলনে তৎকালীন  স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের পতন হবার পর। সম্ভবত ডিমেম্বর মাসে কারণ ’৯০ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে বড় ভাই আলহাজ ওহেদুজ্জামান মেম্বারের সঙ্গে জীবনের প্রথম হযরত শাহ্ জালাল আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করার জন্য সড়ক পথে পুণ্যভূমি সিলেট যাচ্ছিলাম, হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে সিলেট শহর পর্যন্ত কাদের সিদ্দিকীকে স্বাগতম জানিয়ে রাস্তার ওপর নির্মিত অসংখ্য তোরণ দেখেছি। দেখেছি অনেক প্যান্ডেল। তারপরও মনের খুত খুত দূর করার জন্য একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম ভাই এত গেট এত প্যান্ডেল ব্যাপার কি ? লোকটি মনের আনন্দে উৎসাহ নিয়ে বললেন, আরে ভাই দেখছেন ন্ াবাঘা সিদ্দিকী আসবেন। তাই তার সম্মানে এতসব তোরণ। লোকটির উৎসাহ ব্যঞ্জক উত্তর শুনে আমার বুকটি গর্বে ভরে উঠল। মনে মনে ভাবলাম একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাকে এ রকম সম্মান দেয়া আমাদের সকলের কর্তব্য। যদিও কোনো মানদণ্ডে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তার ওপর আবার বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর ন্যায় মুক্তিযোদ্ধা। যার নাম শুনলে পাকহানাদার বাহিনীর হƒৎপিণ্ড কম্পন শুরু হয়ে যেত। বন্ধ হয়ে যেত রাজাকার আলবদর বাহিনীর প্রস্রাবপায়খানা। তবে সব চেয়ে মজার ব্যাপার হলো তখন ও বঙ্গবীরকে স্বশরীরে দেখার ভাগ্য আমার হয়ে উঠেনি। যদিও তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের রাজপথের মিছিলে আমি নিজেও একজন ক্ষুদে সৈনিক ছিলাম। তাকে আমার প্রথম দেখার সুযোগ হয়েছিল সম্ভবত ১৯৯২ সালে মোঃপুরে, আমাদের কেরানীগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য বোরহান উদ্দিন গগনের মৃত্যুর চারদিন পর মরহুমের আÍার মাগফেরাত কামনার্থে মিলাদ মাহফিলে। সে মিলাদ মাহফিলে বঙ্গবন্ধুর মানসপুত্র আব্দুর রাজ্জাক সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। (বর্তমানে আব্দুর রাজ্জাক সাহেব অসুস্থ হয়ে লন্ডনের একটি হাসপাতালে ডাক্তারি চিকিৎসাধীন আছেন। মহান আল্লাহ্তালার কাছে দু’হাত তুলে দোয়া করি তিনি যেন সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন)। সে দিন বাঘা সিদ্দিকীকে প্রথম দেখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম, চিন্তা করছিলাম যে লোকটির কথা অনেক শুনেছি, যার জন্য রাজপথে মিছিল করেছি সেই বিশাল মাপের মানুষটির সামনে আজ আমি দাঁড়িয়ে, খোদা তোমাকে ধন্যবাদ। ঘটনা ক্রমে ওই মিলাদ মাহফিলেই তার একটি সহানুভবতার পরিচয় পেলাম। মিলাদে শেষ পর্যায় আমরা যখন মহানবী (সা:) প্রতি সালাম পেশ করার জন্য দাঁড়ালাম (কিয়াম করছিলাম) তখন হঠাৎ একটি আটদশ বছরের সম্ভবত টোকাই ছেলে দৌড় দিয়ে ভিতরে গিয়ে কাদের সিদ্দীকীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তখন এক লোক ছেলেটিকে হাত ধরে টান দিয়ে বের করে দেবার সময় কাদের সিদ্দিকী সাহেব দু’হাত দিয়ে জাপটে ধরে ছেলেটিকে বুকে চেপে নবীর প্রতি সালাম পেশ করলেন। একজন টোকাই ছেলের প্রতি ভালোবাসা দেখে মনে হলো এ রকম মনের মানুষ না হলে কি এতবড় মাপের মানুষ হওয়া যায়। তারপর শোকসভায় তিনি মরহুম গগনের মতো একজন সংসদ সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধের সংগঠকের অর্থনৈতিক দৈন্যদশার কথা আলাপ করলেন এবং অতি দুঃখের সঙ্গে আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন গগন ভাইয়ের মতো একজন সাবেক সংসদ, মুক্তিযোদ্ধের- সংগঠকের এমন অবস্থা মেনে নেয়া যায় না। পরবর্তীতে অনেক সভা-সমাবেশে তার বক্তৃতা শুনেছি এবং তিনি যে একজন আপসহীন প্রতিবাদী কণ্ঠ তা বুঝতে পেরেছি। এরপর তার সঙ্গে একই মঞ্চে বসার সুযোগ হয়েছিল, সুযোগ হয়েছিল একই জামাতে সম্ভবত বঙ্গবীরের ইমামতিতে মঞ্চের ওপর আচরের নামাজ আদায় করার, সময়টি ছিল ১৯৯৪ সালের ২এপ্রিল, গণহত্যা দিবস উপলক্ষে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২ এপ্রিল বুড়ীগঙ্গা নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জে প্রবেশ করে হাজার হাজার নিরাপরাধ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। সে থেকে  কেরানীগঞ্জবাসী প্রতি বছর ২ এপ্রিল গণহত্যা দিবস পালন করে আসছে। সে উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু পরিষদের ব্যানারে জিনজিরা ঈদগাহ্ মাঠে শহীদদের স্মরণে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। লোকসমাগম হয়েছিল প্রচুর। বিশাল সামিয়ানার ভিতর তিল পরিমাণ জায়গা খালি ছিল না। মাঠের চতুর্দিকে হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়ে বঙ্গবীরের ভাষণ শুনছিলেন। তবে এ সমাবেশে প্রধান অতিথি করার কথা ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি  মোঃ জিল্লুর রহমান, সে সময়ের ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বর্তমান মাননীয় সংসদ সদস্য বেনজীর আহম্মেদ ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিম আহমেদ জিল্লুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ডায়েরি দেখে বলেন ২ এপ্রিল তার অন্যস্থানে প্রোগ্রাম আছে। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা মোঃ নাসিমকে ফোন করে কেরানীগঞ্জ আসতে বললে তারও অন্য জায়গায় প্রোগ্রাম চূড়ান্ত বলে জানান। তখন জিল্লুর রহমান সাহেব হাস্যরসময় মুখে বললেন পাগলাকে ফোন করে দেখি তখন সবাই নেতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পাগলা আবার কে ? কিছুক্ষণের মধ্যেই টেলিফোন রেখে বললেন পাগলা রাজি হয়েছে। আরে কাদের সিদ্দিকী ওকে আমি পাগলা বলে ডাকি। কারণ ও একজন প্রতিবাদী মানুষ। সত্য কথা বলতে কাউকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করে না। অবশেষে ২ এপ্রিল গণহত্যা দিবসে বঙ্গবীর কেরানীগঞ্জে আসলেন স্বভাব সুলভ ভঙ্গিমায় স্পষ্ট ভাষায় অনর্গল প্রায় একঘণ্টা বক্তৃতা করলেন। বক্তৃতার ১ম থেকে শেষ পর্যন্ত পাকহানাদার বাহিনীর নির্মম নিষ্ঠুরতার বর্ণনা দিলেন। পাকহানাদার বাহিনীর জঘন্য অত্যাচারের জন্য তাদের নাপাকবাহিনী বলে সম্বোধন করলেন। স্বাধীনতাবিরোধী এদেশেীয় দালাল আলবদর রাজাকার বাহিনীর লোকদের তুলোধুনো করতে ছাড়লেন না এবং বললেন এ সকল বিশ্বাসঘাতক স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আলবদরদের সহযোগিতার ফলেই নাপাকবাহিনীরা আমাদের মা বোনদের অত্যাচার করেছে। ওদের নিস্তার নেই। তিনি উপস্থিত লাখো জনতার উদ্দেশে পরাজিত স্বাধীনতাবিরোধীদের সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকার পরামর্শ দিলেন। কারণ ওরা পরাজয়ের গ্লানি ভুলেনি। যে কোনো সময় দেশ ও দেশপ্রেমিক জনতার ওপর আঘাত হানতে পারে। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের ওপর তার যে কি পরিমাণ রাগ ছিল তা তার বক্তৃতা থেকে অনুমান করা গেছে। বক্তৃতার একপর্যায়ে তিনি রাগ হয়ে উচ্চস্বরে বললেন আরে ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় আমি কাদের সিদ্দিকী যদি জেলে না থাকতাম তাহলে হুমায়ুন খান পন্নির মতো একজন রাজাকার কিভাবে আমাকে পরাজিত করে তা আমি দেখে নিতাম। তিনি উপস্থিত জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন  মীরজাফর অর্থ কি? প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য অনেকেই হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেলেন। কেউ বললেন মীরজাফর অর্থ বিশ্বাস ঘাতক, কেউ বললেন মোনাফেক, কেউবা বললেন গাদ্দার, কাদের সিদ্দিকী বললেন কারো উত্তর হয়নি। আসলে মীরজাফর একটি নাম। তিনি কাজটি করেছেন বিশ্বাস ঘাতকের, তাই সবাই তাকে গাদ্দার বলেই জানে  সে কারণে মীরজাফর নামটি কেই রাখে না।  তেমনি ‘৭১-এর বিশ্বাসঘাতক গোলাম আযম নামটিও বাংলার কোনো মানুষেই রাখবে না। তার ভাষণ শুনে-উপস্থিত লাখো জনতা উজ্জীবিত হলেন। অনেক বছর পর ‘৭১-এর চেতনায় দেশগড়ার প্রত্যয় নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। শুধু তাই নয় দীর্ঘ দিন পর্যন্ত তার ভাষণ তার কথা হাটে বাজারে মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হলো। আমার নিজের চেতনাও সতেজ হলো। যদিও বঙ্গবীর রচিত স্বাধীনতা ‘৭১ বইটি আমি পড়েছি। তার রচিত বইটিতে তিনি কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন. রাজাকার পাকহানাদার বাহিনীকে শায়েস্তা করেছেন তার প্রত্যেকটি ঘটনাই বিশাদ বর্ণনা দিয়েছেন। আমি কেন, দেশ  প্রেমিক যে কোনো মানুষ বইটি পড়লে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হতে বাধ্য। কাদের সিদ্দিকী এখন আওয়ামী লীগে নেই। মতপার্থক্যের কারণে আলাদা দল গঠন করেছেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় দীর্ঘ পনর বিশ বছর পর তার বর্তমান অবস্থা বক্তৃতা বিবৃতি পত্র পত্রিকায় তার নিজের লিখা কলাম পড়ে এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে টকশোতে কথাবার্তা শুনলে একাল-সেকালের যোগ-বিয়োগ মেলাতে খুব কষ্ট হয়। বঙ্গবীরের মুখে যখন স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রটেকশনের কথা শুনি তখন বড়  বেশী শঙ্কিত হই। ভয় হয় আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা  ভেবে। কারণ ‘৭২ এর  শোচনীয় পরাজয়ের কথা স্বাধীনতা বিরোধীরা ক্ষণিকের জন্যও যে ভুলেনি,তা - তাদের বিগত কর্মকাণ্ড থেকেই বুঝা যায়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাবিরোধীদের সাধারণ অপরাধের কথা ভেবে (খুন,ধর্ষণ ও লুটপাটে জড়িতদের বাদে) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন তারা হয়ত তাদের কৃত অপকর্মের কথা ভেবে সংশোধিত হয়ে দেশ ও দেশের জনগণের উন্নয়নে আÍনিয়োগ করবেন। কিন্তু ফল হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো অধিকন্তু স্বাধীনতাবিরোধীরা  দেশ ও জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করে বলতে লাগল, শেখ মুজিবইতো মাফ করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এ সাধারণ ক্ষমাকে তারা সামান্যতম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাবোধ দেখায়নি। বরং কাজ করেছে বিপরীত। তারা স্বাধীনতার পক্ষের অসংখ্য  লোকে০র হাত পায়ের রগ কেটে দিয়ে জীবনের তরে পঙ্গু করে দিয়েছে। এরশাদ সরকারের শাসন আমলে চট্টগ্রামে যুব ইউনিয়নের লোকদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয় সারাদেশে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে হত্যা করে লাশ ম্যানহলে ফেলে দিয়েছে। ২০০১ সালের চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশব্যাপী অসংখ্য সংখ্যালঘুকে  হত্যা করে ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। চট্টগ্রামে অধ্যক্ষ মহুরীকে ঘরে ঢুকে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। তাদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা ইসলামের নামধারী বিভিন্ন সংগঠন সারাদেশে  সাধারণ মানুষকে অত্যাচার নির্যাতন করেছে। বাংলাভাই শায়েখ রহমানগং তাদেরই সৃষ্টি। তাদের পৃষ্ঠপোষাকতায় বাংলাদেশ নামক এ স্বাধীন ভূ-খণ্ডটিতে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে। তারা যে কতটা হিংস্র তা ১৯ সেপ্টেম্বরের/২০১১ ঘটনা থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। যেখানে গণমানুষের নিরাপত্তা বিধান করা পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব, সেই রাষ্ট্রীয় পুলিশবাহিনীর ওপর গেরিলা কায়দায় হঠাৎ চতুর্দিক থেকে আক্রমণ চালায়, তাদের গেরিলা আক্রমণে পুলিশ দিশেহারা হয়ে জীবন বাঁচানোর জন্য অলিতে গলিতে আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনীর যখন এ অবস্থা তখন সাধারণ পাবলিক যাবে কোথায়। সুতরাং স্বাধীনতাবিরোধী এ সাম্প্রদায়িক দলটিকে কঠোর হস্তে দমন করা না হলে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন হবে। কারণ তারা সুযোগ পেলেই স্বাধীনতা সার্বভৌত্বের ওপর আঘাত আনতে সামান্যতম দ্বিধা  বোধ করে না। সে ক্ষেত্রে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ও অলি আহমেদ এর মতো লোক যারা মুক্তিযুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন করেছে তাদের ছেড়ে দিয়ে জামাইর আদর করবে সে কথা ভাবাটাও পাপ । সুতরাং সাধু সাবধান। ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব হতে পারে কিন্তু ভাইয়ের শত্র“কে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা কখনো মেনে নেয়া যায় না। কেউ যদি ব্যক্তি স্বার্থে করেন তবে তা দেশ বা জনগণের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। বিচলিত না হয়ে পারি না যখন অলি আহমদের মতে  একজন রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রাপ্ত বীরবিক্রমের মুখে দ্বিমুখী কথা শুনি। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মন্ত্রিত্ব না পেয়ে জোট সরকারের শেষের দিকে নানা দুর্নীতির প্রতিবাদ করতে থাকেন। বিশেষ করে ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চারদলীয় জোট সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠ। শুধু কি তাই তারেক রহমান গ্রেফতার হওয়ার  পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত  দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন এখনো  বড় দুর্নীতিবাজকে গ্রেফতার করা হয়নি। অবশেষে দুর্নীতির অভিযোগে তারেক জিয়া গ্রেফতার হয়ে জেলে যাবার পর তার রাগ অস্তমিত হয়। এহেন মাত্র তিন চার বছরের ব্যবধানে যখন সেই নেতার মুখেই ওই সকল  দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের  সঙ্গে এক মঞ্চে বসে তাদের প্রশংসা করেন তখন নিজেকে বুঝাতে বড় কষ্ট হয়। আর এটাই যদি হয় রাজনীতি তবে সেই রাজনীতিকে জনগণ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করবে। 

কারণ নীতিহীন রাজনীতি গণমানুষের কোনো উপকারে  আসে না। অবশেষে সৌদি আরবে আট বাংলাদেশির শিরোñেদের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বর্তমান আধুনিক বিশ্বে এই অমানবিক নির্মম জঙ্গি আইন বাতিলের দাবি রইল এবং সৌদি আরবে আট বাংলাদেশির শিরোñেদের পর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য বাংলাদেশে চলমান বিচার প্রতিক্রিয়ায় সৌদি আরব সরকারের আপত্তি থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই।
 মক্কা ও মদীনায় এক মাস
এম রেজাউল করিম
সারা পৃথিবীর মুসলমানদের ঐক্য ও মহামিলনের প্রতীক হজ। ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে নির্ধারিত তারিখ অর্থাৎ জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত কাবাঘরসহ সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে শরিয়ত নির্ধারিত কাজসমূহ সম্পাদন করাকে হজ বলে। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম হজ। শরীরিক ও আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনে একবার হজ করা ফরজ। তাই পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশে সৌদি আরবের মক্কা, মদীনা, আরাফাতের ময়দান এবং মুজদালিফায় দীর্ঘ এক মাস অবস্থান করেছি। সেখান থেকে ফিরে এক মাসের সফর বিবরণী পাঠকের দরবারে উপস্থাপন করতে চাই। আমার আজকের  লেখায় হজের ধর্মীয় অনুষঙ্গগুলো আলোচনার বাইরে রাখার চেষ্টা করব। কারণ ওই বিষয়ে জ্ঞানগরিমা আমার নেই বললেই চলে। আমি শুধু ভবিষ্যতে যারা পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশে মক্কা-মদীনায় যাবেন তাদের সাধারণ ধারণাদান, বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নীতি-নির্ধারক মহলের জন্য আরো যেসব জরুরি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন তা জানানো এবং পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশে সমগ্র পৃথিবী থেকে সে সব লাখ লাখ মুসলমান সৌদি আরব ভ্রমণ করেন তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট লাঘবে সে দেশের সরকারের আরো যেসব বিষয়ে নজর দেয়া আবশ্যক সেসব বিষয় এ লেখায় উল্লেখ করবো। দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সাধারণভাবে সরকারি অথবা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ পালনের জন্য সৌদি আরব গিয়ে থাকেন। সরকারিভাবে সকল হজযাত্রীর কাছ থেকে সমপরিমাণ অর্থ গ্রহণ করা হলেও বেসরকারি হজ এজেন্টরা এবার ২ লাখ ১৫ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত গ্রহণ করেছেন। অবশ্য যারা বেশি টাকা নিয়েছেন তাদের কেউ কেউ হজযাত্রীদের মক্কা-মদীনায় আল হারামের কাছাকাছি আরামপ্রদ স্থানে থাকার ব্যবস্থা করেছেন বলে শোনা যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি সস্ত্রীক বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এবার সৌদি আরব গিয়েছিলাম। সেখানকার আনুষ্ঠানিকতা, চলাফেরা, হোটেলে অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে সহজভাবে সম্পাদন করার জন্য স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোম্পানি ও মোয়াল্লেম বেছে নেয়াই উত্তম বলে বিবেচনা করেছি। তদনুযায়ী সেলিম ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলসের সঙ্গে আমরা প্রায় ৬৫ জন হজযাত্রী প্রথমে মক্কা নগরীতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রায় ৯ ঘণ্টার বিমান যাত্রা শেষে আমরা জেদ্দা বিমানবন্দরে উপস্থিত হই। সেখানে বাংলাদেশ হজ মিশনের কর্মীরা আমাদের সাহায্য করেন। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রাত ৮টা ৫৫ মিনিটে গালফ এয়ারের বিমানটি বাহরাইনে যাত্রা বিরতির পর জেদ্দায় পৌঁছে। দুর্ভোগ আর কাকে বলে? জেদ্দা বিমানবন্দর থেকে মক্কার উদ্দেশে বাস রওনা হওয়ার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর অমরা জানতে পারি মক্কার দিকে নয় বিপরীত পথে আমাদের বাস ছুটে চলেছে। রাস্তাঘাট চেনা না থাকায় চালক ভুল পথে রওনা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর আমাদের মধ্যে হতাশা আর উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। এমনিতেই সারা রাতে ক্লান্তি, তার ওপর যদি গন্তব্যে পৌঁছতে বিলম্ব হয় তাহলে তাকে দুর্ভোগ ছাড়া আর কি বলা যায়?
