Year-18 # Issue-45 # 25 December 2011

রাজ্জাকের চলে যাওয়া: একটি নক্ষত্রের পতন
আকরাম খান
বাংলাদেশে তখন স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির পুনরুত্থান-পুনর্বাসনের কাজ সমান্তরাল গতিতে চলছে। রাজনীতিতে মোহগ্রস্ত নেতা কর্মী এমনকি সমর্থক সাধারণ মানুষ ও দ্বিধাবিভক্ত। ক্ষমতাকেন্দ্রিক নষ্ট রাজনীতির বেড়াজাল ভেদ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব নিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ‘৯০-এর দশকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সকল শক্তি আবার একত্রিত হয়ে একটি অরাজনৈতিক প্লাটফরমে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসসহ পাকিস্তানি দালালদের প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ করে। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের পক্ষে সেই ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আমাদের স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের বাঁকে বাঁকে অসম সাহসী, সফল সংগঠক, দলমতনির্বিশেষে সকলের প্রিয় নেতা আঃ রাজ্জাক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার পরিচয় দিতেন ‘আমার রাজ্জাক’ বলে। ২৩ ডিসেম্বর ২০১১ তার প্রিয় মাতৃভূমি আর প্রিয় বাঙালিদের মাঝ থেকে তিনি চলে গেলেন চিরদিনের জন্য। অনেক কিছুই তার অপূর্ণ রইল, প্রাপ্যতার  সামান্যতম প্রতিদান  দিতে ব্যার্থ  হলো জাতি, অনাদর-অবহেলা-অবমূল্যায়নের কলঙ্ক রয়ে গেল তার আজš§ গর্বের সংগঠন আওয়ামী লীগের কাঁধে।
    স্থানীয় পর্যায়ে ঘাতকদালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির নেতৃত্ব দেয়ার সুবাদে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে অন্তত দু’বার জননেতা আঃ রাজ্জাক এর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। একবার আমার নিজ উপজেলায়, আর একবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ১৯৯৩ সালে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলা সদরে সমন্বয় কমিটির সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষে এক জামায়াত কর্মী নিহত হয়। তখন শহীদ জননীর সঙ্গে রাজ্জাক ভাইও এসেছিলেন মধুখালীতে। গাড়ী থেকে নেমেই হাসি মুখে বলেছিলেন, -কিরে ভয় পেয়েছিস? মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েছিলাম,-না। তারপর পিঠে হাত রেখে আস্তে আস্তে বললেন, ওদের মৃত্যুর জন্য আমরা দায়ী নই, অনেক ছাড় দিয়েছি, ওদের কর্মই এজন্য দায়ী। যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচারে গঠিত গণআদালতে শুনানির দিনের একটি বিশেষ মুহূর্তের কথা আজ বেশি মনে পড়ছে। পুলিশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে রেখেছে। সারাদেশ থেকে আসা হাজার হাজার সমন্বয় কমিটির নেতাকর্মী আর উৎসুক জনতার ঢল উদ্যানের চারপাশে। পুলিশ কাউকেই  ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের বর্তমান ফ্লাই ওভারের খানিকটা পশ্চিমে শাহবাগের দিকে আমরা অবস্থান করছি। রাস্তা জুড়ে কেবলই মানুষ আর মানুষ। রাজ্জাক ভাই জনতার কাতারে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। সকলেই চিৎকার করে বলছে, নেতা হুকুম দিন, কি করতে হবে? দেখলাম নেতার চোখে মুখে দৃঢ় প্রত্যয় অথচ স্বভাবসুলভ হাসিমুখে কোনো নির্দেশ ছাড়া যেন অপেক্ষার কথাই বলছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই জনউপস্থিতি জনরোষে পরিণত হতে লাগল। ঠিক তখনই খুব কাছে থেকে রাজ্জাক ভাইয়ের ভরাট কণ্ঠের বজ্রধ্বনি ভেসে এলÑ‘দেয়াল ভেঙ্গে ফেল ।’ মুহূর্তের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের  দেয়াল ভেঙ্গে জনতা গণআদালতে প্রবেশ করল। পুলিশ বোকার মতো কেবল দাঁড়িয়ে দেখল জনতার শক্তি, নেতার প্রতি মানুষের আস্থার বহিঃপ্রকাশ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর আদেশ, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থেক’ এরপর আঃ রাজ্জাক ছাড়া আর কোনো নেতার কাছ থেকে এমন সময়োপযোগী নির্দেশ আমি শুনিনি। আমরা যারা  আঃ রাজ্জাককে  এভাবে কাছ থেকে দেখেছি তাদের কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেমন একজনই তেমনি আঃ রাজ্জাকও একজন মাত্র সন্দেহ  নেই।
    মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর সেক্টর কমান্ডার আঃ রাজ্জাকের বর্ণিল রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে দেশের কোনো মানুষেরই অজানা নেই। দলের দুঃসময়ে প্রধান নেতা যখন একটি আসন থেকে পরাজিত হয়েছেন, আঃ রাজ্জাক তখনো দুটি আসনে জয়লাভ করে জনপ্রিয়তার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। একদিকে তিনি সাধারণ কর্মী-সমর্থক এবং জনগণের ভালোবাসা কুড়িয়েছেন অফুরন্ত, অন্যদিকে ভালোবেসে সকলের পাশে দাঁড়িয়েছেন ক্ষমতার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেছেন অন্তরে বাইরে সমানভাবে। ঋণ করে চিকিৎসা ব্যয় মেটানো আর সাহায্য নিয়ে পথ্য কেনা রাজনৈতিক নেতা এদেশে খুঁজে পেতে আমাদের যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করতে হবে, আঃ রাজ্জাকের মতো জাতীয় নেতার জন্য সহস্রাব্দ হয়তবা।

জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি মৃত্য। তবুও অনেক মৃত্যু জীবনকে উপহাস করে, সমাজ-রাষ্ট্র-সভ্যতাকে সম্পূর্ণ দায়মুক্ত করতে পারে না। সভ্যতার বিচারে নয়, জাতি রাষ্ট্রকে বাদ দিলেও নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধা নেই। আমরা কতটুকু দিতে পারলাম এই মহান  দেশপ্রেমিক, গণমানুষের হিতাকাক্সিক্ষ, সবার প্রিয়, অতি সাধারণ আদর্শবাদী এক মহান নেতাকে?  বঙ্গবন্ধুর মতো দৃপ্ত পায়ে  হেঁটে শরীয়তপুরের কাদামাটি আর প্রান্তিকজনের সোঁদা গন্ধ গায়ে মেখে নক্ষত্রের মতো আপন শক্তিতে ভালোবেসে এদেশের মাটি ও মানুষকে ঋণী করে গেলেন তিনি। আমরা দেখলাম প্রচলিত ধারার রাজনীতির সংকীর্ণতা ভেদ করে ডামুড্যা- গোঁসাইরহাটের মানুষের শোক বিহ্বলতা, পারিবারিক স্বজনদের মতো  সমস্বরে মুখ ফুটে কান্না, আর অভিবাবকহীনতার হতাশা কত গভীর! যে মানুষটি  নিজেকে চিরদিন আড়ালে রেখে গণমানুষের দুঃখ দুর্দশাকে প্রকাশ করার নিরন্তর প্রচেষ্টা করে গেছেন, সেসব মানুষের আহাজারিতে দেশের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠল, আওয়ামী লীগের আদর্শবাদী অনেক নেতা কর্মীকেই অশ্র“ লুকিয়ে কাঁদতে হলো, অপ্রকাশ্যে রাজদণ্ডে দণ্ডিত এদশের সক্রেটিস আঃ রাজ্জাক তবুও ক্ষমা চাইলেন না। প্রতিবেশী দেশে চিকিৎসারত অবস্থায় চিকিৎসকদের সকল বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে ২০১১ সালের জাতীয় শোক দিবসে  জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে ফুল দিতে ছুটে এলেন ঢাকায়। নিশ্চয় তিনি উপলব্ধি করেছিলেন অন্তরে-বাইরে ধারণকৃত রাজনীতির আদর্শপুরুষের মৃত্যুবার্ষিকীতে আর হয়ত যাওয়া হবে না তার। ওই দিন বঙ্গবন্ধু ভবনে অসুস্থ হয়ে পড়লে সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবু কারো বিরুদ্ধেই কোনো অভিযোগ, অনুযোগ ছিল না তার। অস্ফুট অভিমানের দহনে পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেলেন তিনি। অর্থের অভাবে সময়মতো চিকিৎসা হলো না তার। ’৭১-এর সাড়ে সাত কোটি বাঙালির উত্তর প্রজš§ ১৬ কোটি নাগরিক এদেশে। কেউ চাইলেই এক টাকা হারে সাহায্য দিলেও অন্তত সাড়ে সাত কোটি টাকার সংস্থান করা সম্ভব ছিল। তথাপি এটাই হতে পারত তার জীবনের শেষ পরিণতি। মৃত্যুই সত্য, ব্যর্থ প্রচেষ্টাকে আমরা তবু সান্ত্ব—নার উপযুক্ত স্থান করে দিতে সক্ষম হতাম। ঘাতকদের হাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর আমরা কেউ প্রাণ খুলে কাঁদতেও পারিনি। তার প্রিয় উত্তসূরির মৃত্যুতে আমরা চিৎকার করে কেঁদে বুকটা হালকা করতে পারতাম। কোথায় যেন একটা লঘু বিদ্বেষ, গুরুদণ্ডের উৎসাহ জুগিয়ে তার প্রতি অনাদর অবহেলার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেমন হয়েছিল শহীদ তাজউদ্দীনের বেলায়। ১৯৬১ থেকে ’৭১, তারপর ’৭৫-এর পর থেকে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মীই জানতেন এবং বিশ্বাস করতেন আঃ রাজ্জাকই বঙ্গবন্ধুর একমাত্র যোগ্য উত্তরসূরি। তথাপি দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আর সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাঁধে দলের নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়া দেশপ্রেম বৈকি!  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই ব্যথিত হবেন এ কারণে যে, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুজিব বাহিনীর একজন সেক্টর কমান্ডার, ’৬৬ সালের ৬ দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নিউক্লিয়াস আর ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সফল সংগঠক আঃ রাজ্জাককে জীবনের শেষ প্রান্তে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র উপযুক্ত প্রতিদান থেকে অকেটাই বঞ্চিত করেছে। এ দেখে ভবিষ্যতে নিঃস্বাথর্, দেশপ্রেমিক, সজ্জন ব্যক্তিবর্গ রাজনৈতিক অঙ্গনে পা বাড়াতে নিরুৎসাহিত হবে। ফলে তোষামোদী মোসাহেবরা একদিন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যাবে নির্দ্বিধায়। মারাÍক বিপর্যয় নেমে আসবে দেশ এবং দেশের মানুষের ওপর। শেষ পর্যন্তু সব সংকোচ, সব বিদ্বেষ, সব অনুতাপ অগ্রাহ্য করে সর্বস্তরের গণমানুষের অশ্র“ভেজা ফুলে ফুলে ভরে গেল মহান নেতার কফিন। চিরসুখ বঞ্চিত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের অভিমানী সুর ধ্বনিত হলো তার প্রাণহীন দেহের নীরব ভায়ায়-‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তারে দিতে এল ফুল।’ তবু দলমতনির্বিশেষে সকলের  শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় শেষবারের মতো সিক্ত হলেন তিনি। দলীয় নেতা হয়েও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার মরদেহ বাংলাদেশ এবং বাঙালির অভিন্ন সুখ দুঃখের কথাই ব্যক্ত করল নিভৃতে। আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম একটি নক্ষত্রের কক্ষচ্যুতি, ১৬ কোটি গ্রহ-উপগ্রহের ওপর আছড়ে পড়ে আন্দোলিত করল  সবার কক্ষপথ। অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র্রীয় অভিবাদনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ইতিহাসের একটি স্মরণীয় অধ্যায়। জীবন সায়াহ্নে কি দারুণ অভিমান আর অব্যক্ত জ্বালা ছিল তার নীরব প্রতিবাদের ভায়ায় আমরা সব জানি না। শুধু জানি, ব্যক্তিগতভাবে কেবল পরিবার পরিজনই নয়, দেশের সকল মানুষ- বিশেষ করে মুক্ত স্বদেশে মুক্তির আশায় ছুটে চলা গরিব মেহনতি,  আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসাম্প্র্রদায়িক মানবতাবাদী সকল মানুষই ছিল তার আপনজন, একান্ত প্রিয়। মৃত্যুতেই জীবনের পূর্ণতাÑশুধু দুঃখ হয় শরৎ চন্দ্রের দেবদাসের মতোই একজন দেশপ্রেমিক আঃ রাজ্জাকের জন্য। ‘প্রার্থনা করিও এমন করিয়া কাহারও যেন মৃত্যু না হয়। মরিবারকালে তাহার প্রিয়জনের চোখে এক ফোঁটা জল দেখিয়া সে যেন মরিতে পারে।’
সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশ
প্রাথমিকে পাসের হার ৯৭.২৬
ইবতেদায়ীতে ৯১.২৮ শতাংশ

সিদ্দিকুর রহমান
গতকাল সোমবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা-’১১ ও ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষা-’১১ এর ফল সারাদেশে একযোগে প্রকাশিত হয়েছে।  প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় চলতি বছর ৯৭ দশমিক ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। আর ইবতেদায়ীতে এবার পাসের হার ৯১ দশমিক ২৮ শতাংশ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মো. আফছারুল আমীন গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফলাফলের অনুলিপি হস্তান্তর করেন। এরপর মন্ত্রী দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল প্রকাশ করেন। এবারের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় বিভিন্ন ধরনের ৮৭ হাজার ৮৩২টি বিদ্যালয়ের ২১ লাখ ৮৫হাজার ৭৪৭ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ২১ লাখ ২৫ হাজার ৮৬৯ জন পরীক্ষার্থী সকল বিষয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। উত্তীর্ণদের মধ্যে ছাত্র ৯ লাখ ৭৫ হাজার ৫২৯ জন (৪৫.৮৯ শতাংশ) ও ছাত্রী ১১ লাখ ৫০ হাজার ৩৪০ জন (৫৪.১১ শতাংশ)। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৬৭৩ জন (৪.৯৭ শতাংশ)। ডিআরভুক্ত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা, অনুপস্থিতির হার, জিপিএ ৫ প্রাপ্তি এবং পাসের হারের ভিত্তিতে ঢাকার মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় শীর্ষে অবস্থান করছে। দ্বিতীয় অবস্থানে ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজ ও তৃতীয় অবস্থানে মতিঝিল অইডিয়াল স্কুল ও কলেজ। ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ২ লাখ ৭২ হাজার ১৭১ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ২ লাখ  ৪৮ হাজার ৪৩৪ জন সকল বিষয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। উত্তীর্ণদের মধ্যে ১ লাখ ১৬ হাজার ১৯০ জন ছাত্র (৪৬.৭৭শতাংশ) এবং ১ লাখ ৩২ হাজার ২৪৪ জন ছাত্রী (৫৩.২৩ শতাংশ)। জিপিএ ৫ পেয়েছে ২১৫০ জন (০.৮৭ শতাংশ)। ডিআরভুক্ত ছাত্র-ছাত্রী অনুপস্থিতির হার, জিপিএ ৫ প্রাপ্তি এবং পাসের হারের ভিত্তিতে ঢাকার ডেমরার দারন্নাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসা শীর্ষে রয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে চট্টগ্রামের ডাবলমুরিং থানার বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসা ও ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানার তানযীমুল উম্মাহ ক্যাডেট দাখিল মাদরাসা। পাসের হার সংযুক্ত এবতেদায়ী মাদরাসায় ৮৯.৪৭ শতাংশ ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসায় ৯১.৫২ শতাংশ। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় বিষয়ভিত্তিক কৃতকার্য হয়েছে বাংলায় ৯৯.১৯ শতাংশ, ইংরেজিতে ৯৯.১৮ শতাংশ, গণিতে ৯৮.১৯ শতাংশ, পরিবেশ পরিচিতি সমাজে ৯৯.৮৪ শতাংশ, পরিবেশ পরিচিতি বিজ্ঞানে ৯৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং ধর্ম বিষয়ে ৯৯.৮৯ শতাংশ। পাসের হার বিবেচনায় ৭ বিভাগের মধ্যে বরিশাল বিভাগ শীর্ষে রয়েছে (পাসের হার ৯৯.০৫ শতাংশ)। ৬৪ জেলার মধ্যে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রথম (পাসের হার ৯৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ) এবং পঞ্চগড় ও চাঁদপুর জেলা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে (পাসের হার ৯৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ)। পাসের হারের দিক দিয়ে হবিগঞ্জ জেলা সর্বনিু (৮৯.৬১ শতাংশ) এবং এ জেলার বানিয়াচং উপজেলায় পাসের হার সর্বনিু (পাসের হার ৭১.৬৮ শতাংশ)। দেশের ৬৮ হাজার ৬২৯টি বিদ্যালয়ে শতভাগ পাস করেছে। অপরদিকে ৩৭১টি বিদ্যালয়ের কোনো পরীক্ষার্থী পাস করেনি।
ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষায় সর্বোচ্চ পাসের হার বিবেচনায় ৭ বিভাগের মধ্যে বরিশাল বিভাগ (পাসের হার ৯৪.৬৫ শতাংশ) ও ৬৪ জেলার মধ্যে ঝালকাঠি জেলা (পাসের হার ৯৭.৮৯ শতাংশ) শীর্ষে রয়েছে। পাসের হারের দিক থেকে মৌলভীবাজার জেলার পাসের হার সর্বনিু (পাসের হার ৭৭.৫৭ শতাংশ) এবং মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর  উপজেলার পাসের হার সর্বনিু (পাসের হার ২৩.০৮ শতাংশ)। শতভাগ পাস করেছে ৬ হাজার ৭৪টি মাদরাসার পরীক্ষার্থী। কোনো পরীক্ষার্থী পাস করেনি এমন মাদরাসার সংখ্যা হলো ৯৯টি। এবারই প্রথম সমাপনী পরীক্ষার ফল  গ্রেড পদ্ধতিতে দেয়া হয়েছে। এবার সমাপনীতে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২২ হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে টেলেন্টপুলে এবং ৩৩ হাজার শিক্ষার্থীকে সাধারণ বৃত্তি  দেয়া হবে। গত ২৩ থেকে ৩০ নভেম্বর প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায়  মোট ২৬ লাখ ৩৭ হাজার ২৩৫ জন পরীক্ষার্থীর অংশ নেয়ার কথা থাকলেও অনুপস্থিত থাকে এক লাখ ৭৮ হাজার ৭৮৯ জন শিক্ষার্থী। সারা দেশের ছয় হাজার ১৬৮টি  কেন্দ্র ছাড়াও সৌদি আরবের রিয়াদ ও জেদ্দা, কাতারের দোহা, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবী ও রাসআলখাইমাহ, লিবিয়ার ত্রিপলি, বাহরাইন ও অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা  কেন্দ্রে এবার পরীক্ষা নেয়া হয়। বিদেশের কেন্দ্রগুলোতে পরীক্ষা দেয় ৬৩২ জন শিক্ষার্থী।

