Year-18 # Issue-49 # 22 January 2012

তুরাগ তীরে লাখো মুসল্লির দোজাহানের কল্যাণ কামনা
আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো বিশ্ব ইজতেমা
অলিদুর  রহমান অলি, টঙ্গী থেকে
আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হলো তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। গতকাল রোববার বেলা ১টা ৩ মিনিটে মোনাজাত শুরু হয়। শেষ হয় ১টা ২২ মিনিটে। ১৯ মিনিট স্থায়ী এই  মোনাজাতে কয়েক লাখ মুসল্লির আমিন আমিন ধ্বনিতে পুরো টঙ্গী এলাকায় সৃষ্টি হয় স্রষ্টার প্রতি আর্তির আবহ।  মোনাজাত পরিচালনাকারী ভারতের মাওলানা জোবায়রুল হাসান  দোয়া করলেন বিশ্ব মুসলিমের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্যও দোয়া করা হয়।
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়েছিল গত ১৩ জানুয়ারি। ১৫ জানুয়ারি আখেরি  মোনাজাতের মধ্যদিয়ে তা শেষ হয়। দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয় ২০ জানুয়ারি। গতকাল রোববার আখেরি  মোনাজাতের মধ্যদিয়ে তা শেষ হলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০ হাজার বিদেশি মেহমানসহ প্রায় কয়েক লাখ মানুষ এই আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। কয়েকটি স্যাটেলাইট  টেলিভিশনে সরাসরি মোনাজাত সম্প্রচারের ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ পরোক্ষভাবে মোনাজাতে শরিক হতে পেরেছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি  মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছিলেন।  রোববার সকাল ৯টা থেকে  মোনাজাতের আগে চলে হেদায়াতি বয়ান। হেদায়াতি বয়ান করেন ভারতের মাওলানা সা’দ। বয়ানে তিনি বলেন, আল্লাহর গজবের বড় স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। তিনি আল্লাহর রাস্তায় (তাবলিগে) দাওয়াতি কাজে পায়ে হেঁটে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার পরামর্শ দেন। কারণ, পায়ে হেঁটে বেশি মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়া সম্ভব হবে। এতে পায়ে যে ধূলাবালি লাগবে তা জাহান্নামের আগুনকে ঠাণ্ডা করে  দেবে। তিনি তাবলিগের দাওয়াতি কাজে গিয়ে মানুষের কাছে ইহজগতের জন্য ছওয়াল করতে বারণ করে বলেন, যে জামাত ছওয়াল করে আল্লাহর সাহায্যের দরজা তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ছওয়াল করলে দিলে শয়তান স্থান পায়। দাওয়াতি কাজে সবচেয়ে বড় কাজ হলো নিজের নিয়তকে সহি করা এবং অন্যের কাছে ছওয়াল না করা।  শৈত্যপ্রবাহে রেকর্ড সংখ্যক মুসল্লি অসুস্থ: বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের  শেষ ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড সংখ্যক মুসল্লি অসুস্থ হয়েছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের কন্ট্রোল রুমের স্বাস্থ্য পরিদর্শক একেএম ফজলুর রশিদ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ৪ হাজার ২৮৫ জনকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আশংকাজনক অবস্থায় ২১ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই নিয়ে বিশ্ব ইজতেমার ২টি পর্বে প্রায় ৫ সহস্রাধিক মুসল্লি অসুস্থ হয়েছেন। বিশেষ করে ইজতেমা চলার সময়ে প্রচণ্ড শীত,  শৈত্যপ্রবাহ ও মাঝে মধ্যে হালকা বৃষ্টি হওয়ায় ইজতেমার পুরো সময়টিই ছিল কনকনে শীতের আমেজে। এরপরও মুসল্লিদের ইজতেমায় অংশগ্রহণ কমেনি। মোবাইল ফোনে মোনাজাতে অংশগ্রহণ: ইজতেমা স্থলে যেতে পরিবহন সংকট ও ভিড় এড়াতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লোকজন মোবাইল ফোনে  মোনাজাতে অংশ নেয় বলে জানা  গেছে। ইজতেমার মূল মাঠ থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে গাজীপুর সদরের চান্দনা  চৌরাস্তা ঈদগাহ ময়দানে কয়েক হাজার মুসল্লি জমায়েত হন। পরে তারা  মোবাইল ও পুলিশের ওয়াকিটকির মাধ্যমে ইজতেমা স্থলে  যোগাযোগ রক্ষা করে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি  মোনাজাতে শরিক হয়েছেন। একইভাবে  জেলার ভোগড়া, বাসন সড়ক ও শিমুলতলী এলাকায় মোবাইল  মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।  মোনাজাত শেষে যান ও জনজট: আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়া মানুষ একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে  ফেরার চেষ্টা করেন। মুসল্লিরা শুরু করে  দেয় হুড়োহুড়ি এবং আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। এতে টঙ্গীর আশপাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় জনজট ও যানজট। ফলে আবারো পায়ে হেঁটে রওনা দেয় মুসল্লিরা। আর পায়ে হাঁটা মুসল্লিদের চাপে দেশের বিভিন্ন জেলা  থেকে আসা মুসল্লিদের যানবাহন আটকা পড়ে যায়। আখেরি মোনাজাত শেষে হুড়োহুড়ি করে বের হতে গিয়ে কয়েক হাজার জুতা-স্যান্ডেল ফেলেই মাঠ ত্যাগ করেন মুসল্লিরা। মোনাজাত শেষে আশ-পাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে কয়েক হাজার জুতা-স্যান্ডেল পড়ে থাকতে  দেখা গেছে। আর  টোকাইদের বস্তায় ভরে ওইসব জুতা-স্যান্ডেল নিয়ে যেতে  দেখা গেছে। বিদায় বিশ্ব ইজতেমা ২০১২: বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পবিত্র হজ পালনের পর দ্বিতীয় অনুষ্ঠান বিশ্ব ইজতেমা। রূপকথার কাহিনী রয়েছে, টঙ্গীর তুরাগ তীরে এক সময় হানিফা সোনাভানের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে বীর হানিফাকে প্রতিপক্ষ যোদ্ধা  সোনাভান, তুরাগ তীরে মাটির নীচে দাবিয়ে দিয়েছেন বলে প্রবাদ রয়েছে। ১৯৬৬ পূর্ববর্তী সময়ে বিশ্ব ইজতেমা শুরুর পূর্বে এই তুরাগতীর ছিল পর্যটকদের চারণ ক্ষেত্র। এই স্থানে ইজতেমা শুরু হলেও এখনো রূপকথার বিখ্যাত স্থান টঙ্গীর এই তুরাগ তীরে মাঝে মাঝেই পর্যটক এসে পড়ে। বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার কাকরাইল মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব ইজতেমা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তে ১৯৪৮ সালে এই ইজতেমাকে চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়। এর ৯ বছর পর নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। এরপর ১৯৬৬ সাল থেকে গাজীপুর  জেলার টঙ্গী পৌর এলাকাধীন ঐতিহাসিক তুরাগ তীরে ১৬০ একর জমির উপর তা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে বিভক্ত হয়ে এই ইজতেমা হচ্ছে। প্রথম পর্ব ১৩, ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় পর্ব ২০, ২১ ও ২২ জানুয়ারি ইজতেমা অনুষ্ঠিত হলো। দুই পর্বে ১৫ ও ২২ জানুয়ারি দু’টি আখেরি  মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। দু’টি  মোনাজাতই পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের মুরব্বি দিল্লীর মাওলানা জোবায়ারুল হাসান।
২০১২ সালের দু’পর্বের ইজতেমায় প্রায় দুই শতাধিক যৌতুকবিহীন বিয়ে হয়। প্রথম পর্বে ১০৪টি ও দ্বিতীয় পর্বে ১০৩টি বিয়ে হয়। এবারের ইজতেমায় প্রায় ১শ’টি দেশের ২০ হাজারেরও অধিক বিদেশি মেহমান অংশগ্রহণ করেন। দেশগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো- মিসর, ওমান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, অস্ট্রেলিয়া, ব্র“নাই, কানাডা, কম্বোডিয়া,  ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, ইরান, জাপান, মাদাগাস্কার, মালি, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, পানামা, সেনাগাল, দ. আফ্রিকা, তানজেনিয়া, ত্রিনিদাদ, রাশিয়া, আমেরিকা, জিম্বাবুই, বেলজিয়াম, ক্যামারুন, চীন, কমোরেস, ফিজি, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, সুইডেন, থাইল্যান্ড, তার্কি, যুক্তরাজ্য, জাম্বিয়া, কোরিয়া, আলজিরিয়া, ডিজিবুতি, ইথিওপিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, কুয়েত, মরক্কো, কাতার, সোমালিয়া, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, পাকিস্তান, বাহরাইন, ইরিত্রিয়া, জর্দান,  মৌরিতানিয়া, ভারত, সুদান ও দুবাই।  এ ছাড়া দু’পর্বে ১৫ মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে শহীদ হন। প্রথম পর্বে ১২ জন ও দ্বিতীয় পর্বে ৩ জন মারা যান। দ্বিতীয় পর্বে যারা মারা গেছেন তারা হলেন- সুনামগঞ্জের আফজাল মিয়া (৭৭),  নোয়াখালীর নজীর আহমেদ (৭২) ও পাবনার  আ. সামাদ (৬০)। এবারে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে সরকার সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর মধ্যে বিভিন্নভাবে প্রায় ১০ হাজারের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত করা হয়।

 সরকার কল্পকাহিনী  তৈরি করে বাকশাল কায়েম করতে চায়: বিএনপি
নিজস্ব প্রতিবেদক
আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। এ দলটি যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে। এবারো ক্ষমতায় এসে বিভিন্ন কল্পকাহিনী তৈরি আর পরিকল্পনা করে বাকশাল কায়েম করতে চায়। গত শনিবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বিএনপির নেতৃবৃন্দ এ অভিযোগ করেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন জিয়াউর রহমানের ৭৬তম জš§বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এ আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দলটির বর্তমান চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়া। সভাপতির বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ হচ্ছে সেই দল যারা একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছে। সকল পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে মাত্র চারটি পত্রিকা নিজেদের অধীনে চালু রেখেছিল। যারা কোনোদিন গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করে না। অতীতের মতো এ দলটি এবারো ক্ষমতায় এসে একদলীয় বাকশাল কায়েম করতে বিভিন্ন কল্পকাহিনী  তৈরি করছে। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ হচ্ছে সেই দল যাদের সময় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। বাসন্তি মাছ ধরার জাল দিয়ে লজ্জা নিবারণে বাধ্য হয়েছিল। এক টুকরো রুটির জন্য কুকুরের সঙ্গে মানুষকে লড়াই করতে হয়েছে। হত্যা, গুম, খুন বেড়ে গিয়েছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও একই ঘটনা ঘটছে। সীমান্তে হত্যা অব্যাহত রয়েছে। গুম, খুন, মামলা দিয়ে বিরোধীদের ওপর নির্যাতন চালনো হচ্ছে। সীমান্তে হত্যা নির্যাতন স্বাভাবিক ঘটনা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির এই নেতা বলেন, ধিক্কার জানাই আওয়ামী লীগকে। ধিক্কার জানাই আশরাফুল ইসলামকে। তিনি আরো বলেন, যে আওয়ামী লীগ সীমান্তে এদেশের সন্তানকে নির্যাতন করে হত্যা করা হলেও প্রতিবাদ করতে পারে না, তারা স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে বড় বড় কথা বলতেও পারে না। স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, আজকে দেশের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ভারতের একটি রাজ্য। আর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব আছে একথাটি মনে করে না, বিধায় ভারত তাচ্ছিল্য করে। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করে না। তিনি সরকারের সমালোচনায় বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর দিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে ভারত তিস্তার পানি দেয়ার কথা থাকলেও দেয়নি । উপরন্তু ১৮টি নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করেছে। বিএনপির এই থিংক ট্যাংক বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী এনে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে বাকশাল কায়েম করেছিল। এবারো ক্ষমতায় এসে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করতে চায়। তিনি আরো বলেন, চতুর্থ ও পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্যে কোনো পর্থক্য নেই। একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। সরকার এ সংশোধনীর মাধ্যমে বারবার একটি দল ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ কখনো গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তারা মুখে বলে এক, করে আর এক। নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, আওয়ামী লীগ যেখানে ব্যর্থ জিয়াউর রহমান সেখানে সফল। এদেশের মানুষ কখানো জিয়াউর রহমানকে ভুলে যেতে পারবেনা। কারণ দেশের সংকটকালীন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ যখন জাতিকে দিকনির্দেশনা না দিয়ে দিশেহারা করেছিল তখন জিয়াউর তাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে মানুষের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। এদেশের মানুষকে দিয়েছেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যিনি অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করেছেন। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাই এ সরকারের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে আরেকটি যুদ্ধ করতে হবে। যে যুদ্ধ হবে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভোটের অধিকার রক্ষার যুদ্ধ। বিএনপির প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক এমাজ উদ্দিন আহমদ, ডা. অধ্যাপক আব্দুল মাজেদ, মাহমুদুর রহমান, অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। 


বিএনপি কখনো সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন করবে না: মওদুদ
নিজস্ব প্রতিবেদক
বিএনপি কখনো সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন করবে না বলে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে নাগরিক ফোরাম আয়োজিত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বিএনপির সিনিয়র এ নেতা এসব কথা বলেন। ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে মওদুদ বলেন, আমরা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই- বিএনপি কোনোদিন কোনো সেনা অভ্যুত্থানকে সমর্থন করবে না। বিএনপি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস করে। এর মাঝে সেনা অভ্যুত্থানের মতো আর কোনো বাধা বিএনপি দেখতে চায় না। তিনি বলেন, বিএনপি দেশের জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন করছে। এজন্য শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি আদায়ের চেষ্টা করছে। বিএনপিকে গণতান্ত্রিক দল অ্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছিলেন। সুতরাং গণতন্ত্রের আমানত রক্ষার্থে বিএনপি কখনো কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় খুশি হয়েছি মন্তব্য করে তিনি বলেন, তবে সরকারের ব্যর্থতায় সেনা অভ্যুত্থানের মতো চতুর্দিকে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ নেতা বলেন, সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। দেশের জনগণকে আন্দোলনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে মওদুদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত বিএনপি আন্দোলন চালিয়ে যাবে। আয়োজক সংগঠনের সভাপতি আব্দুল্লা হিল মাসুদের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, ইসলামী ঐক্যজোটের সভাপতি আবদুল লতিফ, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রমুখ।


যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম গ্রেফতার: আমাদের কিছু কথা
অরুণ ব্যানার্জী
অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সাবেক আমীর গোলাম আযম গ্রেফতার হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এ দোসরকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন দেয়। অধ্যাপক গোলাম আযম আদালতে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থনা করেন চলতি মাসের ১১ তারিখে। উভয়পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনার পর বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠাবার নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে আগামী ১৫ ফেব্র“য়ারি সাবেক এই জামায়াত নেতার অভিযোগ গঠনের পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়। যুদ্ধ অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত গোলাম আযম ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ায় গোটা এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। জামিন শুনানির আদেশের পর হুইল চেয়ারে বসিয়ে বেলা ১১-৫০ মিনিটে গোলাম আযমকে প্রিজন ভ্যানে (ঢাকা-১৪৬৪) তোলা হয়। ঠিক দুপুর ১২টায় তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠাতে প্রিজন ভ্যানটি রওনা দেয়। এ সময় প্রিজন ভ্যানের সামনে পেছনে দেখা যায় পুলিশের কড়া প্রহরা। দুপুরে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেয়ার পথে গোলাম আযম অসুস্থ বোধ করলে তাকে হাসপাতালের হƒদরোগ বিভাগে নেয়া হয়। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গোলাম আযম সুস্থ আছেন। মেডিকেল বোর্ড জানিয়েছে তাকে আর হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেয়ার প্রয়োজন নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গত ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সভা, সমাবেশ ও সেমিনারে গোলাম আযম ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে অনেক স্পষ্ট কথা সাহসিকতার সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। তিনি যা বলেছেন তার মমার্থ এই যে, গোলাম আযম হচ্ছে ইসলামের যম। গোলাম আযমরা ইসলামের আলোয় আলোকিত নয়Ñতারা হচ্ছে আলেয়া। প্রগতির প্রতিবন্ধক। জনতার চেতনার বিপক্ষে তাদের অবস্থান। দেশের মানুষ যখন জল্লাদ খান সেনাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন; তখন গোলাম আযম ও তার দোসররা কাজ করছে তাদের পথপ্রদর্শক হয়ে। তারা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন তথা অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে করেছে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। ২৫ মার্চ ১৯৭১। ইতিহাসের এক জঘন্যতম দিবস। বাঙালি জাতিকে চিরতরে নিঃশেষ করে গোলাম বানাবার জন্য বর্বর পাক বাহিনীর সে এক পৈশাচিক উল্লাস। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ‘পার্টনার ইন ক্রাইম’ জুলফিকার আলী ভুট্টোর নীল নকশায় ইতিহাসের ধিক্কৃত খুনি টিক্কা খান ২৫ মার্চের কালো রাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালিদের ওপর। এ নিয়ে নিন্দা ও ধিক্কারের ঝড় বয়ে যায়। গোলাম আযম ’৭১-এর ৪ এপ্রিল নরঘাতক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে তার হাতকে শক্তিশালী করার আশ্বাস দেন। ৬ এপ্রিল তিনি টিক্কা খানের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। তিনি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন যে ‘ভারতের এই অভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্য এদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করবে’ (দৈনিক পাকিস্তান ৭ এপ্রিল ১৯৭১) পাকিস্তানের ঘাতক সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গোলাম আযম ঢাকায় শান্তি কমিটি গঠন করেন ১০ এপ্রিল। এ শান্তি কমিটির উদ্দেশ্য ছিল বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে সহযোগিতা করা। মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করা। এর জন্য যত রকম নির্যাতন সেলে মুক্তিযোদ্ধাদের অত্যাচার করা হয় তার সহযোগী হন গোলাম আযম ও তার সঙ্গীরা। শান্তি কমিটির প্রথম বৈঠকে গোলাম আযম হানাদার বাহিনীর ২৫ মার্চ কালোরাতে জঘন্যতম নরমেধযজ্ঞ সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করার জন্য সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনগণকে আখ্যায়িত করেন ‘ইসলাম বিরোধী’ ও ‘দুষ্কৃতকারী’ হিসেবে। ১২ এপ্রিল ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তি কমিটির মিছিলে নেতৃত্ব দেন গোলাম আযম। মিছিল শেষে তিনি গণহত্যাকারী পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন (দৈনিক সংগ্রাম, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১) ২২ এপ্রিল গোলাম আযম দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি রাষ্ট্রবিরোধী লোকদের হিংসাÍক ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ সম্পর্কে জানিয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য বিবৃতি দেন। তিনি শান্তি কমিটির কর্মতৎপরতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করেন। ১৪ আগস্ট ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। এ দিবসে তিনি বলেন: ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য শান্তি কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শান্তি কমিটি যদি দুনিয়াকে জানিয়ে না দিত যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দেশকে অখণ্ড রাখতে চায়, তবে পরিস্থিতি হয়ত অন্যদিকে মোড় নিত। তিনি বলেন, দেশকে রক্ষার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর, তাই মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব শান্তি কমিটির হাতে তুলে নিতে হবে। এছাড়া, ঘরে ঘরে যেসব দুশমন রয়েছে তাদের খুঁজে বের করার ওপরও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন’ (দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ আগস্ট ১৯৭১)। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সকল দুষ্কর্মের সহায়তাকারী গোলাম আযম। তিনি ‘শান্তি কমিটি’র অশান্তিমূলক তৎপরতাতেই শুধু খুশি ছিলেন না। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠনেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তার নির্দেশে জামায়াত নেতা একেএম ইউসুফ (খুলনার খবরের কাগজের হকার) ’৭১-এর মে মাসে খুলনার খানজাহান আলী রোডে একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে গঠন করেন রাজাকার বাহিনী। প্রথম পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী ছিল শান্তি কমিটির অধীনে। পরে ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান ‘পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স ১৯৭১’ জারি করে। অতঃপর আনসার বাহিনীর বিলুপ্তি ঘটিয়ে রূপান্তরিত করা হয় রাজাকার বাহিনীতে। রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব ছিল জামায়াতের হাতে। তাদের সংক্ষিপ্ত সামরিক ট্রেনিং দেয়া হয়। তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৃষ্টি করে তাণ্ডব। জাতি ধর্ম বর্ণনির্বিশেষে চালানো হয় ব্যাপক লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ। মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল নেতা-কর্মীদের হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ছিল তাদের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক কর্মসূচি। এমনকি তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে যুবতী মহিলা সরবরাহ করে তাদের ভোগলিপ্সা মেটাত। গোলাম আযমের নির্দেশে সারাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু নারী-পুরুষকে জোরপূর্বক তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের পথপ্রদর্শক হিসেবে গোলাম আযমের জঘন্য ভূমিকা প্রকৃতপক্ষে মানবতাবিরোধী ভূমিকারই নামান্তর। ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার ‘হোটেল এম্পায়ারে’ এক কর্মিসমাবেশে গোলাম আযম বলেন: ‘পাকিস্তান টিকিয়ে রাখতে জামায়াতে ইসলামী শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে।’ (দৈনিক পাকিস্তান ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১) গোলাম আযম যে কত নৃশংস এবং জঘন্য তার বড় প্রমাণ আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন। তারা এ বাহিনীর মাধ্যমে মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জেল হায়দার চৌধুরী, সিরাজউদ্দীন হোসেন, সন্তোষ ভট্টাচার্য্য, জে সি  দেব থেকে শুরু করে দেশের বরেণ্য শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ প্রগতিশীল ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। জামাতীদের মুখপত্রে ‘আলবদর’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বলা হয়: ‘আলবদর’ একটি নাম, একটি বিস্ময়। আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা। যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী আলবদর সেখানেই। যেখানে দুষ্কৃতকারী আলবদর সেখানেই। ভারতীয় চর কিংবা দুষ্কৃতকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ ‘আজরাইল’ (দৈনিক সংগ্রাম, ১৪ সেপ্টেম্বর)। গোলাম আযমের বাংলাদেশ বিরোধী অপতৎপরতা স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তিনি ’৭১-এর ২৭ মে মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে ‘দুষ্কৃতকারী’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি তাদের বিচারের জন্য বিশেষ ‘ট্রাইব্যুনাল’ গঠনের আবেদন জানান পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনীর কাছে। পাক বাহিনী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অনুপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের নামে প্রহসন চালায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিদের সদস্যপদ বাতিলের জন্য আবেদন জানান গোলাম আযম। তাতেও সাড়া দেয় পাকিস্তান সরকার। তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত করা হয়। এমনকি বাজেয়াপ্ত করা হয় তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি। একাত্তরের ঘাতক গোলাম আযম পাকিস্তানকে তুলনা করেন ‘আল্লাহর ঘর’ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পাকিস্তান থেকে বিমান নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় শহীদ হন মতিউর রহমান। ঘাতক গোলাম আযম এ সম্পর্কে বলেন বিমানের অপর পাইলট মিনহাজ রশীদ দুষ্কৃতকারী বুঝতে পেরে তাকে আঘাত করেছে। মতিউরকে হত্যা করে মিনহাজ রশীদ বীরত্ব দেখিয়েছেন বলে দাবি করেন গোলাম আযম। এই হচ্ছে গোলাম আযম নামক ব্যক্তিটির মানবিক উদারতা, তাও আবার ইসলামের নামে। ২৬ নভেম্বর গোলাম আযম পাক বাহিনীর আসন্ন পরাজয় অনুধাবন করে লাহোরে পাড়ি জমান। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশে গণহত্যা বজায় রাখতে জনসভায় বিবৃতি প্রদান অব্যাহত রাখেন। তিনি মুক্তিবাহিনীকে দুষ্কৃতকারী, ভারতের চর আখ্যায়িত করে পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচিত করেন। বুদ্ধিজীবী হত্যা তার মদতেই হয়। হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে জার্মানিতে বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছিল, বাংলাদেশ একই উদ্দেশ্য নিয়ে এই জঘন্য কাজটির পরিকল্পনা করেন গোলাম আযম। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে ৬২টি অভিযোগ এনে যথার্থ কাজই করেছেন। ৩০ লাখ নর-নারীর আÍদান ও ৩ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের পেছনে জড়িয়ে রয়েছে গোলাম আযমের জঘন্য দুষ্কর্মের নাম। ১৯৭২ সালে তিনি পাকিস্তানে বসে ‘পাকিস্তান পুনরুদ্ধার সপ্তাহ’ পালনের ঘোষণা দেন। পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফর করেন ও বাংলাদেশ বিরোধী অপতৎপরতা এবং অপপ্রচারে অংশ  নেন। জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেন। গত মাসে গোলাম আযম দম্ভোক্তি করে বলেছিলেন এ সরকার তাকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা রাখে না। তারপরেও আইনের প্রক্রিয়ায় তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। আমরা তার দুষ্কর্মের বিচার চাই। এ বিচার যাতে দীর্ঘায়িত না হয় সেদিকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ন্যূরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে যাদের সামান্যতম ধারণা আছে তারা অবশ্যই জানেন ঢাকায় যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে তা অনেক বেশি স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। এসব যুদ্ধ অপরাধীর বিচারের জন্য বয়স কোনো ফ্যাক্টর নয়। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির সম্প্রতি বলেছেন: গোলাম আযমের অপরাধ প্রমাণে বেশি সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। জামায়াতের মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’ই তার অপরাধ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। আমরা তাই ঘাতক দালাল গোলাম আযমসহ অন্য যুদ্ধাপরাধীদের নজীরবিহীন অপকর্মের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
ক্রন্দনময় নিখিল হৃদয় তাপ দহন দীপ্ত 
ওয়াহিদ নবী
অবশেষে গোলাম আযম গ্রেপ্তার হলেন। মুনতাসীর মামুন সাহেব বলেছিলেন যে, রাম ছাড়া যেমন রামায়ণ উপাখ্যান পূর্ণ হয় না তেমনি গোলাম আযম ছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের তালিকার পূর্ণ হয় না। গোলাম আযমের গ্রেপ্তারের সংবাদ শুনে বাংলার সচেতন মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে । ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানের নরপিশাচরা আর তাদের দোসররা। পৃথিবীর ইতিহাসে এতো কম সময়ে এতো বেশি নরহত্যা আর কোথাও হয়নি। এ ছাড়াও হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কতোজন আহত হওয়ার কারণে সীমিত জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই। অগ্নিসংযোগ আর ধ্বংসলীলায় বিধ্বস্ত হয়েছে দেশ। এইসব তা-বের জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার আজ ৪০ বছর পরও হয়নি। কেন হয়নি সেটা ভেবে দেখার মতো। আজো একদল মানুষ এই বিচারের প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এদের চিনে রাখা উচিত। কেন তারা এমন করছে তা জেনে রাখলে ভবিষ্যতে জাতি অনেক অঘটন এড়াতে পারবে জাতি। একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলো স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। নিহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্য-সদস্যাদের কান্নায় বাংলার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে রয়েছে। মাথার ওপর চাল নেই হাজার হাজার মানুষের। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিধ্বস্ত। উৎপাদনের মাধ্যমগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত। দেশের প্রশাসন অনভিজ্ঞ। কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ভিার ঝুলি’ বলে অপমানিত করেছিল। তার সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতা করেছিল। এ জন্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তারা বাংলদেশের বিরুদ্ধে নানারকমের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত থাকলো। সঙ্গে থাকলো তাদের দোসররা। নতুন বিশেষণ নিয়ে মেতে উঠলো একদল সমাজতন্ত্রী। এমনি নানা কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার যতোটা অগ্রগতি হওয়া উচিত ছিল তা হলো না। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ২৯ হাজার মানুষ তখন কারাগারে। ১২ হাজার মামলা যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে। এদের পরিবারের হাজার হাজার সদস্য-সদস্যা বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এসব কারণে এবং অর্থনীতিকে সচল করবার জন্য বঙ্গবন্ধু সাধারণ মা ঘোষণা করেন। কিন্তু সরকার স্পষ্ট করে আনিয়ে দেয় যে, নিম্নোলিখিত অপরাধীরা মা পাবে না । ১. যারা দেশদ্রোহিতা, হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে অভিযুক্ত; ২. দালাল মন্ত্রী, উপদেষ্টা, রাজাকার কমান্ডার; ৩. শান্তি কমিটির নেতা। প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে স্বাধীনতা-উত্তরকালে কিছু নৈরাশ্যের কারণ ঘটেছিল। একদল মানুষ তীব্রবেগে ধ্বনি হতে তৎপর হয়ে উঠলো। বঙ্গবন্ধু এদের ‘চাটার দল’ বলে বর্ণনা করে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো ভালো হলে ভালো হতো। যুবসমাজের একাংশের ওপর নৈরাশ্য নেমে আসে। ‘এই রক্তে ভেজা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিল, / জীর্ণ জীবনের কুলে আজ তারা বেছে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার। / আজ তারা আলোহীন খাঁচা খুঁজে নিয়েÑজেগে থাকে রাত্রির গুহায়’। (রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ)
সুযোগ বুঝে অন্ধকারের জীবরা আঘাত হানে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে জিয়াউর রহমান মতায় এলে স্বাধীনতা বিরোধীদের সপে টেনে নেন। বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক এলেক্সি দি টকোভিল বলেছিলেন, ‘ইতিহাস একটা চিত্রশালার মতো। এখানে খুবই কম চিত্র মৌলিক বা নতুন। প্রায় সবগুলো নকল’। জিয়াউর রহমানের কার্যকলাপ ল্য করলে টকোভিলের উক্তির যথার্থতা প্রমাণিত হয়। ধর্মের নামে ব্যাপক হত্যাকা-ে জড়িত হওয়ার জন্য পাকিস্তানের জামাত নেতা মওদুদীকে প্রাণদ- দেয়া হয়। সেনাকর্তা আইয়ুব খান মতায় এসে মওদুদীর প্রাণদ- বাতিল করে দেয়। উদ্দেশ্য একটাই আইয়ুব খান বেসামরিক লোক চায় তার দলে। জিয়াউর রহমানেরও একই অবস্থা। জিয়াউর রহমানের সমর্থনে পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী গোলাম আযম বাংলায় আসে এবং পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও বাংলাদেশ থেকে যায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যারা জনগণ কর্তৃক ধিকৃত হয়েছিল তারাই আইয়ুব খানের দলে ভিড়েছিল। তেমনি ’৭১-এর গণধিকৃতরা জিয়ার দল ভারী করে। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীরাই তো জিয়ার দলের হর্তাকর্তা কাজেই তাদের বিচার না হওয়াই স্বাভাবিক। শাহ আজিজুর রহমান কি নিজের বা বন্ধুদের বিচার করবে। এরশাদ সরকার শুধু দেরিতে আসা জিয়া সরকার। একই ঘটনার ‘অ্যাকশন রিপ্লে’। খালেদা সরকারের মাথায় বসে আব্দুর রহমান বিশ্বাস। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে কে?
গোলাম আযম পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে আসে কিন্তু পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নাগরিত্বহীন অবস্থায় জামাতের আমির নির্বাচিত হয়। বাংলার মানুষ ফুঁসে উঠে। গঠিত হয় ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। আপন সন্তান রুমিকে হারিয়ে শত সন্তানের মা হন জাহানারা ইমাম। বাংলার কৃতী সন্তানরা হন এই সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। গণআদালতে প্রতীকী বিচার হয় গোলাম আযমের, প্রতীকী ফাঁসি হয় তার। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সরকারকে অনুরোধ জানায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার। ঘাতক-দালালদের পুনর্বাসনকারী জিয়া সরকারের খালেদা জিয়া সরকার ঘাতক দালালদের বিচারের ব্যবস্থা তো করেইনি। তারা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ২৪ জন সদস্যের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ নিয়ে আসে (ধৃষ্টতা ছাড়া আর কী বলা যায়!)। মোহাম্মদ মহিউস সুন্নাহ ‘ঘাতক নির্মূল কমিটির আইনগত বৈধতা’ নামে একটি সারগর্ভ প্রবন্ধ লিখেন। যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি প্রাঞ্জল পটভূমিকা লিখেন জনাব মসিউস সুন্নাহ। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পর্কে জাতিসংঘের মনোভাব বিশ্লেষণ করেন। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্বন্ধে আন্তর্জাতিক আইনের কথা আলোচনা করেছেন তিনি। তিনি বলেন যে, ‘বাংলাদেশের বিগত সরকারগুলো বিশ্বজনের নৈতিক আবেদনকে উপো করেছেন বিভিন্ন ধরনের টালবাহনা দিয়ে। বাংলাদেশের জনগণ কিন্তু এ ব্যাপারে বারবার দাবি তুলেছেন কিন্তু এসব দাবি সমানভাবে উপেতি হয়েছে জনবিচ্ছিন্ন সরকারগুলো কর্তৃক’। একটি জনবিচ্ছিন্ন সরকার জনগণের ইচ্ছা প্রতিফলিত করতে পারে না। এরূপ েেত্র জনগণের ওপর কিছু নৈতিক দায়িত্ব বর্তায়। এ অবস্থায় জনগণের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো নৈতিক দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারের কাছে দাবি উঠানো। এতে সফল না হলে জনগণের কর্তব্য হবে গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাত করে ন্যায় বিচারের পথ উন্মুক্ত করা। যেখানে আইন জনগণের সাধারণ মতামতকে প্রতিফলিত করে না সেখানে আইন অমান্য করার দায়িত্ব জনগণের উপর ন্যস্ত হয়। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যথার্থ ভূমিকা পালন করেছে। ‘আইনের শাসন ও গণআদালত’ নামের একটি প্রবন্ধে খালেদা রহমান ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যাবলীর যথার্থতা প্রমাণ করেছেন। আন্তর্জাতিক আইন মানবতাবিরোধী বিচারের ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জেনেভা কনভেনশন আর ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিচারপতি রব্বানী সাহেবের লেখা ‘আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ আইন’ আমাদের বিশেষভাবে সাহায্য করবে। শাহরিয়ার কবির সাহেবের ‘জঙ্গি মৌলবাদ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ আমাদের সাহায্য করবে যুদ্ধাপরাধীদের আন্তর্জাতিক কর্মকা- বুঝতে। শাহরিয়ার কবির সাহেবের সিডিগুলো উন্নতমানের। যেহেতু বিচার বিরোধীরা অত্যন্ত সক্রিয় তাই আমাদের ও সজাগ থাকতে হবে এবং বিভিন্নভাবে তাদের মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য প্রকাশিত পুস্তকাদি পড়তে হবে। ’৯২তে যারা শহীদ জননীকে দেশোদ্রোহী বলেছিল তারাই আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘিœত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে নানাভাবে। তারা বলছে তারাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। বলে তারা কিন্তুর একটা দীর্ঘ তালিকা জুড়ে দিয়েছে। আজ তারা বলছে নিজামি, মুজাহিদেরা নির্দোষ। তারা নিজামি মুজাহিদদের মুক্তি দাবি করে। অদের একজন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে ‘হাস্যাস্পদ’ বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। ওদের আর একজন ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়েছে। এটা ’৯২ সাল নয়। এবার যুদ্ধাপরাধের দাবিদাররা অনেক সজাগ। একাত্তরে যারা পশুশক্তির সহায়তা করেছিল, যারা দানবীয় কর্মে মেতে উঠেছিল তাদের বাংলার মানুষ চেনে। এই পশুশক্তিকে যারা ম“ জুগিয়েছে তারাও বাংলার মানুষের কাছে অচেনা নয়। এদের কৌশল বাংলার মানুষের চেনা হয়ে গেছে। ওরা বলছে ওরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তারপর ওরা ‘কিন্তু’র দীর্ঘ তালিকা জুড়ে দেয়। ১৯৭৫ থেকে আজ পর্যন্ত তাদের ভূমিকা কী ছিল তা বাংলার মানুষ দেখেছে। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা তাদের প্রধান কৌশল। পাকিস্তান সরকারের অগণতান্ত্রিক নেতারা বহু বছর এই কৌশল কাজে লাগিয়েছে। বাঙালিরা কোনোদিন বলেনি যে ওরা ইসলাম চায় না। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের কথা উল্লেখ করা ইসলাম বিরোধিতা নয়। অথচ ইসলামের নাম করেই শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আর নয় ধর্মকে নিয়ে এই পৈশাচিক খেলা। আজ বাঙালিদের পরিষ্কার কথা। যারা লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, যারা লাখ লাখ নারীদের সম্ভ্রমহানি করেছে, যারা অগ্নিসংযোগ করেছে স্বদেশবাসীর ঘরে, ঐসব দেশদ্রোহীদের আমরা বিচার চাই। আমরা নানা কারণে আমরা কর্তব্যচ্যুত হয়েছি কখনো কখনো। আমাদের কবি (আসাদ চৌধুরী) আমাদের তিরষ্কার করেছেন এই বলে, ‘তখন (মুক্তিযুদ্ধের সময়) খাঁটি মানুষ ছিলাম এখন আছি অল্প’। আমরা সে তিরষ্কার মাথা পেতে নিয়েছি। কিন্তু কবির ভাষায় এখনো বাংলার নদীর জলে আর বাংলার বৃষ্টিতে আগুন আছে। তা নাহলে গোলাম আযম কারাগারে নিপ্তি হতো না। আমরা শোকে মুহ্যমান কিন্তু দেশদ্রোহীদের প্রতি ক্রুদ্ধ।
ওয়াহিদ নবী : প্রবাসী চিকিৎসক, কলাম লেখক।

তিন বছরের অর্থনৈতিক অর্জন এবং শেয়ারবাজার বিপর্যয়: সকলি গরল ভেল
 ড. ইশা মোহাম্মদ
সরকারের অর্জনের হিসেব কিতেব শুরু হয়ে গেছে। সাফল্য ও ব্যর্থতার নানান সিকিমের কাহিনী বাজারে চলছে। এক দল প্রচার করছে সরকার তিন বছরে বিশাল বিপুল সার্থকতা অর্জন করেছে। অন্য দল বলছে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। সত্যি সত্যি সরকার তেমন মারাÍক কোনো ব্যর্থতার দায়ী নয়। আবার বিশাল বিপুল সার্থকতা ও নেই। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। কৃষির সাফল্যকে যদি অর্থনৈতিক সাফল্য খুবই কায়ক্লেশে দিন কাটিয়েছে। ব্যাংক, বীমা যাতে টাকা পয়সার টান পড়েছে। অর্থনৈতিক নীতি ও অনুশীলনের ভুলভ্রান্তির কারণে টাকা পয়সার টানাটানি যাচ্ছে না। বিদেশ থেকে টাকা পয়সাও খুব বেশি আসছে না। দাতারা দেব দেব করেও টাকা পয়সা দিচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার একটা মোহের মধ্যে আছে। তারা ভাবছে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো অবশ্যই টাকা পয়সা দেবে। বিশ্বব্যাংক যে সব আপত্তি উত্থাপন করেছে, সেগুলো মেটাতে পারলেই বাংলাদেশ তাদের প্রতিশ্র“ত টাকা পয়সা পাবে এবং প্রাপ্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে সরকার মৌলিক কয়েকটি ভুল করেছে। যে ভুলের কারণে খেসারত দিতে হচ্ছে জনগণকে এবং সরকার খাবি খাচ্ছে।