বাসচালক পথিমধ্যে গাড়ি থামিয়ে কয়েক দফা পথচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ভুল পথে যাত্রার বিষয়টি নিশ্চিত হন। অবশেষে বাসটিকে আবার জেদ্দা বিমানবন্দর হয়ে মক্কার পথে নেয়ার জন্য বাসটিকে উল্টো দিকে ঘোরাতে গিয়ে নতুন একটি সমস্যার উদ্ভব হয়। বিরাটাকৃতির বাসটিকে ব্যাক গিয়ারে নিয়ে ঘুরাতে গিয়ে মরুভূমিতে বালুর ভেতর দেবে যায় পেছনের দুটি চাকা। শত চেষ্টাতেও ওই চাকা দুটোকে মূল সড়কে আনতে না পারায় হজযাত্রীরা সবাই মুষড়ে পড়েন। কারণ, বাসের চালক সদ্য মিসর থেকে হজ মওসুমের বিশেষ ব্যবস্থায় সৌদি আরবে আসায় পথঘাট, পুলিশ, উদ্ধারকারী ক্রেন বিভাগের ফোন নম্বর কিছুই জানা ছিল না তার। আর ভাষা হিসেবে শুধু আরবি জানা থাকায় বাসের চালকের সঙ্গে হজযাত্রীরাও তাকে সাহায্যের ব্যাপারে কোনো কথাবার্তা বলতে না পারায় সকলেই অল্প সময়ের মধ্যে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। রাস্তা দিকে যে বাস, ট্রাক, কারই অতিক্রম করছিল যাত্রীরা তাদের প্রায় সবাইকে থামিয়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি বলতে পারা একজন পিকআপ চালক দয়াপরবশ হয়েÑ বলা যায় আমাদের সাহায্য করার লক্ষ্যেই তার গাড়িটিকে মূল সড়কে না থামিয়ে আমাদের বাসের পাশে সড়কের ঢালে পার্ক করলেন। তিনি অমাদের কাছ থেকে বাসের ভুল পথে আসা এবং বালুর মধ্যে ঢাকা দেবে যাওয়ার বিষয়টি সৌদি পুলিশসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে মোবাইল ফোনে জানানোর ব্যবস্থা কররেন। ঘন্টা খানেকের মধ্যে জেদ্দা থেকে একটি উদ্ধারকারী ট্রাক এসে আমাদের বাসটিকে টেনে মূল সড়কের ওপর আনার ব্যবস্থা করল। পরে তাদের তত্ত্বাবধানেই আরো প্রায় ১০/১২ কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে বাসটিকে পাশের বিপরীত মুখী ওয়ান ওয়ে সড়কে ঘুরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। এখানে একটা বিষয় বলা বিশেষ জরুরি আর তা হলো: আমাদের বাসটিকে যেখানে উদ্ধারকারী দলটি মূল সড়কে টেনে তুলেছিল তার পরে ৫/৬টি স্থান দিয়ে ১০ ফুট দূরবর্তী সড়কে বাস ঘোরানোর সুযোগ থাকলেও উদ্ধারকারী দল বাস বা তাদের উদ্ধার যানটি ঘোরানোর চেষ্টা করেনি। আমাদের দেশ ১০/১২ কিলোমিটার দূরে থাক ২০০/৫০০ গজের মধ্যে কোনোরকমে যানবাহন ঘোরানোর সুযোগ থাকলেই ব্যস্। নালা-নর্দমা-ফসল মাড়িয়ে গাড়ি ঘোরানো কেউ রুখতে পারবে না।
সকালের মধ্যেই যেখানে আমাদের মক্কা পৌঁছানোর কথা সেখানে দুপুর ৩টার দিকে আমরা হোটেলে পৌঁছে দুপুরের খাবার গ্রহণ করে টানা ঘুম দিলাম। আগের দিনের সারা রাতের জাগরণ এবং যাত্রাক্লান্তি দূর করে পরদিন সকাল থেকে ওমরাহ পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ এবং সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সায়ী করার কাজে আÍনিয়োগ করলাম। আমাদের আগে এবং পরে সারা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ মুসলমান মক্কা নগরীতে পদার্পণ করায় ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক...’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছিল। প্রত্যেকটি মুসলমান মক্কা নগরীতে অবস্থানকালে সারাক্ষণ নামাজ-বন্দেগীসহ ধর্মীয় কাজে নিজেদের ব্যাপৃত রেখেছেন। সকলেই চেষ্টা করেছেন তাহাজ্জুদের নামাজসহ প্রত্যেক ওয়াক্তে আল হারামে এসে নামাজ আদায় করতে। এত বিপুল সংখ্যক মুসলমানের নামাজ আদায়ের সময় আল হারামে ঢোকা এবং বিস্তৃত আল হারাম অঙ্গনে চলাফেরা করাতে স্বভাবতই কিছুটা অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি হয়েছে। হারাম শরীফে পর্যাপ্ত স্থান থাকা সত্ত্বেও অনেকে নামাজ শুরুর আগেই প্রাঙ্গণে বসে পড়ায় সমস্যা প্রকট হয়েছে। আগামী বছরগুলোতে হজযাত্রীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন আল হারাম কর্তৃপক্ষ। এগুলো হচ্ছে: প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাজ শুরু না হওয়া পর্যন্ত হারাম শরীফের গেট পর্যন্ত পৌঁছানোর সুবিধার্থে চলাচলের উš§ুক্ত রাখতে হবে। পেইন্ট দিয়ে প্রবেশ পথটুকু চিহ্নিত করে দিতে হবে অথবা ওয়াক্তে ওয়াক্তে দড়ি দিয়ে চলাচলের পথ চিহ্নিত করার জন্য পুলিশ অথবা স্বেচ্ছাসেবকদের মোতায়েন করা যেতে পারে। কোনো অবস্থাতেই নাম শুরুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কাউকে চলাচলের পথে বসতে দেয়া যাবে না। লক্ষ্য করা গেছে কর্তৃপক্ষ কখনো কখনো ‘এস্কেলেটর’ দিয়ে  বিপুল সংখ্যক মানুষকে হারাম শরীফের ছাদে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রাঙ্গণের মতো ছাদেও রাস্তার মধ্যেই সবাই বসে পড়েন। এক্ষেত্রে ছাদে এবং নিচের ‘প্রবেশ পথসমূহ’ চিহ্নিত করা ছাড়াও নির্দেশনা বোর্ড স্থাপন করতে হবে আরবি ছাড়াও ইংরেজি ভাষায়। এভাবে আল হারামে মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু করা সম্ভব। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: মক্কা ও মদীনাস্থ হারাম শরীফদ্বয় বর্তমানে বিশেষ কোনো দেশের সীমাবদ্ধতায় রাখা যথাযথ নয়। এ দুটি স্থান এখন আন্তর্জাতিক তার রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাই এখানকার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন ও উন্নয়ন সময়ের দাবি বটে। লক্ষ্য করা গেছে যে, আল হারাম থেকে মাঝে মধ্যে কিছু ঘোষণা দেয়া হয়Ñ যা শুধু আরবি ভাষায়। লাখ লাখ হজযাত্রীর মধ্যে অধিকাংশই তা বুঝতে পারেন না। তাই, ঘোষণাগুলো অন্তত আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজিতে ঘোষণা করা অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়াও সম্ভব হলে মাঝে মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য ভাষাভাষীদের সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় তা প্রচার করা যেতে পারে। এ ছাড়া আল হারামদ্বয়ের শত শত ফটকে, এর ভেতরে বাইরে নানান কাজে দায়িত্বরত হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সকলেই আরবি ভাষাভাষী হওয়ায় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আগত মুসল্লিরা প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হন। কোনো কিছু জানার জন্য ওইসব কর্মকর্তা- কমচারীর সঙ্গে তারা কথা বলতে পারেন না, এমনকি পুলিশ অফিসারদের শতকরা ৯৫ ভাগ আরবি ছাড়া অন্য ভাষা বলতে পারেন না। অথচ সৌদি সরকার সহজেই এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন। হজ  মৌসুমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বেতন ছাড়াই শুধু সেবামূলক কাজকর্ম করার জন্য এবং ভাষা সমস্যায় সহযোগিতা করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক চাওয়া হলে সব রাষ্ট্রই এ ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে ২০/৫০ জন করে স্বেচ্ছাসেবক নেয়া হলে স্বদেশের মুসল্লিদের তারা সহায়তা দান করতে পারেন। 