ফখরুল ইসলাম
সমুদ্র পরিবহন অধিফতরের দুর্নীতি: নৌমন্ত্রণালয় অসহায় !কয়েকজন সার্ভেয়ারের জালিয়াতি, প্রতারণা ও রাজস্ব ফাঁকির দুর্নীতি প্রমাণিত : দুদকের মামলা
এইচআর সাগর
নৌযানের রেজিস্ট্রেশন, সার্ভে সনদ (ফিটনেস সার্টিফিকেট), বে-ক্রসিং (সমুদ্র সীমা অতিক্রম) সনদ, ডক ইয়ার্ডের লাইসেন্স প্রদান এবং মাস্টার-ড্রাইভার ও নাবিকদের পরীক্ষায় অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, কাগজপত্র জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকিসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুনীতির মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর (ডিজি শিপিং)। এমনকি অবকাঠামোগত ত্র“টিপূর্ণ নৌযানও ফিট হয়ে যায় কর্মকর্তাদের বদান্যতায়। আর এ সব কিছুই হচ্ছে অর্থের বিনিময়ে। এসব অভিযোগ একাধিক তদন্তে প্রমাণিত হলেও পার পেয়ে যান সংশ্লিষ্ট শিপ সার্ভেয়াররা। বিভাগীয় মামলাও ধামাচাপ দিয়ে রাখা হয়। অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। বছরের পর বছর এসব কর্মকান্ড চলে আসলেও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় রয়েছে নিশ্চুপ। বরং মন্ত্রণালয়রে শীর্ষ কর্মকর্তাদের আর্শীবাদে অভিযুক্তরা থাকেন বহাল তবিয়তে। উল্টো তারা বাগিয়ে নেন পদোন্নতি। আবার অধিদফতরও খেলছে কানামাছি খেলা। এ ঘটনায় নৌযান মালিক ও অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। ত্র“টিপূর্ণ নৌযান চলাচলের অনুমোদন দেয়ায় জান-মালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে। জানা গেছে, কয়েকটি নৌযানের রেজিস্ট্রেশনে রাজস্ব ফাঁকি, জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ এনে ডিজি শিপিংয়ের প্রধান প্রকৌশলী একেএম ফখরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় অধিদফতরের একজন অফিস সহকারী এবং ৯জন অয়েল ট্যাঙ্কার ও ড্রেজার মালিককেও আসামী করা হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধান চালিয়ে দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর সহকারী পরিচালক আমিরুল ইসলাম বাদী হয়ে গত ১৬ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় এই মামলা দায়ের করেন। ফখরুল ইসলাম সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়ায় দন্ড বিধির ৪০৯/১০৯ ধারা এবং ১৯৮৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ ২ নং আইনের ৫(২) ধারা বলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। মামলায় তিনি বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। প্রথমে ১৫ দিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে আরো ৪৫ দিনের জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে নেন আদলত থেকে। অধিদফতরের নারায়নগঞ্জে ‘প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক এবং অভ্যন্তরীন নৌযান নিবন্ধক’ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে এই দুর্নীতির আশ্রয় নেন ফখরুল ইসলাম। আর তাকে সহযোগিতা করেন অফিস সহকারী আনিছুর রহমান। ২০০৯ সালের ২০ মে তিনি প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্বে নিয়োগ বাগিয়ে নেন মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে। ফখরুল ইসলাম প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্বে থাকাবস্থায় নারায়নগঞ্জ ও ঢাকায় ‘প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক এবং অভ্যন্তরীন নৌযান নিবন্ধক’ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। এসময় তিনি বিধি লংঘন করে বন্দরে নৌযানসমূহের সার্ভে করার পর অধিদফতরে ঘোষণাপত্র প্রেরণ করেন এবং পরবর্তীতে তিনিই প্রধান প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক হিসেবে সার্ভে সনদ জারি করেন। অভ্যন্তরীন নৌচলাচল অধ্যাদেশ ১৯৭৬ এর বিধি ৯(৩) এ বলা আছে, ‘যিনি সার্ভের (জরিপ) ঘোষণা তৈয়ারি করিবেন, তিনি সার্ভে সার্টিফিকেট (পর্যবেক্ষণ প্রত্যয়নপত্র) মঞ্জুর করিবেন না।’ সরেজমিনে পরিদর্শন না করেই বিভিন্ন নৌযানের সার্ভে সনদ দেয়া হয়েছে। এমনকি একই তারিখে একই সময়ে একাধিক স্থানে এবং একদিনে ২৪টি নৌযানের সার্ভে সনদ দেয়ার রেকর্ড রয়েছে তার। মামলা সূত্রে জানা গেছে, তেলবাহী জাহাজ ওটি নিউ বাংলার সম্রাট, ওটি সিয়াম-১, ওটি মিয়া জমিরশাহ-৪, ওটি সারুলিয়া, ড্রেজার পপুলার আনলোডিং ড্রেজিং প্রকল্প, ড্রেজার আল ফয়সাল-১, ড্রেজার ইসমাইল আনলোড, ড্রেজার এম হোসেন আনলোডিং, এমভি জলপরী, এমভি মাহমুদ-১, এমবি নাজিমুল, এমভি অথৈ এবং এমভি চৌধুরী জাহাজগুলো অনুমোদিত নকশা, নকশা ফি ছাড়া রেজিস্ট্রশন, মিথ্যা সার্ভে ঘোষণাপত্র জারিসহ ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হয়। এসব নৌযানের ক্ষেত্রে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এছাড়া ডকইয়ার্ডের জাল প্রত্যয়নপত্র এবং কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট অফিসের জাল ছাড়পত্র তৈরি করা হয়। 

উল্লেখ্য, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দুদকের কাছ থেকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের তালিকা তলব করে। এ তালিকায় একেএম ফখরুল ইসলামের নাম রয়েছে। এরপরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য গত ১১ অক্টোবর নৌমন্ত্রণালয়ে চিঠি (স্মারক নং ০৫.০০.০০০০.১৮২.৮৫.০১৯.১০-৫৯১) দেয়। পরবর্তীতে চাহিদার প্রেক্ষিতে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর থেকে ফখরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুদকের মামলার কপি পাঠানো হয় নৌমন্ত্রণালয়ে। অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর জোবায়ের আহমেদ স্বাক্ষরিত গত ১৩ নভেম্বর পাঠানো পত্রে (স্মারক নং ডিজি/বিবিধ/৫৭০৯) ফখরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য  অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং তাকে মন্ত্রণালয় নানাভাবে সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর একারণে ফখরুলের দাপট অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতির বোঝা মাথায় নিয়ে নৌমন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) মো. আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে গত ২ ডিসেম্বর বিদেশ সফর করেন দুর্নীতিবাজ একেএম ফখরুল ইসলাম। ইন্দোেিনশিয়ার বালিতে ৬ ও ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত অভ্যন্তরীণ ফেরি নিরাপত্তা বিষয়ক আঞ্চলিক ফোরামের এক সম্মেলনে যোগ দিতে এ সফর। ফখরুল ইসলাম তার স্ত্রীকেও নিয়ে যান বলে সূত্র জানিয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় ড্রেজারসহ নৌযানের রেজিস্ট্রেশন ও সার্ভে সনদ প্রদানে অনিয়ম-দুর্নীতি এবং রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার বিষয়ে ফখরুল ইসলামের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নৌমন্ত্রী, নৌসচিব, ডিজি শিপিংয়ের ডিজি, দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর এবং গোয়েন্দা সংস্থার কাছে অভিযোগ দাখিল করা হয় গত বছরের মার্চ মাসে। এরপরিপ্রেক্ষিতে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। প্রায় এক বছর ধরে চলা অনুসন্ধানে অভিযোগের প্রমাণ পায় দুদক। অবশ্য দুদক ফখরুলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ও প্রকাশিত অনিয়ম-দুর্নীতির সব বিষয়ে তদন্ত করেনি। এখনো তদন্ত অব্যাহত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে তোলা ফখরুল ইসলামের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে দুদক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তার অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতে ফখরুল দুই হাতে বিভিন্ন মহলে টাকা ছড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন দিতে হলে নৌযানের স্টাবিলিটি (অবকাঠামোগত) বুকলেট, নকশাসহ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট এবং জাহাজ পরিদর্শন করা প্রয়োজন। কিন্তু এগুলোর কোন তোয়াক্কা করেননি তিনি। নারায়নগঞ্জ, পাগলা, ঢাকা, মেঘনা, ভৈরব, নরসিংদী ও মিরপুরসহ বিভিন্ন দূরবর্তী এলাকার উল্লেখিত নৌযানের সার্ভে ও রেজিষ্ট্রেশন দেয়া হয়েছে। বে-ক্রসিং সার্ভের জন্য চট্টগামে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও তিনি সেখানে যাননি। অফিসে বসেই রেজিস্ট্রেশন ও সার্ভে সনদ দেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০১১ সালের মে পর্যন্ত ১৫ মাসে ফখরুল ইসলাম নারায়নগঞ্জ কার্যালয় থেকে ২ হাজার ৬৩৯টি নৌযানের সার্ভে সনদ এবং ৫১৩টির রেজিষ্ট্রেশন দেন। এ হিসাবে মাসে গড়ে প্রায় ২২০টি নৌযান চলাচলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর বাইরেও সমুদ্র সীমা অতিক্রম (বে-ক্রসিং) সনদ) দেয়া হয়েছে। যা একার পক্ষে কোনো অবস্থায়ই সম্ভব নয়। ফখরুল ইসলামের বিরুদ্ধে গঠিত তিনটি তদন্ত কমিটির তদন্তে নৌযানের রেজিস্ট্রেশন ও সার্ভে সনদ প্রদানে অনিয়ম-দুর্নীতি, জালিয়াতি ও রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার বিষয় প্রমাণিত হয়। ৭টি ড্রেজার রেজিস্ট্রেশন প্রদানে ২ কোটি ৭৬ লাখ ৯০ হাজার ৯৭১ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার প্রমাণও মেলে তদন্তে। ফখরুল ইসলাম ও সদরঘাটের শিপ সার্ভেয়ার ও রেজিস্ট্রার শাহাদাত হোসেন এসব ড্রেজারের রেজিস্ট্রেশন দেন। তদন্ত কমিটিগুলো তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ সাময়িক বরখাস্তের সুপারিশও করে। এরপরিপ্রেক্ষিতে ফখরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ২০১০ সালের ১৪ জুলাই এবং সর্বশেষ গত ৩০ মার্চ নৌপরিবহন মন্ত্রী ও নৌসচিবের কাছে পত্র দেন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক। মহাপরিচালক পত্রে উল্লে¬খ করেন, ‘ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে তদন্ত করে ফখরুল ইসলামের গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতি সম্পর্কে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’ অধিদফতরের বর্তমান মহাপরিচালক কমডোর জোবায়ের আহমেদও ফখরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে পত্র দেন। এতকিছুর পরেও একেএম ফখরুল ইসলামকে গত ১৮ মে প্রধান প্রকৌশলী পদে স্থায়ী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অজ্ঞাত কারণে ফখরুলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। নৌমন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মান্নান হাওলাদার ও যুগ্ম সচিবকে (প্রশাসন) আলাউদ্দিনকে ম্যানেজ করেই ফখরুল এ পদোন্নতি বাগিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ওই দুই কর্মকর্তার আশীর্বাদেই ফখরুল দাপটের সঙ্গে বহাল রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সূত্র জানায়, অধিদফতরের প্রধান কর্মকর্তা মহাপরিচালকের কাছ থেকে এসিআরে স্বাক্ষর নেয়ার নিয়ম থাকলেও ফখরুল তার তোয়াক্কা করেন নি। তিনি নৌমন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছ থেকে এসিআরে স্বাক্ষর করিয়েছেন। এছাড়া সদরঘাটের সার্ভেয়ার শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রাপ্ত এইকর্মকর্তার মেয়াদ গত ২৯ সেপ্টেম্বর শেষ হলেও চুক্তির মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এর আগে ১৯ জুলাই মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আবদুল বাকি স্বাক্ষরিত এক পত্রে সার্ভেয়ার শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে কিনা তা  জানানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয় সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরকে। কিন্তু শাহাদাতের অনিয়ম-দুর্নীতি গোপন রেখে অধিদফতর থেকে তার কর্মকান্ড সন্তোষজনক উল্লেখ করে পত্র দেয়া হয় মন্ত্রণালয়ে। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে দুর্নীতি আড়াল পড়ে শাহাদাতের। এই সার্ভেয়ার শাহাদাতের বিরুদ্ধে ড্রেজারে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া ছাড়াও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। সূত্র জানায়, গত জুন মাসে ৮৪টি কার্গো, বাল্কহেড, ড্রেজার, স্পিডবোট, তেলবাহী ও বালুবাহী নৌযানের রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে অনিয়মের মাধ্যমে। নৌযানগুলোর মধ্যে হচ্ছে কার্গো-এমভি কুইন অব দোহার, আব্দুল কাদির, দিলসাদ, বুশরা জিয়া-২, প্রিন্স অব ফাহিম, তাজ তানহা, সারা-২, সেতু-৩, মাহমুদা আক্তার, ফাতেমা মীম, আবু ফায়দা-২, মীমতাজ-২, আবু দাবদা-১ ও জান্নাতুজ জামান, মিহির ফয়সাল, আব্দুল্লাহ আল আসিফ-৭, ৮, বাল্কহেড- এমবি শাহপরান নৌপরিবহন, নিউ নূরের আলো, সাফী নৌপরিবহন, রিয়া সোমা নৌপরিবহন, মারুফ সজীব, বিপাশা, ইসরাত জাহান ও আপন, ড্রেজার-এমবি লোড ড্রেজার প্রগতি-১, ৫ ও ৬,  ও মেগা ইউএল ড্রেজার, বালুবাহী নৌযান-এমবি তানিন রাহিম,  নাদিয়া-১, সিদ্দিক নৌপরিবহন, এমভি নিরাজুল ইসলাম-১, এমবি নূর এ কঙ্কা, এমবি ইউনি গ্লোরী-৩, প্রমি নৌপরিবহন, জেরিন সুলতানা, নাসরিন, ইরা প্রমি, একতা, মায়ের দোয়া, ফাহাদ নেভিগেশন, এমবি হৃদয়, ইব্রাহিম জিসান, ভাই ভাই এক্সপ্রেস-৩, সুরজ জসিম নৌপরিবহন, সোহাগ নৌপরিবহন, চাঁদনী নৌপরিবহন, হাজী আ. রাজ্জাক-৩, সোহাগ এন্ড আম্মান, নূর এ মক্কা, গাংচিল, সোবহান আল্লাহ নৌপরিবহন, সেলিম চৌধুরী, এমবি নিলু, বায়তুল মাল, আল্লাহর দান, হাসিব, আল মদিনা নৌপরিবহন, আরএফএল তরী, শাহজালাল নৌপরিবহন ও মা বাবার আশীর্বাদ, তেলবাহী নৌযান- ওটি কর্ণফুলী, ওটি মার মাইড এবং স্পিড বোট সি এঙ্গেল-১, এসআর-৪, এসআর -৩, ফাতেমা এন্টারপ্রাই-৩, আরিফ, আতাহার এন্টারপ্রাইজ, কাওসার, আলিম, সুবর্না, মোজাফফর-১,২, রফরফ-২ ও অন্যন্যা-২, ৩। অনুমোদিত নকশার সঙ্গে মিল না থাকা, জাহাজে গ্রস্টন কম নির্ধারণ করা,  অধিদফতরের নির্মাণ সিডিউল কিল লেয়িং সনদবিহীন, ভ্যাট চালানের সত্যায়িত কপি ছাড়া এবং সরেজমিনে পরিদর্শন না করাসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবকাঠামোগত ত্র“টিপূর্ণ এসব নৌযানের রেজ্রিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এগুলো তদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে অধিদফতরের খুলনা অফিসের ‘প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক এবং অভ্যন্তরীন নৌযান নিবন্ধক’ মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকারের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। অদৃশ্য ক্ষমতা বলে বহাল রয়েছেন তিনিও। ২০০৫ সালের ১৭ এপ্রিল মানিকগঞ্জের আরিচায় যমুনা নদীতে এমএল রায়পুরা দুর্ঘটনায় শতাধিক যাত্রীর মৃত্যুর পর তৎকালীন যুগ্মসচিব নেপাল চন্দ্র সরকারের নেতৃত্বে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ত্র“টিপূর্ণ নৌযানটিকে বিধিবহির্ভুত ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পুন:নিবন্ধন ও ফিটনেস দেয়ার জন্য তদন্ত কমিটি ডিজি শিপিংয়ের ঢাকার সদরঘাট অফিসের তৎকালীন ‘ইঞ্জিনিয়ার এন্ড শিপ সার্ভেয়ার’ জুলফিকারকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নৌমন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জুলফিকারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের হয়। একই বছরের ১৭ মে পটুয়াখালীর চরকাজল নদীতে দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে প্রিন্স অব পটুয়াখালী লঞ্চটি ডুবে যায়। এতে ৪৯ যাত্রীর প্রাণহানী ঘটে। ত্র“টিপূর্ণ এ লঞ্চটিরও সার্ভে সনদ দিয়েছিলেন সার্ভেয়ার জুলফিকার। লঞ্চ ডুবির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি অবকাঠামোগত ত্র“টিসহ নানা অনিয়মের জন্য সার্ভেয়ার জুলফিকারকে দায়ী করেন। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় মামলা দায়ের ছাড়া গত ৬ বছরে রহস্যজনক কারণে আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং গুরুতর এই অভিযোগের তথ্য গোপন করে অভিযুক্ত সার্ভেয়ার জুলফিকার গ্রেড-২ থেকে গ্রেড-১ এ পদোন্নতির জন্য সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালকের মাধ্যমে সম্প্রতি নৌমন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন। ২০০৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সকালে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলায় মেঘনার শাখা নদী দায়রায় যাত্রীবাহী লঞ্চ আল-হেলাল ও একটি ট্রলারের মধ্যে সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক যাত্রীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ত্র“টিপূর্ণ লঞ্চটিকে ফিটনেস দেয়ার জন্য মুঈনউদ্দিন জুলফিকাকে দায়ী করে। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয় নৌমন্ত্রণালয়। কিন্তু পদোন্নতির আবেদনে এই অভিযোগ ও বিভাগীয় পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার কথা গোপন রাখেন তিনি। ২০০৯ সালের ২৭ নভেম্বর  ভোলার লালমোহনে দুর্ঘটনাকবলিত বহুল আলোচিত এমভি কোকো-৪ লঞ্চটিকে টানা পাঁচ বছর ফিটনেস দেন সদরঘাট অফিসের তৎকালীন সার্ভেয়ার মুঈনউদ্দিন জুলফিকার। শুধু তাই নয়, লঞ্চটির পূর্বের নিবন্ধন বাতিল ও যাত্রী ধারণক্ষমতা পরিবর্তন করে ২০০৮ সালের ২৩ এপ্রিল নতুন নিবন্ধন দেন তিনি। দুর্ঘটনার পর লঞ্চটি যথেষ্ট ত্র“টিপূর্ণ ছিল এবং রেজিষ্ট্রেশন ও ফিটনেস প্রদানকারীদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে বলে নৌমন্ত্রী বহুবার গণমাধ্যমে বলেছেন। কিন্তু দুই বছরেও মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিফলন হয়নি। এছাড়া সার্ভেয়ার জুলফিকারের বিরুদ্ধে নৌযান মালিকদের হয়রানি, নকশা অনুমোদন ছাড়া ৪০ মিটার দৈর্ঘ্যরে অনেক কার্গো জাহাজকে মেকানাইজড বোট হিসাবে রেজিস্ট্রেশন প্রদান, পরিদর্শন না করেই নৌযানের সার্ভে ও রেজিষ্ট্রেশন প্রদানসহ ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নৌমন্ত্রী ও নৌ সচিবের কাছে তার বিরেুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমেছে। এ ঘটনায় দুটি তদন্ত হয়। ডিজি শিপিংয়ের পরীক্ষক এসএম নাজমুল হক এবং নৌ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপ-সচিব নাসির মাহমুদ আরিফ এ দুর্নীতির তদন্ত করেন। সার্ভেয়ার মুঈন উদ্দিন জুলফিকারের বিরুদ্ধে মালিকদের হয়রানি, অর্থ আদায়সহ বিভিন্ন অভিযোগে ৩০ জন কার্গো ও যাত্রীবাহী নৌযান মালিক ডিজি শিপিংয়ের ডিজির কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এসব অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পরেও নৌ মন্ত্রণালয় থেকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে জুলফিকারের পদোন্নতির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল সেসময়। ২০০৪ সালের ৭ জুন থেকে ২০০৯ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি সদরঘাট অফিসে দায়িত্ব পালন করেন। গণমাধ্যমে ব্যাপক সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পরে তাকে খুলনায় বদলী করা হয়। এদিকে নৌদুর্ঘটনা ও অনিয়ম দুর্নীতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে শাস্তির দাবি জানিয়েছে গ্রিন ক্লাব অব বাংলাদেশ (জিসিবি)। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মলনের মাধ্যমে এ দাবি জানানো হয়। এ ব্যাপারে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর জোবায়ের আহমেদ বলেন, আমি যোগদানের আগে ফখরুল ইসলামের পদোন্নতি হয়েছে। তার পর তার বিরুদ্ধে দুনীতি দমন কমিশন মামলা করেছে। এখন আইনীভাবে তার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে এখন কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পেলে সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যবস্থা নেয়া হবে। সার্ভেয়ার মুইনদ্দিন জুলফিকারের দুর্নীতির বিষয়ে তার জানা নেই বলে জানান।