বড় ভুল আন্তর্জাতিক সংস্থার টাকা পাওয়ার আশা পোষণ করা। বার বার করে বলা হয়েছে বিশ্ব মহামান্দায় আক্রান্ত। মহামন্দার কারণে ধনতন্ত্রী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো মারাÍক অর্থকষ্ট ভোগ করছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঋণ করতে বাধ্য হয়েছে। কেউ ঋণ দিতে রাজি হয়নি। শেষমেশ চীন ঋণ দিয়েছে। বনেদী ধনতন্ত্রীরা ‘ইউরো’ দিতে পারছে না। গ্রীস নাশকতা চালাচ্ছে। গ্রীসের লালবাতি নিভানোর চেষ্টা চরিত্র করছে পশ্চিম ইউরোপ। হয়ত ইউরো ভেঙে দিয়ে তারা নিজেরা আÍরক্ষা করবে। যদি তা হয়, তবে তাদের জন্য মারাÍক ক্ষতি হয়ে যাবে। ডলার আবার চাঙ্গা হয়ে যাবে। মার্কিনীরা চায় ইউরোর ধ্বংস হোক। ডলারের আন্তর্জাতিক প্রতিপক্ষ এখন ইউরো, সাম্রাজ্যবাদের মিত্ররাই সাম্রাজ্যবাদের প্রতিপক্ষ হয়েছে। তাই ডলার ইউরোকে সহ্য করতে পারছে না। তারা অনেক ষড়যন্ত্র করছে ইউরোকে ধ্বংস করার। এহেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কি করে আশা করে যে, দাতাগোষ্ঠীর সদস্যরা নিজেদের ঘর না সামলিয়ে বাংলাদেশকে টাকা দেবে? কখনই দেবে না। তারা নানা ছল ছুতোয় টাকা পয়সা বন্ধ করে দেবে। যেমন পদ্মা সেতুর টাকা দিচ্ছে না।
পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। যে দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে, তা আইনসম্মত নয়। আর দুর্নীতি হলে তা প্রাথমিক পর্যায়ে দেখাশোনা করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। বাংলাদেশ সরকার কি বলেছে যে, তারা দুর্নীতির বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে অসমর্থ? তবে বিদেশি সংস্থা কেন দুর্নীতির কথা বলে মাতব্বরী দেখাচ্ছে? প্রধান উদ্দেশ্য কালক্ষেপণ করা। তারা ভাবছে দু’চার বছরের মধ্যে তাদের টাকার সংকট কেটে যাবে। তখন তারা ‘কৈফিয়ত’ গ্রহণ করবে এবং টাকা দেবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থার বেশ কয়েক মোটা তরিকার এজেন্ট আছে বাংলাদেশে। সরকারের মধ্যেও আছে। তারা চাচ্ছে- বাংলাদেশ সরকার যেন বিশ্বব্যাংককে বুড়ো আঙ্গুল না দেখায়। তারা নেতৃত্বকে প্রকারান্তরে ভয়ভীতি দেখায় এবং সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে বলে বিশ্বব্যাংক অবশ্যই টাকা দেবে। এটি ঠিক যে বিশ্বব্যাংক তৃতীয় বিশ্বের সব দেশেই টাকা দেবে। মন্দা কেটে যাবার পর। মন্দা কাটতে আরো বছর চার-পাঁচ বছর লাগবে। যদি আরো কোনো বড় মন্দার ঢেউ না আসে তবে। তখন বিশ্বব্যাংকের ঋণ দিতে না পারার কারণে ব্যাংকই অচল হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের বিশেষ বিশেষ প্রকল্পলো হাতছাড়া হয়ে গেলে পরবর্তী পর্যায়ে কোনো বড় প্রকল্প নেয়াও সম্ভব হবে না ওই অবিশ্বাসের কারণে। তাই বিশ্বব্যাংক চাচ্ছেÑ তারা টাকাও দেবে না এবং অন্য পন্থায় কাজও করতে দেবে না। বাংলাদেশে তাদের এজেন্টরা সরকারকে অন্য পন্থায় কাজ করতে নিরুৎসাহিত করে। এই এজেন্টদের পাল্লায় পড়ে পদ্মা সেতুর ব্যাপারে সরকারের তিন বছর নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আছে মাত্র দু’বছর। এই দু’বছরে কতটুকুই বা কাজ করতে পারবে? পদ্মা সেতুর মতো অন্য সব বিষয়েই বিশ্বব্যাংক টাকা পয়সা দেয়া বন্ধ করে দেবে। কয়েক এনজিওওয়ালা এবং মৌলবাদীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে যেন মহাজোট সরকার আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে কোনো টাকা পয়সা না পায়। আবার বাংলাদেশ সরকার নিজ দায়িত্বে কিছু একটা করুক, তাও চায় না। আমলাদের সঙ্গে গোপন শলা করে তারা নিজ দায়িত্বে কাজ করার পন্থা ফন্দিফিকির করে নস্যাৎ করে দেয়। সরকার তিন বছরে যথেষ্ট অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা অনেকেই অনুভব করে না। যেমন গ্রামীণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে শহরের ওপরে চাপ অনেক কমেছে। বিশ্ব মন্দায় যদি গ্রামীণ অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যেত তবে শহরের ওপর বিশাল চাপ পড়ত। সে চাপ শহর সহ্য করতে পারত না। শহরও ধ্বংস হয়ে যেত। কৃষিকে বাঁচিয়ে সরকার প্রকারান্তরে শহরকেও বাঁচিয়ে দিয়েছে। যারা সরকারের এ অর্জন দেখতে পায় না। তারা অন্ধÑ এ কথা বললে প্রকৃত অন্ধকে অপমান করা হয়। সরকারের উচিত হবে, এ হেন পরিস্থিতিতে নিজ দায়িত্বে কয়েকটি মৌলিক কাজ করা। বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পকে। যেমন পদ্মা সেতু, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি শেয়ারবাজারে দাঁড় করিয়ে দেয়া। ওই প্রকল্পের সমুদয় টাকা শেয়ারবাজার থেকেই আয় করা সম্ভব। দ্বিতীয় পথ হচ্ছে বিদেশি বন্ধু কোম্পানির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করা। বাংলাদেশের বড় ব্যবসায়ীদের সমবায় করে। তাদের সঙ্গে জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশীয় কিং চীনের বড় কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ তৈরি করা এবং তাদের মাধ্যমেই পদ্মা সেতুর মতো বড় কাজগুলো করা। বিশ্বব্যাংকের পায়ে ধরার চেয়ে ওই পন্থা ঢের ভালো। বাংলাদেশ সরকারের নিজেরও কিছু টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। একটি উন্নয়ন চন্দ্র তৈরি করে তা শেয়ার মার্কেটে ছেড়ে দিলে অতিসত্বর বাংলাদেশ সরকারের ভাড়ার পূর্ণ হয়ে যাবে। এসব ভালো ভালো পদক্ষেপ না নিয়ে সরকার বার বার ভুল পদক্ষেপ নিয়ে শেয়ারবাজারকে বড়ই অস্থির করেছে। কাজটা ভালো হচ্ছে না। হঠাৎ করে সরকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শেয়ারবাজারে ব্যবসা করতে পারবে না। এটি বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি ভুল সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা কর্মচারীরা অন্য যে কোনো দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আটোনমি আছে। কিন্তু তার পরও রাষ্ট্রই বাংলাদেশে বড় উদ্যোক্তা, বড় এন্টারপ্রাইজ। এই এন্টারপ্রাইজের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আয়ের বড় অংশ বাজারে যেতে হবে। যদি প্রাইভেট মেকার তেমন বিশালভাবে বিকশিত হতো, তবে এ রকম খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। খারাপ হলেও রাষ্ট্র উদ্যোগ ব্যর্থ হয়নি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সার্থক হয়েছে। এর ফল হয়েছে এই যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিজেই এখানে এন্টারপ্রাইজের চরিত্র অর্জন করেছে। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ব্যক্তিমালিকানায় দিয়ে দেয়া হতো। এমন কি কর্ণফুলী পেপার মিলও ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়ার কথাও উঠেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে পাকিস্তানি আমলের উল্টো ঘটনা ঘটে। ব্যক্তি উদ্যোগকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। রাষ্ট্র একটি বিশালদেহী উদ্যোক্তায় পরিণত হয়। বাংলাদেশের সেই রাষ্ট্রীয় চরিত্র বহাল আছে। এমন একটি দেশে কোনো ক্রমেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না। মারাÍক ক্ষতি হয়ে যাবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাধারণ মানুষের মতো বাজারী আচরণ করতে উৎসাহ দিতে হবে। যেন স্বেচ্ছায় তারা বাজারে প্রবেশ করে। অর্থনৈতিক পরিবেশের কারণে সরকারি কর্মচারীরা ছদ্মবেশে বাজারে প্রবেশ করেছে। এটিও ভালো নয়। তারা প্রকাশ্যে বাজারে আসা-যাওয়া করবে। নইলে তাদের আয় ভোগে ব্যয়িত হবে। দেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হয়ত অনেকেই ভাবছেন যে, সরকারি কর্মচারীরা যে আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সেগুলো বাজারে চলাচলের সমর্থক নয়। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এদের বোঝানোর ক্ষমতা হয়ত বাংলাদেশে কারোরই নেই। প্রথম সরকারি চাকরির বিধিবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন। অন্তত আর্থিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে। সরকারি কর্মচারীদের যে কোন যৌথ উদ্যোগে কিংবা সমবায়ী উদ্যোগে উৎসাহ দেয়া উচিত। রাষ্ট্র যতদিন এন্টারপ্রাইজ থাকবে ততদিন এই ব্যবস্থা বহাল রাখতে হবে। তবে ভবিষ্যতে এই কঠিন অবস্থা যে পরিবর্তিত হয়ে যাবে তেমনটা মনে হয় না। তাই সরকারের উচিত হবে না সরকারি কর্মচারীদের পিটিয়ে বাজার ছাড়া করা। বরং তাদের উৎসাহ দেয়া উচিত এবং প্রণোদনা ও দেয়া উচিত। যাতে করে তারা তাদের উপার্জনকে ভোগে বিনষ্ট না করে বাজারে বিনিয়োগ করে। বাংলাদেশ সরকার মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে উন্নয়ন করার চেষ্টা করছে। মুক্তবাজার টাকা ছাড়া চলবে না। বাজারে টাকা আসবে কোত্থেকে? অবশ্যই উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশে উদ্যোক্তা সংকট আছে। যাদের হাতে টাকা আছে তাদের বড় অংশ আমলা মুৎসুদ্দি। মুৎসুদ্ধি পুঁজিবাজার ছাড়া বাজার ‘বউবাজার’ হয়ে যাবে। সরকার কি এসব বোঝে? সরকারকে শিক্ষা দেয়ার জন্য এক দল আমলা সব সময়েই কুপ্রচোরণা দেয়। সরকারি কর্মচারী বিষয়ক কথাবার্তা ওই জাতীয় কুপ্ররোচনা। যখন দেখা যাচ্ছে যে, শেয়ারবাজার সরকারের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছে, তখন সরকারের সব উদ্যোগের সঙ্গে এক ফোটা ‘গরুর চোনা’ মিশিয়ে দিচ্ছে। এরা জ্ঞানপাপী এবং সরকারের শত্র“, সরকার কি এদের চিনতে পারে না। বিগত চারদলীয় জোটের সময়ে শেয়ারবাজার ভালোই চলছিল। সে সময়ে এই সব আমলারা কিন্তু বলেনি যে, সরকারি কর্মচারীদের বাজার থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। এখন বাজারের দুঃসময়েই ওই কথা কেন বলা হলো? প্রকৃতি কারণ হচ্ছে সরকার যে সব উদ্যোগ নিচ্ছেÑ তা যেন ব্যর্থ হয়ে যায়। সরকার আর্থিক ক্ষেত্রে তিন বছরে কিন্তু না হলেও কিছুটা অর্জন করেছে। সে আর্থিক অর্জনকে ম্লান করে দেয়ার জন্য কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ষড়যন্ত্র করছে। তাদের সঙ্গে গোপনে এনজিওওয়ালাও আছে। এ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা প্রায় সবাই মৌলবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। এরা আমলাদের টাকা দিয়ে, তাদের ইচ্ছামতো কাজ কারবার করাচ্ছে। প্রয়োজন একজন যোগ্য অর্থমন্ত্রী এবং আর্থিক বিষয়ক যোগ্য উপদেষ্টা। শেয়ারবাজার তুলতে না পারলে সরকার তার সুনাম ধরে রাখতে পারবে না। প্রয়োজন অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। শেয়ারবাজারে ব্যর্থতা তার সব আর্থিক অর্জনকেই ম্লান করে দিচ্ছে। যে কোনো মূল্যে শেয়ারবাজার বাঁচাতে হবে। প্রয়োজনে দু’চারজন পাপী তাপীকে ‘গণহত্যাকারী’ আখ্যা দিয়ে বিচারালয়ে তুলতে হবে। প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি বিধান করা এবং ভবিষ্যতে যাতে কেউ তেমন ধরনের অপরাধ না করে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। আশা করি সরকার সকল ‘নেতি’ পরিত্যাগ করবে এবং সকল প্রকার স্বস্তি গ্রহণ করবে। একটি এক্সপেরিমেন্ট এখনই করতে পারে। পদ্মা সেতুকে শেয়ারবাজারে ছেড়ে দিয়ে দেখতে পারে। শেয়ারবাজার কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়? অবশ্যই সাধারণ মানুষ উন্নয়নে সাড়া দেবে এবং প্রচুর অর্থ আসবে পদ্মা সেতু নির্মাণে। তবে আমার প্রত্যাশা মরীচিকা হবে এ কারণে যে, এজেন্টরা-আমলারা সরকারকে ভুল বোঝাবে এবং যে কোনো সৎ উদ্যোগে নিরুৎসাহিত করবে। তবে নেতৃত্ব যদি দুঃসাহসী হয়, তবে একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে পারে। কাজ হয় কিনা হয়। সরকার যাই করুক, এক্ষুণি করতে হবে। কেননা, তিন বছর গেছেÑ এক বছর আছে। শেষ বছরটা ইলেকশনের বছর। তাই যা কিছু করার এক্ষুণি করতে হবে। আশা করি সরকার প্রকৃত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং শেয়ারবাজারও দাঁড়িয়ে যাবে। 

রাজধানীর যানজট সমস্যার সমাধান কবে হবে
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
যানজট বিড়ম্বনা যেন কিছুতেই ঢাকাবাসীর পিছু ছাড়ছে না। প্রতিদিনের ভয়াবহ যানজটে আজ দুর্বিষহ  রাজধানীতে বসবাসকারী প্রায় দু’কোটি মানুষের  জীবন।  রুদ্ধ তাদের জীবন-জীবিকার সকল আয়োজন। সকালে কর্মস্থলে যেতে ও বিকেলে বাসায় ফিরতে নগরীর বিভিন্ন বাসস্টপেজে কর্মজীবী মানুষকে অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যানজটের কবলে পড়ে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অফিস- আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী, কল-কারখানার শ্রমজীবী মানুষ সময়মতো তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন না। ফলে জনমানুষের ভোগান্তি ছাড়াও প্রতিদিন অগণিত শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়ে যায়। দেশ হয় ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন। রাজধানীতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষের চাপ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, অপর্যাপ্ত ও অনুন্নত সড়ক ব্যবস্থা, নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহন চলাচল ও যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাসের অপ্রতুলতা, ফুটপাত  অবৈধ দখল, বিক্সার মতো ধীর গতিসম্পন্ন যানবাহনের অবাধ চলাচলের মতো কারণগুলো  যানজটের জন্য দায়ী। নগর জীবনের আকর্ষণ, শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধার কারণে প্রতিদিনই রাজধানীতে বাড়ছে মানুষ। শ্রমজীবী  বিশেষ করে নদী ভাঙন ও মঙ্গাপীড়িত এলাকার মানুষের একমাত্র কর্মসংস্থানের জায়গা হচ্ছে রাজধানী ঢাকা। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন মেটাতে রাজধানীতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে বাড়িঘর, হাট-বাজার। দ্রুত বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। কিন্তু সে অনুপাতে রাস্তাঘাট বাড়ানো যাচ্ছে না। সংকীর্ণ রাস্তাঘাটে ছুটে চলছে ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যানবাহন। একই সড়কে ধীর গতিসম্পন্ন রিক্সা, ভ্যান ও দ্রুত গতিসম্পন্ন যানবাহন চলাচল করায় সঠিক গতিতে চলাচল করতে পারছে না দ্রুত গতিসম্পন্ন যানবাহন।  ত্র“টিপূর্ণ এবং অপর্যাপ্ত ট্রাফিক সাইন ও সিগন্যালও রাজধানীর যানজটের আরেকটি কারণ। তাছাড়া যানবাহন চালকদের ট্রাফিক আইন মেনে না চলার প্রবণতা তো রয়েছেই। রাজধানী ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধানকল্পে ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে নানারূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বার বার রাস্তা ও ফুটপাত দখল উচ্ছেদ অভিযানের উদ্যোগ তেমন সফল  হয়নি। যানজট ঠেকাতে রাজধানী ঢাকার চারটি ট্রাফিক ডিভিশনে কাজ করার জন্য এক সময় তিন হাজারের বেশি ফোর্স মোতায়েন করা হয়। দুই সহস্রাধিক ট্রাফিক কর্মকর্তার সঙ্গে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আনসার ও কমিউনিটি পুলিশ নিরলস প্রচেষ্টায় যানজট নিরসনে তেমন সুফল বয়ে আনেনি। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকার যানজট সমস্যা সমাধানে একবার রমজানের শুরুতে কিছু নিয়ম-কানুন চালু করে ট্রাফিক  বিভাগ। মহানগরীর ১৩টি পয়েন্টে চালু করা হয় ফোর লেন পদ্ধতি। বাড়ানো হয় পুলিশের তৎপরতা। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বন্ধেও নেয়া হয় উদ্যোগ। ট্রাফিক পুলিশের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির পদক্ষেপও রাজধানীর যানজট কমাতে খুব একটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। পরবর্তীতে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত ও ব্যাংকের সময়সূচির পরিবর্তন করেও যানজট সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজা হয়েছে। রমজানের শুরুতে দেশের সকল স্কুল-কলেজে দীর্ঘমেয়াদি ছুটি ঘোষণার পরও তীব্র যানজটে আটকা পড়ে  রাজধানীবাসী।  রাজধানীকে ৭টি অঞ্চলে ভাগ করে মার্কেট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি নির্ধারণ করেও তেমন সুফল পাওয়া যায়নি।
বর্তমানে রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যার সঠিক হিসাব জানা না থাকলেও তা প্রায় দুই কোটির কাছাকাছি হবে বলে মনে করে অভিজ্ঞ মহল। ডিডিসির সূত্রমতে, ঢাকার যানবাহন চলাচলের জন্য উপযুক্ত রাস্তা রয়েছে  বর্তমানে ২২৫০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১ লেনের রাস্তা ৩৮৬ কিলোমিটার, ২ লেনের ১৪০৮ কিলোমিটার, ৪ লেনের রাস্তা ৪৩৪ কিলোমিটার। এসব রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন  চলাচলকারী যন্ত্রচালিত যানবাহনের সংখ্যা ৫ লাখ ২৭ হাজার। বিগত ছয় বছরে যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার। বিআরটিএ সূত্রমতে, রুট পারমিট হিসেবে ঢাকার বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৫ হাজার ১০৩টি। অথচ এর প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। বাস ও জনসংখ্যার হিসেবে প্রতি ৩ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র ২টি বাস। প্রকৃত পক্ষে একটি বাস প্রতিদিন ৪৫০ জন যাত্রী বহন করে। এ ছাড়া অত্যধিক যানবাহনের কারণে ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টায় গড়ে ১৪ কিলোমিটার এবং স্বাভাবিক সময়ে ঘণ্টায় মাত্র ১৮ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলাচল করে। বেশ কিছুকাল আগে বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যাল ইম্পোটার্স এ্যান্ড ডিলার্স এ্যাসোসিয়েশন বারভিডা আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অব্যবস্থাপনাই রাজধানীর যানজটের প্রধান কারণ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। অনুষ্ঠানে নগরীতে অযান্ত্রিক যানবাহন দ্রুত নিয়ন্ত্রণ ও অল্প খরচে উন্নত মানের গণপরিবহন চালু করার ওপরও গুরুত্ব আরোপিত হয়। এ ছাড়া আপাতত রাজধানীতে বিপুলসংখ্যক এলিভেটেড টাওয়ার কার পার্কিং ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব করা হয়। যানজটমুক্ত সড়ক ব্যস্থার জন্য একটি নগরীর মোট আয়তনের ২০ শতাংশ রাস্তা থাকা প্রয়োজন। অথচ ঢাকা মেগাসিটিতে সড়কের পরিমাণ রয়েছে সাত ভাগেরও কম। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রণহীন যান চলাচল, ফুটপাত দখলসহ নানাবিধ কারণে যানজট ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। এসব সমস্যার সমাধানসহ রাস্তা প্রশস্ত করতে না পারলে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। ট্রাফিক সাইন ও সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নয়ন যানজট সমস্যা সমাধানের অন্যতম একটি পদক্ষেপ। সড়ক মহাসড়কে গাড়ি চালকদের ট্রাফিক আইন মেনে চলার ব্যবস্থা নিতে হবে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে ট্রাফিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের। বৃদ্ধি করতে হবে জনবল কাঠামো। ট্রাফিক আইনশৃঙ্খলা মেনে চলতে যানবাহন চালক ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা মেগাসিটিতে বসবাসকারী মানুষের চাপ কমাতে কিছু মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অন্যান্য অফিস আদালতকে নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, মানিকগঞ্জের মতো দূরবর্তী কোথাও স্থানান্তর করা যেতে পারে। এমনকি ঢাকার বাইরে উপযুক্ত কোনো বিভাগীয় বা জেলা শহরে কিছু কিছু অফিস-আদালত স্থানান্তর করাও অসম্ভব নয়।   উপরন্তু এ সকল স্থানের সঙ্গে শাটল ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারলে ঢাকায় বসবাসরত জনসংখ্যা হ্রাস পাবে এবং তা রাজধানীর যানজট কমাতে সহায়ক হবে। জয়দেবপুর ও ময়মনসিংহের সঙ্গে ঢাকার ট্রেন যোগাযোগ উন্নত হলে তা যানজট সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। রাজধানী থেকে পর্যায়ক্রমে রিক্সা তুলে দিয়ে তার পরিবর্তে অটোমোটিভ যানের পরিকল্পনা নিলে কালক্রমে রিক্সা চালকরাই এসব যানবাহন চালাতে পারবে এবং তাদের বেকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। তাদের সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে এসব অটোমোটিভ যান ক্রয়ের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ভবিষ্যতে রাজধানীতে মিনি, ম্যাক্সির বদলে বেশি যাত্রী ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন  পাবলিক বাস চলাচলের ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি তুলে দিতে হবে ত্র“টিপূর্ণ যানবাহন। ঢাকার রাজপথে প্রাইভেট কারের দাপটে পড়েই সাধারণত বেড়ে যায় যানজটের তীব্রতা। মোট জনসংখ্যার মাত্র শতকরা দু’ভাগ কার ব্যবহার করার সুযোগ পেয়ে থাকে। তাই রাজধানীতে প্রাইভেট কার চলাচল সীমিত রেখে অধিক সংখ্যক পাবলিক ও প্রাইভেট বাস চালু করার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। পাশাপাশি রাজধানীর সকল অবৈধ স্থাপনা  উচ্ছেদ, রাস্তা ও ফুটপাত দখল বন্ধ করতে হবে। যত্রতত্র গাড়ি ও বাস পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা। ঢাকা মহানগরীতে পর্যাপ্ত সংখ্যক আন্ডারপাস, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। ফ্লাইওভারের সঠিক পরিকল্পনা মোতাবেক নির্মাণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে তা রাজধানীর জানজট সমস্যা সমাধানে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। উপরন্তু জনগণ সড়ক ব্যবহারের যথার্থ অভ্যাস গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ হলে  যানজট   সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে বলে আশা করা যায়।    লেখক : প্রাবন্ধিক  ও গল্পকার