আমেরিকার মাদকযুদ্ধের অন্তরালে
মূল : নোয়াম চমস্কি
মনির তালুকদার
মেক্সিকোতে সহিংসতা এক ভয়াবহ বিভীষিকার রূপ ধারণ করেছে। ২০০৮ সালের প্রথম থেকে সেখানে, বিশেষ করে সিউদাদ জুয়ারোজে সহিংসতা ভয়াল রূপ নেয়। সেসময় থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে হিংসাÍক ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তবে যেখানে থেকে শুরু সেই সিউদাদ জুয়ারেজে নিহত হয়েছে প্রায় নয় হাজার সাংবাদিকরা ওই অঞ্চলে সবসময় ভয়ভীতির মধ্যে দিন অতিবাহিত করছেন। সম্প্রতি এল ডিয়ারিও পত্রিকার এক ফটোসাংবাদিককে হত্যা করেছে সন্ত্রাসী বলাবাহুল্য, বেশির ভাগ সহিংসতা মাদক সন্ত্রাসীদের হাত দিয়ে ঘটেছে। মেক্সিকোর সহিংসতা কেন এত ভয়ংকর রূপ নিয়েছে, কেন সেগুলোকে কোনো ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আর ওই সহিংসতার পেছনে কে বা কারা এর নেপথ্যে কাজ করছে, তার ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন স্বনামধন্য মার্কিন সমাজবিজ্ঞানি, বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘লা জরনাদার’ পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে তার ওই সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মাদক ব্যবসায়ী চক্র ও ওই ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে তারা অনেক গোপন অথচ চাঞ্চল্যকর তথ্য সংগ্রহ করেছেন। অথচ সে তথ্য তারা প্রকাশ করতে পারছেন না খুন হওয়ার ভয়ে। কারণ মাদক চক্রগুলো যে কাউকে হত্যা করার ক্ষমতা রাখে। আবার হত্যা করে তারা দিব্বি পার পেয়েও যায়। তবে তারপরও কেউ কেউ যে ওই বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করছে না তা নয়। যেমন লা জরনাদায় প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে, জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার পক্ষে মাদক বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত একজন বিশ্ব বিদ্যালয় অধ্যাপকের তথ্যানুসন্ধানে ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে, মেক্সিকোর প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যবসা  কোনো না কোনোভাবে মাদক চক্রের সঙ্গে জড়িত। ওইগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে মেক্সিকো সমাজের ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছে যাওয়া যাবে, যারা কখনই চাইবে না ওই বিষয়গুলো পত্রিকার পাতায় আসুক। চমস্কি বলেন, মেক্সিকো সরকারের কার্যকলাপ থেকে মনে হয় সরকার মাদক চক্রগুলোর কোন একটিকে অন্য একটির বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিচ্ছে। মাদক ব্যবসার অবসান ও মাদক চক্রগুলোকে নির্মূল করতে হলে সামরিক ব্যবস্থার দ্বারা হবে না বলে মনে করেন নোয়াম চমকিস্ক। তার মতে সেটার জন্য সমস্যার মর্মমূল যেতে হবে। সমস্যার আংশিক সমাধান পাওয়া যাবে সাবেক তিন প্রেসিডেন্ট জেদিল্লো, কারভোসো ও গাভিনিয়ার বক্তব্য থেকে। তারা এক যুক্ত ঘোষণায় বলেছেন যে, মাদক ব্যবসার দুর্বৃত্তরায়ন  থেকে ওই সমস্যার সৃষ্টি। তাদের মতে, মাদক ব্যবসাকে এক অর্থে বৈধতা দিতে হবে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যেমন করা হয় অন্যান্য এ্যালাকোহলের ক্ষেত্রে। তা হলেই আর এ নিয়ে অপরাধী চক্রের সিন্ডিকেট ও আর তৈরি হবে না। নোয়াম চমস্কি মনে করেন মাদক সমস্যাটা মেক্সিকোর নয়- যুক্তরাষ্ট্রের। এই সমস্যার সঙ্গে যেহেতু চাহিদা ও লেগানোর সম্পর্ক আছে তাই সমস্যা যুক্তরাষ্ট্রের সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। তার বক্তব্য হলো যুক্তরাষ্ট্র যে মাদকযুদ্ধ চালাচ্ছে তার একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে বাহুল্য জনগোষ্ঠীকে সরিয়ে দেওয়া আর সেটা হবে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী। সে জন্য মাদকযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে কারারুদ্ধ করার হার অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। তুলনীয় দেশগুলোর চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এই হার হয়তো ৫ গুণ কী ১০ গুণ। যুক্তরাষ্ট্রের ওই হারাটাই সম্ভবত বিশ্বের সর্বাধিক। ওই লক্ষ্য হলো প্রধানত কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষরা। আমেরিকার ইতিহাস মূলত দাসত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। দাসপ্রথা উঠে যাবার পর বছর দশেক কৃষ্ণাঙ্গরা আনুষ্ঠানিক অর্থে মুক্ত ছিল। কিন্তু তারপর কারাবরণ রোধের মাধ্যমে দাস প্রথা আবার চালু হয়ে যায়। ১৮৭০-এর দশক নাগাদ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে আইন পাস হয় এবং কেন্দ্রীয় সরকার সেসব আইন অনুমোদন ও করে। ওইসব আইনে একান্তভাবেই কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনের দুর্বৃত্তায়ন ঘটানো হয়। রাস্তার পাশে কোন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষকে দাঁড়িতে থাকতে দেখা গেলে ভবঘুরে বৃত্তির জন্য তাকে গ্রেফতার করা যেত। কেউ যদি অভিযোগ করত সেই কৃষ্ণাঙ্গটি একজন শ্বেতাঙ্গ রমনীর দিকে কুনজর দিয়েছিল তাহলে তাকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার করা যেতো। সেক্ষেত্রে খুব অল্প সময়ে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের এক বিরাট অংশের স্থান হয় কারাগারে। ফলে তারা নতুন দাস শ্রমশক্তিতে পরিণত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প বিপ্লবের একটা বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত খনিতে নিয়োজিত কারাগার থেকে ইজারা নেয়া দাস শ্রমশক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবধি ওই অবস্থা চলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শ্রমের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনীতিতে একটা তেজীভাব আসে যা ২০ বছর ধরে চলে ১৯৫০ ও ১৯৭০ দশক অবধি স্থায়ী হয়। এ সময় কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষরা দেশের শ্রমিক বাহিনীর সঙ্গে একাÍ হয়ে যেতে শুরু করে। তারা সেসময় মোটর গাড়ি কারখানায় কিংবা অন্য কোনো ভাল চাকরি পেতে পারত, বাড়ি কিনতে পারত, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে পারত। ১৯৭০ সালের মধ্যে সে অবস্থা শেষ হয়ে যায়। অর্থনীতি লগ্নিকায়িত হয়, উৎপাদন বাইরের দেশগুলোতে স্থানান্তরিত হতে থাকে। শিল্পকারখানার চাকরির সুযোগ বহুলাংশে হারিয়ে যায়। ওই অবস্থায় কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কী করণীয় এর জবাব ছিল মাদকবিরোধী যুদ্ধের নামে ওদের আবার কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া। এইভাবে চিরাচরিত মার্কিন কায়দায় সামাজিক শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়। এ হলো মাদকযুদ্ধের একটা দিক। অন্যদিকটা হলো অস্ত্র। মেক্সিকোর মাদকচক্রগুলো কোথা থেকে অস্ত্র পায়? সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রই তাদের অস্ত্র যোগায়। অস্ত্রের প্রবাহ বন্ধ করে দিতে হবে। এতে করে সহিংসতা একেবারে বন্ধ হবে তা নয়। তবে এর বড় ধরনের প্রভাব হয়তো পড়বে। চমস্কি মনে করেন মাদক সন্ত্রাসের পেছনে উত্তর আমেরিকা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা নাফতা’র ভূমিকা আছে। আগে মার্কিন মেক্সিকো সীমান্ত ছিল উš§ুক্ত। তখন লোকজন আÍীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্য সীমান্ত দিয়ে অবাধে যাওয়া আসা করতে পারত। তবে নাফতা চালু হবার পর ১৯৯৪ সাল থেকে ওই সীমান্তের সামরিকীকরণ শুরু হয়। সীমান্তের কাছে মেক্সিকোর বিশাল বিশাল এলাকা আগে যেখানে কৃষিকাজ হতো এখন সেখানে আফিম চাষ হচ্ছে। প্লেন থেকে দেখা যায়, তবে সেখানে যাওয়া যায় না। প্রথমত মাদক চক্রগুলো এসব আফিম ক্ষেত কড়া পাহারায় রাখে। সেনাবাহিনীও ওই কাজে তাদের সাহায্য করে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রে মাদকের অতৃপ্ত চাহিদা, যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকোতে অস্ত্রের সার্বক্ষণিক যোগান এবং নাফতার প্রভাব এগুলোর মোকাবেলায় মেক্সিকোর কী করার থাকতে পারে সে প্রশ্ন তুলেছেন চমস্কি। চমস্কি মনে করেন মারিজুয়ানা, কোকেন, হেরোইন প্রভৃতি মাদকদ্রব্যকে বৈধতা দিয়ে এগুলোর ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলে মাদক নিয়ে দুর্বৃত্তায়ন অনেক কমে আসবে। আর দুর্বৃত্তায়ন কমলে সহিংসতা ও কমবে। মার্কিন মাদকযুদ্ধকে চমস্কি জনগণকে নিয়ন্ত্রণের একটা হাতিয়ার হিসেবেও দেখেন। কিছুদিন আগে ওই বিষয়টিকে অন্যত্র ব্যাখ্যা করে চমস্কি বলেছেন, প্রতিটি সমাজে তা সেটা সামরিক একনায়কত্বই হোক আর গণতন্ত্রই হোক, জনগণকে নিয়ন্ত্রন করার একটা চিরাচরিত ও স্বাভাবিক উপায় হলো তাদের ভীতসন্ত্রস্ত হলে তারা তাদের ঊর্ধ্বতনের কাছে কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে রাজি হবে যারা তাদের রক্ষা করবে। তারা এই ধরনের যুক্তি দেবে, ‘ঠিক আছে, আমি তোমাকে আমার জীবন পরিচালনা করতে দেব যাতে করে তুমি আমার নিরাপত্তা বিধান কর।’ যুক্তরাষ্ট্রেরও সেই সমস্যা আছে যেখানে জনগণ সবসময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তারা যাতে নিষ্ক্রিয়, নির্লিপ্ত এবং অনুগত থাকে, আর ক্ষমতা বা সুযোগ সুবিধার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করে সেটা সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হয়। বিভিন্ন ব্যবস্থার একটা হচ্ছে জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করা এবং সেটা করার একটা কৌশল হচ্ছে মাদক ভীতি ও অপরাধ ভীতি সঞ্চারিত করা। এ কাজটা রাষ্ট্র ও ব্যবসায়ী প্রচারের মাধ্যমে করা হয়। মাদক যুদ্ধ হলো বিপজ্জনক লোকজন সম্পর্ক জনমনে ভীতি জাগ্রত করা যাদের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করা প্রয়োজন। এটা কথিত ‘বিপজ্জনক- শ্রেণীগুলোকে’ বাহুল্য জনগোষ্ঠীকে যাদের সম্পদ ও মুনাফা সৃষ্টির কাজে অবদান রাখার মতো সত্যিকারের কোন কাজ নেই তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা প্রত্যক্ষ রূপ ও বটে। চমস্কি বলেন,  যুক্তরাষ্ট্রে এই বিপজ্জনক শ্রেণীর লোকদের যে জেলে পোরা হয় শুধু তাই নয়, তাদেরকে মেরে ফেলাও হয়। আশির দশকে আর্থিক নীতির কারণে মার্কিন সমাজে অসাম্য অনেক বেড়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সুষ্ঠিমেয় কিছু লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। সমাজের শীর্ষ ভাগে অতি সামান্য কয়েক শতাংশ মানুষ অতিমাত্রায় ধনবান হয়েছিল, অন্যদিকে মধ্যবিত্তের আয় সত্তরের দশক থেকেই স্থবির হয়ে পড়ে ছিল। সেক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক মানুষ হয়ে পড়েছিল। নিরাপত্তাহীন, সংকট ও দুর্দশা কবলিত। এদের একটা বড় অংশকে মূলত গ্রেফতার করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে ছিল। এ কারণে যে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

প্রতিবন্ধীদের করতে প্রয়োজন প্রযুক্তিশিক্ষা
মোঃ আবুল হাসান ও খন রঞ্জন রায়
আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। জাতিসংঘের আহ্বানে ১৯৯২ সাল থেকে এ দিনটি বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে। জš§গত অধিকার, বৈষম্যহীনতার প্রতি সম্মান, সম সুযোগ, সম অংশগ্রহণ এবং স্বাধীনতার প্রতি সম্মানের মূলনীতিই এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য। জাতিসংঘভুক্ত ১৯৯টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও আজ এই দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করছে। সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলো আয়োজন করবে সভা, সেমিনার, র‌্যালি। দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ নিবন্ধ। এছাড়াও বাংলাদেশে প্রতি বছর এপ্রিল মাসের প্রথম বুধবার পালিত হয় জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস। ৩ ডিসেম্বর সমগ্র বিশ্বের প্রতিবন্ধীদের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ দিন তেমনি এপ্রিল মাসের প্রথম বুধবার বাংলাদেশের  প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস। শারীরিক ও মানসিক ত্র“টির কারণে জীবনের স্বাভাবিক গতি যাদের বাধাগ্রস্ত, তাদের বলা হয় প্রতিবন্ধী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ প্রতিবন্ধী। সেই হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১ কোটি ৬০ লাখ। পুরুষ ও নারী প্রতিবন্ধীর অনুপাত ৪৮ ঃ ৫২। শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রতিবন্ধী ৩৮ লাখ, মানসিক প্রতিবন্ধী ৪২ লাখ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ৩৩ লাখ, বাক শ্রবণ এবং নানাবিধ প্রতিবন্ধী ২৫ লাখ। সিএসআইডি পরিচালিত গবেষণায় দেশের ৪০.৯৫ ভাগ নারী ও কিশোরী প্রতিবন্ধিতার শিকার হয় জš§গত কারণে, ৩.৩২ ভাগ শিকার হয় ভুল ও অপ চিকিৎসায়। এছাড়া বিভিন্ন অসুখ জ্বর, পোড়া ও দুর্ঘটনায় ৫৫.৭৪ ভাগ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সাড়ে ৩ যুগ অতিক্রান্ত হলেও  মোট জনসংখ্যার এক দশমাংশ প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে বাস্তবভিত্তিক কোনো উদ্যোগ বা অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। এদেশের প্রতিবন্ধীরা বড়ই অসহায়। আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতো তাদের সামাজিক সব অধিকার ভোগ করার কথা থাকলেও তারা বরাবরই থাকে বঞ্চিত। আত্মীয় স্বজন সামাজিক মান মর্যাদার ভয়ে তাদের দূরে সরিয়ে রাখেন। পারিবারিকভাবে স্বাভাবিক মর্যাদা উপভোগ করার সুযোগ পায় না। তাদের অবাধ চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। শিক্ষা, চাকরি, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, বিয়ে, প্রজনন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে  বৈষম্যের কারণে তারা সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে পারে না। প্রতিবন্ধীরা বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবারের। কেউ বা পরিবারের প্রধান ব্যক্তি যার আয়ের ওপর নির্ভরশীল গোটা পরিবার। পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রতিবন্ধী সেই মানুষটিকে নামতে হয় জীবনের কঠিন যুদ্ধে। দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় সুস্থ সবল ও শিক্ষিত এক ব্যক্তিকে যেখানে কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়, সেখানে একজন প্রতিবন্ধীর অসহায়ত্ব প্রকট থেকে প্রকটতর হওয়াই স্বাভাবিক। ফল হয় অধিকাংশ প্রতিবন্ধীর ভিক্ষাবৃত্তি। আমাদের দেশে প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করতে হয় নারী প্রতিবন্ধীদের। কিশোরী প্রতিবন্ধীদের যৌতুকের জন্য বিয়ে দীর্ঘায়িত হয়, সংসার গড়ার আগেই ভেঙ্গে যায়। ফিরে আসেন মা-বাবার বাড়িতে। বিধবা প্রতিবন্ধী পিতাবিহীন সন্তান লালন পালনে পিতা-মাতার সংসারে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেন। এক সময় ভিক্ষাবৃত্তি বা পতিতালয় হয় তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। প্রতিবন্ধীদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তারা আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা আমাদের ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, মা-বাবা। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের জন্য বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সেমিনার, ওয়ার্কশপ, র‌্যালির আয়োজন করা হয়। ধর্মীয়ভাবেও একজন প্রতিবন্ধীর মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষায় মানুষকে কর্তব্য সচেতন হওয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ২৯ নং ধারায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমসুযোগ, সম অংশগ্রহণ, সমঅধিকার রক্ষায় নির্দিষ্ট আইন রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিবন্ধীদের আমানত গ্রহণ, ঋণ প্রদান ও ব্যাংক হিসাব খুলতে সহযোগিতা করাসহ সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা দিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ  দেয়া আছে। জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতি বছর অর্থ বরাদ্ধ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দশক ২০০৩-২০১২ বিওয়াকো মিলেনিয়াম ফ্রেমওয়ার্ক ফর একশনের (বিএমএফ) ৭টি অগ্রাধিকারযোগ্য ক্ষেত্রকে গুরুত্ব ও বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সেগুলোও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে- (১) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আত্ম সহায়ক সংগঠন, সংশ্লিষ্ট পরিবার ও অভিভাবকদের প্রতিষ্ঠার উন্নয়ন, (২) প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন, (৩) সূচনায় শনাক্তকরণ দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শিক্ষা, (৪) আত্মকর্মসংস্থানসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান, (৫) নির্মাণ কাঠামোগত পরিবেশে প্রবেশগম্যতা ও সর্ব সাধারণের জন পরিবহন যান, (৬) তথ্য যোগাযোগ এবং সহায়ক প্রযুক্তিসহ যোগাযোগের প্রবেশগম্যতা ও (৭) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সক্ষমতা উন্নয়ন  সামাজিক নিরাপত্তা এবং দীর্ঘস্থায়ী জীবিকা কর্মসূচির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২০০টি সংগঠন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কাজ করছে। এদের মধ্যে অনেক সংগঠন প্রতিবন্ধীদের আবেগ সৃষ্টি করে কোটি কোটি টাকা ফায়দা লুটছে। বিশ্বের ৭০ কোটি প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় সারাবিশ্ব সোচ্চার। জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনিসেফ, ইউএনডিপি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গত ২০০৩-২০১০ এই আট বছরে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবগুলো দেশ প্রতিবন্ধীদের ৭টি অধিকার বাস্তবায়নে ৮৫ শতাংশ অর্জন করেছে। বাকি ১৫ শতাংশ বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী দুই বছর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত না হলে কিংবা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত না হলে ২০১২ সালের পূর্বে উপরোক্ত ৭টি অধিকার পূর্ণতা লাভ করবে। দেশসমূহ অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছে তাদের দেশের তৃণমূল পর্যায়ে ডিপ্লোমা প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতার মাধ্যমে। বিএমএফ এর ৭টি শর্তই কর্মমুখী শিক্ষা সংশ্লিষ্ট। ডিপ্লোমা প্রযুক্তি শিক্ষা একজন প্রতিবন্ধীকে জন সম্পদে পরিণত করে। ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জনের পর কর্মে হাতছানি দিয়ে ডাক দেয়। প্রতিবন্ধীরা প্রযুক্তি শ্রমের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠে। তাদের শ্রম ঘণ্টা জাতীয় আয়ের একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অনেক দেশে প্রতিবন্ধীদের ডিপ্লোমা শিক্ষার হার ৭০ শতাংশ। ২০১২ সালে এই হার ১০০ শতাংশে উন্নীত হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিবন্ধীদের ডিপ্লোমা প্রযুক্তি শিক্ষার হার শূন্য। প্রতিবন্ধীদের উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সহ সামাজিক পরিবেশের মাধ্যমে তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানো গেলে তাদের মধ্য থেকে সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী,  বৈমানিক, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, নার্স, কৃষিবিদ, বয়নবিদ, লাইব্রেরিয়ান, ব্যাংকার, শিল্পোদ্যোক্তা, খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী, সংগীত শিল্পী কিংবা গুণী লেখক সৃষ্টি হতে পারে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে তারাও উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় অবদান রাখতে পারবেন।
অন্ধ কবি হোমার, ইলিয়ট, উইলিয়াম শেক্সপিয়র সাহিত্যাঙ্গনে উজ্জ্বল নক্ষত্র। মানব সেবায় কিংবদন্তি হয়ে আছেন জš§গত বধির হেলেন কেলার। বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবন্ধীতে পরিণত হলেও তার গবেষণা কর্ম গোটা বিশ্বকে অবাক করছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট প্রতিবন্ধী হয়ে বিশ্ব নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেছেন নিপুণ হাতে। অন্ধ পাইলট মাইলস্ হিলটন দেশের পর দেশ ক্লান্তিহীনভাবে ঘুরে  বেড়াচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীরা উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ পেলে উন্নত বিশ্বের প্রতিবন্ধীদের মতো জেগে উঠতে পারে যা আমরা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে লক্ষ্য করতে পারি। বাংলাদেশের বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরা বিশ্ব অলিম্পিকের শ্রেষ্ঠ পদক অর্জন করেছে। আধুনিক বিশ্বে প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পূর্ণ জনশক্তি, উন্নয়নের প্রধান পুঁজি। বিশ্বায়নের এ যুগে বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞান ছাড়া প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন সম্ভব নয়। দার্শনিক সক্রেটিসের মতে ডিপ্লোমা শিক্ষা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে অর্থবহ করে  তোলে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রতিবন্ধীরা ডিপ্লোমা প্রযুক্তিবিদ্যা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মানব সম্পদে পরিণত হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে একজন নাগরিক হিসেবে সকল অধিকার ভোগ করার কথা থাকলেও বাংলাদেশের দেড় কোটি প্রতিবন্ধীর প্রযুক্তি শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সকল প্রকার বাধা বিঘœ অতিক্রম করে প্রতিবছর ৯টি মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২ লাখ ১৭ হাজার প্রতিবন্ধী এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। তাদের ৯০ শতাংশের বাস গ্রামে। তাদের মধ্যে অনেকে আছেন নারী কিংবা এতিম। এসব প্রতিবন্ধী অভিভাবকের সহযোগিতার মাধ্যমে গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলার হাইস্কুলে অধ্যয়ন করেন। তাদের জীবনের বাকি সিঁড়িগুলো আর অতিক্রম করতে পারেন না কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে। এদেশে যতগুলো ডিপ্লোমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়েছে সবগুলোই রাজধানী শহর ঢাকা ও বিভাগীয় শহরে। বরেন্দ্র, হাওর-বাঁওড়, পাহাড়ি, উপকূল, সীমান্তে কোনো ডিপ্লোমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়নি। প্রতিবন্ধীদের খাওয়া, নিদ্রা, গোসল, প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ডগুলোর জন্য অপরের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। নারী প্রতিবন্ধীদের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। এসব কারণে প্রতিবন্ধীরা রাজধানী ও বিভাগীয় শহরে গিয়ে কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। তৃণমূল প্রতিবন্ধীদের কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণ করতে গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলায় ডিপ্লোমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ডিপ্লোমা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকর্মী ভিন্ন মতাবলম্বীর বোর্ড, কাউন্সিল, ফ্যাকাল্টি দুর্গম এলাকায় ডিপ্লোমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। এ বাধা দূর করতে প্রশাসনিক বিভাগ অনুযায়ী ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। আগামী ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব পালন করব। তখন আমরা এক নতুন বাংলাদেশ দেখতে চাই। যেখানে প্রতিবন্ধী প্রতিটি যুবক মহেশখালী থেকে ঢাকা পর্যন্ত ডিপ্লোমা প্রযুক্তিবিদ্যা শিক্ষার সুযোগ পাবে। প্রযুক্তি জ্ঞানের মাধ্যমে একটি সম্মানজনক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাদের কর্মের সুফল বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে। দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিবন্ধীরা সকলের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস হয়ে উঠবে সফল, সার্থক ও গৌরবময়। 

লেখকদ্বয়: কলামিস্ট