নৌবাহিনীকে বিশ্বমানে উন্নীত করা হচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় আস্থা ব্যক্ত করে বলেছেন, বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্থানীয় ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বর্তমান আধুনিকায়ন পরিকল্পনার আওতায় ২০২১ সালের মধ্যে ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠবে।  নৌবাহিনীকে বিশ্বমানে উন্নীত করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বাহিনীকে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং মেরিটাইম সিকিউরিটি ও বিশ্ব শান্তিতে অবদান রাখতে সক্ষম হিসেবে গড়ে তোলা হবে। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ নৌ একাডেমীতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী সোয়াডস কমান্ডের বানৌজা ‘নির্ভিক’ ঘাঁটির নামকরণ এবং নেভাল এভিয়েশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণকালে তিনি এ কথা বলেন। নৌ এভিয়েশনের উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে পরিণত করায় এক ধাপ অগ্রগতি অর্জিত হলো। তিনি ব্যয়বহুল ও প্রযুক্তিভিত্তিক এই বাহিনীকে সময়োপযোগী রাখতে কঠোর পরিশ্রম করার জন্য নৌ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা বলেন, জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণ ও আহরণে নৌবাহিনীকে বাংলাদেশের জলসীমায় যে কোন আগ্রাসন মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, ভবিষ্যত প্রজšে§র জন্য আধুনিক ও ত্রিমাত্রিক যুদ্ধ কৌশলে পারদর্শী এবং নিজ জলসীমায় শান্তি ও যুদ্ধকালীন যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম একটি নৌবাহিনী গড়ে তোলা । তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, নেভাল কমান্ডোরা দেশের নৌ ও সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় যে কোন ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা, ডাকাতি, জলদস্যুতা, অবৈধ অস্ত্র ও মাদকদ্রব্যসহ সব ধরনের চোরাচালান রোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নৌকমান্ডোগণের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে দু:সাহসী নৌ-কমান্ডোগণ চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর নদীবন্দর এবং দাউদকান্দি ফেরিঘাটে একযোগে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। তারা শত্র“পরে ২৪টি জাহাজ, বার্জ ও প্লুটন এবং ২৮ হাজার টন যুদ্ধ সামগ্রী ধ্বংস করেছে। তিনি বলেন, পাশাপাশি নৌ-পথে মাইন স্থাপনের ফলে শত্র“র সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। এতে আমাদের স্বাধীনতা ত্বরাণ্বিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে নৌকমান্ডো ও ডুবুরিগণের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে নৌঘাঁটির নামকরণ করা হয়েছে ‘নির্ভিক’। শেখ হাসিনা বলেন,  স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে কাপ্তাই বানৌজা শহীদ মোয়াজ্জেম ঘাঁটিতে একটি ব্যাচের প্রশিক্ষণও সম্পন্ন হয়। তিনি বলেন,  বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ২০০৯ সালে নৌবাহিনীতে ‘স্পেশাল ওয়ার ফেয়ার ডাইভিং এন্ড সেলভেজ (সোয়াড)’ নামের নৌকমান্ডো ও ডুবুরীদের সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয় এবং আজ সোয়াড কমান্ডো ঘাঁটি ও বানৌজা নির্ভিকের নামকরণ ও কমিশনের মাধ্যমে নৌ-বাহিনীতে নেভাল কমান্ডো গ্র“পের আত্মপ্রকাশ ঘটছে।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, নেভাল কমান্ডো গ্র“পের বিশেষ প্রশিণপ্রাপ্ত সী এয়ার এন্ড ল্যান্ড (সীল) এবং স্পেশাল বোট স্কোয়াডর্ন-এর সদস্যগণ জাতির যে কোন ক্রান্তি লগ্নে বিশেষ ভূমিকায় নিয়োজিত হবে।
শেখ হাসিনা সোয়াডের প্রশিণ ও উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অব্যাহত সমর্থনের প্রশংসা করে বলেন, দু'দেশ এবং দু'দেশের নৌবাহিনীর মধ্যকার বন্ধুত্ব আগামীতে আরো জোরদার হবে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর উন্নয়নে তাঁর সরকারের নেয়া বিভিন্ন ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার ২০০১ সালে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে অত্মাধুনিক যুদ্ধ জাহাজ বানৌজা বঙ্গবন্ধু নৌবাহিনীতে সংযোজন করেছিল। এই জাহাজকে পূর্ণাঙ্গরূপে সমরাস্ত্রে সজ্জিত করার অংশ হিসেবে আজ আমাদের নৌবাহিনীতে সংযোজন করা হয়েছে নেভাল এভিয়েশন এবং ইটালি থেকে সদ্য ক্রয়কৃত দু’টি মেরিটাইম হেলিকপ্টার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সমুদ্র এলাকায় টহল জোরদার করতে ইতোমধ্যে জার্মানির ডরমিয়ার কোম্পানির সাথে দু’টি মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফট ক্রয়ের চুক্তি হয়েছে। এ দু’টি এয়ারক্রাফট ২০১৩ সালের মধ্যে নেভাল এভিয়েশনে যুক্ত হবে। তিনি জাতি গঠন কর্মকান্ড, বিভিন্ন সময়ে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা এবং অভ্যান্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা রায় নৌবাহিনীর বিশেষ ভূমিকার প্রশংসা করেন। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে মন্ত্রীবর্গ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, পদস্থ সামরিক ও বেসমরিক কর্মকর্তাগণ এবং বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মোজেনা ও ইটালির রাষ্ট্রদূত গিয়র গিও গুগলিলমিনু উপস্থিত ছিলেন।

ভ্যাট বা মূসক প্রদানে বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে
এইচআর সাগর
ভ্যাট বা মূসক (মূল্য সংযোজন কর) প্রদানে বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। ইসিআর কিংবা ফিসক্যাল প্রিন্টার ব্যবহার না করে হাতে লিখে কিংবা নিজেদের প্রিন্টারে প্রিন্ট করে ক্যাশমেমো দেয়ায় কত টাকা বিক্রি হচ্ছে এবং কত টাকা ভ্যাট আদায় হচ্ছে তার সঠিক হিসাব রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর বিপুল অংকের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, ভ্যাট ফাঁকি রোধে এনবিআর’র পক্ষ থেকে নির্ধারিত বড় ও মাঝারি আকারের হোটেল রেস্টুরেন্ট ও দোকানে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) বা ফিসক্যাল প্রিন্টারের মাধ্যমে ক্যাশমেমো দেয়ার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু গত দুই বছরে রেজিস্ট্রেশন নেয়া একটি মাত্র ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউই ফিসক্যাল ইসিআর’র মাধ্যমে ক্যাশমেমো দিচ্ছে না। আর ক্রেতারা নির্ধারিত ভ্যাট দিলেও সরকারের কোষাগারে সেই অর্থ পৌঁছে না। সরেজমিনে অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারা দেশে দুই হাজার আসবাবপত্রের বিপণন কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার টাকা বিক্রি হলে বছরে ৭০ কোটি টাকা, ১০ হাজার ফ্যাসন হাউজে প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার টাকা বিক্রি হলে বছরে ৩৭৫ কোটি টাকা, পাঁচ হাজার মিস্টির দোকানে প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার টাকা বিক্রি হলে বছরে ৪৫০ কোটি টাকা, আগোরা-মিনাবাজারের ন্যায় কম্পিউটার সফটওয়ার ব্যবহারকারি এক হাজার প্রতিষ্ঠান গড়ে ৫ লাখ টাকা বিক্রি হলে  বছরে ৩৭০ কোটি টাকা, একশ’বারে প্রতিদিন এক লাখ টাকা বিক্রি হলে বছরে ৭৫ কোটি টাকা, ১০ হাজার রেস্টুরেন্টে গড়ে প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা বিক্রি হলে বছরে ৯শ’ কোটি টাকা, এক লাখ হোটেলে গড়ে তিন হাজার টাকা বিক্রি হলে বছরে এক হাজার ৩৫০ কোটি টাকা, দুই হাজার স্বর্ণের দোকানে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ লাখ টাকা বিক্রি হলে বছরে ৭৫০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য ৫০ হাজার জেনারেল স্টোরে গড়ে ১০ হাজার টাকা বিক্রি হলে বছরে ৩৭৫ কোটি টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আদায় হওয়ার কথা। আর এ হিসেবে বছরে চার হাজার ৭২০ কোটি টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আদায় হওয়ার কথা। কিন্তু রাজস্ব বোর্ডের হিসাব মতে, ২০০৯-১০ অর্থ বছরে ৫০৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা ভ্যাট আদায় করা হয়েছে। কিন্তু রেজিস্ট্রেন নেয়া সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ইসিআর বা ফিসক্যাল প্রিন্টার স্থাপন করে ক্রয় বিক্রয়ের প্রকৃত হিসাব নিতে পারলে ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ চার প্রকাশ না করার শর্তে রাজস্ব বোর্ডের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান। কেননা ফিসক্যাল প্রিন্টার বা ইসিআরের মেমোরিতে কত টাকা বিক্রি হয়েছে এবং কত টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আদায় করা হয়েছে তার সঠিক হিসাব থাকত। নিয়ম অনুযায়ী মূসক বিভাগের কর্মকর্তাদের দেয়া নিরাপত্তা সিল দিয়ে ফিসক্যাল প্রিন্টার বা ইসিআর আটকানো থাকত। যে কারণে ভ্যাট ও সম্পূরক ফাঁকি দেয়া সম্ভব হতো না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। বর্তমানে অধিকাংশ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নিজেদের ইচ্ছেমত হাতে লিখে রশিদ তৈরি করে ক্যাশমেমোতে ভ্যাটের পরিমাণ লিখে দিচ্ছে। আর সফটওয়ার ব্যবহারকারিরা নিজেদের প্রিন্টারে প্রিন্ট করে ভ্যাট নিচ্ছে। যা ইচ্ছে করলে নিজেরাই মুছে ফেলতে পারছে। জানা গেছে, ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি রোধে ২০০৮ সালে হোটেল, রেস্তোরাঁ, ফাস্ট ফুড সপ, মিস্টির দোকান, আসবাবপত্রের বিপণন কেন্দ্র, বিউটি পার্লার, কমিউনিটি সেন্টার, মেট্রোপলিটন এলাকায় অভিজাত শপিং সেন্টার, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, জেনারেল সেন্টার, বড়-মাঝারি পাইকারী এবং খুচরা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও স্বর্ণের দোকানে ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব স্বচ্ছতা রাখার জন্য ইসিআর বা ফিসক্যাল প্রিন্টারের মাধ্যমে ক্রেতাদের ক্যাশমেমো দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এনবিআর। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে সকল সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এবং পহেলা জুলাই থেকে সকল জেলা শহরে ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নেয়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ফিসক্যাল প্রিন্টার বা ইসিআর স্থাপনের নির্দেশ দেয় এনবিআর। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা কার্যকর করা হয়নি। কারণ ফিসক্যাল প্রিন্টার বা ইসিআর স্থাপন করে ক্যাশমেমো দেয়া হলে ভ্যাট ফাঁকি বন্ধ হয়ে যাবে। আর ভ্যাট ফাঁকি বন্ধ হয়ে গেলে মূসক পরিদর্শকদেরও ঘুষ নেয়া বন্ধ হয়ে যাবে। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানয়, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভ্যাট ফাঁকি রোধের জন্য ফিসক্যাল প্রিন্টার বা ইসিআর’র মাধ্যমে ক্যাশমেমো দিতে হবে। আর ক্যাশমেমোর একটি অংশ ক্রেতাদের এবং আর একটি অংশ রোল আকারে সংরক্ষণ করে প্রতিমাসে মূসক কর্মকর্তাকে দেখাতে হবে। প্রতিমাসে মূসক বিভাগীয় কর্মকর্তার কাছে ফিসক্যাল প্রিন্টার বা ইসিআরটির মেমোরিতে থাকা আদায়কৃত ভ্যাটের পরিমাণ দেখিয়ে আনতে হবে। আবার মূসক বিভাগীয় কর্মকর্তার মাধ্যমেই বিদ্যুতের মিটারের ন্যায় পরবর্তী মাসের ভ্যাট আদায়ের জন্য ফিসক্যাল প্রিন্টার বা ইসিআরে নিরাপত্তা সিল দিয়ে আনতে হবে। এছাড়া প্রতি কর মেয়াদে মোট বিক্রয়মূল্য ও মোট মূসকের পরিমাণ সম্বলিত রিপোর্ট যা এম রিপোর্ট হিসেবে স্থানীয় কর কার্যালয়ে জমা দেয়ার নিয়ম করা হয়েছিল। শুধু তাই নয় ভ্যাট ফাঁকি রোধে মূসক প্রদানের পরিমাণ ডি ফর্ম আকারে হার্ড কপি চার বছর পর্যন্ত রেখে দেয়ার বিধান করা হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের ক্যাশমেমো দেয়ার জন্য ফিসক্যাল প্রিন্টার বা ইসিআর ব্যবহার না করায় ভ্যাট আদায়ে সিংহভাগ অর্থ চলে যাচ্ছে মূসক পরিদর্শক ও ব্যবসায়ীদের পকেটে। জানা গেছে, বেসরকারি হিসাব মতে দেশে বর্তমানে রেজিস্ট্রেশন নেয়া ব্যবসায়ীর সংখ্যা দেড় লাখ। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দেশে বর্তমানে কত ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন করা ব্যবসায়ী রয়েছে তার প্রকৃত হিসাব নেই। এ ব্যাপারে এনবিআর’র মূসক বিভাগের প্রথম সচিব মোহাম্মদ আহসানুল হক বলেন, সারা দেশের ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নেয়া ব্যবসায়ীদের সংখ্যা এনবিআরের কাছে নেই। তবে এ মাসেই ঢাকার চারটি সার্কেলের কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক করে এর একটি তালিকা করা হবে। 

পর্যায়ক্রমে সারা দেশের তালিকাও করা হবে বলে তিনি জানান। জানা গেছে, সিদ্ধান্তের পর থেকে এখন পর্যন্ত রাজধানীর পাঁচটি মাত্র ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ফিসক্যাল প্রিন্টার ক্রয় করা হয়েছে। এর মধ্যে একটিমাত্র ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ফিসক্যাল প্রিন্টারের মাধ্যমে ক্যাশমেমো দেয়া হচ্ছে। বাকি চারটি প্রতিষ্ঠানে ফিসক্যাল প্রিন্টার থাকলেও তা ব্যবহার করা হচ্ছে না। তাই কোনো প্রতিষ্ঠান কত টাকা বিক্রি করছে তারও সঠিক হিসাবও নেই রাজস্ব বোর্ডের কাছে। শুধু তাই নয়, এনবিআরের ভ্যাট আদায়ের তালিকায় আসবাবপত্রের বিপণন কেন্দ্র, অভিজাত শপিং স্টোরের, ডিপার্টমেন্টাল সেন্টার, জেনারেল সেন্টার ও স্বর্ণের দোকানের নামও নেই। এনবিআর’র সদস্য (ভ্যাট) মো. ফরিদ উদ্দিন জানান, ভ্যাট ফাঁকিরোধে ফিসক্যাল প্রিন্টার বা ইসিআর স্থাপনের সিদ্ধান্ত হলেও ভ্যাট আদায়ের ব্যাপারে রাজস্ব বোর্ডে চারজনের স্থলে সাতজন সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাই একটু এলোমেলো অবস্থা রয়েছে। সবকিছু ঠিক করতে একটু সময় লাগছে বলে তিনি জানান।
 ভেঙ্গে পড়ছে বিএনপির চেইন অব কমান্ড
ইকরাম-উদ দৌলা
সরকার বিরোধী চলমান আন্দোলনে চূড়ান্ত রূপ দিতে নানা পরিকল্পনা করলেও কার্যত রাজপথে শক্ত কোনো অবস্থান নিতে পারছে না বিএনপি। স্থানীয় পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মাঝে মনোবল ফিরে আসার সময়কালে কেন্দ্র হয়ে পড়ছে রাজপথ শূন্য। ফলে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের কমান্ড নেতাকর্মীরা না মানায় রাজধানী কেন্দ্রিক আন্দোলন জোরদার করতে পারছে না বিএনপি। কারণ হিসেবে দলটির চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়াকে দায়ী করছেন অনেকে। নেতাকর্মীদের অভিমত সাধারণ নেতাকর্মী সমর্থকদের মাঝে সাংগঠনিক পর্যায়ে বা ইউনিট বাই ইউনিট নির্দেশনা না থাকায় কেউ রাজপথে নামছেন না। গণমিছিল পণ্ড হওয়ার ঘটনা এর উজ্জল প্রমাণ বলে আখ্যায়িত করছেন তারা। দলীয় সূত্রে জানা গেছে বিএনপির বেশীরভাগ কর্মসূচি আসে মহাসচিবের ঘোষণার মাধ্যমে। কিন্তু কর্মসূচি ঘোষণার পর আন্দোলন সফলে নেতাকর্মীদের মাঝে সংশ্লি¬ষ্ট নেতাদের কোনো নির্দেশনা থাকে না। এজন্য বড় থেকে শুরু করে ছোট পর্যন্ত কোনো নেতার অনুসারিরা কর্মসূচিতে যোগ দেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নেতা জানান, আমরা বিএনপি করলেও আমাদের সুনির্দিষ্ট নেতা রয়েছেন। তার নির্দেশনা না পেলে কোন ভরসায় রাজপথে থাকবো। মহাসচিবের ঘোষণা থেকে কর্মসূচি আসলেও অনেক নেতাই তার অনুসারিদের কোনো নির্দেশনা দেন না। ফলে কোনো লোকবলও থাকে না। ফলে উৎসাহ উদ্দীপনা ছাড়া কর্মসূচিগুলো পণ্ড হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। যদিও কর্মসূচি পণ্ড হওয়ার পেছনে প্রশাসনের ভয়ও একটা ভূমিকা রাখে। গত ২১ ডিসেম্বরের গণমিছিলে সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অংশ নেয়ার নির্দেশনা থাকলেও সেদিন কাউকেই দেখা যায়নি। বর্তমান সরকারের আমলে এই প্রথমবারের মতো শুধু শীর্ষ ১৫জন নেতার একটি দল মিছিল করার চেষ্টা করেছে। সেদিন সকাল থেকে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থানকারী নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, সহ-সভাপতি, যুগ্ম মহসচিব, প্রচার সম্পাদক ও গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক। পুলিশী নির্যাতনের ভয়ে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনা পৌঁছায়নি সাধারণ কর্মী পর্যন্ত। ফলে মিছিলে সরকার বিরোধী স্লোগান ধরতে হয়েছে খোদ মহাসচিবকে। এদিন বিএনপির ভ্যানগার্ড ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, কৃষকদলসহ অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনেরর নেতাকর্মীদের টিকিটিও পাওয়া যায়নি; অনুসারি তো দুরের কথা। এ নিয়ে দলের নীতি নির্ধারণী মহলেও রয়েছে যথেষ্ট হতাশা। হাইকমান্ড বুঝে উঠতে পারছেন না নির্দেশনা না মানার কারণ। এজন্য সচরাচর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিভিন্ন সভা সেমিনার আলোচনা সভায় খুব দুঃখের সঙ্গে  অভিযোগ করছেন, আগের মতো দেশ বিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এগিয়ে আসছে না। বাকস্বাধীনতা হরণ করার চেষ্টা হলেও প্রতিবাদ করছে না কৃষক যুবা। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ছাত্র যুবা কৃষকরা এগিয়ে না আসলে কিংবা তাদের কণ্ঠ প্রতিবাদ না করলেও এদেশের ভাবিষ্যৎ কী হবে। এটা জাতীর জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি মিছিলও আর আজ বের হয় না। অথচ একই সময় অব্যাহত ভাবে চলছে সীমান্তে হত্যা। সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরের বেড়ে চলছে হত্যা, গুমের ঘটনা। অন্যদিকে বিএনপির সামনের আন্দোলন স্তিমিত হয়ার আশঙ্কা করছেনও অনেকে। নেতাকর্মীরা মনে করছেন সরকার ইতোমধ্যে ২০০১ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় জড়িত সন্দেহে বিএনপির ২১ হাজার নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করছেন। এছাড়া ঢাকায় ১৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও যুবদলের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। সঙ্গত কারণেই এসব নেতা এখন গা বাঁচিয়ে চলবেন। ফলে তার অনুসারিরা আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই রাজপথে বিএনপির আন্দোলন ধোপে টেকবেনা। এই অবস্থায় আন্দোলনের গতিপথ পরিবর্তন নিয়েও ভাবছে বিএনপি। সূত্রমতে দলটির নীতি নির্ধারণী মহলের প্রধান লক্ষ্যই এখন চট্টগ্রাম রোডমার্চ সফল করা নিয়ে। কারণ এটা পণ্ড হয়ে গেলে কিংবা কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটলে রোডমার্চের পুরো সাফল্যই ধুলিসাৎ হয়ে যাবে। ভেঙ্গে পড়বে সাধারণ নেতাকর্মীদের মনোবল। জানা গেছে লালদীঘি ময়দান থেকে ঢাকা ঘেরাও এর যে কর্মসূচি আসার কথা ছিলো শেষ পর্যন্ত তা আর হচ্ছে না। এখান থেকে বিএনপির চেয়ারপার্সন পরবর্তী আন্দোলনে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ঘোষণা দেবেন। তবে সিলেট রাজশাহী খুলনার মতো এ রোডমার্চে একই কারণে গাড়িবহর খুব বেশী বড় হবে না বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ সময়কে বলেন, রোডমার্চে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতিই প্রমাণ করে বিএনপির চেইন অব কমাণ্ডে কোনো সমস্যা হয়নি। গত কয়েক দিনে যেটা হয়েছে, নেতাকর্মীরা পুলিশের নির্যাতন আর গ্রেফতারের ভয়ে রাস্তায় নামতে পারেনি। স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য লে.জে (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকারের মনোভাব হচ্ছে বিএনপিকে আন্দোলন না করতে দেয়া। তাদের মামলা হামলার ভয়েই নেতাকর্মীরা রাস্তায় বেরুতে পারছে না। মিছিলের মতো গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে বাঁধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বিএনপি সুশৃঙ্খল একটি দল। এখানে সবাই নিয়ম আর নির্দেশনা মেনে চলে।

সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা অপহরণ থামছে না
১১ বছরে বিএসএফ’র গুলিতে ১ হাজার বাংলাদেশি নিহত, নির্যাতনের শিকার আড়াই হাজার
ইকবাল হাসান ফরিদ
সীমান্তে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এর হাতে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা, অপহরণ ও পুশইনের মতো অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন কিছুতেই থামছে না। বিভিন্ন অজুহাতে সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশি হত্যা ও নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে বিএসএফ। ক’দিন পরপরই সীমান্তে মানুষ হত্যার নতুন নতুন খবর আসছে। বিগত ১১ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে বিএসএফ। একই সময়ে নির্যাতনে আহত, পুশইন, অপহরণের শিকার হয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার বাংলাদেশি। গত মার্চে কিশোরী ফেলানী হত্যাকাণ্ডে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার পর খুবই স্বল্পসময়ের জন্য হত্যা বিরতি দিয়েছিল বিএসএফ। এরপর আবার শুরু করেছে সীমান্তে মানুষ হত্যা ও নির্যাতন। সর্বশেষ গত গত ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম, মেহেরপুর ও দিনাজপুরের বিরামপুর এবং সিলেটের গোয়ানাইনঘাট সীমান্তে ৫ বাংলাদেশি বিএসএফ’র গুলিতে নিহত হয়েছেন।
১৭ ডিসেম্বর ভোর সাড়ে ৬টার দিকে কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার কইঞ্চারকুটি সীমান্তে ৯৩১ নং আন্তর্জাতিক পিলারের পার্শ্ববর্তী স্থানে বিএসএফ গুলি করে আলমগীর (২৫) নামে এক বাংলাদেশিকে হত্যা করে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে ভারতের নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পের টহলরত বিএসএফ আলমগীরকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় বলে জানা গেছে। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এদিকে দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলার কাটলা সীমান্তের অভ্যন্তরে বিএসএফের গুলিতে  মতিয়ার রহমান (২০) ও তাইজুর ইসলাম (২৬) নামে দুই বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। নিহতরা কাটলা সীমান্তের দাউদপুর রনগ্রামের বাসিন্দা মতিয়ার রহমান নবাবগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ দাউদপুর গ্রামের সিদ্দিক সরকারের পুত্র। এদিকে মেহেরপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ১৬ ডিসেম্বর রাতে নাহারুল হোসেন (৩৫) নামের এক বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। তার বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া ইউনিয়নের শাওড়াতলা গ্রামে। তিনি রাত ৮টার দিকে সীমান্ত এলাকায় জমিতে সেচকাজ করতে গিয়েছিলেন বলে পরিবারের লোকজন দাবি করে। এদিকে সিলেটের গোয়ানইঘাট সীমান্তে ডিবি হাউর এলাকার আব্দুল মালেকের পুত্র বাদশা মিয়াকে ১৭ ডিসেম্বর মধ্যরাতে বিএসএফ সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রেকর্ড অনুযায়ী ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত— ৯৯২ জন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে বিএসএফ। একই সময় বিএসএফের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হয়েছেন ৯৯৫ জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন অন্তত এক হাজার, নিখোঁজ হয়েছেন দুই শতাধিক ও পুশইনের শিকার হয়েছেন ৩০০ জনেরও বেশি। অধিকারের জরিপে জানা গেছে, ২০১১ সালে বিএসএফ’র গুলিতে নিহত হয়েছেন ৩৩ জন, ২০১০ সালে ৭৪, ২০০৯ সালে ৯৬, ২০০৮ সালে ৬২, ২০০৭ সালে ১২০, ২০০৬ সালে ১৪৬, ২০০৫ সালে ১০৪, ২০০৪ সালে ৭৬, ২০০৩ সালে ৪৩, ২০০২ সালে ১০৫, ২০০১ সালে ৯৪ এবং ২০০০ সালে ৩৯ বাংলাদেশি নাগরিক। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের মর্যাদা না দিয়ে ভারতীয়রা বার বারই বাংলাদেশিদের অপমানিত ও লাঞ্ছিত করছে। যার ধারাবাহিকতায় সীমান্ত এলাকায় কৃষক, ব্যবসায়ী, নারী, শিশু কেউই এখন নিরাপদ নন। তাদের মতে, সাধারণ নাগরিকদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে হত্যা করা মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন। এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপারের সময় সীমান্তরক্ষীরা অবৈধ পারাপারকারীদের গ্রেফতার করতে পারবে। কোনো অবস্থাতেই গুলি করা যাবে না যদি না কোনো আক্রমণাত্মক ভূমিকা না দেখা যায়।

দেশে পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে
নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলে তিন বছরে একাত্তর হাজার পাঁচশ’ অভিযোগ
ইকবাল হাসান ফরিদ
দেশে নারী নির্যাতন বেড়েছে। গত তিন বছরে দেশের ৬টি বিভাগে মহিলা অধিদপ্তরের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলে পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুক, শারীরিক নির্যাতন, স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহ ও বিয়ে বিচ্ছেদের ৭১,৫৫১টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এরমধ্যে ২৮ হাজার ৫৫৩টি অভিযোগের নিস্পত্তি হয়েছে।
মহিলা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুক, শারীরিক নির্যাতন স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনায় নারীর প্রতি আইনী সহায়তা দিতে ১৯৯০ সাল থেকে ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল স্থাপন করা হয়। এসব সেলে নারীরা অভিযোগ করলে তা বাদী-বিবাদী দু’পক্ষকে তলব করে মিমাংসা করা হয়। এছাড়াও নির্যাতিতাকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়।
দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা নতুন নতুন কৌশলে সংঘটিত হচ্ছে। সম্প্রতি নরসিংদিতে লেখাপড়া করার অপরাধে এক নারীকে হাতের আঙ্গুল কেটে দিয়েছে পাষণ্ড স্বামী। শুধু তাই নয়, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, শ্বাসরোধে হত্যা, রগ কেটে, পানিতে চুবিয়ে হত্যা, নির্যাতন সইতে না পেরে আÍহত্যার ঘটনা দেশে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতার চিত্র ফুটিয়ে তোলে। দেশে শতকরা ৪২ থেকে ৫৮ ভাগ নারী বিভিন্ন প্রকার নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে গঠিত মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের এক জরীপ থেকে জানা গেছে, দেশে নারীরা ৭৪ ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে ২১ ধরনের দৈহিক নির্যাতন, ১৪ ধরনের যৌন নির্যাতন, ৭ ধরনের বার্ন ও ৩২ ধরনের মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ৬ বিভাগে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলে পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগ জমা পড়েছে ৪২ হাজার ৫৩৫টি। এরমধ্যে নিস্পত্তি হয়েছে ২৬ হাজার, ৫৭০টি। যৌতুকের অভিযোগ জমা পড়েছে ১৮ হাজার ২২২টি। অভিযোগের নিস্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৩২টি। শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ জমা পড়েছে ৫ হাজার ১৪৭টি। এরমধ্যে নিস্পত্তি হয়েছে ৫৫৩টি। স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের অভিযোগ জমা পড়েছে ১ হাজার ৬৫৩টি। এরমধ্যে নিস্পত্তি হয়েছে ২৭১টি। বিয়ে বিচ্ছেদের অভিযোগ জমা পড়েছে ৩ হাজার ৯৯৪টি। এরমধ্যে নিস্পত্তি হয়েছে ১৫৭টি। আইসিডিডিআরবি’র একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশে প্রতি ৪ জন নারীর ৩ জনই কোন না কোনভাবে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে স্বামীর হাতেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হতে হয় নারীকে। শুধু শহরেই ৪০ ভাগ নারী শারীরিক এবং ৩৭ ভাগ নারী স্বামীর যৌন নির্যাতনের শিকার হন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরীপে দেখা গেছে, শহরে ৬০ ভাগ নারী এবং গ্রামের ৬১ ভাগ নারী পরিবারের কাছের মানুষের দ্বারা শারীরিক, মানসিক এমনকি যৌন নির্যাতনের শিকার হন। বিবাহিত নারীদের মধ্যে শহরে ৪০ ভাগ এবং গ্রামের ৪২ ভাগ নারী স্বামীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। শহরের ৩৭ ভাগ এবং গ্রামের ৫০ ভাগ নারী স্বামীর যৌন নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনে মারাÍক আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। শহরের ২৭ ভাগ এবং গ্রামের ২৫ ভাগ নারী নির্যাতনের কারণে আহত হন। তবে নির্যাতনের তুলনায় প্রতিকার চাওয়ার হার খুবই কম। বেশিরভাগই এ ধরনের নির্যাতনকে লজ্জাজনক চিন্তা করে তা গোপন রাখেন। কেউ কেউ বিষয়টিকে একান্তই ব্যক্তিগত এবং অন্যের হস্তক্ষেপ করা উচিৎ নয় বলে মনে করেন। ফলে অগোচরে থেকে যায় নারী নির্যাতনের নানা কাহিনী। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের আইনজীবী পারভীন আক্তার খান বলেন, এখানে সমাজের সব শ্রেনীর নারীরা অভিযোগ নিয়ে আসেন। এর মধ্যে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের অভিযোগ বেশি আসে। দু’পক্ষকে হাজির করে আমরা বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করি। মীমাংসা করা না গেলে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেই ও সহযোগিতা করি। বেসরকারি সংস্থা নিজেরা করির পরিচালক খুশি কবির বলেন, যখন মূল্যবোধের অবক্ষয় হয় তখন নারী নির্যাতনের মতো অপরাধ বেড়ে যায়। অপরাধের জন্য আইন ও শাস্তি আছে। কেউ যদি মনে করে সে অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে তখন অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়। এ কারণে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যেসব আইন আছে সেগুলোর কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন।

বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণের দিকে ঝুকছে সরকার
মো. রেজাউর রহিম
বিদ্যমান সংকট মোকাবেলায় চড়া সুদে বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণের দিকে ঝুঁকছে সরকার। দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়ার ফলে ব্যাংক থেকে আর নতুন ঋণ না নিতেই এ ব্যবস্থা। এজন্য বিদেশ থেকে বেশি সুদে বাণিজ্যিক ঋণ নেয়ার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারের সামনে আর  কোন বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় বন্ড ছেড়ে বিদেশ থেকে টাকা সংগ্রহের কথাও  ভাবা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। কোন দেশের ঋণ মানের ওপর নির্ভর করে বন্ড ছেড়ে এ ধরণের ঋণ গ্রহণ করা হয় বলে এটিকে সার্বভৌম (সভরেন) ঋণ বলা হয়। এ ধরণের ঋণের সুদের হার অনেক বেশি। সাধারণত আর্থিক সঙ্কট মারাÍক রুপ ধারণ করলে কোন রাষ্ট্র এ ধরণের ঋণ নেয়ার বিষয়ে চিন্তা করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে কোন সরকারই এর আগে এ ধরণের সার্বভৌম ঋণ গ্রহণ করেনি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে এ ধরণের ঋণের প্রভাব সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্ণরকে পরামর্শও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সূত্র জানায়, আর্থিক সংকট মোকাবেলায় সভরেন ঋণ নেয়ার সরকারী আগ্রহকে অর্থনীতিবিদরা বিপদজনক বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। কিন্তু সরকারের ব্যয় যেভাবে বাড়ছে সে হারে আয় হচ্ছে না, এর ওপর রয়েছে অতিরিক্ত ভর্তুকির চাপ। সব মিলিয়ে ব্যয় সামলাতে আর কোন বিকল্প দেখছে না সরকার। জানা গেছে, সরকারের সামনে এখন নানামুখি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে উন্নয়ন ও অনূন্নয়ন ব্যয় সামলাতে নগদ টাকা দরকার, অন্যদিকে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের দায় মেটাতে দরকার বৈদেশিক মুদ্রা। এছাড়া অভ্যন্তরীণ ঘাটতি ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হলেও বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সামাল দিতে গিয়ে রিজার্ভের পরিমাণ দিন দিন আশংকাজনক হারে কমছে। এছাড়া সরকার পদ্মা সেতু বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন প্রকল্পে যে ধরণের বৈদেশিক সহায়তা প্রত্যাশা করেছিল সে পরিমান সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্নীতির অভিযোগে দাতাদের পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ-এ সঙ্কটকে আরো তীব্র করেছে। এ অবস্থায় আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকসহ দাতাসংস্থাগুলোর কাছে বাজেট সহায়তা পাওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চলছে। তবে দাতা সংস্থার ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে শর্তারোপসহ প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এখন দেশের বাইরে বেসরকারি খাত থেকে সভরেন ঋণ গ্রহণের বিষয়টিকে একমাত্র বিকল্প ভাবছে সরকার। জানা গেছে, সভরেন ঋণ নিতে গেলে সরকারকে অতিরিক্ত সুদ গুনতে হবে। এর ফলে বাজেটে সুদ বাবদ ব্যয় বেড়ে যাবে। কিন্তু বিওপি চাপ আর সরকারের ব্যয় মেটাতে আর কোন বিকল্প না থাকায় অধিক সুদে বিদেশ থেকে বাণিজ্যিক ঋণ নেয়াকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। সূত্র জানায়, সভরেন ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হারের বিষয়টি উদ্বেগজনক। মূলত এ ধরণের ঋণের সুদের হার নির্ণয় হয় ঋণগ্রহীতা দেশটির ঋণ মানের ওপর। গত দু’বছর ধরে বাংলাদেশের ঋণ মান নির্ণয় করে আসছে আন্তর্জাতিক দু’টি প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর ও মোদি। এই ঋণ মান অনুসারে সভরেন ঋণ নিলে সুদের হার কতো হতে পারে এবং তাতে বাজেটে কী ধরণের প্রভাব পড়তে পারে সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদে ১০ বছরের মেয়াদে বন্ড ছেড়ে এ ধরণের ঋণ গ্রহণ করেছে। শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের ঋণ মান সমপর্যায়ের হওয়ায় সুদের হার কাছাকাছি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।  বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সামগ্রিক মুদ্রা প্রবাহ (এম২) এবং ঋণ প্রবাহ কমিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মুদ্রানীতিতে গড় মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ ধরে সামগ্রিক মুদ্রা প্রবাহ ২১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ঋণ প্রবাহ ২৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৮ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়। কিন্তু ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের কারণে মুদ্রানীতিতে মুদ্রাপ্রবাহের যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল তা বাস্তবায়ন করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। সূত্র জানায়, সরকারের ব্যাংক ঋণের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সতর্ক করা হয়েছে। যে হারে সরকারের ব্যাংক ঋণ বাড়ছে সেটি অব্যাহত থাকলে মুদ্রাপ্রবাহ আরো বাড়বে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন আরো কঠিন হয়ে পড়বে। আর অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতে সরকারের ঋণ বাড়লে একদিকে যেমন বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ সংকুচিত হবে অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা অসম্ভব হবে বলেও মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

এসব বিষয় বিবেচনা করেই সরকার শেষ পর্যন্ত বিদেশ থেকে বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকারের সভরেন ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্তটি অর্থনৈতিক সঙ্কটকে আরো তীব্র করবে। তিনি বলেন, দাতা সংস্থাগুলোর ঋণে নীতিগত শর্ত থাকলেও সুদের হার কম, কিন্তু সভরেন ঋণে যে ধরণের সুদের হার সেটি সরকারের দায় আরো বাড়িয়ে দেবে। এছাড়া অনূন্নয়ন ব্যয়- বিশেষ করে ভর্তুকি সামাল দিতে যদি এ ঋণ নেয়া হয় তবে সরকারের দায় আরো বেড়ে যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
৯৮ শতাংশ শিশুকে স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করা হয়েছে
সিদ্দিকুর রহমান
নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কার্যক্রম জোরদার হওয়ায় দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বইছে গুণগত পরিবর্তনের হাওয়া। সরকারের ৩ বছরে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছে বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ক্ষেত্রে তা অনুপাতিক হারে প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে জেন্ডার বৈষম্য বিলোপ করে ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংখ্যাসাম্য অর্জিত হয়েছে। বস্তুত গত ৩ বছরে  শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্জনে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলংকার পরেই এখন বাংলাদেশের স্থান। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রে বলা হয়েছে, আসছে নতুন বছরের শুরুতে প্রায় শতভাগ শিশুকেই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ কার্যক্রমের আওতায় আনা সম্ভব হবে। চলতি বছরে ৯৮ শতাংশ শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। আর শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করা সম্ভব হয়েছে ৯৫ শতাংশ। আসছে নতুন বছরে ঝরে পড়া রোধ শতভাগ উন্নীত করার লক্ষ্যে সরকার নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সব উপজেলায় শিক্ষার্থীদের ৪০ শতাংশকে উপবৃত্তি টিউশন ফি এবং পরীক্ষার ফি প্রদান করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মেয়ে ও ১০ শতাংশ ছেলে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উপবৃত্তি প্রদান অব্যাহত রয়েছে। øাতক পর্যায়ে ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদানের বিষয়টি বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ষষ্ঠ থেকে øাতক পর্যন্ত গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান এবং বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে একটি ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ৩০৭টি উপজেলায় প্রত্যকটিতে ১টি করে বিদ্যালয়কে মডেল বিদ্যালয়ে রূপান্তরের কাজ চলছে। মাদ্রাসা শিক্ষার অধুনিকায়নের জন্য ৩৫টি মডেল মাদ্রাসা গড়ে তোলা হচ্ছে। ৩১টি মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালু করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৩ হাজার হাইস্কুল, ১ হাজার মাদ্রাসা, ১ হাজার ৫শ’ কলেজ, ৩০৬টি মডেল স্কুল, ৩৫টি মডেল মাদ্রাসা প্রভৃতি সর্বমোট প্রায় ৬ হাজার ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ঢাকা মহানগরে সরকারি উদ্যোগে ১১টি হাইস্কুল এবং ৬টি সরকারি কলেজ স্থাপন করা হচ্ছে। রংপুর-পাবনা-বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম চালু হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন গত বছর ১৮ জুন থেকে কার্যকর করা হয়েছে। দেশের ৬টি বিভাগে ১১টি আধুনিক ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, অমাদের শিক্ষার লক্ষ্য হলো, নতুন প্রজš§কে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ এবং নৈতিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে নতুন যুগের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। যুগোপযোগী শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ লক্ষ্যকে সফল করে তোলা হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষার্থীদের জন্য বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি নতুন ছাঁপানো পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে জাতীয়ভাবে অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা গ্রহণ করায় শিক্ষার্থীদের সনদ লাভ এবং সারা দেশে একই মান অর্জনের লক্ষ্য বাস্তবায়ন হতে চলেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতির জঞ্জাল পরিস্কার করার কাজ চলছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি ২৯ শতাংশ থেকে কমে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে বলে টিআইবি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রের সকল স্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আগে প্রতিবছর স্কুলগুলোতে ক্লাশ শুরু করতেই মার্চ-এপ্রিল হয়ে যেতো। যথাসময়ে বই কেনার সমস্যা ছিল প্রকট। নোট বা গাইড বই কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হতো। এখন স্কুলে ১ জানুয়ারি থেকে ক্লাশ শুরু হচ্ছে। সকল পরীক্ষার ফলাফল ওয়েবসাইট, ই-মেইলে দেয়া হচ্ছে। ২০ হাজার ৫শ’ স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম চালু করা হয়েছে। সরকার ৬ষ্ঠ শ্রেণী হতে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত কারিকুলাম ঢেলে সাজানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১২ সালের মধ্যে নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী সকল বই ছাঁপিয়ে ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারির মধ্যে এ নতুন বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো হবে। অর্থাৎ ২০১৩ সাল থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চলবে নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ডা. আফসারুল আমীন বলেন, বর্তমান সরকার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরেপড়া রোধে বিশেষ উদ্যোগের অংশ হিসেবে ৯৬টি উপজেলার সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্কুল খোলার দিন দৈনিক ৭৫ গ্রাম ফার্টিফাইভ বিস্কুট প্রদান করা হচ্চে। ২০ লাখ শিক্ষার্থী এ সুবিধা ভোগ করছে। সরকার  ‘স্কুল ফিডিং কর্মসূচি’ আরো সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে চলতি বছরের প্রথম দিকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও রংপুর বিভাগের দারিদ্র পীড়িত আরো ৮৬টি উপজলায় প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য ১ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্প্রসারিত স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। সরকার দ্রুত ঝরে পড়া সম্পূর্ণভাবে রোধ ও শতভাগ শিশুকে ভর্তি নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-২) এর বাস্তবায়ন প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং নতুন করে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রোগ্রাম-৩ বাস্তবায়নের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সরকার ২০১৪ সালের মদ্যে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে।