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের উপায় কি
সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা থামছে না। একটি দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে প্রতিদিনই ঘটছে আরেকটি দুর্ঘটনা। গত এক মাসে ভয়াবহ কয়েকটি দুর্ঘটনায় জীবন দিয়েছেন দেশবরেণ্য অনেকেই। সারাক্ষণ আতঙ্ক নিয়ে রাস্তায় বের হতে হচ্ছে আমাদের। এসব অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর দায় কার। রাজধানীসহ মহাসড়কে বেহাল রাস্তা, অসংখ্য বাঁক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ এবং লাইসেন্সবিহীন চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানো এসব মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলে ধারণা করা হয়। পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষিকা, পুলিশ ও কোস্টগার্ড কর্মকর্তাসহ ৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজারের টেকনাফ, গাজীপুর, হবিগঞ্জ, কুষ্টিয়ার কুমারখালী, নাটোর ও বগুড়ায় এসব দুর্ঘটনা ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনায় এক গার্মেন্ট কর্মী ও বগুড়ায় স্কুল শিক্ষিকা নিহত হওয়ার প্রতিবাদে মহাসড়কে অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর ও বিক্ষোভ করেছে এলাবাসী। এর কয়েকদিন আগে বগুড়ার মহাসড়কে মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে চালকসহ একই পরিবারের পাঁচ সদস্য। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, মহাসড়কে চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তারা সড়ক ও জনপথ বিভাগকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করছে। একটি জাতীয় দৈনিকের হিসাবে শুধুমাত্র রাজধানীতেই ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করে ২ লাখেরও বেশি। এই গাড়িগুলোর মেয়াদ পেরিয়ে গেছে ১০ বছর আগেই। এগুলো দেখা বা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে যত্রতত্র দুর্ঘটনা ঘটছে। যেসব চালকরা এসব গাড়ি চালাচ্ছে তাদের বেশির ভাগই হেলপার, বয়সে তরুণ। এসব তরুণ বয়সীদের দিয়ে গাড়ি চালানো কোনোভাবে ঠিক নয়। নিয়ম না মেনে তাদেরকে নির্দ্বিধায় লাইসেন্স দিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ৫৯ জন লোক পথদুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া অনেকেই। এসব দুর্ঘটনা রোধে সরকারের কি কিছুই করার নেই। সারাদেশের মহাসড়গুলোতে খানাখন্দসহ অসংখ্য বাঁক রয়েছে। এসব বাঁকগুলোতে গাড়ির গতিসীমা সম্পর্কিত সতর্কীকরণ চিহ্ন নেই অনেক এলাকায়। এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষের নজরদারি নেই। আমরা মনে করি, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে শুধু সরকারই নয়, ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হতে হবে চালকদের। মনে রাখতে হবে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে যেন কারো জীবন চলে না যায়। গাড়ি চালানোর সময়টুকু অন্তত মোবাইলে কথা বলা বন্ধ রাখতে হবে। একটু অসতর্কতার জন্য ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। নিয়ম মেনে চললে দেরি হবে হয়তো তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকেও তো রেহাই পাবো আমরা।  

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান চেষ্টার নেপথ্যে আর এক জিয়া
মাহবুবুল আলম
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা বিপন্ন করে নবম জাতীয় সংসদে তিন-চতুর্থাংশ আসনে বিপুল বিজয়ী বর্তমান শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতের একটি চেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে বলে গতকাল বৃহস্পতিবার দেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সেনাসদরের প্রদত্ত বক্তব্যে দাবি করা হয়েছে। এ নিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও তোলপাড় শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা সৃষ্টির মাধ্যমে বর্তমান শেখ হাসিনার সরকারকে শুধু উৎখাত নয় তাকে হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর কাঁধে বন্দুক রেখে আরো একটি পনের আগস্ট সৃষ্টি করে সেনাবাহিনী তথা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরো একটি কলঙ্কিত অধ্যায়ের প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত কিছু মাধ্যম সারির ধর্মান্ধ সদস্য। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কুশীলব যেমন ছিলেন উপসেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া, তেমনি এ ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নেপথ্য নায়কও আরেক জিয়া। জিয়া-ফারুক-রশিদের উত্তরসূরি এই জিয়া প্রবাসী কয়েক বাংলাদেশি ও দেশের ভেতর একটি চেনা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্ররোচনায় সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে শেখ হাসিনাকে হত্যার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। ১৯৭৫ সালে যেমন এরা সেনাবাহিনীতে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতা বিরোধীদের পৃষ্ঠপোষক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ষড়যন্ত্র ও ইন্দনে বঙ্গবন্ধু হত্যার পথকে সুগম করে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্য বানানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়ে আমাদের গৌরবান্বিত ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিল, তেমনিভাবে ২০১১ সালের মধ্য ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয়ের মাসে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ইন্দন ও প্ররোচনায় শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত ও হত্যা করার চেষ্টা চালিয়েছিল। আমাদের ভাগ্য ভালো যে তাদের এ ষড়যন্ত্র আলোর মুখ দেখার আগেই নস্যাৎ করে দিয়েছে দেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী।
১৯ জানুয়ারি ২০১২ দৈনিক কালের কণ্ঠে সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা ও অভ্যুত্থানের অপচেষ্টা সম্পর্কিত একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়। এ খবরের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রভাবশালী মিডিয়ায়ও তা ফলাও করে প্রচার করে বিশেষ প্রতিবেদন ছাপে। কোনো কোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে প্রচার করা হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ও শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতের খবরটি। বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স, এপি, এএফপি, ট্রিবিউন, ইকোনমিক টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি, ডন, ফার্স্ট পোস্ট, চ্যানেল নিউজ এশিয়া ও এবিসি নিউজসহ প্রায় অর্ধশতাধিক গণমাধ্যম ও ইন্টারনেট সংস্করণে প্রতিবেদন ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। এ ছাড়াও ফেসবুক ও বিকল্প গণমাধ্যম ব্লগগুলোতে এ নিয়ে লেখা হয় শত শত পোস্ট। গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার ফলে সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালানো সম্পর্কে সেনাসদর দফতরের পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিং করা হয়। এর আগেও বেশ ক’বার শেখ হাসিনাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট ইতিহাসের ভয়াবহ ও নৃশংসতম গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ব্যর্থ হলেও শেখ হাসিনাকে হত্যার মিশন সফল করতে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছিল। টাকা লেনদেনের কাজটি করা হয় হাওয়া ভবন থেকে। হাওয়া ভবনও মোটা অঙ্কের টাকার ভাগ পায়। যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে গড়া একটি শীর্ষ ইসলামী রাজনৈতিক দল টাকার বিষয়টি মধ্যস্থতা করে। কিন্তু মিশন সফল না হওয়ায় বাবরকে হাওয়া ভবনে তলব করা হয়েছিল। বাবর সশরীরে হাওয়া ভবনে উপস্থিত হয়ে কৈফিয়তের জবাব দেয়। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বাবর মামলা ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে দোষারোপ করেন। বাবর জিজ্ঞাসাবাদে আরো বলেছেন, গ্রেনেড হামলার আগাম তথ্য প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পর্যন্ত জানানো হয়েছে। এমন কি তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে মাঝে মধ্যে খালেদা জিয়াকে অবহিত করা হয়েছে বলেও বাবর জিজ্ঞাসাবাদে বলেন। ইতিহাসের এই ভয়াবহ ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডের নানা ধরনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জনকণ্ঠ, ডেইলি স্টার, সমকাল, যুগান্তর, প্রথম আলোসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্র-পত্রিকার রিপোর্টে ইতিহাসের সবচেয়ে কাপুরুষোচিত এই গ্রেনেড হামলায় যে, হাওয়া ভবন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যাবতীয় কলকাঠি নাড়া হয়েছে তা প্রকাশিত হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও বিশেষ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত নারকীয় এ হামলার বিষয়টি পুরোপুরিই মনিটর করেছিল হাওয়া ভবন। এই মনিটরিংয়ের ধারাবাহিকতায় ও হাওয়া ভবনের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান থেকে শতাধিক আর্জেস গ্রেনেড আনার কাজে সহায়তা করে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। সেই সময়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যেভাবেই হোক শেখ হাসিনাকে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় করে দিতে হবে। তাদের পরিকল্পনায় ছিল শেখ হাসিনার বাবাকে হত্যার পর যেমন আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতার মুখ দেখেছে; শেখ হাসিনাকে হত্যা করে এমন অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে যাতে আওয়ামী লীগ ৪০ বছরেও ক্ষমতায় আসতে না পারে। বর্তমান মেয়াদে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকেই তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং কিভাবে দ্রুততম সময়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায় সেই নীল নকশা বাস্তবায়নে মেতে ওঠে। এর অংশ হিসেবেই সরকার গঠনের মাত্র ৪৫ দিনের মাথায়, বিডিআরের ইতিহাসের পাশবিক এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। এর মাধ্যমে তারা এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করতে চেয়েছিল। এক. এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আর্মির মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টির মাধ্যমে একটা ক্যু ঘটিয়ে পঁচাত্তরের পুনরাবৃত্তি ঘটানো, দুই. বিদ্রোহের নেপথ্য মদদদাতারা চেয়েছিল এই হত্যাকাণ্ডের রেষ সীমান্তে সীমান্তে ছড়িয়ে দিয়ে ভারতীয় আগ্রাসনের ধোয়ো তুলে সীমান্তকে অশান্ত করে তোলা। এতে সরকারের পতন ঘটানো সহজতর হতো। শেখ হাসিনার বিচক্ষণতায় যদি এ বিদ্রোহ শান্তিপূর্ণ ও রক্তপাতহীন সমাধান না হতো তাহলে ক্রমেই তা সেনানিবাসে সেনানিবাসে বর্ডারে বর্ডারে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক রক্তক্ষয়, প্রাণহানি ঘটত। এমন কি শেখ হাসিনার জীবনও যে বিপন্ন হতে পারত সে সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এবারো একই কায়দায় সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত ও তাঁর জীবননাশের চেষ্টা চালানো হয়েছিল। এ ষড়যন্ত্রের পেছনেও যে একটা মুখচেনা গোষ্ঠীর ইন্দন ও ষড়যন্ত্র ছিল তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও খবরা খবর থেকে বেরিয়ে এসেছে। অতি সম্প্রতি খালেদা জিয়ার চট্টগ্রাম অভিমুখে লংমার্চ শেষে আয়োজিত জনসভায় খালেদা জিয়া সেনাবাহিনীকে উসকে দেয়ার জন্য বলেছিলেন ‘সরকার গুমের রাজনীতি করছে, শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সেনাবাহিনীর অফিসারদেরও ধরে ধরে গুম করে ফেলা হচ্ছে।’ তার এ ধরনের উস্কানিমূলক বিভ্রান্তিকর বক্তব্যে দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ এবং রাজনৈতিক বোদ্ধারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, খালেদা জিয়ার বক্তব্য আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে উসকে দেয়ারই নামান্তর। খালেদা জিয়া যখন প্রকাশ্য জনসভায় দাঁড়িয়ে এ ধরনের বক্তব্য দেন তখন সেনাবাহিনীতে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র চলছিল, যা সেনাসদরের বক্তব্য থেকে আরো ধারণা পাওয়া যায়। আমরা সবাই কম-বেশি জানি যে, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজেট ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে সরকার উৎখাতের নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছিল। আন্দোলনের মাধ্যমে একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করতে না পেরে তারা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতের তাত্ত্বিক নেতাসহ বাঘা বাঘা নেতাদের গ্রেফতার করে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার এবং তাদের বিচারকার্য শুরু করার পর ওই চিহ্নিত গোষ্ঠীটি মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা যখন এ কথা বুঝতে পারে যে শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করতে না পারলে নির্বাসনে থাকা খালেদা জিয়ার দুর্নীতিবাজ দুই পুত্র ও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো যাবে না তখনই তারা সরকার উৎখাত ও শেখ হাসিনাকে হত্যার হীন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। যার ফলে সেনাবাহিনীর কয়েক অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ও সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চাভিলাষী সদস্য সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার উৎখাতের অপচেষ্টা চালায়। এর নেতৃত্ব দেয় ধর্মান্ধ (অবঃ) সেনা অফিসার আরেক জিয়া।
বিএনপি ও এর মিত্ররা যে এতদিন সরকার পতনের জন্য হম্বিতম্বি করছিল এ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে, তাদের জানা ছিল যে, সেনাবাহিনীর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের যে ভাবশিষ্যরা রয়েছে তাদের মাধ্যমেই সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ ও বিশৃংখলা সৃষ্টির মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হবে। তাই তাদের হম্বিতম্বি হুঙ্কারের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন দৃঢ়ভাব লক্ষ্য করা গেছে। আর এ কারণেই হয়ত জেনারেল জিয়ার শিষ্য এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অবঃ) অলি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, ডিসেম্বর ’২০১১-এর মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হবে। অলির এ বক্তব্যকে এতদিন দেশের মানুষ রাজনৈতির মেঠো বক্তব্য বা একটি নির্দোষ বক্তব্য বলে মনে করলেও ডিসেম্বরে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা চালানোর মাধ্যমে প্রমাণ হলো যে এ ব্যাপারে খালেদা-অলি-গোলাম আযম-নিজামীরা আগে থেকেই জানতেন। তাই তারা এতদিন তাদের কাক্সিক্ষত দিনটির অপেক্ষায় থেকে মনে মনে বগল বাজাচ্ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী তাদের অভ্যুত্থানের অপচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিয়ে দেশপ্রেমের এক অন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে জানিয়ে দিল যে আমাদের সেনাবাহিনী বার বার বিশেষ করে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথকে রুদ্র করে কোনো গোষ্ঠীর ক্রীড়নক হিসেবে আর ব্যবহার হতে রাজি নয়। তাদের এ সংকল্পের কথা সেনাপ্রধানের উপস্থিতিতে সেনাসদরের প্রেস ব্রিফিংয়েও প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ করা হয়েছে। আমি কিছুতেই ভেবে পাই না বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানি সেবাদাসরা কেন বুঝতে চায় না যে ১৯৭৫ আর ২০১১ এগারো এক নয়। তথ্যপ্রযুক্তির সুপার হাইওয়ের যুগে অতীতের সেই পচা-বাসি-নোংরা খেলা এদেশে আর কোনোদিনই চালানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মানুষ এবং তরুণ প্রজš§ দেশপ্রেমে এখন এতটাই উদ্বুদ্ধ যে, ষড়যন্ত্রকারীরা যতই ষড়যন্ত্র করুক না কেন কিছুতেই আর এ দেশের গণতন্ত্র ও প্রগতির চাকাকে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারবে না। এ দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক অতন্ত্র প্রহরী হয়ে দুর্নীতিবাজ, যুদ্ধাপরাধী ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে তাদের বিষদাঁত ভেঙে দিতে সদাজাগ্রত। আর সেই চিহ্নিত ষড়যন্ত্রকারীরা ঘৃণার বাগাড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট 


উচ্চশিক্ষা-বিশ্ববিদ্যালয় ধারণা কোন্ পর্যায়ে
লুৎফর রহমান