সয়াবিনের বাজারে চরম অস্থিরতা
দিশেহারা সাধারণ ভোক্তারা 

মো. নাজিম উদ দৌলা সাদি
বর্তমানে বাংলাদেশের আমজনতার প্রধান ভোজ্যতেল হলো সয়াবিন। যা পুরোটাই আমদানি নির্ভর। এ জন্য আমদানিকারকদের মর্জির ওপর নির্ভর করতে হয় ভোক্তাদের। তারা ইচ্ছে হলে দাম বাড়ায়, ইচ্ছে হলে কমায়। তাদের লাগাম ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এক সময় এ দেশবাসীর প্রধান ভোজ্যতেল ছিল সরিষার তেল। দেশে উৎপন্ন শস্য থেকে এ তেল উৎপাদিত হত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে সরিষার তেলের ব্যবহার দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে। সরিষার তেল খেলে হƒদরোগ ও রক্তের কোলস্টরেলবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন রোগ বাড়ে- এমন নানা গুজব দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি বিকল্প ভোজ্যতেল হিসেবে সয়াবিন তেল বাজারে আমদানি করা হয়। ধীরে ধীরে সরিষার তেলের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায় এবং মানুষ সয়াবিনের ওপর পুরো মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে আমদানিকারকরা বিভিন্ন সময়ে তেল নিয়ে তেলেসমতি কারবার শুরু করে। তারা নিজেদের স্বার্থে তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এ গণতান্ত্রিক রা®্র¡ে ব্যবসায়ীদের এ স্বৈরচারিতা দেখার কেউ নেই। যারা ক্ষমতায় আছে তারা অজানা কারণে নীরবতা পালন করছে।  কয়েক দিনের ব্যবধানে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া হঠাৎ সয়াবিন তেলের বাজারে চরম অস্থিরতা  দেখা দিয়েছে। সরকারের বাজার তদারকি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা কোনো কিছুই দামের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির মাশুল গুণতে হচ্ছে স্বল্প আয়ের লোকদের। দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ উল্লেখ করতে পারেনি খুচরা ব্যবসায়ীরা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নিুমুখী হওয়া সত্ত্বেও দেশীয় বাজারে দাম বৃদ্ধির ঘটনা চরম উদ্বেগজনক। ব্যবসায়ীদের এ খামখেয়ালীপনায় দিশেহারা ভোক্তা সাধারণ। সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ব্যবসায়ীদের সৃষ্ট সঙ্কট কাটাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারি সংস্থা টিসিবির (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) হিসাবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম বেড়েছে ১৩ টাকা। খুচরা বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায়। বাস্তবে এ চিত্র ভিন্ন। খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেল লিটার প্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৪০-৪২ টাকায়। লাগামহীন বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারে পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এ সুযোগ আরো বেশি কাজে লাগাচ্ছে পাড়া-মহল্লার দোকানিরা। ক্রেতাদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো দাম আদায় করছে তারা। পাইকারি বাজারেও প্রতিমণ সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬শ টাকা। বর্তমানে বাজারে প্রতিমণ সয়াবিন ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এক সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয় ৪ হাজার ৪শ টাকায়। চলতি বছর জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন সয়াবিন বিক্রি হয় ১ হাজার ২শ ৭১ ডলারে। এরপর গত কয়েক মাস সয়াবিন তেলের দাম মোটামুটি স্থির ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ২০ জুলাই সরকার মিলগেটে ১০৫ টাকা, খুচরা ১০৭ টাকা ও ভোক্তা পর্যায়ে ১০৯ টাকা তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয়। হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই ১৪ নভেম্বর লিটার প্রতি ৩-৪ টাকা বাড়িয়ে দেয় মিলমালিকেরা। চলতি ডিসেম্বরে মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭০ ডলারে। অথচ চলতি সপ্তাহে খুচরা বাজারে তেলের দাম লিটার প্রতি বেড়েছে ১৫-২০ টাকা। ব্যবসায়ীদের এ নৈরাজ্য দেখার কেউ নেই। নিরূপায় ভোক্তারা বেশি দামেই বাজার থেকে তেল ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে। তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে সরকার পক্ষ ও ব্যবসায়ীরা ভিন্ন মত দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার সংসদ ভবনে বাণিজ্যমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে কমিটি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব মো. গোলাম হোসেন জানান, শীতে তেলে ভেজাল না মেশাতে পারায় ব্যবসায়ীরা সয়াবিনের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তেলে ভেজাল মেশাতে না পারা যদি দাম বৃদ্ধির কারণ হয়, তাহলে তো সারাবছর ভেজাল মেশানোর দায়ে ব্যবসায়ীদের শাস্তি হওয়া উচিত। নাকি ব্যবসায়ীদের শাস্তি দিলে দাম বৃদ্ধির আসল কারণ উদ্ঘাঠিত হবে, এ ভয়ে মূল ঘটনা আড়াল করা হচ্ছে?
ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, চাহিদা অনুযায়ী সয়াবিনের সঙ্কট রয়েছে। এছাড়া ডিও প্রথা তুলে দেয়ায় ভোজ্যতেলের বাজার এখন কয়েকটি মিল মালিকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা সুযোগ বুঝে দাম বাড়াচ্ছে।  যে কারণে পাইকারি ব্যবসায়ীরা টাকা দিয়েও তেল পাচ্ছে না। অন্যদিকে তারল্য সঙ্কট ও ডলারের দাম বৃদ্ধিতে ব্যাংকগুলো সয়াবিন তেল আমদানির জন্য এলসি খুলতে গড়িমসি করছে। ফলে প্রয়োজনীয় তেল আমদানি বিলম্বিত হওয়ায় দাম বেড়েছে। দেশে মুদ্রাস্ফীতি ও ডলারের দাম বেড়েছে সত্যি, তাই বলে পূর্বে আমদানিকৃত তেলের দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক। আধুনিক যুগে পণ্যের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য কত নিত্যনতুন যন্ত্র আবিষ্কার হলেও সয়াবিনের ভেজাল বুঝতে আমাদের শীতের ওপর নির্ভর করতে হয়। এদেশে তেল পরিক্ষার পর্যাপ্ত যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও অনুমান করে  শীতের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়া চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক। দায়সারা এ প্রতিবেদন দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীদের লাগাম এখনই টেনে ধরতে হবে। ব্যবসায়ীদের রাজত্ব দেখার জন্য এ দেশ স্বাধীন হয়নি। মহজোট সরকার অনেক প্রতিশ্র“তি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর হীন স্বার্থের জন্য সরকারের গায়ে কলঙ্কের কালিমা যাতে না লাগে সেদিকে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া উচিত। সরকারের সামনে আর আছে মাত্র দু’বছর। ব্যবসায়ীবান্ধব নীতি পরিহার করে এখনই জনবান্ধব সিদ্ধান্ত  নেয়া উচিত। সকল যুক্তিতর্ক বন্ধ করে তেলের বাজারের উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ অতি জরুরি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এমনিতেই দিশেহারা সাধারণ মানুষ। এর ওপর তেল ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ব্য। নিু আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে এবং বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করার আগেই সরকারের উচিত অসাধু ব্যবসায়ীদের লাগাম টেনে ধরা। সরকার যদি তেলের রাজ্যের স্থিরতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয় তবে জনমনে চরম অস্থিরতা বিরাজ করবে। যা মহাজোট সরকারের জন্য মোটেও শুভকর হবে বলে মনে হয় না। ব্যবসায়ীদের মনে রাখতে হবে, ক্রেতারা বিমুখ হলে তাদের ব্যবসা লাটে উঠবে। অযৌক্তিক কারণে দু’দিন পর পর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা কোনো ব্যবসায়ীর উচিত নয়। কেবল লাভের উদ্দেশে নয়, সেবার মানসিকতা নিয়ে জনবান্ধব ব্যবসায়িক সুবিধা প্রদানে ব্যবসায়ীদের সচেষ্ট থাকতে হবে।
তেলের বাজারের নৈরাজ্য বন্ধে সরকারের উচিত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। সবকিছু ব্যবসায়ীদের মর্জির ওপর ছেড়ে দিয়ে সরকারের দায় এড়ানো উচিত নয়। দেশে ব্যবসায়ীদের রাজত্ব নয়, জনগণের রাজত্ব কায়েম হোক এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। 

বিএনপির হেঁটে লংমার্চ গাড়িচেপে শর্টমার্চ
প্রবীর দত্ত
গত ১০ অক্টোবরের পর বিএনপির তথা চারদলীয় জোটের তিনটি লংমার্চের তৃতীয়টি গত ২৭ নভেম্বর সম্পন্ন করেছে। সরকারের পতনসহ বেশ ক’টি দাবি সংবলিত তার মধ্যে মানবতাবিরোধী স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের বিচার ঠেকাবার সুর অনেকটাই প্রকাশ পেয়েছে হেঁটে লংমার্চ, যন্ত্রচালিত গাড়ি চেপে শর্টমার্চ সম্পন্ন করা হয়েছে। লংমার্চ, শর্টমার্চ যেটিই হোক সফলতায়, শান্তিপূর্ণ এবং নির্বিঘেœ শেষ হয়েছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা-দুর্ঘটনার কথা শোনা যায়নি। এখন প্রশ্ন হলো, সরকারেরবিরোধী এই লংমার্চের প্রাপ্তি এর প্রত্যাশা আদৌ কিছু আছে কি? সরকারকে এ লংমার্চ গদিচ্যুত করার বা বিএনপির জন্য ইতিবাচকÑ কিংবা জনগণের ভাগ্যের? না দুই দলের জন্যই শুভ-অশুভ কোনোটিই ঘটেনি। বরং পদব্রজে লংমার্চ না করে গাড়ি করে তেল পুড়িয়ে দেশ ও জনগণের ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। ভেজা কম্বল ভাড়ি করা হয়েছে। লংমার্চে সরকারকে যতটাই ক্ষতিগ্রস্ত করার কথা তা হয়নি। সরকারের এক চুল ভিতও নড়াতে সক্ষম হয়নি। বিএনপির এই লংমার্চে সরকার এতে ভীত এবং শঙ্কিতও নয়। আগামী আরো ২ বছরের বেশি সময় সরকার ক্ষমতায় থাকবে। এই লংমার্চের কারণে ক্ষতি বিএনপিরও নয়। সরকারের তো নয়ই। ক্ষতি কেবল ভুক্তভোগী-সাধারণ মানুষের। আজকের এই বিরোধী দল ২০০১ সালে এই বিএনপি সরকারে পাঁচ বছরের একদিন পূর্বে ক্ষমতা ছেড়ে পালায়নি তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের অসংখ্যবার হরতাল, লংমার্চের কারণে। প্রবাদ কথাটিই জনগণের ভাগ্যে বাঘে-মষে নল খাগড়ার শেষ। ক্ষতির অংশ জনগণ। অর্থাৎ যে জনগণ ভোট দিয়ে সরকার বানিয়েছে এবং বিএনপিকে বিরোধী দলে বসিয়েছে। এমনিতেই দেশ বিদ্যুৎহীন একরকম। সারাদেশ অন্ধকারময় বিদ্যুতের অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য হুমকির মুখে বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না, বিদ্যুৎ-গ্যাসের অভাবে। সরকার দফায় দফায় বিদ্যুৎ-গ্যাস এবং জ্বালানির মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে যার খেসারত যানবাহনে প্রতিনিয়ত বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। অন্যদিকে রাস্তাঘাটে, যানবাহনের আধিক্যহেতু মানুষকে জ্যামের দুর্ভোগ পোহাতে হয় সারাক্ষণ। এসব তো সাধারণ মানুষকে মুখ বুঝে হজম করতে হচ্ছে। বিএনপির লংমার্চের দুই হাজার গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে তার দুর্ভোগও জনগণের ওপর বাড়িয়েছে। লংমার্চের দীর্ঘ গাড়ির লাইন পার হতে রৌদ্রে দগ্ধ আগুনে জনগণকেই পুড়তে হয়েছে। দুই হাজার গাড়ি এক সঙ্গে রাস্তায় এ কি খেলা কথা। গাড়ি বহরের বিএনপির এ লংমার্চকে অনেকেই ভালো চোখে দেখননি। এটিকে ন্যায়-নীতিবির্বজিত বলে জ্ঞান করেছেন। এটি দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতিকারকই নয়, গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ভঙ্গকারী, দুই দিনের লংমার্চে গাড়িতে যে জ্বালানি ব্যয় করা হয়েছে তা না হলেও আগামী তিন মাসের মজুত। দু’দিনে তেল পুড়ে তেলের ঘাটতি করেছে। অপচয় তেল ও অর্থের উভয়ের। যা কাক্সিক্ষত নয়। রাজনীতির নামে নিজ স্বার্থ, দলের স্বার্থে ব্যস্ত দল দু’টি। কেউ সাধারণ জনগণের কথা মাথায় রাখছে না। লংমার্চের নামে বেহুদা তেল পুড়িয়ে সেই তেল নিয়েও রাজপথ দখলে রাখছে। সংসদে যাচ্ছে না অথচ মাসে মাসে বেতন তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। একদিনের সংসদ পরিচালনা বাবদ ব্যয় হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। স্টাফ ব্যয়, বিদ্যুৎ-টেলিফোন এবং আপ্যায়নে। ওদিকে তারা সংসদে না এসে সর্বাধিক প্রাপ্ত বেতন-ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চলে যাচ্ছে। অর্থা
যা কিছু এ সবই রাজনীতিনামী তাদের জন্যই। অর্থা সব ভালো সুযোগের তারাই একমাত্র ভাগিদার ‘বড় ভাগি জবার মা’ এ দুটি দল। বিএনপিও ক্ষমতায় থাকতে বিদ্যু-গ্যাসের দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের পকেট শূন্য করে সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে। তাদের সব কিছু ঠিক রাখতে তারা যা করছে এটা ঠিক শোষক আর শাসকের নীতি যে রকম হয়। বিএনপি মনে মনে সান্ত্বনা পাচ্ছে তারা জনগণকে তাদের জন্য একটি শুভ বার্তা পৌঁছাতে পেরেছে। আসলে এটি ঠিক নয়। বরং ২০০১-এর জোট সরকারের অপরাধ অপর্কীতিকে আবারো সামনে তুলে ধরেছে। তারা গত পাঁচ বছরের যে বিপুল অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়েছে, তারা তারই প্রমাণ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গাড়ির নম্বর  দেখে তাদের অর্থের উস বের করা হবে। যে দেশে অভাবের তাড়নায় সাধারণ মানুষ অনাহারে দিনাতি পাত করছে। এরপরে প্রায় প্রতিদিনই চাল, ডাল, তেল এবং বিদ্যু-গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করছে। এর মধ্যে লংমার্চের নামে তেল পুড়িয়ে দুই হাজার গাড়ি নিয়ে এ দাবির যৌক্তিকতা আদৌ আছে বলে মনে হয় না। বিরোধী দল বিএনপির আজ সংসদে বসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এড়িয়ে রাজপথে হাঁটছে। এভাবেই তার অধিকার ক্ষুণœ করে দল দুটি বিরোধী দলে বসে লংমার্চ হরতাল, মানববন্ধন, জাতির সব অস্থিতিশীল  পরিবেশের এবং ধ্বংসাÍক কর্মসূচি পালন ও রাজপথ পুঁজির দ্বারাই বিরোধী দলের অধিকার রক্ষার অপকৌশল পথ বাতলাচ্ছে। গত ’৯০-এর পর থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। বিএনপি সরকারে গেলে আওয়ামী লীগে এক থেকে দুই বছরের মাথায় বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে লেগে পড়ে। শুরু হয় সরকার পতনের কর্মসূচি। প্রথমে ডাকা হয় হরতাল। বারো ঘণ্টা, ছত্রিশ ঘণ্টা এবং বাহাত্তর ঘণ্টা। পাশাপাশি মানববন্ধন, লংমার্চ, লগি-বৈঠা মার্চ। বিএনপির যন্ত্রচালিত যান্ত্রিক এ গাড়ি মার্চ, শর্টমার্চ আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাবার অভিন্ন পথ শেষমেশ খালেদা জিয়া গত পরশু বলেছেন, লংমার্চে সরকারের ভিত নড়ে গেছে। আর একটি বড় ধরনের কর্মসূচি দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো হবে। বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রতি আবেদন অনেক বড় ধরনের কর্মসূচি দিন। দিতেই পারেন। অধিকার রয়েছে। কর্মসূচিই আসুক তা যেন দেখবেন সত্যি সত্যিই জনগণের মঙ্গল হয়। আর একটি কথা দেখবেন এ কর্মসূচি কারো পরিবারে যেন কান্নার সৃষ্টি না করে। সাধারণের রুটি-রুজির ব্যাঘাত না ঘটায়। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি সাধিত না হয়। আগামী দিনগুলোর জন্য ধ্বংসের কোনো ইস্যু রাখবেন না। রাষ্ট্রীয় সম্পদ, জনগণের জীবন সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা আমলে রাখবেন ২০০৬-এর মতন রাজপথে লগি-বৈঠার দুই দলের মধ্যে হত্যার রাজনীতি আর দেখতে চায় না দেশের মানুষ। তারা শান্তি চায়। নিরাপত্তা চায়। দেশের সম্পদ, জাতির সম্পদ, রাজনীতির নামে জ্বালাও পোড়াও এমন চিন্তা-চেতনা থেকে সবাইকে দূরে থাকাটাই মঙ্গল হবে। বিএনপি সে পথেই আগাক সেটিই সবার কামনা।
সিএজির বিশেষ নিরীক্ষা
ভ্যাট ও কর শাখাতে দেড় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি
মো. রেজাউর রহিম
সর্বশেষ পরিচালিত মহাহিসাব নিরীক্ষক কার্যালয়ের (সিএজি) এক বিশেষ নিরীক্ষায় রাষ্ট্রের দেড় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি ধরা পড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) ভ্যাট ও কর শাখাতে এ অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। এ বিষয়ে নিরীক্ষা শেষে ৩টি পৃথক প্রতিবেদন দিয়েছে সিএজি কার্যালয়। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এসব প্রতিবেদনের ৩৮টি অনুচ্ছেদ বা ধারায় আপত্তি জানিয়ে নিরীক্ষকরা বলেছে, এতে সরকারের মোট ১ হাজার ৪৬৬ কোটি ৬৪ লাখ ৪৮ হাজার ১০৬ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, নিরীক্ষিত প্রতিবেদন সর্বসম্মতভাবে ও একাধিক আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে প্রস্তুত হয়েছে। তাই মহাহিসাব নিরীক্ষক কার্যালয় থেকে এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে এনবিআরকে অনাদায়ী অর্থ দ্রুত আদায় করে তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করার তাগাদা দেয়া হয়েছে। এদিকে, বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থ ক্ষতির বিষয়টি নিরীক্ষিত হওয়ার পর সংবিধানের ১৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মহাহিসাব নিরীক্ষা কার্যালয় থেকে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করা হয়েছে। জাতীয় সংসদেও এই নিরীক্ষিত প্রতিবেদন উত্থাপিত হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি হিসাব সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভায়ও এটি পর্যালোচনা হচ্ছে। তবে এতদসত্ত্বেও ক্ষতিকৃত অর্থ আদায়ের পথে সৃষ্ট নানা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত নিরীক্ষার সন্তোষজনক নিস্পত্তি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।  নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজস্ব সংক্রান্ত আইনের বিভিন্ন বিধি বিধান ও রাজস্ব বোর্ডের আদেশ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সঠিক পরিপালন না হওয়া, আর্থিক শৃঙ্খলার অভাব ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হওয়ার কারণে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ (১ হাজার ৪৬৬ কোটি ৬৪ লাখ ৪৮ হাজার ১০৬ টাকা) আদায়যোগ্য আয় থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে, যা রাষ্ট্রের তহবিলে জমা হওয়ার কথা ছিল। এ অবস্থায় এ ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করার ব্যাপারেও সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, সরকারের উর্ধ্বতন পর্যায় থেকে এই অর্থ আদায়ে চলমান প্রক্রিয়ায় যথাযথ মনিটরিং থাকা দরকার। ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম প্রতিরোধে এনবিআর ও তার আওতাভূক্ত অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও জোরদারের সুপারিশ করেছেন তারা। এ ব্যাপারে স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আব্দুল বাছেত খান নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলেন, অডিট পর্যবেক্ষণের সঙ্গে জড়িত অর্থ আদায়ের বিষয়ে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম ত্বরান্বিত হলে সরকারি কোষাগারে ওই পরিমাণ রাজস্ব জমা করা সম্ভব। জানা গেছে, রাজস্ব ফাঁকির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে নিরীক্ষা প্রতিবেদনের অগ্রহণযোগ্যতা প্রমাণে আইনি লড়াইয়ে নেমেছে। তারা যথারীতি ট্রাইব্যুনালের আশ্রয় নিয়েছে। আবার কৃতকর্মের দায় এড়াতে রাজস্ব বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে ওঠা আপত্তিকে যে কোনোভাবে অগ্রহণযোগ্য প্রমাণের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, দৈবচয়নের ভিত্তিতে মহাহিসাব নিরীক্ষা কার্যালয়াধীন স্থানীয় ও রাজস্ব নিরীক্ষা অধিদফতর এলটিইউ’র কর ও ভ্যাট রাজস্ব খাতে বিগত ২০০৫-০৬ ও ২০০৬-০৭ অর্থবছরের কর্মকাণ্ডের ওপর এই নিরীক্ষা চালায়। এতে রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিধি বহির্ভূতভাবে রেয়াত প্রদান ও এসব প্রতিষ্ঠানের নথিপত্রের সঠিক সংরক্ষণ না হওয়া এবং মূসক আদায় সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে মূসক আইন বিধিমালা ১৯৯১ এর ধারা এবং এনবিআরএর অন্যান্য আদেশ/নির্দেশ যথাযথ পরিপালন না হওয়ায় রাস্ট্রের এ বিপুল ক্ষতি হয়েছে বলে চিহ্নিত করা হয়। নিরীক্ষা পর্যালোচনায় জানা যায়, বিগত ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এলটিইউ’র ভ্যাট কর্মকাণ্ডের উপর ১৭টি অনুচ্ছেদের ওপর আপত্তি তুলে নিরীক্ষা বিভাগ। এসব আপত্তির নথিপত্র নিরীক্ষিত হওয়ার পর এতে ১ হাজার ২৬৫ কোটি ৮১ লাখ ৯১ হাজার ৯২৬ টাকার রাজস্ব ক্ষতি ধরা পড়ে। একই খাতে তার আগের (২০০৫-০৬) অর্থবছরে ৮টি অনুচ্ছেদে জড়িত রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ ধরা পড়ে ১৬০ কোটি ২৯ লাখ ৩৪৭ টাকা। অন্যদিকে এলটিইউ’র ট্যাক্স শাখার (২০০৬-০৭) অর্থবছরের কর্মকাণ্ডে রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারার সঠিক পরিপালন না হওয়ায় এখানে ১৩টি আপত্তি তুলে নিরীক্ষা বিভাগ। এ থেকে নিরীক্ষা শেষে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ ধরা পড়ে ৪০ কোটি ৫৩ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩৩ টাকা। তবে  নিরীক্ষিত এ প্রতিবেদনের পুরোপুরি গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এলটিইউ ও এনবিআরের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, তাদের কাছে নিরীক্ষিত প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধ। তবে রাজস্ব কর্মকাণ্ডে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে নিরীক্ষার আংশিক আপত্তি (কোন কোন ধারায়) সত্যও হতে পারে। সেগুলো নিস্পত্তির ব্যাপারে এখন আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে।  এ ব্যাপারে এনবিআর সদস্য (কর জরিপ) মো. শাহাজাহান বলেন, এ ধরনের নিরীক্ষিত প্রতিবেদন এবং নিরীক্ষায় জড়িত বড় অংকের রাজস্ব ক্ষতির বিষয়টি আমি অবহিত হয়েছি। নিরীক্ষা বিভাগ তার নিরীক্ষার কাজ করেছে। তাদের কাছে যেটুকু অসংগতি মনে হয়েছে তার আলোকে এবং তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই এই নিরীক্ষার কাজ করেছে। তিনি জানান, এটুকু বলা যায় নিরীক্ষায় আনিত জড়িত অর্থের পরিমাণ পুরোপুরি বাস্তবসম্মত নয়। আবার নিরীক্ষিত প্রতিবেদন উড়িয়ে দেয়ার মতোও কোনও বিষয় নয়। যেহেতু বিষয়টি রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। সরকারের নিরীক্ষা বিভাগ এবং রাজস্ব বিভাগ রাস্ট্রের স্বার্থরক্ষায়ই কাজ করে থাকে। তাই এনবিআরও মনে করে এলটিইউর সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকাণ্ডে আনিত নিরীক্ষা বিভাগের আপত্তিগুলো গুরুত্বপুর্ণ। এজন্য এনবিআর আপত্তিজনিত ধারায় জড়িত অর্থের নিস্পত্তিতে পুণঃপরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। অন্যদিকে অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুণঃতদন্তের কারণে জড়িত প্রতিষ্ঠানও এ ব্যাপারে রাজস্ব বিভাগের মামলা মোকাবেলার উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া বেশ কিছু আপত্তি নিস্পত্তির উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু অভিযোগের জবাব প্রস্তুত করে সরকারি হিসাব সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিতে ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় বসার জন্য পাঠানো হয়েছে। সেখানে এনবিআর সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা ছাড়াও অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়োজিত নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের নিরীক্ষা বিভাগের ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় সংশ্লিষ্ট হিসাবের নথিপত্র যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের বিষয়তো আছেই।  অবশ্য এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআর’র একজন প্রথম সচিব বলেন, আয়কর খাতের বড় অংশের রাজস্ব আদায় হয় বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) থেকে। বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর আয়-ব্যয় ও রাজস্ব প্রদানের নথিপত্রও থাকে এলটিইউ’র অধীনে। কিন্তু এলটিইউ’র কর্মকাণ্ড এখনও চলে ফাংশনাল অ্যাপ্রোচে। এই শাখাটিই মূলত সেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, এরজন্য সব সময় খুঁটিনাটি ধরা সম্ভব হয় না। কারণ এজন্য সেই ধরনের জনবল ও লজিষ্টিক সাপোর্টও নেই। তাই এলটিইউ নিজেও যেমন করদাতার ওপর আস্থা রাখে, আবার করদাতারাও এলটিইউর ওপর আস্থা রাখে। তবে এটি সত্য, এলটিইউ শাখা থেকে আরও বেশি রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতা রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এলটিইউ মোট রাজস্বের ৫০-৬০ শতাংশ আদায় করে। তাই সরকারের উচিত এলটিইউতে অধিক সংখ্যক দক্ষ কর্মকর্তার সমন্বয় ঘটিয়ে আরও শক্তিশালী করা, তাদের দক্ষতা উন্নয়নে দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণ প্রদান, আধুনিক কর ফাঁকি শনাক্তকরণ, তথ্য-আদান প্রদান এবং তথ্য যোগাযোগের উন্নয়ন, প্রাইসিং ক্রস বর্ডার ট্রানজেকশন এবং অনলাইনের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদানের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। এলটিইউ’কে ভ্যাট ও করের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে হবে। তাহলে এ ধরনের ফাঁকি কিংবা সমন্বয়হীনতা আর থাকবে না।  

তেল কোম্পানিগুলোর লীলাক্ষেত্র
মনির তালুকদার
মেক্সিকো উপসাগরীয় অঞ্চল এখন জ্বালানি তেলের লীলাক্ষেত্র। সেখানকার প্রতি মুহূর্তের নারকীয় দৃশ্যাবলীর সঙ্গে মিল আছে নাইজার বদ্বীপ এবং ইকুয়েডরের আমাজন অববাহিকার। ওবামা প্রশাসন মেক্সিকো উপসাগরে তেল উত্তোলনে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির পাওনা পরিশোধ না করার যে প্রস্তাব দিয়েছে ফেডারেল আপিল আদালতের তিনজন বিচারক তা প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। কারণ বড় তেল কোম্পানির সঙ্গে আর্থিকসহ বিভিন্ন রকম সম্পর্কে তারা আবদ্ধ। নিউ অরলিন্সের উত্তরাঞ্চলের পঞ্চারট্রেইন লেকটিও বিপির নিঃসৃত তেলে ভেসে গেছে। বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য বিপি যে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সেই আগুনে এখন পুড়ে মরছে সাগর উপকূলের সংকটাপন্ন কচ্ছপসহ অন্যান্য জলজপ্রাণী। স্থানীয় জেলে এবং ঝিনুক ব্যবসায়ীদের জীবন-জীবিকা ধ্বংস হয়ে গেছে। মেক্সিকো উপসাগরীয় অঞ্চলের অধিবাসীদের  শরীরে আশংকাজনভাবে বিষক্রিয়ার নমুনা লক্ষ্য করা গেছে।
তবে ওইসব খবরে নাইজার বদ্বীপ কিংবা আমাজন অরণ্যাঞ্চলের অধিবাসীদের অবাক করে না। একইভাবে ১৯৬৯ সালে সান্তা বারবারা এবং ১৯৮৯ সালে এক্সন ভালোদেজ কোম্পানির জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছিল। নাইজেরিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলীয় নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলটি আটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জলবেষ্টিত ভূমি। মেক্সিকো উপসাগরীয় অঞ্চল যেমন চিংড়ি ও ঝিনুকের অভয়ারণ্য। ওই বদ্বীপটির জলজ বনভূমিও তেমনি কাঁকড়া আর ঝিনুক জাতীয় জলজপ্রাণীর আশ্রয়স্থল। আর আমাজনের গভীর অরণ্যাঞ্চলটি হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকারী। ২০০ কোটি বর্গমাইলব্যাপী বিস্তৃত এই গহীন অরণ্য এই গ্রহের ২০ শতাংশ অক্সিজেনের জোগানদাতা। অথচ তেল কোম্পানিগুলো বিশ্বের সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালী অঞ্চলগুলোকে কীভাবে নিজেদের স্বার্থে ধ্বংস করছে তা নিয়ে দুনিয়ার তাবড় তাবড় সংবাদ নীরব।
নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলে গই নামে একটি গ্রাম আছে। গ্রামটি যে নদীর তীরে অবস্থিত তার জলপ্রবাহ এক সময় প্রচুর পরিমাণ চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ বয়ে আনত। নদীতে জাল ফেললেই মাছে ভরে যেত। কিন্তু গ্রামটি ওই বদ্বীপের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া পাইপলাইনগুলোর একটির বেশ কাছেই অবস্থিত। বছর ছয়েক আগে নদীতে জ্বালানি তেলে বড় ধরনের এক নিঃসরণ ঘটে এবং ভাসমান তেলে আগুন ধরে গিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে। ৫০ বছর আগে ওই বদ্বীপ অঞ্চলে শেল কোম্পানি তাদের প্রথম ১৭টি কূপ খনন করে। সেই থেকেই দুঃস্বপ্নের ইতিহাসের যাত্রা শুরু। বাড়তে থাকে সরকারি পর্যায়ে সীমাহীন দুর্নীতি, পরিবেশ বিপর্যয় এবং চরম দারিদ্র্য। এক হিসাব থেকে জানা গেছে, অর্ধশতাব্দী সময়ে ওই বদ্বীপ অঞ্চলে ৫৪ কোটি ৬০ লাখ গ্যালন পরিমাণ তেল নিঃসরণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ গ্যালন করে। নাইজার বদ্বীপের পাইপলাইন থেকে বছরে যে পরিমাণ তেল নিঃসৃত হতো তার পরিমাণ মেক্সিকো উপসাগরে নিঃসৃত তেলের চেয়ে বেশি। ফ্রেন্ডস অব আর্থ ইন্টারন্যাশনালের নাইজেরীয় প্রধান, নিমো বাসে ঘটনার পরপরই ওই অঞ্চলটি পরিদর্শনে যান। সম্প্রতি এক রেডিও সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, পুরোপুরিভাবে পুড়ে যাওয়া বিশাল এক জলজ বনাঞ্চল। নদীর পাশ দিয়ে অবস্থিত মাছের খামারগুলোও পুড়ে গেছে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে নদী তীরবর্তী ঘরবাড়িগুলো। এ যেন জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া এক রণক্ষেত্র। জনজীবন পুরোপুরিই  বিধ্বস্ত। নাইজেরিয়ায় তেল উত্তোলনকারী সবচেয়ে বড় কোম্পানি রয়াল ডাচ শেল বারবার বলে আসছে, তারা গই গ্রামটি পরিষ্কার করে দিয়েছে। কিন্তু নিমো বাসে জানিয়েছেন, তেলের ঘটনা আপনি লুকিয়ে রাখতে পারবেন না। গিয়ে দেখুন, সবই আপনার চোখে পড়বে। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৪ সালে। চলতি বছরেও আমি ওখানে দু’বার গিয়েছি। বিপর্যয়ের চিত্রটি সেদিন যে রকম ছিল এখনো ঠিক সে রকমই আছে। আপনি এখনো নদীর জলে ভাসমান তেলের আস্তরণ দেখতে পাবেন। জলজ যে গাছপালা, পুড়ে চারখার হয়ে গিয়েছিল। সেগুলোর সেই ধ্বংসস্তুপ এখনো আগের মতোই পড়ে রয়েছে। কোনোরকম পরিবর্তন সেখানে ঘটেনি। ধ্বংস হয়ে যাওয়া মাছের পুকুরগুলোও আপনার চোখে পড়বে। চোখে পড়বে পুড়ে যাওয়া জাল এবং মাছ ধরার নৌকাগুলোও। সব কিছু ঠিক একই রকম আছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার চিহ্নটুকুও আপনি খুঁজে পাবেন না। বাসে জানান, স্থানীয় অধিবাসীরা এখনো সেখানে রয়ে গেছেন বটে, তবে জীবিকার জন্য তারা আগের মতো আর মাছ ধরার ওপর নির্ভর করতে পারছে না। শেষবার যখন আামি সেখানে গেলাম, দেখলাম একটি ছোট্ট শিশু তার বাবার সঙ্গে চিংড়ি ধরতে নদীতে এসেছে। তার হাতে ছিল ছোট্ট একটি প্লাস্টিকের ডুলা। সারারাত চেষ্টা করে সকালে যখন তারা ফিরে যাচ্ছিল তখন তাদের ডুলার তলানিতে কয়েকটা মাত্র বাগদা চিংড়ির পোনা। ডুলাটার সারাগায়ে নষ্ট তেল লেগেছিল। মাছগুলোও ঢেকে গিয়েছিল তেলের আস্তরণে। ভাবছিলাম এগুলো দিয়ে তারা কী করবে। জিজ্ঞেস করতেই ছেলেটি জানাল, ভালো করে ধুয়ে নিয়ে ওইগুলোই খাবে তারা। গই গ্রামটির লোকজনকে বাজার থেকে এমন মাছ কিনে খেতে হয়। ওইসব মাছও  আবার তাজা নয়। কোনো কোনেটি সিদ্ধ। তাছাড়া মাছ কিনে খাওয়াটা সেখানে বিলাসিতার পর্যায়েই পড়ে। কারণ নাইজেরিয়ার ৭০ শতাংশ মানুষই এখন দিনে ১ ডলারের কম আয়ে জীবন ধারণ করে থাকেন। তেল কোম্পানিগুলো ইকুয়েডর পেরু ও ব্রাজিলের বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে অবস্থিত আমাজন বনাঞ্চলে তাদের বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চলছে। ইকুয়েডরের অরিয়েন্ট অঞ্চলে সেকোয়া আদিবাসী হামরারটো পিয়াগিজের কথায়, “এক সময় কতা সুন্দরই না ছিল আমাদের জীবন। চারদিকে পাখির কলকাকলি, লতাগুল্ম, জীবজন্তু আর গাছপালা। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে অসংখ্য নদী-নালা যাদের শেষ গন্তব্য আমাজন নদী। মনে হতো পুরো অঞ্চলটিই একটি স্বর্গোদ্যান। এসবের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার কথা আমাদের মনেই আসত না। আক্ষরিক অর্থেই গভীর এ বনাঞ্চল সর্বসাধারণের সম্পত্তি বলেই আমাদের কাছে মনে হতো। আমরা মনে করতাম এই মাটির নিচে জমে থাকা তেলসম্পদ হচ্ছে আমাদের পূর্ব পুরুষদের রক্ত। এখানে বসবাসকারী সব মানুষের কাছেই গভীর এ অরণ্য হচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। তার কাছ থেকে জানার আছে অনেক কিছু। এখানকার ঔষধি লতাপাতা যেন একটি গণহাসপাতাল।” তবে টেক্সাকো এই জঙ্গলে এলো আধিপত্য বিস্তার করতে। কোকান উপজাতির এমারগিল্ডো ক্রাইলো তার স্মৃতি হাতড়ে টেক্সাকোর আগমনের কাহিনীটি তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, “১৯৬৭ সালে তার বয়স ছিল আট। হঠাৎ একদিন দেখলেন একটি হেলিকপ্টার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এর আগে এমনটি কখনো দেখেননি বলে ভাবলেন, এটি বুঝি অদ্ভুত ধরনের কোনো পাখি। তবে পরে দেখতে পেলেন জঙ্গলের মধ্যে টেক্সাকো একটি দোকানঘর বসিয়েছে। ছয় মাসের মধ্যেই দেখলেন বাড়ির কাছের একটি খালের মধ্য দিয়ে তেল ভেসে যাচ্ছে। পরিণত বয়সে ওই টেক্সাকোর কারণেই ক্রাইলো তার দুটি সন্তানকে হারান। জšে§র ছয় মাস পর থেকেই ছোট  সন্তানটির শারীরিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। আর বড়টি নিঃসৃত তেলের কারণে দূষিত হয়ে যাওয়া নদীর জলে গোসল করতে গিয়ে জল খেয়ে ফেলে। বাড়ি এসেই তার রক্তবমি শুরু হয়ে যায়। পরদিনই মারা যায় সে। “টেক্সাকো তার প্রথম ২৫ বছরেই অরিয়েন্ট অঞ্চল থেকে ১৫০ কোটি ব্যারেল জ্বালানি তেল উত্তোলন করেছে। এক হিসাবে জানা যায় টেক্সাকো ইকুয়েডরের গভীর অরণ্যাঞ্চল থেকে এবং জলপ্রবাহগুলো থেকে ৩৪ কোটি ১০ লাখ গ্যালন অশোধিত তেল নিঃসৃত করে। ২০০৯ সালে টেক্সাকোর নিজস্ব হিসাবকে উদ্ধৃত করেই আমাজন রাইট ওয়াচ নামক একটি সংস্থা জানায়, কোম্পানিটি ১ হাজার ৮০০ কোটি গ্যালন পরিমাণ বিষাক্ত তরল বর্জ্য সরাসরি প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।  তা ছাড়া টেক্সাকো জঙ্গলের মধ্যে যেসব তেলকূপ খনন করেছিল সেগুলোর প্রতিটির পাশে অন্তত দুটি করে ময়লা ফেলার গর্ত খুঁড়ে রেখেছিল। ওইসব গর্তের ময়লা উপচে পড়েও স্থানীয় নদ-নদী ও জলাশয়গুলোকে দূষিত করে দিয়েছে। দীর্ঘ ৪০ বছরের তেল অনুসন্ধান এবং তেলের উৎপাদন অরিয়েন্ট অঞ্চলের ভূমি, মানুষ, প্রাণীকুল তার ক্ষেতের ফসলকে ধীরে ধীরে বিষক্রিয়ার শিকারে পরিণত করেছে। কোনোরকম বিকল্প উৎস না থাকার কারণে নাইজার বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের মতোই এখানকার আদিবাসীরা দূষিত জলে গোসল এবং তা দিয়ে রান্নার কাজ সারতে বাধ্য হচ্ছে। এই দূষিত জল থেকে অন্তত ৮ ধরনের ক্যান্সার হতে পারে বলে জানিয়েছেন হার্ভার্ড মেডিকেল সেন্টার ও ইকুয়েডরের স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিশেষজ্ঞরা। আসলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর তেলের প্রতি নেশা মানবসভ্য তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে।

ঢাকাকে  সচল করার বিকল্প নেই
আর কে চৌধুরী
রাজধানী ঢাকা ক্রমেই মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ঢাকাকে এখন বলা হচ্ছে যানজটের নগরী। প্রায় দেড় কোটি মানুষের এ মহানগরীতে মানুষের ঘোরাফেরা বা নির্বিঘেœ শ্বাস নেয়ার মতো মুক্ত পরিবেশের অভাবও প্রকট। মাঠ, পার্ক, গাছপালা ইত্যাদির সংখ্যা রাজধানী ঢাকা থেকে দিনকে দিন লোপ পাচ্ছে। নদ-নদী, খাল, লোক, পুকুর তো বিরল বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। যানজটে রাজধানী ঢাকা ক্রমেই অচল নগরীতে পরিণত হচ্ছে। রাজধানীতে জনসংখ্যার তুলনায় সড়কের সংখ্যা এমনিতেই কম। তারপরও রয়েছে স্বল্পগতির রিকশা ও প্রাইভেটকারের আধিক্য। ফুটপাত দখল করে দোকানপাট চালানো কিংবা রাস্তায় যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিংÑ এ মেগাসিটিতে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তার ওপর নির্মাণসামগ্রী রাখা এ নগরীতে অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না। ট্রাফিক নিয়ম না মানাকেই রাজধানীর যানবাহন চালকদের কাছে নিয়ম বলে পরিচিত। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই সাধারণ মানুষও। ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা না করে এ নগরীতে যেখানে-সেখানে রাস্তা পার হওয়ার কসরত চলে। ওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও নিচ দিয়ে রাস্তা পারাপার অনিয়মের বদলে এই নগরীতে নিয়ম হিসেবেই বিবেচিত হয়। পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, টেলিফোন ও গ্যাস লাইনের জন্য যখন-তখন রাস্তা খোঁড়া দেড় কোটি মানুষের এ মহানগরীতে প্রতিদিনের চিত্র বললে অত্যুক্তি হবে না। এর পাশাপাশি রয়েছে জনসভা ও মিছিলের মতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। রাস্তায় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করাকে কেউ কেউ রাজনৈতিক অধিকার বলে ভাবেন। কখনো কখনো গাড়ি ভাঙচুরকে ভাবা হয় গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড হিসেবে। চারদিকের অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা রাজধানী ঢাকার রাজপথকে সত্যিকার অর্থেই চলাচলের অযোগ্য করে ফেলেছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে দুর্বিষহ অবস্থায় ফেলছে যানজট। এক সময় ঢাকার পরিচিতি ছিল মসজিদের নগরী হিসেবে। এখন সে পরিচিতি ডিঙিয়ে যানজটের নগরী হিসেবে ঢাকার অভিষেক ঘটেছে। বলা হয়, আজকের যুগ হলো গতির যুগ। কিন্তু যানজট রাজধানীর মানুষকে ইতোমধ্যে গতিহীন করে ফেলেছে। বিদেশিদের কাছে ঢাকার যানজট একটি মূর্তমান সমস্যার নাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাজপথে অথর্ব হয়ে বসে থাকার বিড়ম্বনা এড়াতে অনেকে এ নগরীকে পাশ কাটিয়ে চলতে চান। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবেও ঢাকার যানজটকে চিহ্নিত করা হয়। ঈদ সামনে রেখে এ যানজট গত কয়েকদিন ধরে সীমা অতিক্রম করার যেন চেষ্টা চালাচ্ছে। রাজধানীর যানজট সহনীয় মাত্রায় আনতে স্বল্পগতির যানবাহন ও প্রাইভেটকারের সংখ্যাধিক্যের দিকে নজর দেওয়া দরকার। ট্রাফিক আইন যাতে সব ক্ষেত্রে কড়াকড়িভাবে মানা হয় সে ব্যাপারেও যতœবান হতে হবে। ফুটপাত থেকে দোকানপাট উঠিয়ে দেওয়া, যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া এবং দিনের ব্যস্ত সময়ে প্রাইভেটকার চলাচল কমিয়ে আনার কথাও ভাবতে হবে। গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার নির্মাণসহ যানজট নিরসনে সরকারের যেসব পরিকল্পনা রয়েছে তার দ্রুত বাস্তবায়নও জরুরি হয়ে উঠেছে। রাজধানী ঢাকা শুধু যানজট নয় নানা সমস্যার ভারে আক্রান্ত। প্রাত:ভ্রমণের মতো জায়গার অভাব দেড় কোটি মানুষের এই নগরীতে সত্যিকার অর্থেই প্রকট। ঢাকার পানি বিদ্যুৎ ও গ্যাস সমস্যা কতটা প্রকট তা বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। এগুলো ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আওতায় নিয়ে আসলে সমস্যার সমাধান সহজতর হত বলে অনেকের বিশ্বাস। ঢাকা নগরের পার্কগুলো (যদিও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কমসংখ্যক পার্ক রয়েছে) নগরবাসীর চিত্তবিনোদনের জন্য স্থাপিত হলেও বেশিরভাগ পার্কের তত্ত্বাবধান করে থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানÑ গণপূর্ত বিভাগ। কেন্দ্রীয় সরকারের মালিকানায় ঢাকা ওয়াসা ঢাকা নগরবাসীর পানি সরবরাহ করে, অথচ ঢাকা নগরের নিজস্ব ওয়াসা নেই। পল্টন ময়দানটি ঢাকা নগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হলেও এর নিয়ন্ত্রণভার ও মালিকানা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের। রাজউকের নিয়মানুযায়ী ঢাকায় বহুতল বাড়ি নির্মাণ করতে হলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা নগর করপোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস, উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) ও পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নিতে হয়। এক্ষেত্রে ঢাকা নগর করপোরেশন ছাড়া বাকি সব প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান। সেক্ষেত্রে ঢাকা মহানগরীর যাবতীয় অব্যবস্থাপনার জন্য মহানগরীতে করপোরেশনের দায়ভার কতটুকু। ঢাকা নগরে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে মেয়র ও কাউন্সিলররা যে কত অসহায় নিমতলীর ট্র্যাজেডিতেই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। গত বছর ৩ জুন ঢাকা নগরের নিমতলী এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্যে আগুন লেগে ১২৩ জন নাগরিকের প্রাণহানি ঘটে। ওই দুর্ঘটনায় নগর করপোরেশনের কোনো উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা দেখা যায়নি। আগুন নেভানো, ক্ষতিগ্রস্তদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, লাশ দাফন করা, গৃহহারাদের জন্য লঙ্গরখানা খোলা, সাময়িক বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, মানসিকভাবে ভারাক্রান্ত মানুষকে পরামর্শমূলক সহায়তা করাÑ এ ধরনের সবই করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের লোকজন। অথচ উন্নত বিশ্বে এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়। কয়েক মাস আগে নিউইয়র্কে একটি গাড়িবোমা বিস্ফোরিত হলে নগর মেয়রের নেতৃত্বে উদ্ধার তৎপরতা পরিচালিত হতে দেখা যায়। সেখানে নাগরিকদের সেবা দেওয়ার জন্য প্রায় সব বিভাগ নিউইয়র্ক নগর সরকারের অধীন কিংবা নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের কাজ হলো সহায়তামূলক ও পরামর্শমূলক। কোনো কারণে যদি নগর কর্তৃপক্ষ উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা চালাতে অক্ষম হয় তবে সেখানকার নিয়ন্ত্রণভার অবশ্যই কেন্দ্রীয় সরকার নেবে। আমাদের দেশের গ্রাম-গঞ্জে দেখা যায়, পরিবারের কোনো সদস্য দায়িত্বশীল ও সংসার চালাতে সক্ষম কিনা তা দেখার জন্য তাকে কিছু সম্পত্তি দিয়ে পৃথক করে দেওয়া হয়। একইভাবে স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করে একই সঙ্গে গ্রামে ও নগরে স্থানীয় প্রতিনিধিদের সংসার আলাদা করে দিতে হবে। ঢাকাকে মানুষের বসবাস করে তুলতে হলে এ মহানগরীতে নতুনভাবে কলকারখানা স্থাপন বন্ধ করতে হবে। রাজধানী থেকে গার্মেন্টশিল্পকে নির্দিষ্ট কোনো স্থানে স্থানান্তরের কথা ভাবতে হবে। প্রশাসন বিকেন্দ্রীয়করণ করে ঢাকার ওপর থেকে বাইরের জনস্রোতের চাপ কমানো দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, রাজধানী পরিচালনায় আইন-শৃঙ্খলা, যোগাযোগ, পানি, বিদ্যুৎ-গ্যাস উন্নয়ন সব খাতের সমন্বয় থাকা দরকার। অচল রাজধানীকে সচল করার সেটাই প্রকৃষ্ট উপায়।
লেখকঃ প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান , আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ,ঢাকা ।