যে কোনো শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর তার উদ্দেশ্য থাকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। সন্দেহাতীতভাবে সেই প্রত্যাশার জায়গায় থাকে একটি প্রথম শ্রেণীর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন এবং ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যার অনুপাতে  আকাশ-পাতাল তারতম্য হওয়ায় সবার পক্ষে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সহজ হয়ে ওঠে না। যদিও আমাদের সংবিধানের  মৌলিক অধিকারের তালিকায় শিক্ষা অন্যতম উপাদান। পাশ কাটিয়ে যাবার কোনোই সুযোগ নেই, শিক্ষা রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে ভিত্তি রচনা করে। পরিশীলিত, মার্জিত, বিজ্ঞানমনস্ক, পরিমিতি বোধের একটি মানবসমাজ গঠনে শিক্ষার প্রয়োজন অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয় সেই শিক্ষা প্রসারের আঁতুড়ঘর। কিন্তু আমাদের বড় ব্যর্থতা এই অর্থবহ বোধগম্যতায়। যাক সে কথা, যে সংখ্যার ছাত্র-ছাত্রী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নামক আবাসনে জায়গা করে নিচ্ছে তাদের কতটুকু শিক্ষা দিতে পারছে আমাদের রাষ্ট্র? বেছে-বেছে মেধাবীদের সমাবেশ ঘটিয়ে রাষ্ট্র কী তার দায়িত্ব পালন করছে? এভাবে ক্রমাগতভাবে প্রশ্ন করলে প্রশ্নের সারি দীর্ঘ হবে। যেখানে উত্তর অনেক, সেখানে প্রশ্নের পরিমাণটা বেশি হয়। পাবলিক বা সর্বজন আবাসনে সুযোগ পাওয়া সৌভাগ্যবানদের মধ্যে আমিও একজন। পরীক্ষার্থীদের দীর্ঘ সারি আর ফরম পূরণের লম্বা তালিকা  দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম প্রচণ্ড। আমার মতো সকলের মনের গভীর উৎকণ্ঠা, সঙ্গে আসা পিতা-মাতার কষ্টকর ভোগান্তি শুধু একটা আসনের বন্দোবস্ত করার লক্ষ্যে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সেই কাক্সিক্ষত সুযোগটি সৃষ্টি করে আমার জন্য। ভর্তি হই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে।  বিশ্ববিদ্যালয় ধারণাটি উচ্চতায় দীর্ঘ, ব্যাপ্তিতে সুদূর প্রশস্ত। বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিক  বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের আবহবাহী। এ রকম কিছু এলোমেলো কনসেপ্ট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ আমার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচরণের পর উপলব্ধি করলাম  ক্রমশ কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য তার মূল জায়গা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং একটি পেশিবহুল শ্রেণীর কব্জায় বন্দি হচ্ছে। এছাড়া আরও লক্ষ্য করলাম, কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় নামক পবিত্র চেতনাটি আমাদের কাঁধের ওপর বোঝা হয়ে চাপছে। আশু কোনো পরিবর্তন বা বড় ধরনের জবভড়ৎসধঃরড়হ  ছাড়া এ ব্যাধি নিরাময় হবে বলে মনে হয় না। আমাদের এখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা ১৯৯২ সালের দিকে। দেশের শিক্ষার প্রসারে বেবির অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমানে প্রায় ৫৪টি বেবি তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া আর বাকিগুলোর অবস্থা  সনদ বিক্রি ছাড়া আর কিছু নয় তা তাদের কার্যক্রম দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়। ফ্লাট বাড়ির দুটো ফ্লোর নিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়। নিচতলায় পুরি-শিঙ্গাড়ার দোকান, ওপরে বিউটি পার্লার বা পাদুকা হাউস। গ্রীন ইউনিভার্সিটি নামে একটি বেবি আছে। ইদানীং এ বেবির যে তীব্র আর্তচিৎকার টিভির স্কিনে দেখা যায়, তাতে পণ্যদ্রব্য ভেবে কোনো শিশু আবার বায়না ধরে না বসেÑ আব্বু-আম্মু আমি গ্রীন ইউনিভার্সিটি খাব! এটা খেলে ডাক্তার, জজ, পাইলট ইত্যাদি হওয়া যায়! যেহেতু অধিক উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশীদের সবাইকে রাষ্ট্রের পক্ষে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে নাÑ তাই ব্যক্তি খাতে উচ্চশিক্ষার দ্বার উš§ুক্ত হওয়া প্রয়োজন। তবে অরাজকতা, লুটপাট আর সনদ ব্যবসাভিত্তিক যাতে না হয় সে দায়িত্বটা রাষ্ট্রকে এড়ালে চলবে কী করে। প্রাইভেট এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইদানীং একটা সামাজিক স্তরবিন্যাস তৈরির অপচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেটার মূল সুর অনেকটা এ রকম, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মধ্যবিত্ত আর দরিদ্রের বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ধনী আর অভিজাতদের বিশ্ববিদ্যালয়। এ সব চক্রান্তের মূলে রয়েছে ব্যবসা আর মুনাফা। তাদের সেই চক্রান্তের নীলনকশায় মীর জাফরের ভূমিকা পালন করছে আমাদেরই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বণিক-সওদাগর প্রকৃতির শিক্ষক। তাদের অনেকে ‘ভাড়াটিয়া’ ‘ক্ষ্যাপের শিক্ষক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এই ভাড়াটিয়া আর ক্ষ্যাপ মারা শিক্ষকরা অনেকটা উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এই শ্রেণীর শিক্ষকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে বেশি পছন্দ করেন। যার কারণে তারা সময়মতো নিজের কর্মস্থলের দায়িত্বটি পালন করতে পারেন না। তাছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কয়টি ক্লাস নেন, সেখানে তাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এম্বাসেডারের ভূমিকা পালনকারী হিসেবে দেখা যায়। তারা গুণ-ভজন করতে থাকেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের। অর্থাৎ তারা একই সঙ্গে নামমাত্র শিক্ষকতা এবং ওই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপনের কাজটা করে থাকেন। এ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেও হয়ত আলাদাভাবে কিছু মাল-মসলা কামিয়ে নেয়া যায়। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কাঠামো অধঃপতনের আরেকটি কারণ ‘দলবাজ’ নামক একটি শ্রেণীর আবির্ভাব। এই শ্রেণী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে কফিনে শোয়াতে তৎপর গোষ্ঠীদের অন্যতম। যে কোনো ব্যক্তিস্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য রাজনৈতিক ছায়া প্রয়োজন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের পথভোলা গণতন্ত্রান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ সুযোগ সন্ধানীদের প্রকোপ ভয়াবহ। সুযোগ যেহেতু প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করে তাই সুযোগ সন্ধানীদের ভিড় রাজনৈতিক ছায়ায় বেড়ে যায়। আর এই সুযোগবাদের মহামারী বিশ্ব^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও বাদ দেয়নি। ক্ষমতার প্রলোভন আর ভঙ্গুর রাজনীতি শিক্ষকদের ক্লাস, গবেষণা এবং আত্মমান-উন্নয়নের চেয়ে রাজনৈতিক প্রভাবে নিজেদের প্রভাবিত করতে চাচ্ছেন বেশি করেÑযা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য  মোটেই শুভকর নয়। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙ্গে পড়ার আরেকটি মুখ্য কারণ। একজন দুস্থ প্রকৃতির গ্রাজুয়েট শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলে তার  সেই দুস্থ ব্যাধি কতটা সংক্রামক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে তা কল্পনাও করা যায় না। এর ফল সর্বোপরি ভুগতে হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে। বৃহৎ পরিসরে পুরো জাতিকে। যেটি হচ্ছে গবেষণাপত্র, ভালো রেজাল্ট শিক্ষকতার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ শিক্ষক নিয়োগে স্ব-জাত্যমানস আরো ভয়ঙ্কর। অর্থাৎ যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ  দেবেÑ নিয়োগ প্রার্থীকে অবশ্যই সেই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হতে হবে। এই অঘোষিত জাতপ্রথা  প্রবণতাটাও আমাদের দুর্যোগের আরেকটি কারণ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, শিক্ষক নিয়োগ এখন হয় ভোটার বৃদ্ধির পদ্ধতিতে। যেমনটি হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়কে শিবির অধ্যুষিত করার জন্য একসঙ্গে ৪০০ শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল তখনকার প্রশাসন। যার কারণে পরবর্তীতে শিবিরের দুর্গরূপে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় ঘটে সারাদেশে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আওয়ামী লীগের আমলে বর্তমান প্রশাসন দু’শ’রও বেশি শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। তার পরও শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে ভরাডুবি ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষকদের। অর্থাৎ গণহারে শিক্ষক নিয়োগের নির্বাচন জয়ের ফর্মুলা এখানে কাজে লাগেনিÑ বিফল হয়েছে। এ বিফলতা ভোটে হয়েছে সহনীয়, কিন্তু শিক্ষা কাঠামোয় যদি এ বিফলতা ভর করে তবে তার খেসারত পোহাতে হবে জাতিকে। পরিশেষে যে বিষয়টি বলা প্রয়োজন তা ক্যাম্পাসের ছাত্র-রাজনীতি। গত ৯ জানুয়ারি ছাত্র রাজনীতির বলি হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ। পেক্ষাপট বিবেচনায় এখন ছাত্র রাজনীতির জায়গা দখল করে নিয়েছে অছাত্র আর পেশিপ্রসারণশীলরা। গত ১২ তারিখ আরটিভিতে সন্ধ্যা ৭.৫০ মিনিটে ‘প্রিয়প্রাঙ্গণ-আওয়ার ডেমোক্রেসি’ নামক এক অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক রোবায়েত ফেরদৌস একটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তিনি বলেন, গত ২০ বছরে ছাত্র রাজনীতি থেকে আমাদের প্রাপ্তিটা কী? খুবই অনুসন্ধান এবং যৌক্তিক একটি বিষয়ে ওনার মন্তব্য ভেবে দেখার মতো। ওই অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক নাসিম আক্তার হোসাইন এবং ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ। ২০ বছরে ছাত্র রাজনীতির অর্জনের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে হারুন-অর-রশিদ সেনা-ছাত্র আন্দোলন এবং নাসিম আক্তার হোসাইন ১৯৯৮-এর যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের কথা বলেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন সেনা-ছাত্র আন্দোলনে মূল ভূমিকা পালন করেছিল শিক্ষকরা আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ’৯৮-এর আন্দোলনে মূল ভূমিকায় ছিল সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী এবং প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ। ’৯৮-এর সেই আন্দোলনে তো মূল খলনায়ক ছিল ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। ছাত্র রাজনীতির বর্তমানে যে নেতিবাচক পরিণতি সে হিসেবে এ ছাত্র রাজনীতিকে শিক্ষাদস্যু হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। সুবিধাবাদে বিশ্বাসী ছাত্রদের নৈতিক স্খলনের মাত্রা কোন্ পর্যায়ে চলে গেছে তা বিশ্ববিদ্যালয়ে না থাকলে বোঝা কঠিন। যে শক্তি এক সময় জাতির শক্তি ছিল, এখন  সেই শক্তি হয়েছে রাজনৈতিক দলের পোস্টার লাগানো বাহিনীতে। বাংলাদেশে সবচেয়ে সস্তা শ্রম হচ্ছে ছাত্রদের। একটা পুরি-একটা শিঙ্গাড়া আর এক প্যাক স্টার সিগারেট খাইয়ে তাদের মিছিল-মিটিংয়ে নেতারা  ভেড়াতে পারেন। এ রুগ্ন ছাত্র রাজনীতি নামক অপরাজনীতি সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি।
লেখক: শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মিয়ানমার-মার্কিন সম্পর্কের বরফ গলছে
মনির তালুকদার
সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন মিয়ানমার সফরে যান। ৫০ বছরের মধ্যে কোনো সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তার এটাই ছিল প্রথম মিয়ানমার সফর। ঐতিহ্যবাহী বর্মী পোশাকে প্রেসিডেন্ট থিন সেইন রাজধানী নেপিডোতে তার বাসভবনে হিলারি ক্লিনটনকে সাগত জানান। সেখান মনোরম পরিবেশে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়। প্রেসিডেন্ট থিন সেইন তার দেশকে একদলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় ব্যবস্থায় রূপান্তরের জন্য কিভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তা হিলারি ক্লিনটনের কাছে ব্যাখ্যা করেন। সেক্ষেত্রে হিলারি মিয়ানমারকে অর্থনৈতিক সহায়তাদানের প্রতিশ্র“তির পাশাপাশি সেখানে রাষ্ট্রদূত। নিয়োগের বিষয়টিও বিবেচনা করার আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক সব সময়ই অটুট থাকবে যদি বর্তমান সংস্কারকার্য চালিয়ে যাওয়া হয়। তার ওই সফর সম্পর্কে অবশ্য সমালোচকরা বলেছেন, সুচির পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণার পর পরই নড়ে চড়ে বসে যুক্তরাষ্ট্র। কেননা, বেশ কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল মিয়ানমার। তখন কিন্তু মার্কিন সরকারের তেমন ব্যতিব্যস্ততা লক্ষ্য করা যায়নি। তবে উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, হিলারির এ সফর সে দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জান্তা সমর্থিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন ওই দেশটির জন্য এটি পরোক্ষভাবে একটি স্বীকৃতি। হিলারির ওই সফর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার আগে সুচির সঙ্গে সরাসরি টেলিফোনে কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। মিয়ানমারে সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে অগ্রগতির ইঙ্গিত হিসেবেও অভিহিত করেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে এর কারণ নিয়ে। হঠাৎ করে মিয়ানমার নিয়ে এত কেন চিন্তিত যুক্তরাষ্ট্র? জার্মানির অন্যতম এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ গারহার্ড ভিলের ভাষায়, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের প্রাধান্য স্থাপন করাই এর মূল কারণ। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা। চীনের দিকে আঙ্গুল তুলে বলা যে, শুধু তারাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রেরও এ অঞ্চলের একটি দেশের ওপর প্রাধান্য রয়েছে। মানবাধিকার কর্মী মার্ক ফার্মানের জানান, ওবামার সাম্প্রতিক এশিয়া সফরেও এর একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে সৈন্য সংখ্যা বাড়ানো এই অঞ্চলের ২১টি দেশের মধ্যে মুুক্ত বাণিজ্যের ব্যাপারে আমেরিকার উৎসাহ এসব চীন ও ভারতের পাশাপাশি নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে এই সফর চীনের সঙ্গে কোনোরকম প্রতিযোগিতার অংশ কিনা সে সম্পর্কে তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতায় আমরা নেইÑ আর নামতেও চাই না। আমি এই সফরের মাধ্যমে মিয়ানমার এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। চীনের সঙ্গে তার প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক যদি ভালো হয় তা হলে তা গোটা অঞ্চলের জন্যই একটি ভালো খবর। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের পর হিলারি সাক্ষাৎ করেন রেঙ্গুনে অং সান সুচির সঙ্গে। সেখানে তিনি তার সঙ্গে অনেকটা সময় কাটান। এটা ছিল হিলারির সঙ্গে সুচির প্রথম বৈঠক। সে সময় হিলারি মৃদু কণ্ঠে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিয়ানমারের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করা যায় কিনা, তা আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এর পরও অবশ্য মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং সাবেক সামরিক জান্তা সরকারের সদস্যদের আমেরিকা ভ্রমণের ওপর বিধিনিষেধ বহাল রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে বিরোধী দলের কেউ কেউ মনে করেন মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে হিলারি ক্লিনটনের এত মাখামাখি করার সময় এখনো আসেনি, যা তিনি করছেন।  মিয়ানমারে রাজবন্দী মুক্তিসহ মানবাধিকারের এমন অনেক সুযোগ ইস্যু আছে যেগুলো উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। তার পরও হিলারি ক্লিনটনের ওই সফরের আয়োজন করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং মিয়ানমার উভয় দেশের একটা অভিন্ন স্বার্থ থেকে। এই অবস্থায় মিয়ানমারকে কাছে টানতে পারলে মার্কিনীদের সোনায় সোহাগা। তবে পাল্টে যাচ্ছে মিয়ানমারের দৃশ্যপট। সামরিক সরকারের দোর্দণ্ড দাপটে যে দেশ এক সময় কাঁপত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার যেখানে বার বার ভূলুণ্ঠিত হতো, সেখানে এখন বইছে পরিবর্তনের হাওয়া। সংস্কারের মাধ্যমে দেশটি এখন গণতন্ত্রের পথেই এগুচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই। যদিও এখনো পর্যন্ত এর তেমন আহামরি কোনো শক্তিশালী ভিত তৈরি হয়নি। তার পরও সাম্প্রতিক অনেক ঘটনাই সেদিকটার পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। বিশেষ করে অং সান সুচির দলকে পুনরায় নির্বাচনে অনুমতি, সামনে উপনির্বাচনে সুচির অংশগ্রহণ, রাজবন্দীদের মুক্তি, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সফর, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মনেপ্রাণে সম্পর্কোন্নয়ন প্রভৃতি বিষয় ওই ধারণাকেই বদুমূল করেছে যে, দেশটিতে গণতন্ত্রের পথ সুগম হচ্ছে। গত মার্চ ২০১১ সামরিক জান্তা বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এর পর থেকেই শুরু হয়  গণতন্ত্রের নতুন পথচলা এবং অবসান হয় দীর্ঘ ৫০ বছরের সামরিক শাসন। তখন অবশ্য এ ধারণাও করা হয়েছিল যে, নতুন সরকার জান্তার আজ্ঞাবহ এবং পুতুল সরকার হিসেবেই কাজ করবে। সামনে বেসামরিক সরকার আর পেছন থেকে কলকাঠি নাড়াবে সামরিক জান্তা। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সে ধারণাকে অনেকটা বদলে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই আসা যাক সুচির রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের অনুমতির বিষয়টি। গত কয়েক দিন আগে রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরে বল হয়েছে, বৈধভাবে পুনরায় নিবন্ধন করতে সুচির দলকে অনুমতি দিয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এতে করে সে দেশের রাজনীতির মূল ধারায় ফিরে আসতে গণতন্ত্রপন্থি দলটির পথ সুগম হলো। সামরিক সমর্থিত নতুন সরকার সংস্কার সাধনের একাধিক পদক্ষপ গ্রহণের পর নিবন্ধনের ওই পদক্ষেপ নেয়া হলো। এর ফলে ২০১২ সালের পার্লামেন্টের উপনির্বাচনে সুচির প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ প্রশস্ত হলো। ২০১০ সালে সুচির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি  (এনএলডি) নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলে সামরিক সরকার একটি বৈধ রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও তাদের নিবন্ধন বাতিল করে। কয়েক দিন আগে সে দেশের একটি সরকারি সংবাদপত্র জানায়, নির্বাচন কমিশন একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে পুনঃ নিবন্ধনে এনএলডির আবেদন অনুমোদন করেছে। সেক্ষেত্রে সুচি বলেছেন, তিনি আসন্ন উপনির্বাচনে অংশ নেবেন। যদিও এখন পর্যন্ত ওই নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। তার পরও দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, জানুয়ারি ২০১২, নতুন করে আরো রাজবন্দী কিংবা সব রাজবন্দীকেই মুক্তি দিতে পারে দেশটির সরকার। মিয়ানমারের লেখক, ইতিহাসবিদ এবং সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা থান্ট মাইন্ট বলেছেন, পার্লামেন্টের উপনির্বাচন মার্চ ২০১২তে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তিনি বলেন, সরকারের ওই পদক্ষেপ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের উপায় হিসেবে কাজ করবে সিঙ্গাপুরে সম্প্রতি দেয়া এক সাক্ষাতকারে মাইন্ট বলেন, সব বন্দি যদি মুক্তি নাও পায় তবুও জানুয়ারিতে বেশিরভাগ রাজবন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে। তারপর ফেব্র“য়ারি বা মার্চে উপনির্বাচন হবে। রাজবন্দীদের মুক্তি ছাড়াও দেশটির গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণও শিথিল করা হবে। গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সুচির সম্পর্কের বরফও গলছে দ্রুত। সরকার ইতোমধ্যে ৩০০-এর বেশি রাজবন্দীকে মুক্তি দিয়েছে। এমন কি গত আগস্টে সুচির সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন। সরকার দেশের নির্বাচনী আইনেরও সংস্কার করেছে। গত অক্টোবরে গঠিত হয়েছে মানবাধিকার কমিশন। ইউনিয়নের স্বার্থ বিবেচনায় রেখে মিয়ানমারে তৈরি হয়েছে নতুন শ্রম আইন। সর্বোপরি ২০১৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশসমূহের জোট “আসিয়ান”-এর সভাপতি হতে যাচ্ছে মিয়ানমার। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট পথ ধরেই গণতন্ত্রের বিকাশ হচ্ছে দেশটিতে। মিয়ানমার সরকার যে আরো অনেক বিষয়ে নমনীয় হচ্ছে তার আরো একটি উদাহরণ হচ্ছে তারা জাতিগত সংখ্যালঘু কাচিন বিদ্রোহীদের ওপরও হামলা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন সেনাবাহিনীর প্রতি ওই নির্দেশ দিয়েছেন। মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশ কাচিন এবং তারা মূলত খ্রীস্টান। গত জুন থেকে চীন সীমান্তের কাছে কাচিন প্রদেশে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ) নামের গেরিলাদের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাদের প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলছে। যুদ্ধের কারণে হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। তাই এখন থেকে সরকার রাজনৈতিকভাবে ওই সংকট মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সর্বশেষে বলা যায়, অনেক সামরিক রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দেশটিতে এখন বইছে গণতন্ত্রের বাতাস তথা পরিবর্তনের হাওয়া। আর ওই পরিবর্তনের নৈপথ্যে যিনি কাজ করছেন তিনি হচ্ছেন গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সুচি। আর তার হাত ধরেই দেশটি গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাবেÑ তেমনটিই সকলের প্রত্যাশা।
লেখক: কলামিস্ট
দেশপ্রেমিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
দেব কুমার মণ্ডল
বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার সৃষ্টিও সাধনার মাধ্যমে বাংলাদেশকে, দেশের মানুষকে নিজের ভাষাকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালোবেসেছিলেন। আর সে কারণেই তার লেখনীর মধ্য দিয়ে বাংলাকে ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বললেন...
‘রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।
সাধিতে মনের সাধ, ঘটে যদি পরমাদ
মধুহীন করোনা সাধ, ঘটে যদি কোকনদে।’
কৃষক যেমন তার কাজের মাধ্যমে, সৈনিক যেমন তার দক্ষতা ও রণকৌশলের মাধ্যমে, সাধারণ মানুষ যেমন তাদের অর্থ সম্পদ ও শ্রমের মাধ্যমে দেশের সেবা করে, তেমনি কবি সাহিত্যিকরা তাদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে যুগে যুগে, কালে কালে দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে গেছেন। তেমনি বাংলা সাহিত্যে মাত্রা সংযোজনের স্রষ্টা বাঙালি জাতির অহঙ্কার নতুন শতাব্দীর নতুন বাংলাদেশের বাঙালির প্রাণপুরুষ, বিপ্লবী সত্তার অধিকারী মাইকেল মধুসূদন দত্ত ভালোবেসেছিলেন নিজের দেশ এবং মা, মাটি মানুষকে। আর সে কারণেই তো তিনি দেশপ্রেমিক কবি হিসেবে সুপরিচিত। স্বদেশপ্রেম বা দেশপ্রেম তাকেই বলে যে তার দেশকে ভালোবাসে। ভালোবাসে তার নিজ জš§ভূমিকে। জš§ভূমির সবকিছুর ওপর যার গভীর ভালোবাসা আছে তাকেই বলে স্বদেশপ্রেম। আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ মাইকেল মধুসূদন দত্ত সেকারণেই একজন দেশপ্রেমিক। কারণ বিদেশি চাল, চলন, হাব-ভাব সবকিছুই একজন বিদেশির মতো হলেও তিনি কখনো ভুলে যাননি নিজ জš§ভূমির কথা, জš§ভূমির মা, মাটি ও মানুষের কথা। তিনি তাই স্বগর্বে পরিচয় দিয়েছেন ‘যশোরে সাগরদাঁড়ী কপোতাক্ষ তীরে আমার জš§ভূমি। আমি একজন বাঙালি।’ বিদেশে অবস্থান করেও বাংলাদেশের প্রতিটি জিনিসকে তিনি মনেৎপ্রাণে ভালোবেসেছেন। সুদূর ভার্সাই নগরীতে বসেও তিনি স্মরণ করেছেন তার স্বদেশ ভূমির ওপর প্রবাহিত নদ ‘কপোতাক্ষের’ কথা। তাই তো তিনি লিখলেনÑ
‘সতত হে নদ’ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে
সতত যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া মন্ত্রধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে’
বাঙালির জীবনবোধ ও চিন্তাচেতনায় যিনি এনেছেন আধুনিকতা, সেই কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত দেশপ্রেমের যে অফুরন্ত স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তিনি বলেছেন দূরে থাকি যবে তোমাদের শুধু ফিরে ফিরে মনে পড়ে। সমধুর শৈশব স্মৃতি ঘেরা সুন্দর দিনগুলোকে মনে পড়ে স্বপ্নে মায়ামন্ত্রধ্বনির মতোই জীবনজুড়ে থাকা মা, মাটি, মাতৃভাষা আর শৈশবসহচর বহুবিচিত্র ব্যক্তি ও বস্তুসত্তার কথা, মনে পড়ে মাতৃসমা মাতৃভাষার কথা, যাকে একদিন অনাদরে অবহেলায় সযতেœ সজোরে নিশ্চিন্ত নিক্ষেপে বহু দূরে ঠেলে ফেলে দেয়া হয়েছিল। যত তাড়াতাড়ি তাকে ভুলে যাওয়া যায় ততই মঙ্গল বলে মনে করা হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল মিলটনের মাতৃভাষায় মহাকবি না হতে পারলেও সেই কবিদের দেশে পৌঁছাতে না পারলে জীবনের অস্তিত্বই বৃথা। তাই শয়নে-স্বপনে, চিন্তায়-চেতনায়, কথায়-কাজে বিলক্ষণ বিলেতী বেশে, স্বদেশে বিদেশীর মতো বাঞ্ছিত বিদ্যা ও সাহিত্য চর্চায় বিমুগ্ধ বিনিয়োগ আকর্ষণ করে রাখল মন্ত্রমুগ্ধের মতো। নাম হলো, কিন্তু দাম হলো না। মনে হলো এত প্রাণপণ করে ‘তবু ভরিল না চিত্ত।’ অন্তরের অন্তস্তলে নিশ্চিন্তে নিধুবাবু ততদিনে তান ধরেছেন তার তানপুরায়, ‘বিনে স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা?’ আশা তার সত্যিই মেটে না, মেটে না যেমন ধারা জল বিনা চাতকীর তৃষ্ণা। তাই তখনই অনুকূল আবহাওয়ায় দরদী দৃষ্টি যায় কবির মাতৃভাষার ওপর। মনে হয় অমীয় রতœরাজি সঞ্চিত এর অক্ষয় ভাণ্ডারে। মনে হয় এর চর্চায় জীবনপাত করাই উচিত। মনে হয়, যে তার নিজের মাতৃভাষা ভালোভাবে জানে না তাকে শিক্ষিত বলা কোনো ক্রমেই সমীচীন নয়। কবি মধুসূদনের মনে পড়ে অনাহারে-অনিদ্রায় কায়মনো সপে সর্বসুখ পরিহার করে অবরেণ্যকে বরণ করার বিফল তপস্যার কথা। মনে হয় কমল কানন ভুলে শৈবাল দলে কেলিকরার কথা। কবির মনে পড়ে মাতৃরূপা মাতৃভাষার কুললক্ষ্মী কর্তৃক স্বপ্ন প্রদর্শনের কথা। পথহারা অবোধ শিশুর মনিজালে পরিপূর্ণ মাতৃভাষারূপ খনির সীমাহীন রতœরাজির কোলে সানন্দে সাগ্রহে অবাধ আÍসমার্পণের কথা। জীবন যখন জরাজীর্ণ কারাগার হিসেবে কঠোরভাবে কাছে ঢাকছে, মৃত্যু যখন মারাÍকভাবে কাম্য বলে বোধ হচ্ছে, সন্তান সন্তুতির ভবিষ্যৎ ভাবনা, পাওনাদার ও পত্তনিদারদের চিন্তা যখন কুরে কুরে খাচ্ছে, মাথায় যখন খপ করে খনচুড়ে যায়, তখনই তার সেই সুদূর ফরাসী দেশে সেই ভবনা ভারাতুর ভার্সাইয়ে বসে মনে হয় মাতৃরূপা মাতৃভাষার কল্যাণী কুললক্ষ্মীর কথা। মনে হয় তার অশেষ আশীর্বাদপুষ্ট আজ্ঞা প্রতিপালনের কথা। একেই বুঝি বলে কবির কথায় হƒদয় রক্ত রঞ্জনে তব চরণ রাঙিয়ে দেবার কথা। দূর দেশে অবস্থান করেও কবি হƒদয়ের এই আকুতি স্বদেশী সাহিত্যের প্রতি তার ভালোবাসার প্রতিফলন ঘটেছে।
শৈশব সহচর কপোতাক্ষের কথা কবি মধুসূদন দত্তের কলমে অন্তরঙ্গ আকুতিতে প্রাণপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তার গভীর ভালোবাসার কথা স্বরূপে সৌন্দর্যে সুরভিত হয়ে উঠেছে। কবির কাছে কপোতাক্ষ তাই শুধু একটি শৈশব সহচর কুলনাদী কপোতাক্ষ নদই, তার অশান্ত অন্তরের অন্যতম নিশ্চিন্ত নক্ষত্র স্বরূপে তা তার জীবন জটিলতার পথে অন্যতম দিকনির্দেশকারী ধ্র“বতারা। সাতসমুদ্র তেরো নদীর কালাজল পেরোবার পথে অসংখ্য নদ-নদী তার দৃষ্টিগোচর হয়েছে কিন্তু কপোতের অক্ষির ন্যায় সুøিগ্ধ ও এমন সুন্দর প্রাণদায়িনী তৃষ্ণার শান্তি সুশীতল এবং সুমিষ্ট জল তার চোখে পড়েনি। সেদিন স্বপ্নেমায়া মন্ত্রধ্বনির মতোই ভ্রান্তির ছলনে কবি কানে কলকল গীতের গুঞ্জন সৃষ্টিতে মুগ্ধ করে রেখেছিল জš§ভূমি স্তনে দুগ্ধ স্রোতোরূপী কলনদী কপোতাক্ষ। বিদেশে বসবাসের বিপর্যস্ত দেহমনের দুঃসহ দিন গুলোতে শৈশবের সহচর সুরভিত সুন্দর স্মৃতিগুলো কবির কুঞ্জে কলকাকলী জাগিয়ে রেখেছিল তার ব্যাকুল হƒদয় সন্দেহে সচেতনে বড় হয়ে উঠেছে। তিনি সত্যিই আর কখনো তার প্রিয় সেই কপোতাক্ষ পাড়ে ফিরে আসতে পারবেন কিনা! পরম প্রেমিকের মতো প্রবাসে তার অন্তর ভরে থাকে সেই কলম্বরা কপোতাক্ষের কথায়। আজ যদিও সেই কলম্বরা কপোতাক্ষ আর নেই, তার বুক চিরে আর লঞ্চ, স্টিমার চলেনা। সেই কপোতাক্ষের আজ মৃত্যু ঘটেছে। আজ সেই কপোতাক্ষ শুধু মধুর স্মৃতিকে ফিরে শৈবলদাম বুকে নিয়ে যেন চির নিদ্রায় শায়িত। ‘মেঘনাদ বধ কাব্যে’ স্বদেশ প্রেমের যে নিদর্শন কবি মধুসূদন রেখেছেন তা চিরস্মরণীয়। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে রামায়ণের রাবণ চরিত্রটি পাপাচারি রাক্ষস, আপোহরণ কারী, পিশাচ, লম্পট হিসেবে পরিচিত কিন্তু মধুকবি তাকে একজন মহান পুরুষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। রাবণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মহামহিম বীর হƒদয় বলে আখ্যায়িত করেছেন। জš§ভূমির প্রতি তার অসীম দরদ। মেঘনাদ মহাবীর যাকে অন্যায়ভাবে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ রামলক্ষণ গুপ্তঘাতক এবং বিভীষণকে দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। স্বদেশ ভূমি রক্ষা করতে যেয়ে বীরবাহু মেঘনাদের মৃত্যু ঘটলে রাবণ তাঁর নিজ স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলেন যে ছেলে দেশের জন্য যুদ্ধ করে মৃত্যু বরণ করে সে ধন্য, এমন ছেলের পিতা-মাতা হওয়াও গর্বের বিষয়। কবির লেখনীতে রাবণের উক্তিÑ
‘জš§ভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে
যে ডরে, মূঢ় সে, ভীরু, শতধিক তারে।’
একজন মহান দেশপ্রেমিকের পক্ষেই এ ধরনের সত্য ভাষণ সম্ভব। স্বদেশের বর্ণ গন্ধ সৌন্দর্যকে তিনি দু’বাহু বাড়িয়ে পেতে চেয়েছেন। তার রোমান্টিক কল্পনার কুৎসিত, সুন্দর, রাবণের অহঙ্কারত্ব কোমল প্রাণের উত্তাপে ভরা। সাগর মেঘলা, শ্যামল বাসনা, মনিকুন্তলা স্বদেশের জন্য তার অন্তহীন আকর্ষণ। কলকাতার ব্যারিস্টার মধুসূদন মেঘনাদবধ কাব্যের মহাকবি। তিনি বাংলাদেশের সন্ধ্যাকালের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, অস্তগামী সূর্যের স্বর্ণরশ্মিতে সবুজক্ষেত, অস্পষ্ট নীল আকাশ, ‘সায়ংকালের সন্ধ্যা’ শীর্ষক কবিতাটির কথা মনে করিয়ে দেয়। রাত্রি তার কাব্যের বিভিন্ন জায়গায় দিনের আলোতে হারিয়ে গেছে। এখানে নিঃশব্দ প্রশান্তি নিয়ে রাত নেমে এসেছে। দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার চতুর্দশপদী কবিতাবলীতে প্রকাশ পেয়েছে। শ্যামাপাখী, কেউটিয়া সাপ, নন্দন কানন, ‘কুসুমেকীট’ সায়ংকালের তারা’ ‘নিশা’ সবই স্বদেশের কাহিনী অবলম্বনে রচিত। এটা মধুকবির গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় বহন করে।
‘তিলোত্তমা সম্ভব’ সৌন্দর্যমুগ্ধ মধুসূদন দত্তের প্রথম কাব্য। তিলোত্তমার সৌন্দর্যে আছে চোখের তৃপ্তি, হƒদয়ে জাগায় আনন্দ উল্লাস। কিন্তু কারো আয়ত্তের নয় তিলোত্তমা। ‘উপক্রম’ কবিতাটিতে কবি আপন পূর্বতন কবি কৃতী সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, তিলোত্তমা কাব্য মুক্তা সদৃশ, ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য গভীর সুর ঝঙ্কার ব্রজাঙ্গনা কাব্যকে তিনি বলেছেন কল্পনায় ব্রজধামের কাহিনী নির্মাণ এবং বীরাঙ্গনা হলো বিরহ লেখন। আবার চতুর্দশপদী কবিতাবলীর। ‘কমলেকামিনী’ এবং ‘শ্রীমন্তের টোপর’ কবিতা দুটিতে ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যপাঠের স্মৃতি ধরা পড়ে। শ্রীমন্তের টোপর কবিতায় রতœখচিত টোপরটি যখন সমুদ্রে পড়ছে তখনকার দৃশ্যকে মধুসূদন তুলনা করেছেন স্বচ্ছ সরোবরে মাছ ধরবার উদ্দেশ্যে মাছরাঙার গতিবিধির সঙ্গে। দেশজ সম্পদ সরোবর, মাছরাঙা বাজপাখি প্রভৃতি তার লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে যেটা গভীর দেশপ্রেমিকতার পরিচয় বহন করে। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল’ কাব্যপাঠের স্মৃতি খুঁজে পাওয়া যায় অন্নপূর্ণার ঝাঁপি’ এবং ‘ঈশ্বরী পাটনী’ কবিতাদ্বয়ে।’ ‘ঈশ্বরী পাটনী’ কবিতায় কবি একজন সরলপ্রাণ নির্লোভ দরিদ্র ব্যক্তির সৌভাগ্যের কথা বলেছেন। ঈশ্বরী পাটনীর পারাপারের নৌকায় বসেছেন মানবী বেশে দেবী অন্নপূর্ণা, যার পদস্পর্শে কাঠের নৌকা স্বর্ণময় হয়ে উঠেছে। কবি এখানে বলেছেন ঈশ্বরী পাটনী যেন দেবীর নিকট থেকে এ ঐশ্বর্য চেয়ে নেয়। কাব্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভের আশায় ব্যাকুল কবি সহায়সম্বলহীন নিঃস্ব অবস্থায় কালযাপন করছেন। তাই তার একমাত্র অবলম্বন দেশজচৈতন্য তাঁরই পসরা সাজিয়ে চতুর্দশপদী কবিতাবলী রূপে যে উপঢৌকন দিলেন যা তার দেশাত্ববোধেরই পরিচয়।
‘চতুর্দশপদী কবিতাবলীতে’ মহাভারত পাঠেরও বহু স্মৃতি জড়িত আছে। এখানে কবি কাশিরাম দাশকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। তিনি এ দেশবাসীর  বোঝার জন্য বাংলাভাষায় মহাভাতের কাহিনীর রূপান্তর ঘটিয়েছেন। এভাবে দেশজ সাহিত্যের অবলম্বনে আধুনিক ভাবধারায় রচিত কাব্য সাহিত্য দেশবাসীকে উপহার দিয়ে দেশ প্রেমিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। দূর দেশে থাকার ফলে দেশের সবকিছু তার স্মৃতিতে মমতার সঙ্গে ভাস্বর হয়েছে, যার প্রমাণ তিনি রেখেছেন তার দেবদোল, শ্রীপঞ্চমী, বিজয়াদশমী কোজাগার লক্ষ্মীপূজা প্রভৃতি কবিতাগুলোতে। এই কবিতাগুলোতে কবিচিত্তের বেদনা, মমতা এবং আকাক্সক্ষা এক প্রকার বাণী অর্চণার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
যে কবি তাঁর দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে, নিজ সাহিত্যকে ভালোবেসে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন তিনি হলেন বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ ও একজন দেশপ্রেমিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাঙালির জীবনবোধ ও চিন্তাচেতনায় যিনি আধুনিকতা এনেছেন তিনি আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব, স্বদেশপ্রেমিক কবি মধুসূদন দত্ত। তাই কবি মধুসূদনের স্বদেশপ্রেম মানবিকতার মূল্যবোধে মহীয়ান।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, সাগরদাঁড়ী এম এম ইনস্টিটিউশন 

 এমএলএম ব্যবসার দুর্নীতি রোধে শুধু আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়
বেশ কিছুদিন হইতে পাতি দুর্নীতিবাজ তাহার ডায়েরি লিখিবার সময় করিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। বিশেষ কারণে দেশের বাহিরে অবস্থান করায় ডায়েরি লেখায় সাময়িক ছেদ পড়ায় দুঃখ প্রকাশ করিয়া এখন হইতে নিয়মিত হইবার অঙ্গীকার করিতেছেন। পাঠক ভাইবোনেরা নিজ গুণে অধম পাতি দুর্নীতিবাজকে ক্ষমা করিয়া দিবেন। গত কয়েক মাসে পাঠকবৃন্দ নিশ্চয়ই খেয়াল করিয়াছেন যে, দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি বড় ধরনের বিষয় সংবাদপত্রের পাতায় ফলাও করিয়া প্রচারিত হইয়াছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্ব ব্যাংক মোটা দাগে ঋণ প্রদান করিতে যাইয়া হঠাৎ করিয়া তাহা স্থগিত করিয়া দেয়। তাহাদের অভিযোগ, সেতু নির্মাণ শুরু হইবার আগেই যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কিছু অনিয়ম করিয়াছে- যাহা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। বিশ্ব ব্যাংকের অভিযোগের আঙ্গুল ছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের দিকে। প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ আমলে নেয় নাই। বরং বিশ্বব্যাংকের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়িয়া দিয়া বলা হইয়াছিল টাকা পাওয়া না গেলে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে উহা নির্মাণ করিবে। কিন্তু, পরবর্তীতে সরকার অবস্থান পরিবর্তন করে এবং যোগাযোগমন্ত্রীকে প্রত্যাহার করিয়া তাহাকে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কিন্তু, ইহা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংকের বরফ গলিতে শুরু করে নাই। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী টাকা ছাড় করিবার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করিলেও প্রকৃত অবস্থা অন্যরকম। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর এলেন গোল্ডস্টেইনের সাম্প্রতিক এক বক্তব্য হইতে বিশ্বব্যাংকের অবস্থান স্পষ্ট অনুধাবন করা যাইতে পারে। তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে (পদ্মায়) জলবায়ু সম্পর্কিত এক আলোচনা সভায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সরকার আমাদের কাছে যেসব তথ্য উপাত্ত চাহিয়াছে আমরা তাহা সরবরাহ করিয়াছি। তিনি আরো বলেন, ‘এমন হইতে পারে যে, আমাদের দেওয়া তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলির পছন্দ হয় নাই!
দুই পক্ষের এই টানা হ্যাঁচড়ায় শেষ পর্যন্ত পানি কোনদিকে গড়ায়- উহাই লক্ষণীয় বিষয়। আমরা আশা করি সহসাই এই জট খোলা সম্ভব হইবে এবং বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পদ্মা সেতু নির্মাণের পথ উš§ুক্ত হইবে। দেশে দুর্নীতি কার্যক্রম যে বেপরোয়া গতিতে চলিতেছে উহার অন্য একটি নমুনা উল্লেখ করিয়া পরবর্তী প্রসঙ্গে চলিয়া যাইব। চট্টগ্রাম বন্দর হইতে খবর আসিয়াছে যে, জাল ছাড়পত্র বানাইয়া একজন আমদানিকারকের প্রতিনিধি ১১টি কনটেইনার ভর্তি রাসায়নিক দ্রব্য লোপাট করিয়া দিয়াছেন। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এতবড় জালিয়াতির ঘটনা নাকি আগে কখনো ঘটে নাই। কাস্টমস বিভাগ সংশ্লিষ্ট পণ্যের শুল্ককর নির্ধারণ করিয়াছিল ৬৭ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। কাস্টমস হাউস সূত্রে জানা গিয়াছে, স্বাভাবিক নিয়মে গেটদিয়া মালামাল বাহির করার সময় অনলাইনে ছাড়পত্র নম্বর দিয়া শুল্ক করে পরিশোধ করা হইয়াছে কিনা-উহা যাচাই করা হয়। কিন্তু, সিসিটি ১ গেটে অনলাইন পদ্ধতি অচল থাকায় বিষয়টি শনাক্ত করা যায় নাই বলিয়া বলা হইতেছে। এখন যাচাই করিয়া দেখা দরকার যে, সংশ্লিষ্ট গেটের অনলাইন পদ্ধতিটি কতদিন যাবৎ অচল এবং অপরাধ সংঘটনের লক্ষ্যেই উহা অচল করিয়া রাখা হইয়াছে কিনা? দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি সম্পূর্ণ নতুন ও চাতুর্যপূর্ণ লোক ঠকানো ব্যবসার উল্লেখ করিয়া অদ্যকার লেখার ইতি টানিব। সম্প্রতি এই ব্যবসাটি বেশ রমরমা হইয়া উঠিয়াছে এবং প্রশাসনের নাকের ডগায় সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তিরা ফাঁদ পাতিয়া নিরীহ মানুষকে ঠকাইয়া চলিয়াছে। পক্ষান্তরে নিজেরা লক্ষ লক্ষ টাকা হাতাইয়া লইয়া মানুষকে সর্বস্বান্ত করিতেছে। ইতিপূর্বে বছর দশেক আগে ‘এমএলএম’ ব্যবসার নামে কতিপয় ব্যবসায়ী দেশের লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে ঠকাইয়া দ্রুত ধনী বনিয়া গিয়াছে। মানুষকে দ্রুত ধনী হওয়ার লোভ দেখাইয়া নিজেরা দ্রুত ধনী হইতে তাহাদের বিন্দুমাত্র বাধে নাই। বরং নানান ধরনের মার্কেটিং পদ্ধতি প্রয়োগ করিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও কোম্পানিসমূহ এমন এক প্রতারণার জাল ছড়াইয়া দিয়াছিল যে, লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতী সর্বস্বান্ত হইয়া পথে বসিতে বাধ্য হইয়াছে। আর এই মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) করার সময় সংশ্লিষ্টরা মন্ত্রী হইতে শুরু করিয়া নিচের দিকের শত শত প্রভাবশালী ব্যক্তিকে নিজেদের পক্ষে আনিতে নগদ টাকাসহ নানান ধরনের উপহার সামগ্রী বিলিবণ্টন করিতে কার্পণ্য করে নাই। ফলে অবস্থান ভেদে ছোট-বড়-মাঝারি আকারের উপহার সামগ্রী উপঢৌকন পাইয়া সকলেই নিজ নিজ কর্তব্য বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছেন। আর সেই সুযোগে ‘এমএলএম’ ব্যবসার নামে কোটি কোটি টাকা আহরণ করিয়া নব্য ধনীরা বড় বড় ব্যবসায় শুধু ফাঁদিয়া বসেন নাই অসংখ্য জমি-জমা, দালান কোঠা কিনিয়া সমাজের উঁচু স্থানে আসন গাড়িয়া বসিয়াছেন। আর ঐসব কোম্পানির ফাঁদে পা দিয়া ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক সদস্য সদস্যরা হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হইয়া কপাল ঠুকিতেছেন। সাম্প্রতিককালে নতুন আরো দুইটি এমএলএম ব্যবসায় দ্রুত ছড়াইয়া পড়িতেছে। সুযোগ সন্ধানী প্রতারকরা প্রচুর লাভ বা মুনাফার হাতছানি দিয়া বিপুল সংখ্যাক নিরীহ মানুষকে তাহাদের সহিত সংশ্লিষ্ট করিয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ রোজগারের ব্যবস্থা করিয়াছেন। এই মুহূর্তে যাহারা এসব কোম্পানির সদস্য হইতেছেন তাহারা মোটামুটি লাভ করিতে পারিলেও শেষ পর্যায়ে যাহারা সদস্যভুক্ত হইবেন তাহারা নির্ঘাৎ ক্ষতিগ্রস্ত হইবেন। কারণ, ঐ পর্যায়ে লক্ষ লক্ষ সদস্য অন্যদের সদস্য বানাইবার প্রতিযোগিতা শুরু করিলে এমন এক সময় আসিবে যে, নতুন করিয়া আর সদস্য খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। নতুন ব্যবসায় দুইটির একটি হইতেছে ‘অনলাইন ব্যবসায়।’ ইহাতে একজন সদস্য হইতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে ৭  হাজার টাকা জমা দিয়া একটি ‘আইডি নম্বর পাসওয়ার্ড’ সংগ্রহ করিতে হয়। বিনিময়ে সদস্যভুক্তির দিন হইতে তাহাকে প্রতিদিন ১ ডলারের সমপরিমাণ টাকা মুনাফা দেওয়া হয়। যদি ঐ ব্যক্তি নতুন করিয়া আরো ৭ ব্যক্তিকে সদস্যভুক্ত করিতে পারেন, তাহা হইলে পুরস্কার হিসাবে তিনি প্রত্যেকের জন্য ১০ ডলার করিয়া পাইবেন। উল্লেখ্য, ডলারের মূল্যমান যাহাই হউক না কেন সদস্যভুক্তির সময় সকলকে ১  ডলারের মূল্য ৭০  টাকার বেশি দেওয়া হইবে না বলিয়া জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে। অতএব, একজন সদস্য এক মাসে ১০ জন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করিতে পারিলে তিনি ৭ী১০ ডলার হিসাবে ৭ হাজার এবং এক মাসে ৩০ দিন ী ১ ডলার হিসাবে ২ হাজার একশত টাকাসহ মোট ৯ হাজার ১শ’ টাকা আয় করিতে পারিবেন সহজেই। আমার অফিসের এক তরুণ ‘ডোলেন্স’ নামের অনলাইন সংস্থায় সদস্যভুক্তির ১৫ দিনের মধ্যেই তাহার টাকা উসুল করিয়া এখন লাভের অঙ্ক গুনিতে শুরু করিয়াছেন। নতুন ‘অনলাইন ব্যবসায়’ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মচারীটি দ্রুতই সদস্য খুঁজিয়া পাইতেছেন। পক্ষান্তরে, ‘অনলাইন’ ব্যবসার মালিকগণ শত শত ব্যক্তির কাছ হইতে ৭  হাজার টাকা আদায় করিয়া কি পরিমাণে লাভবান হইতেছেন তাহা একটু চিন্তা করিলেই সম্যক উপলব্ধি করা যাইবে। নতুন ব্যবসার অন্যটি হইতেছে ১০  মাস মেয়াদি ডিপিএস ব্যবসায়। ইহাতে একজন সদস্য ১ লক্ষ টাকার প্যাকেজের একটি হিসাব খুলিলে ১০  মাসে উহা দ্বিগুণ হইয়া যায়। মাসে মাসে ১০ হাজার টাকা জমা দিতে হয়। শুরুতে কোনো টাকা হস্তান্তর না করিলেও হিসাব খোলা সময়েই ২০ হাজার টাকা মুনাফা হইয়াছে দেখাইয়া হিসাবধারীকে রসিদ প্রদান করা হয়। পরে মাসে মাসে ১০  হাজার টাকা জমা করিলে ১০ মাস পরে তাহাকে পুরো টাকা ফেরত প্রদান করার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। এখন কথা হইল ১০  মাস পর ঐ কোম্পানির কর্মকর্তাদের হদিস পাওয়া যাইবে কিনা! এই ব্যবসার ক্ষেত্রেও অস্বাভাবিক লাভ প্রদানের অঙ্গীকার করা হইয়া থাকে এবং সহসাই অনেকে বিপজ্জনক জানিয়াও এই ফাঁদে পা দেন। সুখের বিষয় সরকার অনেক বিলম্বে হইলেও অসংখ্য ব্যক্তি পথে বসার পর মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হইয়াছে ‘ডাইরেক্ট সেল আইন-২০১২।’ আইনটি জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হইবার পর কেহই দ্রুত ধনী হইবার বিজ্ঞাপন দিয়া ব্যবসায় করিতে পারিবেন না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খসড়া আইনের মুখ বন্ধে উল্লেখ করিয়াছে যে, এমএলএম-এর পিরামিড সদৃশ ‘পণ্য’ বা ‘সেবা’ একটি ‘অভিনব কৌশল’ এবং নতুন আইনে এই কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হইয়াছে। কথা হইতেছে দেশে অনেক আইন আছে, নূতন, নূতন আইনও প্রণয়ন করা হইতেছে। কিন্তু আইনগুলি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলি কি তৎপর হইবে? ঘুষ ও উপঢৌকনের তলায় উহা চাপা পড়িবে না তো?

 বঙ্গবন্ধুর বাঙালিয়ানা
মাওলানা এম এ রহমান
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই অসীম আÍিক শক্তিসম্পন্ন একদল মহামানব এক একটি যুগে জš§গ্রহণ করে পুরো মানব সমাজকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শাসন করে গেছেন। মানুষের কল্যাণ সাধনকারী হিসেবে যখন যা প্রয়োজন, তাদের দ্বারাই তা দুনিয়াতে আবিষ্কৃত ও প্রবর্তিত হয়েছে। সেই সব অসাধারণ ব্যক্তিই নিজ নিজ যুগের নবী ছিলেন। ধর্মচিন্তা ও লজ্জাবোধ পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ.) থেকেই প্রবর্তিত হয়েছে। হযরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া (আ.) উভয়েই যখন বেহেশত থেকে দুনিয়াতে পতিত হন, তখন বেহেশতের গাছের পাতা ছাড়া তাদের আর কোনো আবরণ ছিল না। পৃথিবীতে সূর্য তাপে হযরত আদম (আ.) কষ্ট পেতে থাকলে তিনি বসে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হাওয়া রোদ্রে আমার বড়ই কষ্ট হচ্ছে। তখন ফেরেশতা হযরত জিবরাইল (আ.) তুলা নিয়ে আসলেন। তিনি হাওয়াকে সুতাকাটা আর আদমকে কাপড় বুনানো শিক্ষা দিলেন (তফসিরে দোরবে-মনছুর)। আর এভাবেই এক এক নবী এক এক যুগে দুনিয়াতে এসে এক বা একাধিক জিনিস বা বিষয়ের প্রবর্তন করেছিলেন। যেমন নবী হযরত নূহ (আ.) দুনিয়ার সর্বপ্রথম জাহাজ নির্মাতা, হযরত ইদ্রিস (আ.) দুনিয়ার সর্বপ্রথম দর্জি, হযরত হুদ (আ.) সর্বপ্রথম ব্যবসায়ী, হযরত দাউদ (আ.) সর্বপ্রথম কর্মকার এবং প্রাচীন গোষ্ঠীপতি শাসিত সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তক, হযরত ইবরাহীম (আ.) উত্তম রান্না প্রণালী, সোনা-রূপার বিভিন্ন অলংকার এবং সুরম্য বাড়ি নির্মাণকারী ও প্রস্তুককারক। এমনকি মেয়েদের অলংকার পরিধানের জন্য নাক-কান ছিদ্র করাসহ পুরুষদের ‘খাতনা’ বা মুসলমানি করানোর প্রথাও দ্বারাই প্রবর্তিত হয়। আর এভাবেই পরবর্তীতে নবীযুগের প্রবর্তিত সকল বিষয়াদির বিস্তৃতি ঘটে এবং এর দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আগমনকারী উলামা-মাশায়েখ তথা আধ্যাÍিক জ্ঞানসম্পন্ন মহামনীষীগণই আমাদের বাঙালি জাতি তথা ভারতবর্ষের মানুষদের জীবনাচরণের বিভিন্ন উপায়-উপকরণ এনে দিয়ে গেছেন। তারপর সুলতানী আমল থেকে এ পর্যন্ত অবস্থার উন্নতিকল্পে নানা বিচিত্রতা পরিলক্ষিত হলেও আমাদের পোশাক-আশাক, খাওয়া-খাদ্য, ওঠা-বসা, চাল-চলন বচনভঙ্গি আর সকল সামাজিক আচার-আচরণ সবকিছুতেই একটি কাকতালীয় মিল রয়েছে। বাংলার স্বাধীন সুলতানী আমলের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়েই আলোচনা করছি। স্বাধীন সুলতানী আমলে অভিজাত এবং বিত্তবান  মুসলিম নারী-পুরুষ উভয়ই মূল্যবান রুচিসম্পন্ন ও আকর্ষণীয় পোশাক পরিধান করতেন। পুরুষের ইজার বা পায়জামা ও গোল গলাসহ লম্বা জামা পরতেন। কোমরের সঙ্গে চিকন কাগজসহ চওড়া ফিতা বেঁধে রাখতেন। তারা মাথায় পাগড়িও ব্যবহার করতেন। কারুকার্যমণ্ডিত চামড়ার জুতা, মোজা পরতেন। আর অতি শৌখিনতার নানা রকম নকশা আঁকা জুতাও ব্যবহার করতেন। মধ্যবিত্ত মুসলিমদের পোশাক ছিল পায়জামা জামা ও মাথার পাগড়ি। তারা পায়ে জুতাও  ব্যবহার করতেন। সাধারণ গরিব শ্রেণীর মুসলমানরা লুঙ্গি, খাটো জামা ও মাথায় টুপি পরত। বাংলার মানুষের প্রতিদিনের জীবনে মুঘলদের জীবনযাত্রা লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু ধনী ও জমিদার শ্রেণীর পোশাক পরিচ্ছদ বিশেষভাবে পাল্টে  যেতে থাকে। তারা পছন্দ করতে থাকেন  মুঘল পোশাক। জমিদার মুক্তা বসানো ঝলমলে পোশাক, সালোয়ার, কামিজ শোভা পেতে থাকে এ দেশের হিন্দু ও মুসলমানদের শরীরে। সুদীর্ঘকাল আগে থেকেই পেশাগতভাবে বাঙালি কৃষির্নিভর এবং এদেশের বাঙালি কৃষকদের সংখ্যাগুরু অংশটি বাঙালি মুসলমান। এদেশের প্রায় ৮৫ জন লোক গ্রামে বাস করে। আর এই গ্রামীণ মধ্যবিত্ত এক মুসলমান পরিবারেই ইংরেজি ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জš§গ্রহণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কৃষকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা ছিল অপরিসীম। তিনি মহৎ, উদার এবং খুব হাসি-খুশি মানুষ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছোটবেলা থেকেই অধিকার সচেতন ছিলেন। তিনি অতি সহজেই বাংলার খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করতেন।
জানা যায়, দশ বছর বয়সে একবার বঙ্গবন্ধু পিতার ধানের গোলা গ্রামের গরিব প্রতিবেশীদের মধ্যে ধান বণ্টন করে দিয়েছিলেন। এর কারণ হিসেবে তিনি তার পিতাকে বলেছিলেন, “আমাদের তো অনেক ধান। আর ওদের ঘরে কিছুই নেই। আমরা খাব আর ওরা খাবে না।” বঙ্গবন্ধু আবির্ভাব হয়েছিলেন বাঙালি শোষিতের শোষণ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তির জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করতেই। কেউ তার রাজনীতির ধরন-প্রকৃতি জানতে চেষ্টা না করে বরং সবাই তার কথাকে আইন এবং তার অঙ্গুলি হেলনকেই যথার্থ মনে করেছে। বঙ্গবন্ধুর সবকিছুতেই ছিল বাঙালিয়ানা ও মুসলমানিত্বের ছাপ। তিনি পোশাক-পরিচ্ছদও পরতেন খুবই সাধারণ  বাঙালি মুসলমানের পোশাক-আশাকের মতোই। তিনি লুঙ্গি, গেঞ্জি, পাঞ্জাবি, পায়জামা ও একটি সিঙ্গেল কোট পরতেন। জেনেভা এবং জাতিসংঘে তার গায়ে জাতীয় ঐতিহ্য বহনকারী দেশের অধিকাংশ বাঙালি মুসলমানের পোশাক পাঞ্জাবি এবং পায়জামা আর হাফ কোট পরিহিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হয়েও এ দেশের অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান ও আলেম-ওলামাদের পোশাক, পাঞ্জাবি-পায়জামাকেও তার ব্যক্তিগত পোশাকে পরিণত করেছেন। তবে ওই কোটটির ব্যাপারে কথা হলো, যুগ যুগ আগে থেকেই উপমহাদেশের আলেম- ওলামারা পাঞ্জাবির ওপর একটি সিঙ্গেল হাফ কোটটি পরিধান করে আসছিলেন। এটিকে ছেদরিয়া বা আলেম কোটও বলা হয়। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর যখন ‘গ্রেড লিডার’ হলেন তখন তিনিও এই ‘ছেদরিয়া’  বা আলেম নিয়মিত পরতে থাকেন। আর তখন থেকেই সেটির নাম হয়ে যায় ‘মুজিব কোট’। বঙ্গবন্ধু খানাপিনা করতেন অতি সাধারণ বাঙালির খাওয়া খাদ্যের মতো। খুব সাধারণ ভাত, মাছের ঝোল ও সবজি খেতেন। খাবারের শেষ পর্যায়ে দুধ-ভাত-কলা ও গুড় খেতেও পছন্দ করতেন। সত্যিকার অর্থেই এসব খাবার অতি সাধারণ বাঙালির ঘরের খাবার। বঙ্গবন্ধুর এসব খাবারে বাঙালির জন্য স্বাভাবিক মান বেঁধে দেয়া হয়েছে। এমনকি, তাতে ধৈর্যশীল ও সংযমী হওয়ারও গন্ধ রয়েছে। বিশেষ কোনো ক্ষেত্র ছাড়া নানারকম ফল-ফলাদি বা নানা প্রকার মূল্যবান খাদ্যদ্রব্য বঙ্গবন্ধুর নিয়মিত খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সে হিসেবে বলা যায় খাওয়া খাদ্যের ব্যাপার তিনি মিতব্যয়ীই ছিলেন, অপচয়কারী ছিলেন না। মহান আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কোরানে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলে সম্বোধন করেছেন। বঙ্গবন্ধু আলেম-ওলামাদের বিশেষ সম্মান এবং শ্রদ্ধা করতেন। তিনি মওলানা ভাসানী এবং মাওলানা তর্কবাগীশকে ‘হুজুরে’ বলে সম্বোধন করতেন। আর তার নেতা শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকে ডাকতেন ‘স্যার’। আর বঙ্গবন্ধুকে সম্বোধনকালে সরকারি আমলারা ‘স্যার’ বলেই চিনত। এর আগে এবং পর থেকে এদেশে ‘স্যার’ অথবা ‘ম্যাডাম’ ডাকের নিয়ম থাকলেও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে সবাই ‘আপা’ ডাকতেই পছন্দ করেন। তিনিও সবার কাছে ‘আপা’ থাকতেই ভালোবাসানে। এসব সম্বোধিত ডাকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ-বক্তৃতায়ও ছিল দরদি মানুষের ভাষা এবং মায়াবি, আÍিক সম্বোধন। তিনি পৃথিবীর প্রায় সকল  দেশের জাতীয় নেতাদের মতো বক্তৃতায় প্রিয় দেশবাসী সম্বোধন করতেন না। বলতেন ‘আমার ভায়েরা, আমার বোনেরা, কিংবা ‘ভায়েরা আমার বোনেরা আমার।’ এসব সম্বোধিত বাক্যে তাকে মনে হতো, সাত কোটি বাঙালির একটি যৌথ পরিবারের সদস্য তিনি। তাছাড়া ব্যবহারিক আলাপচারিতা এবং বক্তৃতার বেলায় বঙ্গবন্ধুর আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করতেন। তার কথাবার্তা, চলা-ফেরায় কোনো বাবুয়ানা ভাব ছিল না। প্রায় সময়ই তিনি অশ্র“সিক্ত নয়নে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে হƒদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী ভাষণ দিতেন। বঙ্গবন্ধু প্রখর ও স্পর্শকাতর নেতা ছিলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে তার সাহসিকতা, আÍবিশ্বাস এবং পরিবেশ সচেতনতা ছিল পাহাড়সম। আর জনগণের প্রতি ছিল তার সুগভীর ভালোবাসা ও সহমর্মিতা। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বেশি বাস্তবতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তার কথোপকথন এবং ভাষণ-বক্তৃতায়ও তা বারবার ফুটে উঠেছে। তিনি ভিক্ষাবৃত্তি, দুর্নীতি, মদ ও নোংরামি করা পছন্দ করতেন না। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু হতে জাতির জনকের খেতাব লাভ করা তা এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক রাজপথ। এপথ পাড়ি দিতে বঙ্গবন্ধুকে প্রায়  দুই যুগ সময় লেগেছে এবং এর পথপরিক্রমাও ছিল খুবই বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময়। আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু ছিলেন কৃষকের সন্তান তিনি যে কৃষক সন্তান, তা নিজেও কখনো ভোলেননি এবং তা অন্যকেও ভুলতে দেননি। তিনি ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ প্রথম সাধারণ নির্বাচনে গোপালগঞ্জের আসন থেকে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ১৫ মে প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রীর দায়িত্বও লাভ করেছিলেন। তারপর পাকিস্তান গণপরিষদের তিনি বাংলার কৃষকদের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণের পরও বাংলার কৃষকদের কথাই বারবার ভেবেছেন, চিন্তা করেছেন। বলেছে “আমি কী চাই? আমি চাই, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে খেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণ ভরে হাসুক।” (রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে-৯ মে ১৯৭২)। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের অধিকারী। তার পিতা শেখ লুৎফুর রহমান পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায়ের পাশাপাশি নিয়মিত তাহাজ্জুদ গুজারি ছিলেন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু নিজেও নামাজ পড়তেন এবং অন্যকেও নামাজ পড়তে উৎসাহিত করতেন। তিনি তার অতি কাছের বন্ধুপ্রতিম সহকর্মীদের বলতেন, ‘মওলানা আকরমা খাঁ মোস্তফা চরিত পড়বে। নামাজ পড়বে, ভাইটি। শরীর ভালো থাকবে।’ তবে ধর্মের বাড়াবাড়ি বঙ্গবন্ধু পছন্দ করতেন না। অন্য ধর্মের মানুষকে শংকিত বা উৎকণ্ঠিত করা তার কাজ ছিল না। আর এ জন্যই মৌলবাদ এবং ধর্মের আলখেল্লাধারীদের উত্থান ঠেকাতে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার পথ বেছে নিয়ে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ধর্মরিপেক্ষতায় লেশমাত্র দুনিয়াদারিতা ছিল না। বরং তাতে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ মানুষকে সর্বোত্তম আসনে অধিষ্ঠিত করার একটি সহজ উপায় সাব্যস্ত ছিল। দর্শনের ভাষায়, মানুষকে প্রথমত প্রাণী বোঝালেও মানুষ মূলত হায়াওয়ান নয়, জানোয়ারও নয়। মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ তথা সৃষ্টির সেরা জীব। কারণ, মানুষ অতি বিবেকবান এবং নিজে বৈধ সব চেষ্টা অব্যাহত রেখে আল্লাহ্নির্ভরও। সুতরাং সে অর্থেই বঙ্গবন্ধু তার জীবনের চরম রাজনৈতিক সংকট মুহূর্তেও আল্লাহ্র ওপর আÍনির্ভরশীল রয়েছেন, অবিচল থেকেছেন। আর ভবিষ্যতে কোনো কাজ করবেন এমন সুদৃঢ় ইচ্ছায় তিনি বারবার ‘ইনশাল্লাহ্’ও বলেছেন।
 লেখক: কলামিস্ট

রাজধানীতে ছিনতাইকারীরা সক্রিয় প্রশাসনিক তপরতা জরুরি
রাজধানীতে ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয়। দিনে দুপুরে যে কেউ এদের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে। মহানগরীর অলিগলি, ব্যস্ততম এবং যানজট লেগে থাকা সড়কে ছিনতাই এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্ত্রধারী ছিনতাইকারীরা কখনও মাইক্রোবাস বা মোটরসাইকেলে এসে ছিনতাই করছে। সর্বশেষ গত রোববার রাজধানীর শান্তিনগর ও যাত্রাবাড়ীতে ১৩ লাখ টাকা ছিনতাই হয়েছে। এ নিয়ে গত এক মাসে বড় অংকের কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে যাওয়ার রাজধানীজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাজধানীতে হঠাৎ করে ছিনতাইয়ের প্রবণতা এবং এ ক্ষেত্রে পুলিশের নিস্ক্রিয়তা নিয়ে সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন।
রাজধানীর বেশকিছু পয়েন্টে ছিনতাইয়ের প্রবণতা বেশি। এরকম প্রায় ৩শ’ স্পট রয়েছে যেখানে পুলিশের প্রহরা নেই বললেই চলে। পুলিশের অনুপস্থিতির সুযোগ ছাড়াও ছিনতাইকারীরা পুলিশের দায়িত্বের পালাবদলের সময় বেশি ছিনতাই করে। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রের আশপাশের মূল সড়ক, আগারগাঁও মোড়, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, গাবতলী বাস টার্মিনাল, মিরপুর বেড়িবাঁধ, মিরপুর-১ নম্বর সনি সিনেমা হলের সামনে, পীরেরবাগ মুক্তি হাউজিং, মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোড, কাঁটাসুর, ধানমন্ডির ৮ নম্বর ব্রিজ মোড়, ফার্মগেটসংলগ্ন ইন্দিরা রোড ও টিঅ্যান্ডটি কার্যালয়ের পেছনের গলি, বনানীর ঢাকা গেট, গুলশান নিকেতন, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার তিব্বত মোড়, খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ রেলগেট, কাকলী মোড়, গুলশান শ্যুটিং ক্লাবের সামনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বর, তিন নেতার মাজারের সামনের রাস্তা, মহাখালী কাঁচাবাজারের সামনে, মগবাজার নয়াটোলা, শ্যামপুরের দনিয়া, আলমবাগ, সূত্রাপুরের ঢালকানগর, ভজহরী সাহা স্ট্রিট প্রভৃতি এলাকা।
পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীতে ১০টি বড় ধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। ছিনতাইকারীদের গুলিতে একজন নিহত, ৯জন গুলিবিদ্ধ ও একজন ছুরিকাহত হয়েছেন। প্রত্যেকটি ঘটনা ঘটেছে প্রকাশ্যে দিনের বেলায়। দুর্বৃত্তরা ৮১ লাখ টাকা নিয়ে গেছে। এসব ঘটনায় থানায় মামলা হলেও পুলিশ এর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক থেকে টাকা তোলার পর একটু দূরে গেলেই পথরোধ করছে ছিনতাইকারীরা। তাদের টার্গেট বড় লেনদেন। ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা তোলার খবর ছিনতাইকারীদের কাছে যায় কিভাবে। এক্ষেত্রে একশ্রেণীর ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ খতিয়ে দেখা জরুরি। সম্প্রতি বেশ কিছু ছিনতাইকারী ও অন্যান্য অপরাধী জামিনে মুক্তি পেয়েছে। তারা এসব ঘটাচ্ছে কি না তাও খতিয়ে দেখা জরুরি। এ ছাড়া রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতেই পুলিশ বেশি ব্যস্ত থাকে। এসব কারণে ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। খোদ পুলিশের আইজিপি এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাংবাদিকদের কাছে। আমরা মনে করি ছিনতাই প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাসহ ব্যক্তিগত সাবধানতাও জরুরি। বিশেষ করে কোনো ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা উত্তোলনের সময় পুলিশের সহযোগিতা নেয়া প্রয়োজন। 

বাংলাদেশি যুবকের হ্ইুলচেয়ারে বিশ্ব ভ্রমণ
মোঃ মহরম আলী
সব সমাপ্তির স্বাদ একরকম নয়। জীবন সমাপ্তির বেদনা যেমন আমাদের কাঁদায় তেমনি কোনো সুন্দর উদ্যোগের সুন্দর সমাপ্তি আমাদের আনন্দ দেয় এবং পাশাপাশি নতুন উদ্যোগ গ্রহণে উৎসাহ জোগায়। তবে আমরা অনেক বেশি আনন্দিত হই যখন কোনো উদ্যোগের সমাপ্তিতে থাকে কোনো সুন্দর অর্জন। আজ আমি আপনাদের একটি সুন্দর উদ্যোগের সুন্দর অর্জনের গল্প  শোনাব। তার নাম মোঃ মহরম আলী। ২৫ বছর বয়সী এক প্রতিবন্ধী যুবক। যিনি হ্ইুল চেয়ারে চলাফেরা করেন। এ মুহূর্তে তিনি রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। তিনি তার হুইলচেয়ার ব্যবহার করে বাস/ ট্রেন/জাহাজের মাধ্যমে ২৫,৮২৮ কিলোমিটার, ১৯টি দেশ (বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, নেপাল, তিব্বত, চীন, কাজাখস্তান, রাশিয়া, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, লিয়েখটেনস্টেইন, অষ্ট্রিয়া, ইতালি, ভেটিকানসিটি, চেক রিপাবলিক, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড এবং ইউএসএ, ৩টি মহাদেশ (এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকা) পারি দিয়ে তিনি গত ৯ জানুয়ারি নিউইয়র্কের জ্যামাইকাতে পেঁছেছেন। থাকছেন মেহেরপুরের নিউ ইয়র্ক প্রবাসী মি. জাকির হোসেনের বাসায়। অর্জন: গত ১৩ জানুয়ারি তিনি নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘের সদর দফতরে এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে তার ‘ওয়ার্ড ডিজএ্যাবিলিটি ফান্ড’ কনসেপ্টটি অফিসিয়ালি উপস্থাপন করেন এবং জমা দেন। এখন জাতিসংঘ এটি নিয়ে কাজ করবেন। আগামী  সেপ্টেম্বরে মহরমকে আবারো নিউইয়র্কে যেতে হবে ১৫ জাতি বিশিষ্ট জাতিসংঘের প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক কমিটির সামনে তার ‘ওয়ার্ড ডিজএ্যাবিলিটি ফান্ড’ কনসেপ্টের ওপর প্রফেশনাল ব্যাখ্যা এবং এর প্রয়োজনীতা উপস্থাপন করার জন্য। তিনি বলেন এটি একটি সদূরপ্রসারী এবং দীর্ঘ মেয়াদি কাজ। একাজকে এগিয়ে নিতে  বেশ সময়, পরিশ্রম এবং অর্থের দরকার হবে। মূল গল্পে আসি: তার জš§, বেড়ে উঠা, শিক্ষা সবই হয়েছে নাটোর জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণপুর গ্রামে। বর্তমানে কাজ করছেন মিস ভেলরী টেইলর প্রতিষ্ঠান সিআরপির ফিজিওথেরাপি বিভাগে। পাশাপাশি জড়িত আছেন জাগরণ, এডিডি বাংলাদেশ, এনজিডিও, নন্দন-নাটোর, ভোলাস চিলড্রেন এম এ আলী প্রতিবন্ধী স্কুল, প্রথম আলো বন্ধুসভা, আদ্রিদ-বরিশালের সঙ্গে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে মহরম একটি সুন্দর সপ্নের (কনসেপ্ট) জš§ দেন। স্বপ্নটি হচ্ছে: সারা বিশ্বের প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য একটি কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক সরকার উদ্যোগ তহবিল ধারণা (কনসেপ্ট)। তার ভাষ্য মতে বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘসহ সরকারি/বেসরকারি পর্যায়ে অনেক ধরনের তহবিল রয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর সব রাষ্ট্র সরকার মিলে (অল স্ট০্যাট ইনিশিয়েটিভ) কোনো কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক তহবিল নেই। তিনি মনে করেন: প্রতিবন্ধিতা একটি উন্নয়নমূলক ইস্যু। যেটি অন্যান্য সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মতোই। এটাকে সামান্য-গুরুত্বপূর্ণ ভাবার কোনো সুযোগ নেই। তাই প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে দুনিয়াজুড়ে লাখ লাখ সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তাদের মধ্যে  বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রমই চোখে পড়ার মতো। আবার এ উন্নয়ন ইস্যুটিকে চলমান রাখার জন্য কাজ করছে জাতিসংঘসহ অনেক সরকারি/বেসরকারি সংস্থা। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে কাজ করছে এমন প্রত্যেকটি সংস্থার অর্থ প্রাপ্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব সংস্থা প্রয়োজনীয় অর্থ পেতে ব্যর্থ হলে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ইস্যুটি ধীরগতি পাবে বা অনেক ক্ষেত্রে থেমেও যেতে পারে। ধীরগতি পাওয়া বা থেমে যাওয়া কোনোটিই মহরম প্রত্যাশা করেন না। তাই তিনি মনে করেন সারাবিশ্বের প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য একটি কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক সরকার উদ্যোগ তহবিল থাকা খুবই দরকার।  যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি নিজের  মেধা খাটিয়ে এই তহবিলের জন্য একটি কনসেপ্ট পেপার (ইনফরমাল এন্ড নন-প্রফেশনাল)  তৈরি করলেন। নাম দিলেন ওয়ার্ল্ড ডিসএ্যাবিলিট ফান্ড কনসেপ্ট। প্রথমে তিনি তা শেয়ার করলেন তার বন্ধুদের এবং সহকর্মীদের সাথে। অনেকেই বুঝতেই চাইলেন না আসলে মহরম কি বলছেন তবে অনেকেই এই ধারণাকে সাধুবাদ জানিয়েছিল। তাদের অন্যতম জোতিষ্ক বিশ্বাস জিকো। মি. জিকো জাগরণ নামক একটি এনজিওর কার্যনির্বাহী সদস্য এবং সিআরপি-প্রথম আলো বন্ধুসভার উপদেষ্টা। অনেকে বললেন এটি অনেক বড় বিষয়। মহরম ভাবতে শুরু করলেন কিভাবে তার এই ধারণাটি বিশ্ব দরবারে  পৌঁছানো যায়। মহরম রাজনীতি বিশ্বাস করেন এবং তিনি খুব ভালোভাবে বুঝেন যে এই মহাবিশ্বের উন্নয়নে রাজনীতিকরাই একমাত্র ভরসা। তাই তিনি মনস্থ করলেন তার এ তহবিল ধারণা তিনি রাজনৈতিক এজেন্ডায় পরিণত করবেন। কারণ: কোনো-না-কোনোভাবে আমরা রাজনীতিকদের ওপর নির্ভলশীল এবং তারাই বিশ্বের কল-কাঠি নাড়ছেন। পৃথিবীর প্রায় ৯০% দেশেই রয়েছে রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার। সরকার নামক ম্যাকানিজমই চালাচ্ছেন ওই দেশগুলো। এমনই ১৯৩টি দেশ নিয়ে গঠিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংগঠন হচ্ছে জাতিসংঘ। সুতরাং তিনি ভাবলেন জাতিসংঘ হচ্ছে এ ধরনের বড় বড় উদ্যোগ ধারণ উপস্থাপনের জন্য পারফেক্ট সংগঠন। তিনি নিজেকে মূল্যায়ন করলেন এভাবে - যেহেতু আমি তৃতীয় বিশ্বের একটি গরিব দেশের অতি সাধারণ নাগরিক তাই আমার এ তহবিল ধারণাটি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে আমাকে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ভিন্ন পন্থা খুঁজতে খুঁজতে তিনি ভাবলেন কেমন হয় যদি তিনি হুইলচেয়ার ব্যবহার করে বাস/ ট্রেন/জাহাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ইউএসএ-এর বাণিজ্যিক রাজধানী নিউইয়ক পৌঁছান? যেখানে অবস্থিত জাতিসংঘের সদর দফতর। হ্যা অবশ্যই হুইলচেয়ারে বিশ্ব ভ্রমণ একটি ভিন্ন ধারণা এবং এই সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ভ্রমণের মাধ্যমে চমক সৃষ্টি করে তার তহবিল ধারণা উপস্থাপনের জন্য তিনি মনস্থ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমেই যে বিষয়গুলো ভেবে ভয় পেয়েছিলাম পরে অবশ্য সত্যি সত্যিই সেই বিষয়গুলো ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’ তার হুইলচেয়ারে বিশ্ব ভ্রমণের মূল কঠিন বিষয়গুলো ছিল সব দেশের ভিসা এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা। বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং ইউকেএআইডির সহযোগিতায় তিনি সকল ভিসা সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। কিন্তু তিনি অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে হোঁচট খান। অর্থ সংগ্রহে ছুটাছোটির তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার না করে তিনি শুধু বলেন ‘আমি বাংলাদেশ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থের পুরোটা সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছি এবং প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব গত প্রায় ৭ মাসে আমাকে অনেক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রেখেছে, যা এখনো আমার পিছু ছাড়েনি।’ তবে তিনি খুব জোরালে কণ্ঠে বলেছেন বাংলাদেশের ৪টি এনজিও (জাগরণ, সিআরপি, এডিডি, এনজিডিও) সহ রাশিয়া এবং ইউরোপের কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তাকে সহযোগিতা করেছেন। তাছাড়া কোনোভাবেই এই ভিন্নধর্মী ভ্রমণ শুরু করে নিউইয়র্ক পৌঁছাতে পারতেন না।গত ২৫ জুন ২০১১-তে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার হতে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে বাসে করে তিনি যান ইন্ডিয়ার রাজধানী দিল্লিতে। সেখানে তিনি থাকেন ৩৪ দিন। মিডিয়ার সঙ্গে কাজসহ তিনি সেখান থেকে সংগ্রহ করেন আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ড এ্যামবেসি হতে সেনজেন এবং কাজাখস্তান ভিসা। তারপর তিনি যান নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডুতে। সেখানে তিনি থাকেন ৬ দিন। প্রয়োজনীয় অনুমতে সংগ্রহের পর তিনি যান কাজাখস্তান। তারপর ৭৭ ঘণ্টা ট্রেনে করে তিনি পৌঁছান রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে। মস্কোতে তিনি থাকেন ১৯ দিন। যেহেতু তার প্রধান স্পনসর মস্কোভিত্তিক তাই সেখানে তিনি বিভিন্ন মিডিয়া, সংগঠনের সঙ্গে কথা বলতে সমর্থ হন। মিটিং করেন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক মস্কো, বাংলাদেশ প্রবাসী পরিষদ, এসোসিয়েশন অফ ইউরোপিয়ান বিজনেস এবং আরো সংগঠনের সঙ্গে। তারপর তিনি ইউক্রেনিয়ান ট্রেনে করে যান ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ। মিটিং করেন বাংলাদেশ কালচারাল সোসাইট ইউক্রেন, ইউক্রেন কনসালটিং সঙ্গে। বাংলাদেশি ছাত্রদের আমন্ত্রণে তিনি ভ্রমণ করেন অন্য দুই বড় শহর লুগান্সক্ এবং সিমফ্রাপোলে। ১৫ দিন ইউক্রেনে কাটিয়ে তিনি ১ অক্টোবর ইউক্রেনিয়ান ট্রেনের করে পোল্যান্ডে ঢোকার মাধ্যমে এশিয়ার পাঠ চুকিয়ে ইউরোপ ভ্রমণ শুরু করেন। ১ দিন পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারসোতে কাটিয়ে ওয়ারসো-বার্লিন এক্সপ্রেস ট্রেনে মহরম জার্মানির রাজধানী বার্লিনে যান। সেখানে তিনি দেখা করেন তার জার্মান বন্ধু  ডেভিড  লেবুজারের সঙ্গে এবং অন্য একজন স্পনসরের সঙ্গে। তারপর তিনি জার্মান ট্রেনে করে যান জার্মানির অন্য শহর ফুলদাতে। সেখানে তিনি থাকেন ৩ দিন এবং দেখানে করেন অন্য আরো একজন স্পনসরের সঙ্গে। কথা বলেন একজন ক্ষুদ্র সফট্ওয়ার ব্যবসায়ীর সঙ্গে যিনি বাংলাদেশি ক্ষুদ্র প্রোগ্রামারদের কাজে লাগাতে চান এবং ইতোমধ্যে ভারতের ক্ষুদ্র সফট্ওয়ার নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করছেন। কথা বলেন বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের দ্বারা ইন্টারনেট ভিত্তিক রেডিওর সম্ভাব্যতা নিয়ে এ বিষয়ে এক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। তারপর আবারো জার্মান ট্রেনে করে ৯ অক্টোবর তিনি যান জার্মানির অন্য শহর কনস্টাঞ্জে। দেখা করেন তার ট্রাভেল এডভাইজারের সঙ্গে। ওই দিন দুপুরেই তার এক জার্মান শুভাকাক্সক্ষীর (যিনি সুইজারল্যান্ডে থাকেন) বাসায় দুপুরের খাবার খেতে সুইজারল্যান্ডের সেন্ট গ্যালান শহরে যান তার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে। দুপুরের খাবারের পর তিনি বিকেলে ওই শুভাকাক্সক্ষীর সঙ্গে যান পাশের  ছোট্ট দেশ লিয়েখটেনস্টেইনে। লিয়েখটেনস্টেইন ৩৫ হাজার মানুষের একটি  ছোট্ট দেশ। লিয়েখটেনস্টেইনে ৪০ মিনিট কাটানোর পর  রেড বুল এনার্জি ড্রিংক  কোম্পানির আমন্ত্রণে অষ্ট্রিয়ান ট্রেনে করে তিনি পৌঁছান অষ্ট্রিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী সলজ্বার্গে। ৯ অক্টোবর ২০১১ দিনটি ছিল তার জন্য একটি রেকর্ড দিন। এক দিনে তিনি পদার্পণ করেন ৪ দেশ - জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, লিয়েখটেনস্টেইন এবং অষ্ট্রিয়া। পৃথিবীর খ্যাতনামা এনার্জি ড্রিংক  কোম্পানির আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবানদের একজন মনে করেন। কারণ রেড বুলের অফিসিয়াল অতিথি হওয়া ছোট বিষয় নয়।  সেখানে তিনি কথা বলে অষ্ট্রিয়ান ন্যাশনাল হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দল, রেডবুল কম্পানির অথরিটির এবং  রেড বুলের অংগ-প্রতিষ্ঠান হাঙ্গার ৭ (হাঙ্গার  সেভেন) সঙ্গে। তারপর তিনি ইতালিয়ান ট্রেনে করে ভ্রমণ করেন ইতালির শহর রোম এবং মিলান।  সেখানে তিনি দেখতে পান ৮/১০ লাখ টাকা খরচ করে বাংলাদেশিরা ইতালিতে এসে কত মানবেতর জীবন-যাপন করেন। দেখেন বিদেশের মাটিতে এসেও  দেশের রাজনীতি নিয়ে কিভাবে দলা-দলি করে নিজেদের মধ্যে অশান্তির সৃষ্টি করেন। এরই মধ্যে ২১ অক্টোবর জার্মানির প্রভাশালী প্রতিকা স্পিগেল এ ভ্রমণ এবং ভ্রমণের উদ্দেশ্যের ওপর একটি বড় প্রতিবেদন করে। প্রকাশ করে ৬টি ছবি। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জার্মান ভাষীদের নিকট থেকে পেতে থাকেন ছোট/বড় অনেক আমন্ত্রণ। দাওয়াত আসে আবারো জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের। ইতালির রোম হতে ইতালিয়ান ট্রেনে করে আবারো যান সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায়। সেভানে ৪দিন থাকার পর ৬ নভেম্বর জার্মানির  ছোট্ট শহর হফ-এ যান। সেখানে প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি বড় স্কুলের আমন্ত্রণে বিভিন্ন সরকারি/ বেসরকারি অনুষ্ঠানে মূল বক্তা হিসেবে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এবং ওয়ার্ল্ড ডিজএ্যাবিলিটি ফান্ডের ওপর কথা বলেন। ৩য় দিন বিকেলে ওই স্কুলেরই এক চেক রিপাবলিকান নারী শিক্ষকের সঙ্গে রাতের খাবার খেতে চেক রিপাবলিক যান। তার সঙ্গে ওই রাতেই আবার জার্মানি ফিরে আসেন। ৩৩৮ ইউরো দিয়ে টিকেট কিনে জার্মান ট্রেন দিয়ে ১০ নভেম্বর শুরু হয়ে ১১ নভেম্বর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস্ হয়ে ইউরো স্টার ট্রেনে করে একই দিন দুপুরে মহরম পৃথিবীর ঐতিহ্যবাহী শহর ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন পৌঁছান। মহরমকে লন্ডনে রিসিভ করেন তার সাবেক সহকর্মী পাপ্পু লাল মদক এবং তার সহপাঠীরা। লন্ডনসহ ইংল্যান্ডের আরো কিছু শহরের বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের দেখা করেন এবং কথা বলেন। ভিজিট করেন কিছু আকর্ষণীয় জায়গা। অভ্যাস গড়ে তুলেন জন পরিবহনে এবং আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেনে চলা-ফেরার। লন্ডনে তিনি ছিলেন পূর্ব লন্ডনের নিউ হাম এলাকাতে। পেয়েছেন বাংলাদেশি ছাত্রদের সম্মান। হতার ভাষ্যমতে  আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না পাপ্পুদা, আতিক ভাই, পিয়াস ভাই, রনিভাইসহ  অনেকের কথা। আমার মতো হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য প্রবেশগম্য কম টাকায় বাসা পাওয়া লন্ডনে খুবই কঠিন। উপরোক্ত ব্যক্তিগণ আমাকে সর্বক্ষেত্রে সবসময় সহযোগিতা করেছেন। একজন  পেয়িং গেস্ট হিসাবে প্রায় ৫৮ দিন আমি ইউকে-তে কাটিয়েছি। সর্বমোট ২৫,৮২৮ কিলোমিটার, ১৯টি দেশ, ৩টি মহাদেশ পারি দিয়ে গত ৯ জানুয়ারি তিনি নিউইয়র্কে   পৌঁছান। তার এই ভ্রমণের লাইভ ম্যাপ দেখা যাবে www.bezgraniz.ru
ওয়েব সাইটে এবং সমস্ত আপডেট ও ছবি পাবেন তার ব্লগ www.mohoramswheels.posterous.com এ। এই ভ্রমণের  ফেসবুক গ্র“প হচ্ছে www.facebook.com/groups/MohoramsWheels. তিনি বলেন এটি একটি সুদূরপ্রসারী এবং দীর্ঘ মেয়াদি কাজ। একাজকে এগিয়ে নিতে বেশ সময়, পরিশ্রম এবং অর্থের দরকার হবে। সবশেষ তিনি বলেন এটি ছিল আমার উদ্যোগ কিন্তু এটি সবার অর্জন। আমার এ অর্জনে পাশে থাকার জন্য সকল স্পনসর, সহকর্মী, শুভাকাক্সক্ষী,  দেশ/বিদেশের সকল মিডিয়া, সকল এ্যামবেসি, সকল ডিপলোমেটিক মিশন, দেশবাসীসহ সবাইকে ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।  ফেব্র“য়ারি মাসের শেষ দিকে তিনি ঢাকায় অবতরণ করবেন।