“দাবি বিশ্ব মানবতার-যুদ্ধাপরাধীর হোক বিচার”
 সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১

ডা. সুব্রত ঘোষ
অনেক বাধা বিপত্তি আর বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে বিজয় দিবসের ৪০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে ৩ ডিসেম্বর ২০১১ “দাবি বিশ্ব মানবতার-যুদ্ধাপরাধীর হোক বিচার” স্লোগানকে বুকে ধারণ করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাঙালি জাতির প্রাণের সংগঠন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১-এর ৩য় জাতীয় কনভেনশন ২০১১। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সংগঠনগুলোর মধ্যে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১-এ একমাত্র সংগঠন যেখানে দল-মতের ঊর্ধ্বে থেকে মুক্তিযোদ্ধারা কাজ করে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, দেশকে সত্যিকারের মুক্ত করার জন্য। ত্রিশ লাখ শহীদ আর তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের বাংলাদেশ থেকে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা শেষ শত্র“টিকে তাড়াতে সেক্টর কমান্ডারবৃন্দ, সাব-সেক্টর কমান্ডারবৃন্দসহ সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে শান্তিপ্রিয় বাঙালিরা আজ সমবেত একই পতাকাতলে। আর সময়ের দাবি মেটাতে অগ্রগামী থেকে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১-এ সংগঠনটি  নেতৃত্ব দিচ্ছে আরো একটি লড়াইয়ের আশায়। এ লড়াই দেশকে রক্ষার লড়াই, এ লড়াই দেশকে  দেশদ্রোহীদের হাত থেকে রক্ষা করার লড়াই। জীবদ্দশায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে চান মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেক্টর কমান্ডাররা। তাদের দাবি অনেক দিন হয়ে গেছে। আর বিলম্ব কেন? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যত কালক্ষেপণ হবে এ বিচার নিয়ে মানুষের মনে ততই সংশয়ের সৃষ্টি হবে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১টি সেক্টরের কমান্ডারদের অধিকাংশই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। কেউবা বিদায় নিয়েছেন সময়ের চিরন্তন নিয়মে, কেউবা বিদায় নিয়েছেন দুর্ঘটনায় আবার কাউকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে ক্ষীণ স্বার্থ সিদ্ধির আশায়। এটাই প্রকৃতির নির্মম পরিহাস। যে ক’জন বেঁচে আছেন তারা আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার লে. কর্নেল (অব.) কাজী নুরুজ্জামান বীর উত্তম এবং ৫ নম্বর সেক্টর কমান্ডার  লে. জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলী বীর উত্তম এ বছরই মৃত্যুবরণ করেছেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ. কে. খন্দকার বীর উত্তম, মুক্তিযুদ্ধে এস ফোর্স প্রধান ও ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) কে. এম. সফিউল্ল¬াহ বীর উত্তম, ৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) সিআর. দত্ত বীর উত্তম, ১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক কমান্ডার কমান্ডার লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী বীর উত্তম, ২ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার  লে.  জেনারেল (অব.) এম. হারুন-অর-রশিদ বীর প্রতীক এখনো সক্রিয় রয়েছেন মাঠের আন্দোলনে। প্রতি মুহূর্তেই তারা দেশের এ প্রান্ত থেতে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তৃণমূল পর্যায়ে জনমত তৈরিতে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি, স্বাধীনতার পক্ষের জনমত সৃষ্টি এবং নতুন প্রজšে§ও মাঝে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারিত করার লক্ষ্যে পাঁচ বছর আগে তারা গড়ে তোলেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরদর্পে একের পর এক যুদ্ধজয়ী এই বীররা বলেন, কতিপয় যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের দোসর ছাড়া দেশের প্রতিটি স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ চায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। সেই লক্ষ্যে তারা গত জাতীয় নির্বাচনে রায় দিয়েছে। সরকার এ বিষয়ে অত্যন্ত আন্তরিক। তবে বিচার কার্যক্রমের ধীরগতি নিয়ে আমরা বিচলিত। নবম জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত পাস হয়েছে। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি, তদন্তকারী কর্মকর্তা, আইনজীবী প্যানেল নিয়োজিত রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান, কাদের মোল্ল¬া, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী মীর আব্দুল আলীমকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটক করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের শিরোমনি গোলাম আযমকে এখনো কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন তারা। বলেন, বিচার কার্যক্রমে কেন এত বিলম্ব হচ্ছে?
একে খন্দকার সংগঠনের চেয়ারম্যান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় পরিচালনার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ভেতরে-বাইরে যথেষ্টই সোচ্চার তিনি। একে খন্দকার বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে। দেশের মানুষের প্রাণের দাবি এটি। আর বর্তমান সরকারও এই বিচারের বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে তারা জনগণের কাছে অঙ্গীকার করেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে। তাই বিচার নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশ নেই। তিনি দৃঢ় আশা ব্যক্ত করে বলেন, যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন উৎস্বর্গ করেছেন একদিন না একদিন সে স্বপ্ন পূরণ হবেই। চার যুগ হলো মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এরই মধ্যে অনেক মুক্তিযোদ্ধা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তারা অনেক বেদনা নিয়ে এ দেশে যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালন দেখেছেন। এখনো যারা বেঁচে আছেন তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে চান। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। এই বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম সারাদেশে আন্দোলন চালিয়ে যাবে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্যই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। অপরাধীদের বিচার না করলে তার ফল ভোগ করতে হয়। তিনি বলেন, প্রতিশ্র“তি দিয়েও পাকিস্তান ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করেনি। তার ফল তারা এখন পাচ্ছে। অপরাধীদের বিচার না করলে দিনে দিনে সেখানে যে অপরাধ বেড়েই চলে তার প্রমাণ দেখছে বিশ্ববাসী। পাকিস্তান এখন বিশ্বে এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হিংসার জন্য চাই না। বিচার করা হচ্ছে জাতীয় জীবনের কলঙ্ক মোচনের জন্য। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হলে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা এমপি-মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছে। সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচারের আওতায় আনতে আরও ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে নতুন প্রজšে§র মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। সংগঠনের সহ-সভাপতি কেএম সফিউল্লাহ বিচারের ধীরগতি নিয়ে বিচলিত। অতি দ্রুত বিচার শুরু এবং রায় কার্যকর করার দাবি জানান তিনি। কেএম সফিউল্লাহ মনে করেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আর মোটেও বিলম্ব করা উচিত হবে না। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে উচ্চ আদালতে তাদের আপিল করার কোনো সুযোগ না রাখারও জোর আবেদন জানান তিনি। বলেন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধীরা যখন নির্বিচার মানুষ হত্যা করে, নিরীহ মানুষের ঘর-বাড়িতে আগুন দেয়, অসহায় নারীদের ধর্ষণ করে, তখন এই নরপিশাচরা কোনো আইন, মানবিকতার ধার ধারেনি। বিজয়ের প্রাক্কালে যখন দেশের কৃতী সন্তানদের ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তখন তাদের আকুল আবেদনও মানেনি ঘাতকরা। তাদের কথা পর্যন্ত শোনেনি। তাহলে এই ঘাতকদের কথা কেন শোনা হবে? তাদের আপিল করার সুযোগ কেন ট্রাইব্যুনালে থাকবে? তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে ট্রাইব্যুনাল যে রায় দেবে তাই চূড়ান্ত হবে। তিনি জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, জামায়াত নেতা শাহ আবদুল হান্নানসহ সকল শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতারের দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের মতো এত বড় অপরাধ করে যদি কেউ ছাড় পেয়ে যায় তাহলে তার পক্ষে যে কোনো অপরাধ ঘটানো সম্ভব। যে সমাজে অপরাধীর বিচার হয় না সে সমাজ সভ্য বলে নিজেদের পরিচয় দিতে পারে না। জামায়াত এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শত্র“ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, যারা ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তাদের বন্ধু ভাবা ঠিক হবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী হচ্ছে না বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে যে ২৩ মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দিয়েছে সেটা কোন্ মানদণ্ডে ছিল? খালেদা জিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নেয়া অবাকের কিছু নয় মন্তব্য করে শফিউল্লাহ বলেন, তার স্বামী জিয়া  যেহেতু জামায়াতকে রাজনীতির সুযোগ করে দিয়েছে, এমপি-মন্ত্রী বানিয়েছে সেহেতু খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষেই থাকবেন। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন বলে জামায়াত যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে তা মিথ্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বিচার শুরু করেছিলেন। এখন সেই বিচার কাজ শেষ করা হবে। দালাল আইন পুনরুজ্জীবিত করে সকল দালালকে কারাগারে নেয়ারও দাবি করেন কে এম সফিউল্লাহ। তিনি বলেন, জিয়া দালাল আইন বাতিল করায় প্রায় ১১ হাজার দালাল বিচার থেকে রক্ষা পায়। এটা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আরেক সহ-সভাপতি সিআর দত্তের মত হচ্ছে, মানুষ সোচ্চার হলেই যে কোনো সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে বাধ্য। তিনি বলেন, আমরা, আমাদের অধীনে সাব সেক্টর কমান্ডারবৃন্দ এবং একাত্তরের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জীবদ্দশায়ই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে চান। সিআর দত্ত বলেন, একটি অসাম্প্রদায়িক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তারা বীরদর্পে লড়াই করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করেছে। কতিপয় রাজাকার-আলবদর-আলশামস ছাড়া পুরো দেশের মানুষই নয় মাস মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত থেকেছে। সেই মানুষ আজ অনেকেই নেই। যারা আছে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিচার চাইলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, যারা এদেশের স্বাধীনতা চায়নি, যারা এখনো বাংলাদেশ বিশ্বাস করে না, জাতীয় সঙ্গীতে আস্থা নেই, জাতীয় পতাকাকে সম্মান করে না তাদের গাড়িতে, বাড়িতে অতীতে যখন জাতীয় পতাকা উড়েছে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর বেদনায় নীল হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমরা আর এমন দৃশ্য দেখতে চাই না। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এখন আবার সময় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিমন্ত্র ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। অন্যতম সহ-সভাপতি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রফিকুল ইসলাম বলেন, বিচার হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, এদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনাল হয়েছে। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) সংশোধন করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এখন আর এই বিচার থেকে সরে আসার কোনো অবকাশ নেই। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক এই বিচার করতে হবে। তবে বিচার শুরুতে সময় ক্ষেপণের সমালোচনা করে তিনি বলেন, বিলম্ব হলে বিচার নিয়ে মানুষের মনে সংশয় সৃষ্টি হবে। তাই এ কাজ ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। গত ২০১০ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের ২য় জাতীয় কনভেনশনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করতে সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দেয়ার দাবি জানান মুক্তিযোদ্ধারা। এ সম্পর্কে রফিকুল ইসলাম বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি এখন ট্রাইব্যুনালের বিষয়। সরকার এতে কোন হস্তক্ষেপ করছে না। তাই সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় কাজ। এ নিয়ে তাড়াহুড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই বিচার হবেই।
সহ-সভাপতি আবু ওসমান চৌধুরী আর সময় নষ্ট না করে অতি শিগগিরই দেশে-বিদেশে পালিয়ে থাকা সর্বস্তরের যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতারের দাবি করেন। তিনি বলেন, অনেক আগেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত ছিল। আমরা তা পারিনি। এটা জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা। তবে দেরিতে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই বিচার হবে গোটা জাতি এমনি প্রত্যাশা করে। সকল প্রতিষ্ঠিত যুদ্ধাপরাধীদের এখনই গ্রেফতারের দাবি করে তিনি বলেন, আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের? সরকার এত ভয় পাচ্ছে কেন? আমরা তো আছি। মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালে আমরা শক্তিধর পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করেছি। প্রয়োজনে আবারো যুদ্ধে নামতে প্রস্তুত আছি। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, তাদের গ্রেফতার নিয়ে লুকোচুরির কিছু নেই। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ৫০ জন প্রধান যুদ্ধাপরাধীর তালিকা প্রকাশ করেছে। প্রয়োজনে জেলাভিত্তিক যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাও প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেন, যারা এখনো বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি, যারা প্রকাশ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধিতা করছে তাদের কেন গ্রেফতার করছে না সরকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, এদেশ রাজাকারমুক্ত হবে, স্বাধীন দেশে আর কেউ কোনোদিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে নাÑ এই তো প্রত্যাশা প্রতিটি জীবিত মুক্তিযোদ্ধা আর স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের।
সংগঠনের মহাসচিব সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এম হারুন-অর-রশিদ বীর প্রতীক বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে আলোচনা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নতুন প্রজšে§র কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন ’৭১ সালে ৭ কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন, প্রত্যেকের দু’জন করে স্বজন থাকলেও বর্তমানে ১৪ কোটি মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে থাকার কথা। কিন্তু তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। তাই নুতন প্রজšে§র মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সৃষ্টি করতে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের আনাচে-কানাচে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। নিজ নিজ উদ্যোগে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ সকল জাতীয় দিবস ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দিনগুলো পালন করার জন্য সেক্টর কমান্ডারস  ফোরামসহ সকল স্তরের দেশ্রপ্রেমিক মানুষদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধের ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনিকে ’৭১ সালের মতো উজ্জীবিত করার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উদ্যাপনের ঠিক আগ মুহূর্তে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার নিরলস নিরন্তন সংগ্রামে নিয়োজিত এই জাতীয় বীরগণ আয়োজন করেছেন জাতীয় কনভেনশন-মুক্তিযুদ্ধ মেলা। জীবন সায়াহ্নে এসে আমাদের জাতীয় বীরগণ তাদের প্রিয় বাংলাদেশকে শত্র“মুক্ত করে রেখে যেতে চান পরবর্তী প্রজšে§র জন্য। সেই সঙ্গে এই নতুন যুদ্ধে নবীন প্রজš§কেও পাশে চান তারা। আর বড় জোর ৮/৯ বছর। এর পর প্রকৃতির নিয়মেই মুক্তিযোদ্ধা প্রজš§ চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাবে। বেঁচে থাকবে তাঁদের চেতনা আার আদর্শ। প্রাশ্চাত্য কৃষ্টি-কালচার আর চরম সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যে ধুঁকে ধুঁকে মরতে থাকা আমাদের নবীন প্রজš§কেই এগিয়ে আসতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে, এটি আমাদের দেশ-জাতি-সমাজের প্রতি আমাদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতাও বটে। সফল-সার্থক হোক সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১-এর ৩য় জাতীয় কনভেনশন। জয়তু মুক্তিযুদ্ধ, জয়তু মুক্তিযোদ্ধা, জয় বাংলা।
লেখক: কলামিস্ট, সংগঠক, চিকি
সক ও সমাজকর্মী
নগরীয় কৃষি ব্যবস্থায় পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব
আমিরুল ইসলাম হিরু
এককালের বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত ও গুহাবলীর মানুষ কালের বিবর্তনে আজ একদিকে নগর আর অপরদিকে গ্রামগুলিতে বসবাস করছে। তারা সেই আদিম যুগ থেকে খাদ্যের সন্ধানে দিনরাত পরিশ্রম করে এসেছে। সে সময় খাদ্যের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। জঙ্গলের ফলমূল, পশুপাখি ইত্যাদি শিকার করে খেয়ে তারা জঠরজ্বালা মিটিয়েছে। কালক্রমে কৃষিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলে নব সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়। আগের মত বন-জঙ্গল আর নেই, প্রায় সবই উজাড় হয়ে গেছে। জনসংখ্যার হার বেড়ে চলেছে দ্রুততার সাথে। একই হারে বেড়ে চলেছে ভূমির নানাবিধ ব্যবহার। বাড়ী-ঘর, কল-কারখানা নির্মাণ করতে গিয়ে ধ্বংস হচ্ছে আবাদী জমি।
আমাদের দেশ বাংলাদেশ, সুজলা-সুফলা চির সবুজ এই দেশটি জনসংখ্যার চাপে ভারাক্রান্ত, জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের ৫ম বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত। ৫৬ হাজার ১২৬ বর্গমাইল নিয়ে গঠিত এই দেশে ১৬ কোটি মানুষের বসবাস। এরই মধ্যে প্রমাণ পাওয়া গেছে এদেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষ নগরে বসবাস করছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ দেশের অর্ধেক মানুষ নগরে বসবাস করবে; আর ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের সমস্ত মানুষ নগরে বসবাস করবে। তাই এখন থেকেই পরিকল্পিত কৃষিবান্ধব নগর গঠনে ব্যর্থ হলে খাদ্য সংকটের কারণে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। আমাদের দেশে অতীত থেকেই নগরবাসীর খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা রেখে নগরায়ন করা হয়নি। তখন কৃষিকে বাদ দিয়ে নগরায়ন ভাবা হতো। এ কারণে রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে বসবাসকারী নাগরিকদের খাদ্যের সংকুলান হতো কৃষি থেকে। নির্ভর করতে হতো বিদেশ থেকে আমদানীকৃত খাদ্যশস্যের উপর। এখনও গ্রাম থেকেই চাল, ডাল, লবণ, মাছ, শাক-সবজি, তরি-তরকারি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব কিছুই পেয়ে থাকে। আমরা যারা নগরে বাস করি, তারা যদি একটু বুদ্ধি খরচ করে নিজ নিজ অবস্থানে থেকেই কিছু কিছু ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা করি, তাহলে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার অনেক ফলমূল যোগ হতে পারে। তাতে করে নগর জীবনের নিত্যদিনের খরচের পরিমাণ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ইট-পাথরের কংক্রিট দিয়ে তৈরী আধুনিক বাসা বাড়ীর ছাদে শাক-সবজি, ফলমূলের চাষ ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গত ১৪ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ হয়তো বা নগরবাসী অনেকের মনেই আশার সঞ্চার করেছে। রাজধানীর অদূরে হেমায়েতপুর এলাকার সরকার তাসেক তার বসতবাড়ির ছাদে লাউ আর বেগুনের চাষ করেছেন। তিনি রাসায়নিক সার ব্যবহার করেননি। গোবর সার, কচুরিপানা পচিয়ে এবং ছাই ব্যবহার করেছে সার হিসেবে। ময়লা-আবর্জনাও ফেলে দেননি তিনি তাও পচিয়ে সার তৈরী করেছেন। পোকা দমনের জন্য তিনি ব্যবহার করেছেন নিম পাতার নির্যাস। থেঁতো করা নিমপাতার রস পানিতে মিশিয়ে তিনি ছিটিয়ে দেন তার ফসলের বাগানে। তার দেখাদেখি পৌর এলাকার ব্যাংক কলোনীর লোকেরাও অনুরূপ আবাদ শুরু করে। বাড়ির ছাদে সবজি চাষ শুরু করেছেন তোফায়েল হোসেন, চান মিঞা, শফিকুল সহ অনেকে। ছাদে সবজি চাষের আরো হিড়িক পড়ে গেছে সাভার ব্যাংক টাউন, সবুজ বাচা, ছায়াবিথী ও শাহীবাগের এক বিস্তীর্ণ এলাকার বহুতল ভবনের ছাদে। ছাদে সবজি চাষ পদ্ধতির প্রবর্তক সরকার তাসেক তার ছাদে লাউ ছাড়াও মৌসুম ভেদে করলা, মরিচ, মিষ্টি কুমড়া, ধুন্দলসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি উৎপাদন করেন বলে তথ্য দিয়েছেন। সরকার তাসেকের মাতা তাহেরুন্নেছা বলেন, বহুতল ভবনের উপরের তলায় রোদের কারণে গরম অনুভূত হয়। কিন্তু ছাদে শাক-সবজি চাষ অব্যাহত রাখলে ভবনে সকল কামরা ঠাণ্ডা থাকে।
কৃষিকাজ গ্রামীণ মানুষের পেশা হলেও কৃষি বিভাগের বহু উর্দ্ধতন কর্মকর্তা, কর্মচারী ঢাকা শহরে বাস করেন; রাজধানীর বিভিন্ন ব্লকে নিয়োজিত আছেন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, কৃষিকাজ বিহীন ঢাকা শহরে বসবাসরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ তাদের মাসিক কার্যক্রমে ভূয়া প্রতিবেদন দাখিল করে দায়িত্ব শেষ করেন। আমরা জানি, গ্রামাঞ্চলে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ (ব্লক সুপারভাইজার) কৃষকদের নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্দিষ্ট অফিস কক্ষ রয়েছে। তারা ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন কমিটির সদস্যও। রাজধানীসহ বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন ও পৌর এলাকায় নিয়োজিত কৃষি কর্মকর্তাগণ ওইভাবে সিটি কর্পোরেশন কিংবা পৌরসভার সঙ্গে জড়িত নন। অর্থাৎ এখনও সরকার ও কৃষি সংশ্লিষ্ট গবেষকদের কাছে কৃষি মানেই গ্রাম, কৃষি মানেই মাঠ ও খাল-বিল। পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) বিজ্ঞানীরা মাটি ছাড়াই সবজি ও ফল চাষে সাফল্য পেয়েছেন। মাটি ছাড়া চাষাবাদের এই পদ্ধতির নাম হাইড্রোপনিক পদ্ধতি। তাছাড়া কচুরিপানা যদি পানিতে হতে পারে তাহলে শাক-সবজি জš§ানো কঠিন হবে কেন। তা বিজ্ঞানীরা ভেবে দেখতে শুরু করেছেন। কথায় আছে, প্রয়োজনই আবিস্কারের জননী। সব মিলিয়ে আগামীতে ‘নগরীয় কৃষি ’যে আমাদের খাদ্যের যোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে তা এখন নিশ্চিত করেই বলা যায়। সেজন্য আমাদের বর্তমানকার ও আগামীর নগরগুলো পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত করার জন্য ‘নগর সরকারের’ ভাবনাটি এখনই গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণে ছাড়া পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগর ও নগরায়ন সম্ভব নয়। নগর সরকার ব্যবস্থায় স্থানীয়দের অংশগ্রহণের সে সুযোগ রয়েছে। গত ১৯৯৭ সালের ১৩ জানুয়ারী এক জাতীয় সেমিনারে স্থানীয় সরকার গবেষক আবু তালেব ‘নগর সরকারের রূপরেখা’ তুলে ধরার পাশাপাশি আগামীতে বাংলাদেশ যে ‘নগরীয় বাংলাদেশ’ ও ‘নগরীয় কৃষির বাংলাদেশ’ হবে তা সর্বপ্রথম উপস্থাপন করেন। এই রূপরেখা অনুযায়ী নগর সংসদ, নগর প্রশাসন ও নগর আদালত মিলে ‘নগর সরকার’ গঠিত হবে। নগর সরকার স্বশাসিত, স্বাবলম্বী  প্রতিষ্ঠান হওয়ায় নগর সংসদ হবে নগরীয় ইউনিটের জন্য সার্বভৌম বিধানিক প্রতিষ্ঠান। এই  নগর সংসদ ‘এমপো’ অনুযায়ী নরনারীর ১০০-১০০ প্রতিনিধিত্বে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকায় নারীরাও পুরুষের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার সুযোগ পাবেন। তখন নগরপিতা নগরকে রক্ষা করার জন্য নগরবাসীর নিকটতম কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবেন।
আমিরুল ইসলাম হিরু: কৃষি গবেষক, সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের জন্য ক্যাম্পেইনার। 

ঘটনাবহুল ২০১১ সালের হালচাল
অরুণ ব্যানার্জী
সময়ের ঘর্ঘরিত রথযাত্রায় শেষ হতে চলেছে ২০১১ সাল। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা অতিবাহিত হওয়ার পর শুরু হবে ২০১২ সালের দিনপঞ্জি। চলতি বছর আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে অনেক ঘটনার সমাহারে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কিছু কিছু ঘটনা নিউজের শিরোনাম হয়েছে। দাগ কেটেছে জনমনে। এ নিয়ে পাঠক মনে চলবে অনেক বাদানুবাদ। চলতি বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী গবেষকদের কাছে ইতিহাসের উপাদান হয়ে থাকবে। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের কাছে ২০১১ সৃষ্টি করবে নতুনতর ব্যঞ্জনা। আশা-নিরাশার দোলাচলে হিসেব নিকেশ করবে অনুসন্ধানী মানুষ। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে খুঁজবে আগামী দিনে এগিয়ে চলার  প্রেরণা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে চলতি বছর সরগরম রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গন। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোজাহিদ, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী ও বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমের বিচার চলছে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। চলছে ‘অঘটন ঘটন পটীয়সী’ গোলাম আযম, মীর কাসেম আলীসহ আরো কিছু যুদ্ধাপরাধীর গ্রেফতারের প্রক্রিয়া। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের শ্লথ গতি মেনে নিতে পারছেন না সচেতন মানুষ। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাবার জন্য রোডমার্চের নামে পালন করেছেন জামায়াতের আমিরের ভূমিকা। মহাজোট সরকার চাচ্ছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত রাখতে। পক্ষান্তরে, ৪ দলীয় জোট যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এভাবে তারা দেশটাকে ‘মিনি পাকিস্তান’ বানাতে চায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে চলতি বছরের উল্লেখযোগ্য সময় আলোড়িত হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গন। একটি রিটের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট রায় দিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অরাজনৈতিক পদ্ধতি। তবে আগামী ‘দুই টার্ম’ পর্যন্ত এ ব্যবস্থা চালু রাখা যেতে পারে। কিন্তু আদালতের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আন্তঃ সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে যাচ্ছে। এ নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানান। রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলসমূহকে আলোচনায় বসতে আহ্বান জানান। প্রথমে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব রাষ্ট্রপতির উদ্যোগকে স্বাগত জানান। পরে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি না দিলে বিএনপি রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে সাড়া দেবে না। সর্বশেষ তিনি রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগ সংবিধানের এখতিয়ারবহির্ভূত বলে দাবি করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সরকারের ভূমিকা যেমন বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আদেশের পরিপন্থী; অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভূমিকাও তেমনি পরস্পরবিরোধী। জনগণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য চায় উৎকৃষ্ট পদ্ধতি। আদালত কর্তৃক গত বছর ৫ম ও ৭ম সংশোধনী অবৈধ ও অকার্যকর ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু তার পরেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বহাল রেখেছে সংবিধানে। এতে দেশের প্রগতিশীল, গণতন্ত্রমনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষকে হতাশ করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নির্বাচনী ইস্তেহার দিয়ে দেশের সচেতন মানুষ ও তরুণ প্রজš§কে আকৃষ্ট করেছিল মহাজোট সরকার। ইতোমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকিং সেক্টর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান,  এনজিও, সরকারি অফিস ইত্যাদিতে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে কম্পিউটারসহ আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। দেশের সব ক’টি ইউনিয়নে শুরু হয়েছে ‘ইসেফ’-এর ব্যবহারিক কর্মকাণ্ড। তবে মানুষ কম্পিউটারের ব্যবহার আরো সুগম ও সহজলভ্য হোক এটা চায়। গত ২১ ডিসেম্বর খুলনায় দেশের প্রথম আইটি ভিলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে। এটা সরকারের ইতিবাচক দিক।
কৃষি ও শিক্ষা খাতে সরকারের ঈর্ষণীয় সফলতা রয়েছে। কিন্তু সারের কিঞ্চিত মূল্যবৃদ্ধি ও পাঠ্যসূচিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে দায়সারা গোছের ভাব সরকারের ভূমিকাকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। স্বাস্থ্যসেবার মান বেড়েছে। শেয়ারবাজারে ধস ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মধ্যবিত্ত এবং নির্ধারিত আয়ের মানুষকে হতাশাগ্রস্ত করেছে। সরকার শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতা ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারায় চলতি বছরে জনগণের দুর্ভোগ বেড়েছে। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলে বরাদ্দ বন্ধ করায় দেশের সুনাম দারুণভাবে ক্ষুণœ করেছে। সরকার যোগাযোগমন্ত্রীর দফতর বদল করলেও তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি না দেয়ায় জনমনে প্রশ্নের শেষ নেই। চলতি বছর ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে রবীন্দ্র জš§ সার্ধশত বর্ষ উদ্যাপিত হয়েছে ঢাকায় ও দিল্লিতে। ঢাকার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারী। দিল্লির অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধকালীন বিমান বাহিনীপ্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খোন্দকার। উভয় অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ-ভারতের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ উপস্থিত থেকে সমৃদ্ধ করেছেন অনুষ্ঠানের দিনগুলোকে। ঢাকায় তিন দিনব্যাপী কবিতা উৎসবের উদ্বোধন হয় ১ ফেব্র“য়ারি। এবার এসেছেন নেপাল ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ত্রিপুরার কবি রাতুল দেব বর্মণ। আসামের কবি সুকুমার বাগচী, মেঘালয়ের কবি নাংকিনরিসহ এসেছিলেন ২২ জন কবি। বৃহৎ এ আয়োজনে প্রতিদিনই স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, একুশের গান, কবিতা, সেমিনার ও বিভিন্ন প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া ‘অন্য ভাষার কবিতা’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ অধিবেশন। ২০১১ সালে এসব ঘটনা সংস্কৃতি প্রিয়দের দারুণভাবে উজ্জীবিত করে। ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় শেখ হাসিনা ও ড. মনমোহন সিংয়ের শীর্ষ বৈঠক। এতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক-সাংস্কৃতিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়। কিন্তু তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ মুহূর্তে ঢাকায় না আসায় স্বাক্ষরিত হয়নি তিস্তার পানি চুক্তি। স্বাক্ষর হয়নি ট্রানজিট চুক্তি। এতে বাংলাদেশের কূটনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ২০১২ সালে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি চুক্তি ও ভারত-বাংলাদেশ ট্রানজিট চুক্তি করা সম্ভব হবে বলে রাজনৈতিক মহল আশা করে।
বাংলাদেশের এভারেস্ট বিজয়ী পর্বতারোহী মুসা ইব্রাহীম চলতি বছর জয় করলেন আফ্রিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট কিলিমানজারো। নর্থ আলপাইন ক্লাব বাংলাদেশের (এনএসিবি) এই অভিযানে মুসার সঙ্গে পর্বতচূড়া জয় করেন নিয়াজ মোর্শেদ পাটোয়ারী ও ওয়াসফিকা নাজরিন। তারা কিলিমানজারো বিজয়ের মাধ্যমে সেভেন সামিট এর দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রম করেন। বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা ১০ম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন ও ঢাকায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ১৭ ফেব্র“য়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক তার সফল উদ্বোধন। নারায়ণগঞ্জে প্রথমবারের মতো সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী শাসক দল আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেয়েও বিপুল ভোটাধিক্যে বিজয়ী হওয়াও চলতি বছরের আলোচিত ঘটনা। চলতি বছর নারী নির্যাতন, যৌতুক, এসিড সন্ত্রাসের মাত্রা কমেনি। চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক রুমানা মনজুরের ওপর তার পাষণ্ড স্বামী কর্তৃক পৈশাচিক নির্যাতনে সামাজিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ২০১১ সালে নারী নীতি অনুমোদন হয়েছে। কিন্তু আইন আকারে পাস হয়নি। তবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১১ সংসদে আইন আকারে পাস হয়েছে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে সরকারি চাকরির মেয়াদ বাড়ল দুই বছর। ৬১ জেলায় নিয়োগ করা হয়েছে জেলা পরিষদের প্রশাসক।
চলতি বছর বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে দেশ ও জাতি হারিয়েছে জাতীয় অধ্যাপক বরেণ্য বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সফল সেক্রেটারি জননেতা আব্দুর রাজ্জাককে। যুদ্ধাপরাধী বিরোধী আন্দোলনে তাদের ভূমিকা পূরণ হওয়ার নয়।
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলেছে। কনকনে ঠাণ্ডায় জবুথবু দেশ। বাড়ছে প্রচণ্ড শীতে মৃত্যুর সংখ্যা। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দুই ভাগে বিভক্তি ও প্রশাসক হিসেবে সরকারি নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজে।
চলতি বছরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটেছে অনেক ঘটনা। যা স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তš§ধ্যে ২০১১ সালের মধ্যপ্রাচ্য আফ্রিকার দেশ মিসর, তিউনেসিয়া, লিবিয়ায় সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন ও ক্ষমতাচ্যুতি বছরের আলোচিত ঘটনা। সুদান নামক দেশটি বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ সুদান নামে আÍপ্রকাশ করেছে ২০১১ সালে। মার্কিন কোম্পানিগুলো তেল সম্পদ লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে উপরোক্ত দেশগুলোতে। ইসরাইলের সহযোগিতায় আমেরিকা ইরান ও সিরিয়াকে জব্দ করার প্রয়াসে শুরু করেছে নানারকম তৎপরতা। যার বহির্প্রকাশ হয়ত ঘটবে ২০১২ সালে। পাকিস্তানের এ্যাবটোবাদ ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় শীর্ষ আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন বাহিনী কর্তৃক নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফীকে। গত ২৬ নভেম্বর আফগান সীমান্ত এলাকায় মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হয় ২৪ পাকিস্তানি। যুক্তরাষ্ট্র তদন্ত প্রতিবেদনে বিয়োগান্তক প্রাণহানির জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ ও নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু উক্ত প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তান। চলতি বছরে পাক-মার্কিন সম্পর্কে চলছে টানাপোড়েন। চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্র জনসংখ্যা বৃদ্ধি ৬৫ বছরের মধ্যে সর্বনিু। এ বছর আমেরিকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৭ শতাংশ। ১৯৪৫ সালে ছিল ০.৩ শতাংশ। গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়েছেন মাত্র ৭  লাখ ৩ হাজার মানুষ। সংখ্যার দিক দিয়ে ১৯৯১ সালের পর এ অভিবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে কম। উল্লেখ্য, ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিশ বছরে প্রতি বছরই ১০ লাখের বেশি অভিবাসন ভিসায় যুক্তরাষ্ট্র এসেছে। ইরাক ধ্বংস করে সৈন্য অপসারণ করল আমেরিকা। ২০০৩ সালে মার্চ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  সে দেশে মানবতা বিধ্বংসী পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে এই অজুহাতে হামলা চালায়। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে ১ লাখ ২৬ হাজার ইরাকী বেসামরিক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে ২০ হাজার ইরাকী সৈন্য ও পুলিশ সদস্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪ হাজার ৪৭৪ জন সেনা সদস্য ও ১৭৯ জন ব্রিটেনের সেনা সদস্য প্রাণ হারিয়েছে। এর বাইরে আহত হয়েছে ৩২ হাজার মার্কিন সৈন্য। জাতিসংঘের হিসেবে ১৭ লাখ ইরাকী এই যুদ্ধে হয়েছে বাস্তুচ্যুত। চলতি বছর সার্ক সম্মেলনে পাকিস্তান প্রতিবেশী দেশ চীনকে সদস্যভুক্ত করার আবেদন জানায়। ভারত এ ব্যাপারে ছিল নীরব। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে ভারতের এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সে দেশের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো উন্নয়ন। তা দিতে সক্ষম চীন। বাংলাদেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে চীন। চট্টগ্রাম-কুনসিং সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি নিয়ে এখনো সরকারি পর্যায়ে চলছে পরীক্ষা নিরীক্ষা। এ ছাড়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে চীন। ২০১১ সালে চীনের সঙ্গে কৌশলগত কারণে সম্পর্ক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছে ভারত। সীমান্ত বিরোধ অনেকটা প্রশমিত হয়ে চলতি বছরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সরাসরি কথা বলার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘হট লাইন’। চলতি বছর পাকিস্তানের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিশেষ করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। ইরান, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ত্রিদেশীয় পাইপ লাইন প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে চলতি বছর এগিয়ে চলেছে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা। ভারত সার্কভুক্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বাণিজ্য সুবিধা দেয়ার ব্যাপারে এগিয়ে এসেছে এক ধাপ। বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান ও আফগানিস্থানের ২৫টি বাদে (মদ, পানীয় ও তামাক জাতীয়) সব পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে ভারত। আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়াতে বাংলাদেশ সরকার ভারত, নেপাল, ভুটান ও মায়ানমারকে নিয়ে ৫ দেশীয় বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা এডিবির সহায়তা নিতে যাচ্ছে। পূর্ব এশিয়ার ৪টি দেশ লাওস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কম্পুচিয়ার আদলে এ বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। এটি ২০১১ সালে যোগাযোগের জন্য একটি ইতিবাচক দিক।
তুরস্কে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) ২৯ সাংবাদিককে গ্রেফতারের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে। ২০ ডিসেম্বর তুরস্ক পুলিশ কুর্দি বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে এমন অভিযোগে ৪০ সাংবাদিককে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে ১১ জনের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। নিউইয়র্কভিত্তিক সাংবাদিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা এ গ্রেফতার সাংবাদিকদের পেশাগত জীবনের ওপর অব্যাহত দমননীতির বহিপ্রকাশ বলে অভিযোগ করেন। হাঙ্গেরীর রাজধানী বুদাপেস্টে ২৩ ডিসেম্বর উšে§াচন করা হয়েছে প্রযুক্তিবিদ ও এ্যাপল ইনকর্পোরেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের একটি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। গত ৫ অক্টোবর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি পরলোকগমন করেন। উত্তর কোরীয় নেতা ৬৯ বছর বয়সী কিম জং ইল,  ভারতের প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার মনসুর আলী খান পতৌদি, ব্রিটেনের পিটার রোবাক, দক্ষিণ আফ্রিকার বেসিল ডি অলিভিয়েরায় জীবন দ্বীপ নিভে গেছে ২০১১ সালে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেঞ্চুরিয়ানে ৫০তম টেস্ট সেঞ্চুরির মাইলফলক পূরণ করেন ভারতীয় ব্যাটিং বিস্ময় শচীন টেন্ডুলকার। বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগে আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে ইংল্যান্ড ফুটবল দলের অধিনায়ক জন টেরিকে। চলতি মাসেই ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন লিভারপুলের ফুটবলার লুইস সুয়ারেজকে একই কারণে ৮ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। একই সঙ্গে তাকে করা হয় ৬২ হাজার ডলার জরিমানা।
চলতি বছর শান্তির জন্য নোবেল শান্তি বিজয়ী লিউ শিয়াও তো চীনে গণতান্ত্রিক সংস্কার আন্দোলনের দাবিতে কারাদণ্ড ভোগ করছেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর তার বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেয়ার জন্য প্যারোলে মুক্তিও পাননি। অথচ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে গ্রহণ করেনি যথাযথ ভূমিকা। ব্যবসায়িক গোপন তথ্য চুরির অপরাধে চীনা বিজ্ঞানী হুয়াং কেজুইকে ৭ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। অক্টোবর মাসে আদালতে উক্ত বৈজ্ঞানিক স্বীকার করেন যে, দুটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন উদ্ভাবিত কীটনাশক ও খাদ্যপণ্যের গোপন তথ্য চুরি করে চীন ও জার্মানিতে পাচার করেছেন তিনি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট