Year-18 # Issue-40 # 20 November 2011

৩০ হাজার প্রশিক্ষিত ড্রাইভার গড়ার উদ্যোগ সরকার
নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশে দক্ষ গাড়িচালক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতায় দেশের প্রতিটি জেলাতেই মোটরগাড়ি ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। জেলা পরিষদের মাধ্যমে এসব ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হবে। এতে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার প্রশিক্ষিত ড্রাইভার তৈরি হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। এ বাবদ যে টাকা খরচ হবে তার যোগান দেবে জেলা পরিষদ তাদের রাজস্ব খাতের প্রাপ্ত অর্থ থেকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে সড়ক দুর্ঘটনার হার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার নিজস্ব উদ্যোগে দক্ষ ড্রাইভার প্রশিক্ষণের এ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কারণ দেশের সড়ক, মহাসড়কগুলোতে যেসব সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে তার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ড্রাইভারের অভাব। অবশ্য দুর্ঘটনার জন্য সড়ক ও মহাসড়কের অব্যবস্থা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবও অনেকাংশে দায়ী। তাছাড়া বিআরটিএ ও ডিটিসিবি ড্রাইভারদের অত্যন্ত সীমিত সংখ্যায় স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। কিন্তু জেলা পর্যায়ে বিআরটিএ’র কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। যদিও শিক্ষাগত যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা ছাড়া ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের ব্যাপারে পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু বিআরটিএ এ ব্যাপারে উদাসীন। তারা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গাড়িচালক তৈরির জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ নিচ্ছে না। সূত্র জানায়, প্রতিটি জেলা পরিষদের ভবনে কিংবা ভবন প্রাঙ্গণেই ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হবে। পাশাপাশি প্রতিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্যই এক থেকে দু’টি গাড়ির ব্যবস্থা করা হবে। ফলে প্রতিটি জেলাতেই বছরে ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ গাড়িচালককে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নামমাত্র চার্জ নেয়া হবে। এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বিআরটিএ’র কাছে সহজ শর্তে ২৪ হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ইতিপূর্বে ২০০৯ সালে আইন লঙ্ঘন করে সহজ শর্তে ১০ হাজার ভারি যানবাহন চালককে লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে উচ্চ আদালত জানতে চেয়েছে। এ প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা, এসব ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল করা হলে সড়কপথে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রীর সঙ্গে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ঐক্য পরিষদের এক চুক্তির আলোকে সহজ শর্তে এসব ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। পরিবহন শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের এক পরিবহন ধর্মঘট অবসানে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী পরিবহন নেতাদের সঙ্গে এ চুক্তি করেছিল। বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান লিখিত পরীক্ষা ছাড়া ২৪ হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে বিআরটিএ’কে চাপ দিচ্ছেন। এ নিয়ে বিআরটিএ কর্মকর্তারা বিপাকে। বিআরটিএ সহজ শর্তে আর কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে রাজি হচ্ছে না। অন্যদিকে গত এক যুগে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ২৫০ জন নিহত ও ২ হাজার ৯২৩ জন আহত হয়েছে। এসময়ের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫০ হাজারেরও বেশি। এ প্রসঙ্গে সরকার বিভাগের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, সড়কপথকে সরকার নিরাপদ করতে চাচ্ছে। এজন্য সরকারিভাবে গড়ে তোলা হবে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ড্রাইভার। বর্তমানে দেশের মফস্বল শহরে ও গ্রামে স্বল্পশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বিপুলসংখ্যক কর্মহীন যুবক রয়েছে। তারা যেন পরিবারের বোঝা না হয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আÍকর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের উপকারে আসতে পারে সেজন্যই সরকার এ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। প্রশিক্ষিত গাড়িচালকরা শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও তাদের দক্ষতা কাজে লাগাতে পারবে। এতে আয় কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ সুগম হবে। এ প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে চলতি অর্থবছরের মধ্যেই জেলা পর্যায়ে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালুর যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
উত্তরাঞ্চলের দরিদ্র ও দুস্থ নারীদের উন্নয়ন
বিশ্বব্যাংকের ২৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন
নিজস্ব প্রতিবেদক
বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বিশেষ রেয়াতি সুদে ২৯ মিলিয়ন ডলারের (২১৭ কোটি টাকা)  ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে মঙ্গার কারণে আগত হত-দরিদ্র ও দুস্থ মহিলাদের কর্মসংস্থানের জন্য যারা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) অবস্থিত তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত, তাদের কর্মসংস্থান লাভে সহায়তা প্রদানে এ বিশেষ ঋণ অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংক। এর মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের  ১৮ হাজার মহিলা উপকৃত হবেন।  গতকাল শনিবার বিশ্বব্যাংক এ তথ্য জানায়। জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে ১০ বছর রেয়াতী সুবিধাসহ ৪০ বছরে পরিশোধের শর্তে এই ঋণ অনুমোদন করেছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্য দূরীকরণ  প্রকল্পের (নারী) অধীনে ৩টি ইপিজেড এলাকায় জীবন জীবিকা উন্নয়নে দক্ষতা প্রশিক্ষণ, অন্তর্বর্তীকালীন গৃহায়ন, কাউন্সিলিং এবং চাকরি বদলের সুযোগসহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের দরিদ্র  নারীরা বিভিন্ন সুবিধা পাবেন। রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী এবং লালমনিরহাট জেলার নারীরা এই সুবিধা পাবেন। এটি বিশ্ব ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে গৃহীত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম কর্মসূচি। বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি গোল্ডস্টেইন বলেছেন, বিকাশমান তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত ৩ মিলিয়ন (৩০ লাখ) শ্রমিকের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি নারী। এরা অধিকাংশ সময় অসহায়, অল্প বয়সী, দরিদ্র ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অশিক্ষিত এবং অবিবাহিত। তিনি বলেন, নারী প্রকল্প অভ্যন্তরীণ অভিবাসন প্রক্রিয়াকে সহজ করবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র অঞ্চলের দুস্থ নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক হবে। এদিকে, এ প্রকল্পের অধীনে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বিশেষ সচেতনা কর্মসূচি হাতে নেয়া হবে এবং আগ্রহী প্রার্থী বাছাই করা হবে। বাছাইকৃত প্রার্থীদের ঢাকা, ঈশ্বরদী এবং কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ দেয়া হবে। এর সঙ্গে তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে ইপিজেড এলাকায় ডরমিটরি এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে এক সঙ্গে ৩০০ নারীর প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকবে। আর ডরমিটরিতে ৬০০ নারীর থাকার ব্যবস্থা হবে। তারা সেখানে ৬ মাস অবস্থান করতে পারবেন। এরপর আরো ৩ মাস গৃহায়ন খুঁজে পাওয়ার জন্য বাড়তি সময় পাবেন এসব দুস্থ মহিলারা।
ডিএমপি’কে জালটাকা সনাক্তকরণ মেশিন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-কে জাল টাকা সনাক্তকরণ মেশিন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডিএমপি এসব মেশিন ঢাকার ১৫টি বড় পশুর হাটে জাল টাকা সনাক্ত করতে ব্যবহার করবে। এছাড়া ঢাকার বাইরে সারা দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শাখা অফিসগুলোকে আরও ৬৫টি মেশিন দেয়া হবে।
গতকাল শনিবার বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যালয়ে এ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে নির্বাহী পরিচালক দাশগুপ্ত অসীম কুমার আনুষ্ঠানিকভাবে মেশিনগুলো ডিএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. মশিউর রহমানের কাছে হস্তান্তর করেন। এসময় অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল শাখার মহা-ব্যবস্থাপক আব্দুর রহিম, কারেন্সি বিভাগের মহা-ব্যবস্থাপক (কারেন্সি অফিসার) সাইফুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। দাশগুপ্ত অসীম কুমার বলেন, সম্প্রতি ঈদ এবং নতুন টাকা সরবরাহকে কেন্দ্র করে জাল টাকা তৈরি এবং তার সঙ্গে জড়িত চক্র বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, এ চক্রকে প্রতিহত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো তৎপর রয়েছে। এর অংশ হিসেবে আমরা ডিএমপিকে সহযোগিতা করতে ১৫টি মেশিন দিচ্ছি, যা পশুর হাটগুলোতে ব্যবহার করা হবে। তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সবগুলো ব্যাংককে জাল টাকার বিষয়ে সতর্ক থাকতে এবং সাধারণকে সহযোগিতা করতে নির্দেশনা দিয়েছে। তিনি আরও জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হচ্ছে- মুদ্রা সরবরাহের পাশাপাশি যাতে মানুষের আস্থা থাকে তা নিশ্চিত করা। মুদ্রার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হলে তা  দেশের অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ ক্ষতি হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাই জাল টাকার বাজারকে নষ্ট করে দিতে হবে। ডিএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মশিউর রহমান জানান, ডিএমপি’র গোয়েন্দা শাখা সবসময় জাল টাকার ব্যাপারে সতর্ক। গত কয়েকদিনে ৭টি জাল টাকার কারখানা সনাক্ত করে অভিযান চালানো হয়েছে। তবে সাধারণভাবে জাল টাকা সনাক্ত করা সময়সাপেক্ষ। তাই এ ধরনের মেশিন সরবরাহের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। শিগগির এসব মেশিন নিয়ে পশুর হাটে কাজ শুরু করা হবে বলেও জানান তিনি।
ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুট জোয়ার ভাটার উপর নির্ভরশীল
ইসমাইল হোসেন নেগাবান, বরিশাল থেকে
বরিশালে লঞ্চঘাটের নাব্যতা সংকট দূর হলেও বামনির চড়ে এখনো রয়েছে মাত্র ৭ ফুট গভীর পানি। যার ফলে ঢাকা-বরিশাল রুটে লঞ্চ ও জাহাজ চলাচল এখনো জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর করছে। আর এজন্য যাত্রীদের ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
গতকাল শনিবার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে ঢাকা-বরিশাল রুটে লঞ্চসহ অন্যান্য মালবাহী কার্গো যাতায়াতের ব্যাপক বিঘœ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে এই সমস্যা আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয়। শুধু তাই নয় নাব্যতা সংকটের কারণে কির্তনখোলা নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় বরিশাল লঞ্চঘাট পর্যন্ত লঞ্চ ভিড়তে পাড়ে না। যার ফলে চলতি মাসের প্রথম দিকে ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চগুলো নির্ধারিত সময়ে ঘাটে ভিড়তে ও ঘাট ছাড়তে পারেনি। জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর করে চলতে হয়েছে এসব লঞ্চগুলোকে। এর প্রেক্ষিতে গত ৫ অক্টোবর থেকে লঞ্চঘাট এলাকায় নদী খননের কাজ শুরু হয়। কিন্তু কাজ শুরুর পরপরই কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। একদিকে অভিযোগ ওঠে সঠিকভাবে মাটিকাটা হচ্ছে না অপরদিকে ড্রেজিং করা মাটি নদীতেই ফেলার কারণে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। তবে বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সাইদুর রহমান দাবি করেন যেখানে নদীর গভীরতা বেশি সেখানে ওই মাটি ফেলা হয়েছে। যার ফলে এতে ড্রেজিংকৃত এলাকায় কোন প্রভাব পরবে না। এদিকে গত ২৩ অক্টোবর নদী বন্দর এলাকায় প্রথম কিস্তির খনন কাজ শেষ হয়েছে। মোট ৮৭ হাজার ঘনমিটার মাটি কাটার কথা থাকলেও প্রথম পর্যায়ে ৪৯ হাজার ঘনমিটার মাটি কাটা হয়েছে। দ্বিতীয় কিস্তিতে অবশিষ্ট মাটি কাটা হবে। বিআইডব্লি¬উটিএ’র বন্দর কর্মকর্তা কাজী ওয়াকিল নেওয়াজ জানান, ড্রেজিং’র পূর্বে লঞ্চঘাট এলাকায় গভীরতা ছিলো মাত্র ৩ফুট। ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চগুলো চলাচলের জন্য ৮ফুট গভীর পানির প্রয়োজন। তবে ঈদের সময় লঞ্চগুলোতে অতিরিক্ত যাত্রী থাকায় আরো একফুট অর্থাৎ ৯ফুট গভীর পানির প্রয়োজন হয়। বর্তমানে সেখানে ড্রেজিং’র মাধ্যমে ১৭ ফুট গভীরতা করা হয়েছে। আপাতত বরিশাল লঞ্চঘাট এলাকায় নাব্যতা ফিরে এসেছে। ফলে ওই এলাকায় পূর্বের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় লঞ্চ চলাচল করছে। তবে ঈদের পরে আবারো লঞ্চঘাট এলাকায় ড্রেজিং কার্যক্রম চালানো হবে। এদিকে মেহেন্দিগঞ্জের ভাষানচরের বামনিরচর পয়েন্টে গভীরতা মাত্র ৭ ফুটে চলে আসায় ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চ, মালবাহী কার্গো ও তেলের ট্যাংকার যাতায়াতে ব্যাপক সমস্যা দেখা দিয়েছে। লঞ্চ ও কার্গো চালকরা জানান, মালবাহী জাহাজ চলাচলে কমপক্ষে ১১ফুট গভীরতার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু সেখানে সময় সময় ৭ফুট গভীরতায় নেমে আসলে জাহাজগুলো নদীর তলদেশের মাটিতে বেধে যায়। বর্তমানে বামনিরচর পয়েন্টে জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর করে জাহাজ চালাতে হচ্ছে। যার ফলে প্রায় সময়ই ওই পয়েন্টে ঘন্টার পর ঘন্টা জাহাজ নোঙর করে জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
মংলায় জাহাজের এনওসি দেন এমএমডির কেরানী!

নিজস্ব প্রতিবেদক
বর্তমান সরকারের প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী মংলা সমুদ্র বন্দরের গুরুত্ব বেড়েছে। কিন্তু বন্দরে আসা জাহাজের অনাপত্তি সনদপত্র (এনওসি) দিচ্ছেন একজন অফিস সহকারী। কারণ, দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের (এমএমডি) খুলনা অফিসের কর্মকর্তা মাসের পর মাস ঢাকায় অবস্থান করায় তার অফিসের কেরাণীই পালন করছেন এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি। এভাবে গত তিন মাসে ৪২টি জাহাজের বিপরীতে ৮৪টি এনওসি দিয়েছেন তিনি। তবে, সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রে ওই কর্মকর্তারই স্বাক্ষর থাকছে। এর ফলে বন্দরের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক নৌ চলাচল নিয়ম বা মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিন্যান্স (এমএসও) অনুযায়ী, কোনো জাহাজ বন্দর সীমায় প্রবেশের আগে সেটি চলাচলের যোগ্য ও পরিবেশসম্মত কিনা সেজন্য এমএমডির এনওসি নিতে হয়। একইভাবে বন্দর ত্যাগের আগেও নিতে হয় এনওসি। আর এ দায়িত্বটি পালন করেন সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের অঙ্গ সংস্থা এমএমডির একজন কারিগরী কর্মকর্তা; যার পদবী ‘প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক’।  সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত তিন মাসে ৪২টি সমুদ্রগামী জাহাজ মংলা বন্দরে ভিড়েছে। আর এসব জাহাজের বিপরীতে ৮৪টি এনওসি দিয়েছেন অফিস সহকারী আবুল খায়ের। কারণ, এমএমডি’র খুলনা অফিসের প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক মো. শফিকুল ইসলাম তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তাকে সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসের অন্তত চারদিন সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের (ডিপার্টমেন্ট অফ শিপিং-ডস) মতিঝিল প্রধান কার্যালয়ে দেখা যায়। কোনো কোনো সপ্তাহে তাকে পাঁচদিনও ঢাকায় দেখা যায়। এই কর্মকর্তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও থাকেন রাজধানীর লালমাটিয়ায় নিজস্ব ফ্ল্যাটে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘ তিন মাসে সাপ্তাহিক ছুটির মাঝে অথবা ২-১টি কর্মদিবসে শফিকুল ইসলাম খুলনায় গিয়ে এনওসি ফরমে আগাম স্বাক্ষর করে আসেন। জাহাজ ভিড়লে কিংবা বন্দর ত্যাগের আগে তার অফিস সহকারী আবুল খায়ের জাহাজের নাম লিপিবদ্ধসহ শূন্য ফরম পূরণ করে এনওসি প্রদানের গুরুদায়িত্বটি সম্পন্ন করেন। এ ক্ষেত্রে জাহাজপ্রতি অন্তত ৫০০ ডলার (প্রায় ৩৭ হাজার টাকা) অবৈধ লেনদেন হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
ডস সূত্রে জানা গেছে, প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম অধিদপ্তরের প্রধান পরীক্ষকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পেয়ে দীর্ঘ সময় ঢাকায় অবস্থান করছেন। যদিও সংস্থার জনবল কাঠামোতে (অর্গানোগ্রাম) এই নামে কোনো পদ নেই। তবে ওপর মহলের বিশেষ আশির্বাদে এবং সমপদমর্যাদার একজন সহকর্মীর বিশেষ তদবিরের মাধ্যমে তিনি এই ‘পদহীন’ (প্রধান পরীক্ষক) পদে নিয়োগ পেয়েছেন। ডস এর অপর একটি সূত্র জানায়, বর্তমান মহাপরিচালক জোবায়ের আহমেদ জাহাজী কর্মকর্তাদের পরীক্ষা গ্রহণে ইতিপূর্বে ওঠা নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বদনাম ঘোচাতে শফিকুল ইসলামকে অনেকটা বিধি বহির্ভুতভাবে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু কার্যত গত তিন মাসে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাত্রা বহুগুণ বেড়ে গেছে এবং জাহাজী কর্মকর্তাদের পরীক্ষায় পাস ও গ্রেডেশেনের নামে লাখ লাখ টাকা অবৈধ লেনদেন হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের চেয়ে অধস্তনদের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেকে স্বচ্ছ রাখতে চান তিনি।  প্রধান পরীক্ষক হিসাবে শফিকুল ইসলাম প্রশ্নপত্র করা ছাড়া আর কিছুই করেন না। বাকী যাবতীয়  কার্যক্রম অন্য পরীক্ষক দ্বারা সম্পন্ন  হয় এবং সেখানে চলে দুর্নীতি। 
এব্যাপারে শফিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নি।
চলতি অর্থবছরের ৩ মাসে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ
দাতাদের শর্তের কারণে এডিবিতে বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার বাড়ছে না
সিদ্দিকুর রহমান
দাতাদের আরোপিত নানা শর্ত এবং অনাকাক্সিক্ষত খবরদারির কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন কাজের অগ্রগতি একদিকে পিছিয়ে যাচ্ছে এবং অপরদিকে দেশের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক ঋণের মাত্র ৪ শতাংশ ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রটি থেকে বলা হয়েছে, দাতাদের নানা শর্ত ও খবরদারির কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য এখন সরকারকে নিজস্ব তহবিল থেকে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহ ৪ হাজার ৮শ’ ৩৫ কোটি টাকার এডিবি বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়েছে ৪ হাজার ১১ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণ সহায়তায় প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। সরকার চাচ্ছে, দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কাজে দাতাদের অর্থ ছাড় প্রক্রিয়া যাতে সহজ করা হয়। সেইসাথে তাদের অযৌক্তিক শর্ত ও অনাকাঙ্খিত খবরদারি যাতে পরিহার করা হয়। উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক অনাকাঙ্খিত খবরদারি করে চলছে। অন্যান্য দাতা সংস্থাও যে কোন উন্নয়ন প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করাসহ নানা শর্ত চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে বৈদেশিক নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব উৎস থেকে অর্থের সংস্থান ও নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। সূত্রটি থেকে আরো বলা হয়েছে, দাতারা যদি উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানে অযৌক্তিক নানা শর্ত চাপিয়ে না দিতো তাহলে দেশের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রক্রিয়া অনেক ত্বরান্বিত হতো। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও আরো গতি পেতো। উল্লেখ্য চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার হচ্ছে মাত্র ১১ শতাংশ।

 সমস্যা ও সম্ভাবনার মাঝে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
নিজস্ব প্রতিবেদক
আগামী ২৪ নভেম্বর রাজশাহীতে প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঘটবে। এজন্য রাজশাহীর মানুষ এবং সকল প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা প্র্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগতম জানাতে প্রস্তুত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীরাও অপেক্ষায় রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পথ চেয়ে। এ সফরে তিনি বিদ্যুৎ প্ল্যাণ্টের উদ্বোধন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে  মহিলা হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনসহ বিাভন্ন কর্মসূচীতে যোগদান এবং সর্বশেষ রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানের জনসভায় বক্তব্য দেবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে নগরীকে সাজানো হয়েছে নতুনভাবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কেও সাজানো হয়েছে একইভাবে। উত্তরবঙ্গের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীন পরিবেশ বলে দেয় এর অবস্থান আরও নিচে। এখানকার রাস্তা, ভবন এবং হলের পরিবেশ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে না। দেশের কোন গুও“ত্বপূর্ণ ব্যাক্তিবর্গ ক্যাম্পাসে আসলে রাস্তা, ভবন এবং হলগুলোকে মেরামত এবং রং করা হয়। তাও আবার যে রাস্তা দিয়ে অতিথির আগমন ঘটবে সেগুলোই এর মধ্যে পড়ে। যেমন ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীতে আসলে রাস্তা মেরামত-সংস্কার করা হয়। তিনি সুবর্ণ জয়ন্তী নামে একটি টাওয়ারেরও উদ্বোধন করেছিলেন। এটি  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গুও“ত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর একটি। কিন্তু এ টাওয়ারটি যতেœর অভাবে তার সৌন্দোর্য হারিয়ে ফেলেছে।
আগামী ২৪ নভেম্বও প্র্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজিলাতুন্নেসা নামে একটি মহিলা হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।বলে সূত্রে জানা যায়। শেখ হাসিনা যে রাস্তা দিয়ে যাবেন কেবলমাত্র সে রাস্তা পরিষ্কার ও মেরামত করা হচ্ছে। প্রশাসন ভবন, শহীদ জোহার মাজার, মেইন গেট রং করে আলোকসজ্জায় সাজানো হয়েছে। মেইনগেট থেকে মহিলা হল এবং কাজলা গেট পর্যন্ত যেভাবে সাজানো ও মেরামত করা হচ্ছে যা দেখে আসলে যে কেউ মুগ্ধ হওয়ার কথা। অথচ ক্যাম্পাসের মধ্যে এমনও রাস্তা রয়েছে যা তৈরি ও ওমরামত করা পাঁচ বছর আগে জরুরি ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি সে ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে যেতেন তবে অবশ্যই তা মেরামত করা হতো।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক রাজশাহী বিদ্যালয় শ্ববি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া উত্তরাঞ্চলের জনগনের পশ্চাদপদতা কাটিয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। নানা চড়াই-উৎরাই পার করে উত্তর বঙ্গের শ্রেষ্ঠ এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ বিশ্ববিদ্যালয়টি সময়ের পরিক্রমায় গৌরবের ৫৮ বছর অতিক্রম করে ৫৯ বছরে পদার্পন করেছে আজ। বিশ্ববিদ্যালয়টি তার শৈশব, কৈশর, যৌবন পার করেছে ঠিকই কিন্তু এ বিদ্যাপীঠটি আজও পূর্ণতা পায়নি। শিক্ষা, গবেষনা, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, খেলাধুলা প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে এখানকার শিক্ষার্থীরা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যলয় হওয়া সত্ত্বেও এখানকার জন্য বাজেট হয় একেবারেই নগন্য। ছাত্র-ছাত্রীর তুলনায় কম সংখ্যক শিক্ষকসহ বিভিন্ন সমস্যার ফলে যোগ্য হিসেবে নিজেকে গড়তে পারছে না শিক্ষার্থীরা।

প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষের দাবী ও আন্দোলনের ফসল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহী অঞ্চলে উচ্চশিক্ষা পিপাসু জনগন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেন। সে সূত্র ধরে সব কলেজই ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের অন্তর্ভূক্তকরণের ঘোষণা এলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরূ হয়। ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশনে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৫৩’ পাশ হয়। একই বছরের ৬ জুলাই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ , রাজশাহী কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড. ইতরাৎ হোসেন জুবেরীকে উপাচার্য নিয়োগের মাধ্যমে এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে ৭ বিভাগে ১৫৬ জন ছাত্র এবং ৫ জন ছাত্রী নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থান
১৯৬১ সালে রাজশাহী কলেজ ভবন থেকে স্থানান্তর করে বর্তমান মতিহারের সবুজ চত্তরে নিয়ে আসা হয়। ১৯৫৮ সালে ক্যাম্পাসে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসহ দালানকোঠা গড়ে তোলা হয়। রাজশাহী শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্বে, রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের বাম পাশে মতিহারের সবুজ চত্তরে প্রায় ৩০০ হেক্টর জমির উপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এখানে সিনেট ভবন, ব্যাংক, মিলনায়তন, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, মুক্তমঞ্চসহ বিভিন্ন একাডেমিক ও যাবতীয় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে ৯ টি অনুষদের আওতায় ৪৭টি বিভাগে ৪৯ টি বিষয়ে চার বছর মেয়াদি অনার্স এবং এক বছর মেয়াদি মাস্টার্স কোর্সে ডিগ্রি প্রদান করা হয়। আবার উচ্চতর গবেষণার জন্যও ৫ টি ইনস্টিটিউট রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষার্থী এখানে অধ্যায়ন করছে। শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য ১২ শ শিক্ষক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে সহায়তার জন্য রয়েছে প্রায় ৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। এখানে রয়েছে মহান মুক্তিযদ্ধে স্বাধীনতার প্রতীক শহীদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার। প্রখ্যাত শিল্পী নিতুনকুন্ডের অমর কীর্তি মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য সাবাস বাংলাদেশ , জুবলী গোল্ডেন টাওয়ার, বদ্ধভূমি এবং আধুনিক স্তপত্যের নিদর্শন কেন্দ্রীয় মসজিদ রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যারয়ের গৌরবজ্জ্বল ৫৮ বছরে জড়িত ছিলেন দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ। এখানে শিক্ষকতা করেছেন বহুভাষাবিদ ও জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ভাষা বিজ্ঞানী ড. এনামুল হক, বিখ্যাত নৃ-বিজ্ঞানী পিটার বার্টচী, প্রফেসর ড. এমএ বারীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। বর্তমানে যারা দেশ পরিচালনা করছেন তাদের অনেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল হকসহ অনেকেই শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করেছেন অত্র বিশ্বদ্যালয়ে। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের পদার্থ বিজ্ঞানে একমাত্র প্রফেসর ইমেরিটাস ড. অরুন কুমার বসাক, সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, বিশিষ্ট পদার্থ বিজ্ঞানী এ কে এম আজহারূল ইসলাম, ইতিহাসবিদ এ কে এম ইয়কুব আলী, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ শাহ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, নাট্যকার মলয় কুমার ভৌমিক, সমাজ বিজ্ঞানী ড. আব্দুর কাদির ভূঁইয়া, আব্দুর রহমান সিদ্দিকী’র মতো অনেক সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলি।  
বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ৫৮ বছর পার হলেও যথাযথ সুযোগের অভাবে যোগ্য হিসেবে গড়ে উঠছে না এখানকার শিক্ষার্থীরা। কর্তৃপক্ষের সঠিক নজরদারির অভাব, গবেষনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ফি বৃদ্ধি করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, অপ্রতুল বাজেট, শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে আবাসনের সুব্যবস্থার অভাব, মুক্ত বুদ্ধি চর্চার অনুকুল পরিবেশের অভাব, কম্পিউটার-ইন্টারনেট ব্যবহারে বিভিন্ন শর্তারোপ, শিক্ষকদের দলীয়করণ, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব, ছাত্র সংঘর্ষসহ সর্বোপরি ভৌগলিক কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যারয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদেরকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারছে না। বাজেট বৈষম্যের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন পিছিয়ে পড়েছে তেমনি গবেষণায়ও পিছিয়ে পড়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিকাশের জন্য প্রয়োজন অবাধ ইন্টারনেট, লাইব্রেরি ব্যবহার সাংস্কৃতিক চর্চা এবং খেলাধুলার। পড়ালেখার জন্য হলগুলোতে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি নেই, খেলাধুলার জন্য সুনির্দিষ্ট মাঠও নেই। সব বিভাগে ইন্টারনেট সুবিধা থাকলেও তা কেবল শিক্ষকদের জন্যই হয়ে থাকে। ফলে ক্লাশের ফাঁকে অবসর সময় কাটাতে শিক্ষার্থীরা বাইরে আড্ডা দিয়ে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভি-স্যাট ও ইন্টারনেট থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র কর্র্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবে সব বিভাগ ও হলসমূহে ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য ভবন থাকলেও তা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম।
শিক্ষা ও গবেষণা
শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যে অবদান রেখেছে তা নিশ্চয় অতুলনীয়। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার মান নিম্নমুখী হয়ে পড়ছে। ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা, ধর্মঘট, কর্মবিরতি, ছাত্র-শিক্ষকদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি এবং ছাত্র হত্যা শিক্ষার মানকে বার বার নিম্নমুখী করেছে। উচ্চতর ডিগ্রী লাভের নামে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকগন দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করায় শিক্ষক সঙ্কটে পড়ছে উত্তর বঙ্গের সর্বোচ্চ এ বিদ্যাপীঠটি। দেশে ফেরার পর ঠিক মতো ক্লাশ নিলেও আবার পূর্বের মতো ক্লাশে অনিহা লক্ষ করা যাচ্ছে ডিগ্রীধারী শিক্ষকদের মাঝে। আবার যারা দেশে আছেন তারাও ঠিক মতো ক্লাশ নেন না। অনেকেই ক্লাশ বাদ দিয়ে কাঁচা টাকার গন্ধে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। শিক্ষকদের অলসতার কারনে ১৫-২০ টি খাতা না দেখায় পরীক্ষা শেষের এক বছরের মাথায়ও কোন কোন বিভাগে রেজাল্ট হচ্ছে না। ফলে শিক্ষার মান যেমন কমছে তেমনি সেশনজটও বাড়ছে।
আবাসন সঙ্কট
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। ভর্তি হওয়ার পর এখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের তীব্র আবাসন সঙ্কটে পড়তে হয়। শিক্ষার্থীর তুলনায় এ প্রতিষ্ঠানে আবাসিক হলের সংখ্যা একেবারেই কম। মোট আবাসিক হলের সংখ্যা ১৭ টি যার ১১ টি ছেলেদের ৫টি মেয়েদের এবং একটি গবেষকদের। এ হলগুলোতে প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীকে আবাসনের জন্য খুঁজতে হচ্ছে ক্যাম্পাসের বাইরে ছাত্রাবাস। আবার বাইরে থাকার জন্য হলের সিটের চেয়ে শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে মেস ভাড়ার জন্য। সেশনজটহসহ বিভিন্ন কারনে ছাত্র-ছাত্রীরা পাশ করতে পারে না বলেও আবাসন সঙ্কট অনেকটা বেড়ে যাচ্ছে।   
পরিবহন সমস্যা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবহন সমস্যা বড়ই চরমে। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহরের বিভিন্ন রুটে যাতায়াতের জন্য বাস সার্ভিস চালু আছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও অফিসারদের জন্য রয়েছে আলাদা বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রীর তুলনায় গাড়ির সংখ্যা কম বলে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়। চাপাচাপি ও গাদাগাদির পরও ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যা সমাধান হয়না। ফলে অধিকাংশ সময় বাদুড়ের মতো ঝুলে আবাসনে ফিরতে বাধ্য হয় শিক্ষার্থীরা। এতে অনেক সময় ছাত্র-ছাত্রীরা বাসের গেট থেকে পড়ে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়। বাসস্ট্যান্ডে ছাত্রদের জন্য যাত্রীছাউনি না থাকায় বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে এবং গ্রীষ্মের রোদে পুড়ে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। নেমপ্লেট লাগানোর জন্য বাসে নির্দিষ্ট যায়গা থাকলেও ড্রাইভার ও হেলপাররা তা ব্যবহার না করায় নবাগত ছাত্রদের ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ড্রাইভার এবং হেলপরদের মদদে বহিরাগতরা যাতায়াত করছে বলে বৈধ ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের দাঁড়িয়ে যাতায়ত করতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের সাথে হেলপার ও ড্রাইভারদের ব্যবহার খুবই হতাশাজনক। নিজের ইচ্ছে মতো গাড়ি চালায় ড্রাইভাররা। নির্দিষ্ট স্টপেজে গাড়ি না থামিয়েই চালাতে শুরু করে । ফলে চলন্ত গাড়িতে উঠা-নামা করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় পা ফসকে পড়ে গিয়ে দূর্ঘটনার শিকার হয়। দুটি শিফটে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবহন দফতরে ৫৪ জন করে ড্রাইভার ও হেলপার থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে তা আছে ২৯ জন করে। ৩০-৩৫ বছরের পুরানা ৪০টি বাস থাকলেও এর অনেকগুলোই আবার নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। শিক্ষকদের কয়েকটি বাস ছাড়া অধিকাংশ গাড়িই ফিটনেসবিহীন। বাসের জনালার গ্লাস ও দরজা ঠিক না থাকায় ভিতরে থেকেও যাত্রীদের রোদে পুড়তে হয় এবং বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। নগরীর সবচেয়ে খারাপ গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পরিবহন কাজে ব্যবহƒত হয় বলে অনেকে মুড়ির টিনের সাথে একে তুলনা করে থাকেন। সুখী নগরী হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর পরিবেশ ভীষণভাবে দূষিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ির ধোঁয়ায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা নগরীর আমলাদের এতে একটুও মাথা ব্যাথা নাই।   
খাবার মান
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলিয়ের হলের ডাইনিংগুলোতে খাবারের দাম বৃদ্ধি করা হলেও মানের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির অজুহাতে মিল চার্জ বৃদ্ধি করা হলেও খাবারের মান রয়েছে অপরিবর্তনশীল। এখানকার ডাইনিংয়ে যে খাবার পরিবেশন করা হয় তা একেবারে নিম্নমানের। বাজারে সবচেয়ে কমদামি নষ্ট হয়ে যাওয়া শাক-সব্জি খাওয়ানো হয় হল ডাইনিংয়ে। ডাইনিংয়ে হল কর্তৃপক্ষের ভর্তুকি দেয়ার কথা থাকলেও তার বাস্তবায়ন হয় না। খাবারের মান শধু নিম্নমানেরই নয় অনেক সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ইদুর, কুকুর, শিয়ালের মাংস খাওয়ানো হয় ছাত্রদেরকে। মাদার বখ্শ হলে শিয়ালের মাংস এবং শের-ই বাংলা এ কে ফজলুল হক হলে ইদুরের মাংস খাওয়ানোর ঘটনা শিক্ষার্থীদের দুপুরে ডাইনিংয়ে খেতে এখনও রুচিহীন করে তোলে। প্রত্যেক হলে ডাইনিংয়ে খাবার ব্যবস্থা থাকলেও ছাত্র-ছাত্রীরা ক্যান্টিনে আবার কেউ নিজেই হিটারে রান্না করে খাবার ব্যবস্তা করছে। এতে অনেক বিদ্যুৎ খরচ হওয়ায় দেশের সম্পদ ভীষণভাব নষ্ট হচ্ছে। ছাত্রীদের রান্নার অভ্যস থাকলেও খাবার নিয়ে ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে ছাত্রদেরকে। এতে ছাত্রদের পড়ালেখায় যেমন আগ্রহ হারাচ্ছে তেমনি জীবন থেকে নষ্ট হচ্ছে অনেক মূল্যবান সময়।
মেডিকেল সেন্টারের অসুস্থতা
ক্যাম্পাসের পূর্ব এলাকায় বিনোদপুর গেটের কাছে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার। মেডিকেল সেন্টারে সাধারণ বিভাগ, প্যাথলজি, এক্সরে, ইসিজি, আই, ডেন্টাল ও পরিবার পরিকল্পনা ইউনিট রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে আধুনিক সব ধরনের সারঞ্জামাদি দিয়ে সুস্থ মেডেকেল সেন্টার গড়ার কথা থাকলেও তা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে শান্তনা মাত্র। এখানে রোগীদের জন্য ঠিকমতো ওষধ থাকে না। ডাক্তারগণ অনেক সময় চেম্বারে গল্পের আড্ডা বসায় বলে টোকেন নিয়েও রোগীদের অপেক্ষা করতে হয়। তাছাড়া চিকিৎসকগন বিভিন্ন কারণে দীর্ঘনি ছুটিতে থাকায় সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করে। অনেক সময় চিকিৎসকগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করেন বলে জরুরি অবস্থায়ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ছাত্র সংঘর্ষের সময় আহত কিংবা অসুস্থ ছাত্রের চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বলেন্স পাওয়া যায় না অথচ এই অ্যাম্বুলেন্স ঠিকই প্রশাসনের ঘোষনায় ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহƒত হয়।  
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দফতর
কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের অভাবে প্রতি বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দফতরে নষ্ট হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান নথিপত্র। পর্যাপ্ত যায়গা এবং আলমারী না থাকায় প্রতি বছর নষ্ট হওয়া ফাইলের জন্য শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির শিকার হতে হয়। মাসের পর মাস সেশনজটের জন্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দফতরও অনেকাংশে দায়ী। প্রয়োজনীয় জনবল, অর্থ, জায়গা ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দফতরে এসেছে ধীর গতি। চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
পরিবেশহীন লাইব্রেরি
বিশ্ববিদ্যলয়ের কেন্দ্রস্থলে মনোরম স্থাপত্যের নিদর্শন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে প্রায় তিন লাখ বই রয়েছে। প্র্রধান গেট দিয়ে প্রবেশের পর প্রশাসনিক ভবনের উত্তর-পশ্চিম দিকে মনোরম স্থাপত্যের লাল রঙয়ের তিনতলা একটি ভবন দাঁড়িয়ে আছে জ্ঞনের প্রতীক হিসেবে। লাইব্রেরীর দোতালায় দুইটি পাঠকক্ষ আছে, তিনতলায় রয়েছে সাময়িকী ও পত্র-পত্রিকা বিভাগ। নীচতলায় প্রায় সবটা জুড়ে সকল গ্রন্থের কপি, পুরাতন পত্র-পত্রিকা ইত্যাদি সংরক্ষিত আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দু বছর পর ১৯৫৫ সালে রাজশাহীর বড়কুঠিতে ক্ষুদ্র আকারে গড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যুগের সাথে তাল মিলিয়ে জ্ঞান পিপাসুদের চাহিদা মেটাতে লাইব্রেরীতে অনেক বই সংগ্রহ করেছে। দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির লক্ষ্যে কেবলমাত্র মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য এখানে স্বল্প পরিসরে হলেও কম্পিউটার সমৃদ্ধ ইন্টারনেট ল্যাব রয়েছে। লাইব্রেরিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক অর্থাৎ এসি সংযোজন থাকলেও শুধু গরমকাল ছাড়া এটি শীতে ভেতরের পরিবেশ গরম রাখতে কোন ভূমিকা রাখছে না। এ ছাড়াও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে আলো সরবরাহের জন্য লাইব্রেরিতে কোন জেনারেটর এর ব্যবস্থা নেই যা ছাত্র-ছাত্রীদের অধ্যায়নে সহযোগিতা করবে। ফলে বিদ্যুৎ চলে গেলে শিক্ষর্থীরা পড়ালেখা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। অনেক সময় শিক্ষার্থী, কর্মচারীরা নিজেরা পারস্পরিক গল্প, মোবাইলে কথা বললে পড়লেখার পরিবেশ নষ্ট হলেও কর্র্তৃপক্ষের এদিকে কোন নজরদারি নাই। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসচেতনতার কারণে ক্যাটালগে বইয়ের নাম থাকলেও অনেক সময় সেলফে বই খুঁজে পাওয়া যায় না। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দেয়ালে পোস্টার লাগানো নিষেধ এবং ধুমপান মুক্ত এলাকা এমন নীতিবাক্য ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারী কেউই মানছে না। গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত বই সরবরাহ, সকল শিক্ষার্থীর জন্য ইন্টারনেট সুবিধাসহ  সর্বোপরি লাইব্রেরীতে বেশি টাকা বরাদ্দ দিয়ে ডিজিটালাইজড বা প্রযুক্তি নির্ভর করতে পারলে ছাত্র-শিক্ষক, গবেষক দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের বেহালদশা
১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের সর্বপ্রাচীন সংগ্রহশালা-বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর বঙ্গীয় শিল্পকলার বিপুল ও বর্ণাঢ্য সংগ্রহের জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত। রাজশাহী শহরে অবস্থিত, বাংলাদেশের সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক এই জাদুঘরটি ১৯৬৪ সাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে আসছে। রাজশাহীর জাদুঘরটি এক্ষেত্রে এশিয়ার মধ্যে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন জাদুঘর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। এ জাদুঘরটি রাজশাহীর মর্যাদাকে অনেকটা উপরে তুলেছে। যা কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয় গোটা দেশ জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং জাতিয় ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানটির শত বর্ষ পূর্তি হলেও তেমন সমৃদ্ধ লাভ করেনি। ফলে দিনে দিনে পর্যোটকরা আগের চেয়ে এটা ভ্রমনে বেশি আগ্রহী হয় না। 
শরীরচর্চা শিক্ষা বিভাগে নজরদারি নেই
ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখার ও ক্রীড়া নৈপুন্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শরীর চর্চা শিক্ষা বিভাগ রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন খেলাধুলায় প্রশিক্ষণ দেয়া, আন্তঃবিভাগ, আন্তঃহল,আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কৃতিত্ব প্রদর্শন করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কার এবং এর ব্যবহার উপযোগীকরণে কর্তৃপক্ষের কোন উদ্যোগ নেই। বিশ্বদ্যিালয়ের জিমনেসিয়াম, বাস্কেটবল, টেনিস ও হ্যান্ডবল কোর্ট, অ্যাথেলটিকস জোন, সুইমিংপুলসহ বিভিন্ন অনুশীলন ক্ষেত্রগুলো দীর্ঘদিন অযতœ আর অবহেলায় থাকায় অকেজো হয়ে গেছে।  
সাংস্কৃতিক চর্চা নেই টিএসসিসতে
বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক চর্চা প্রসারের লক্ষ্যে টিএসসিসি স্থাপন করা হয়েছে। এই কেন্দ্র প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করে সাংস্কৃতিক কর্মীদের সহায়তা নিয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসি একতলা হওয়া সত্ত্বেও ছাদ ধসতে পারে বলে অনেকেই এখানে প্রবেশ করতে ভয় পায়। সাংস্কৃতি কর্মীদের বিশ বছরের প্রাণের দাবি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষক-ছাত্র সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (টিএসসিসি)। বিশ বছর ধরে ধীর গতিতে আন্দোলন করে এলেও কোন ফল পাননি সংস্কৃতিমনা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সংস্কৃতি কর্মীরা লাগাতার কর্মসূচি দিলে প্রক্টর আশ্বাস দেওয়ার পরও বিষয়টি সিন্ডিকেট মিটিংয়ে উত্থাপিত হচ্ছে না।

শহীদ মিনার কমপ্লেক্স
শহীদ মিনার, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, দুটি ম্যুরাল ও উš§ুক্ত মঞ্চ নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার কমপ্লেক্স গঠিত। স্বাধীনতা যুদ্ধে শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী এবং বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি চিহ্ন নিয়ে মতিহারের সবুজ চত্তর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৬ সালে গড়ে উঠে দেশের প্রথম শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। ভবনটি ছোট হলেও বাঙ্গালীর গৌরবের প্রতীক হিসেবে এটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এ সংগ্রহশালাটি জনবল স্বল্পতা, যায়গা সমস্যা এবং কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে শিক্ষার্থীদের মন আকর্ষণ করতে পারছে না। বছরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিন ছাড়া শহীদ মিনরের দিকে কর্তৃপক্ষের কোন নজরদারি নাই। 
রাকসু নির্বাচন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ‘রাকসু’ (জধলংযধযর টহরাবৎংরঃু ঈবহঃৎধষ ঝঃঁফবহঃং টহরড়হ, জটঈঝট) নামে পরিচিত। ছাত্রদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষ সাধন এবং শিক্ষাভিত্তিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নির্বাচিত ছাত্র-প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে রাকসু গঠিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদাধিকার বলে রাকসুর সভাপতি। শহীদ মিনারের উত্তরে রয়েছে রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয় কেন্দ্রিয় ছাত্রসংসদ অফিস। গণতান্ত্রিক উপায়ে ছাত্র-ছাত্রীদের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ছাত্র সংসদ। এ থেকে শিক্ষার্থীরা ফিরে পায় তাদের অধিকার এবং দেশকে উপহার দেয় নতুন নেতৃত্ব। কিন্তু আজ থেকে বাইশ বছর আগে রাকসু নির্বাচন হলেও এখন এর কোন গন্ধ পাওয়া যায় না। নতুনভাবে নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীরা বঞ্চিত হচ্ছে সুস্থ গণতন্ত্র চর্চা, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়ার মতো নানা অধিকার থেকে। ১৯৮৯ সালের নির্বাচন হওয়ার বাইশ বছর পর দেশের এই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাটি সর্বমহলে বিপুল উৎসাহউদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। বিরল গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী রাকসু ছিল সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের প্রতীক একটি অতি প্রিয় সংগঠন এবং তাদের মিলনকেন্দ্র। সমাজিক ও সাংস্কৃতিক কমংকান্ডের পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার আদায়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। রাকসু নির্বাচন বন্ধ থাকায় ছাত্ররা সুযোগ পেলেই ছাত্ররাজনীতির নামে নিজের আখের গোছানোর মতো ঘৃণ্য কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে ছাত্ররাজনীতি যেমন কলুষিত হচ্ছে তেমনি দেশ বঞ্চিত হচ্ছে যোগ্য নেতৃত্ব থেকে।
শিক্ষার্থীরা যেন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে লেখা-পড়া শেষ করতে পারে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে খেয়াল রাখতে হবে সবদিকে। এজন্য আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব, গবেষণার জন্য বিভাগভিত্তিক ল্যাব, খেলাধুলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষাক্ষেত্রে উপযুক্ত বাজেট, শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, পড়পলেখার অবাধ পরিবেশ এবং প্রশাসনের সর্বোচ্চ সহায়তা পেলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনেক ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে অনেকে মনে করছেন। আগামীতে এ প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় আকারের বাজেট হাতে নিয়ে এগিয়ে যেতে প্রশাসনকে আরও দায়িত্বশীলের ভুমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষামন্ত্রীকে এর আগে যে সমস্যার বিষয়ে বলা হয়েছিল তা আবারও প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও পারিপার্শিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে এটাই ছাত্র-ছাত্রী এবং াবিভাবকদের প্রত্যাশা।


জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম
কিয়োটো প্রটোকল গৃহীত হওয়ার দীর্ঘ সময় পর কোপেনহেগেন সম্মেলনের আগে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখেছিল শিল্পোন্নত দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনসহ এ বিষয়ক অন্যান্য কর্মসূচি সম্পর্কে আশার বাণী শোনাবেন। কিন্তু ওই সম্মেলন থেকে শেষ পর্যন্ত কাক্সিক্ষত কোন আশার বাণী শোনা যায়নি। পরের বছর কানকুন সম্মেলনের পূর্বে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির সম্মুখীন উন্নয়নশীল দেশের কোটি কোটি মানুষ আবারও বড় কিছু প্রাপ্তির অপেক্ষায় উš§ুখ ছিল। শেষ পর্যন্ত কানকুন সম্মেলনেও সে আশা পূরণ হয়নি। উন্নয়নশীল দেশের এই কোটি কোটি মানুষের উদ্বেগ কেবল নিজেদের জন্য নয়। এ উদ্বেগ সমগ্র বিশ্বের মানব জাতির ভবিষ্যতের জন্য, এ উদ্বেগ আগামী প্রজšে§র জন্য, এ উদ্বেগ বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য। শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতিরিক্ত বিলাসিতার ফলে উন্নয়নশীল দেশের হতদরিদ্র মানুষের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে শিল্পোন্নত দেশগুলোর দায়বদ্ধতা পুরোপুরি স্বীকার করাই যথেষ্ট নয় বরং গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসসহ এ বিষয়ক অন্যান্য দায়িত্ব পালনে তারা সর্বোচ্চ আন্তরিকতার পরিচয় দেবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু বাস্তবে এমনটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির সম্মুখীন দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য কাজ করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সংগঠন ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম’ (সিভিএফ) ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করছে। ১৩ ও ১৪ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত সিভিএফের তৃতীয় সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন যোগদান করায় এ সম্মেলন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। সিভিএফের এ সম্মেলনটি ডারবান সম্মেলনের কাছাকাছি সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে এ সম্মেলনের আলোচনাগুলো ডারবান সম্মেলনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবেÑ এটাই সিভিএফভুক্ত দেশগুলোর জনগণের প্রত্যাশা। এবারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামীতে আরও পর্যাপ্ত সময় থাকতেই সিভিএফের সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কাজ করতে হবে। এ ধরনের সম্মেলন বারবার অনুষ্ঠিত হলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষয়ক্ষতির ধরন যথাযথভাবে তুলে ধরে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয় সময় পাওয়া যাবে এবং একই সঙ্গে এ পৃথিবীকে সুরক্ষায় সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে স্থানীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক পর্র্যায়ে করণীয় সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। সিভিএফের সম্মেলনে বান কি মুনের যোগদানের বহুমাত্রিক তাৎপর্য রয়েছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব যেভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছেন এর জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি গত কয়েক বছর ধরে এ বিষয়ে কেবল বক্তৃতা বিবৃতি প্রদানের মধ্যেই তার দায়িত্ব সীমিত রাখেননি। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল প্রত্যক্ষ করার জন্য ২০০৭ সালেই তিনি বিশ্বের সর্ববৃহৎ জনমানবহীন প্রান্তর, পৃথিবীর ৯০% বরফের উৎস এন্টার্কটিকায় ভ্রমণ করেন। তাও আগে জাতিসংঘের কোন মহাসচিব এন্টার্কটিকা ভ্রমণ করেননি। এই একটি মাত্র উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট হয়, এ বিষয়ে সর্বোচ্চ ইতিবাচক ভূমিকা রাখার জন্য তিনি কতটা তৎপর। কাজেই ঢাকায় সিভিএফের সম্মেলনের অভিজ্ঞতা তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে উলে¬খ করবেন এটাই স্বাভাবিক। এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সদস্য দেশগুলোর ন্যায্য দাবি পূরণে আরও মনোযোগী হবে।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত সিভিএফের সম্মেলনে ৩৩টি সদস্য দেশ ছাড়াও প্রায় ৬০টি দেশের প্রতিনিধিদের যোগদানের কথা রয়েছে। সদস্য দেশগুলোর বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যদের সিভিএফের সম্মেলনে যোগদানের ফলে সিভিএফের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর ন্যায্য দাবির বিষয়টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে আরও বেশি গুরুত্ব পাবে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগের বাইরেও বিভিন্ন দেশ নিজ নিজ দায়বদ্ধতার কথা বিবেচনা করে আলাদাভাবে অবদান রাখার চেষ্টা করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অল্প সময়ে ভারি বৃষ্টিপাত, বন্যা, সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসÑ এসব বহুমুখী সমস্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে এদেশের অনেক দরিদ্র মানুষ তাদের শেষ সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। উলি¬খিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সমগ্র বিশ্বের মানুষকে অতি প্রাচীনকাল থেকেই লড়াই করতে হলেও গত দশকে এসব দুর্যোগের তীব্রতা ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর যে ক’টি দেশ সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। যেহেতু শিল্পোন্নত দেশগুলোর কারণে বাংলাদেশ এখন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির শিকার, তাই শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশ ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কয়েক যুগের সঞ্চয় একটিমাত্র সামুদ্রিক ঝড়ের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হলে একজন হতদরিদ্র মানুষ কতটা দিশেহারা হন উন্নত দেশের অনেকে এটা কল্পনাও করতে পারবে না। প্রায় একই রকম সমস্যা বিশ্বের অন্য যে কোন দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষকেও মোকাবেলা করতে হয়। কিন্তু একই গতির সামুদ্রিক ঝড়ে উন্নত কোন দেশের মানুষ যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের মানুষ তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র মানুষের আবাস সামুদ্রিক ঝড় তো দূরের কথা সামান্য ঝড়ো বাতাসেও ভেঙে পড়ে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার লাখো মানুষ সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বারবার সর্বস্ব হারোনোর পরও নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। বসবাসের জন্য বিকল্প কোন ব্যবস্থা না থাকায় বিপজ্জনক জেনেও তারা সমুদ্রের নিকটবর্তী অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। বংশপরম্পরায় হতদরিদ্র মানুষ উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করে বিপদকে নিয়তি বলে মেনে নেয়া থেকেই তাদের অসহায়ত্ব স্পষ্ট হয়।
কয়েকশ’ বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের গত প্রায় ১০০ বছর ধরে সামুদ্রিক ঝড় আগের তুলনায় ঘন ঘন আঘাত করেছে এবং এসব ঝড়ের তীব্রতা ক্রমেই বেড়েছে। এর কারণ বিশে¬ষণ করে বিশ্বের বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা শিল্পোন্নত দেশগুলোকে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বারবার তাগিদ দিলেও শিল্পোন্নত দেশগুলো এ বিষয়ে তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছে। ফলে বিশ্বজ-ড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা এবং তীব্রতা বেড়েই চলেছে। এতে উন্নয়নশীল দেশের লাখ লাখ দরিদ্র মানুষকে বারবার তাদের সহায়-সম্বল হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বিশ্বজ-ড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। কিন্তু অতীতে এসব দুর্যোগের তীব্রতা তত প্রকট ছিল না। ফলে বিভিন্ন দেশের মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করত। উদাহরণ হিসেবে সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের বিষয়টি উলে¬খ কার যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা ও তীব্রতা অনেক বেড়েছে। এতে উন্নয়শীল দেশের হতদরিদ্র জনগণ দিশেহারা হয়েছে।
বাংলাদেশের উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সামুদ্রিক ঝড়- জলচ্ছ্বাসের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ১৫৮৫ সালের পরে উলে¬খযোগ্য সামুদ্রিক ঝড়টি হয়েছে ১০০ বছরেরও বেশি সময় পর। ১৮৫২ সালের সামুদ্রিক ঝড়ের পরের ঝড়টি হয়েছে ১৮৬৯ সালে। ১৮৩১ সালের পরের সামুদ্রিক ঝড়টি হয়েছে ৪১ বছর পর, ১৮৭২ সালে। এর পরের শতকে সামুদ্রিক ঝড় বহুগুণ বেড়েছে। ১৯৫৮, ১৯৬০, ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৭৪, ১৯৮৩, ১৯৯১, ১৯৯৭, ১৯৯৮Ñ উলি¬খিত সালে প্রতি বছর দুবার বাংলাদেশের উপকূলে সামুদ্রিক ঝড় আঘাত করেছে। এসব ঝড়ের তীব্রতা একই ছিল না। কিন্তু অতীতকালে যেখানে কয়েক দশক পরপর কিংবা একশ’ বছর পর উলে¬খযোগ্য সামুদ্রিক ঝড় হতো সেখানে একই বছর দু’বার সামুদ্রিক ঝড় বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত করার ফলে এদেশের জনগণকে কী দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এক সময় মানুষের ধারণা ছিল, আধুনিক প্রযুক্তি মানুষকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বিশেষভাবে সুরক্ষা প্রদান করবে। মানুষ এখন আধুনিক প্রযুক্তির বহুমুখী সুফল যে পাচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রকৃতির রুদ্র মূর্তির কাছে আধুনিক প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত মানুষও কতটা অসহায় তা এ বছরের মার্চে জাপানে সুনামির আঘাতের সময় আবারও স্পষ্ট হয়। জাপানের মতো উন্নত প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত মানুষগুলোই যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে দিশেহারা হল, এরপর এ নিয়ে উন্নয়নশীল দেশের যে কোন সাধারণ মানুষ বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হবেন এটাই স্বাভবিক। বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী লাখো মানুষ এ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকলেও বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে এখনও তারা সমুদ্রের কাছাকাছি বসবাস করছেন।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সামুদ্রিক ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির দিকে একবার দৃষ্টি দেয়া যাক। ১৬৯৯ সালে সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সামুদ্রিক ঝড়ে ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়। ১৭৬০ ও ১৭৬৫ সালের সামুদ্রিক ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য জানা যায় না। ১৭৬৭ সালে বরিশাল উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সামুদ্রিক ঝড়ে ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়। ১৭৯৭ সালে চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সামুদ্রিক ঝড়ে বন্দরে দুটি জাহাজ ডুবে গেলেও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য জানা যায় না। ১৮২২ সালের জুনে বরিশাল উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সামুদ্রিক ঝড়ে ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়। ওই ঝড়ে প্রায় এক লাখ গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে। ১৮২৩ সালের পরের সামুদ্রিক ঝড়টি হয়েছে ১৮২৪ সালের ৮ জুন। এর পরের সামুদ্রিক ঝড়টি হয়েছে ১৮৩১ সালের ৩১ অক্টোবর। বরিশাল উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ওই সামুদ্রিক ঝড়ে ২২ হাজার মানুষের প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়। এর পরের ঝড়টি হয়েছে ১৮৩৯ সালে জুনের প্রথম সপ্তাহে। ১৮৩৯ সালের পরের ঝড়টি হয়েছে ১৮৪৪ সালে। ১৮৪৪ সালের পরের ঝড়টি হয়েছে পাঁচ বছর পর। ১৮৫০ সালের দু’বছর পর আরকেটি ঝড় হয়। ১৮৬৯ সালে দুবার সামুদ্রিক ঝড় হয়েছে। ১৮৭২ সালের পরের সামুদ্রিক ঝড়টি হয়েছে ১৮৭৬ সালে। বছরের পর বছর এ তালিকা কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হয়েছে।
সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস কি রুদ্র মূর্তিতে হাজির হতে পারে তা এ দেশবাসী ১৯৭০ সালে নতুন করে প্রত্যক্ষ করে। ১৯৭০ সালের ওই সাইক্লোনে মারা যায় প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার গতির ঝড় এবং প্রায় ১০.৬৬ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংস হয় প্রায় ২০ হাজার মাছ ধরা নৌকা, ৪ লাখের বেশি বাড়িঘর, ৩ হাজার ৫০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯৯১ সালের সামুদ্রিক ঝড়ে মারা যায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ। এরপর সাম্প্রতিক সিডর ও আইলার আঘাতে বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্ববাসী তা প্রত্যক্ষ করেছে। উলে¬খিত তথ্য থেকে স্পষ্ট হয় সামুদ্রিক ঝড়ের কারণেই এদেশের উপকূলীয় এলাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন কতটা অরক্ষিত। একইভাবে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিবরণও দেয়া যায়। অর্থাৎ শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই এদেশে উন্নয়নের চাকা বিশেষভাবে স্থবির হয়ে পড়ে।
অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, অসময়ে বৃষ্টিÑ এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ অতীতে থাকলেও এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বর্তমানের মতো কখনোই অতিমাত্রায় তীব্রতা নিয়ে উপস্থিত হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষ এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের সাধারণ অভিজ্ঞতায় মোকাবেলা করতে সক্ষম ছিল। অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে তাদের জীবনযাপন পদ্ধতির একটা সমন্বয় ঘটেছিল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হাজার বছরের এই অভিজ্ঞতাগুলো হঠাৎ অকেজো হয়ে পড়ে। আগামীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও তীব্রতা নিয়ে হাজির হবে, বিজ্ঞানীরা এমনটাই আভাস দিয়েছেন। এ অবস্থায় গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনে সব দেশকে কৃচ্ছ্রতার পরিচয় দিতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে মনে রাখতে হবে, সাময়িক লাভের আশায় তারা যদি অতিরিক্ত গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন অব্যাহত রাখে তাহলে তাদের এই অদূরদর্শিতার কারণে তাদের ভবিষ্যৎ প্রজš§ও চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হবে। কাজেই এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার জন্য সব দেশকে সমন্বিতভাবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর দায়ই বেশি। কারণ তাদের বিলাসিতা ও অতিরিক্ত লোভের কারণে সমগ্র বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্য হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
২.
সিডরের পর বিগত বছরগুলোতে উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণকে সুরক্ষার জন্য টেকসই আবাস এবং আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে নানা রকমের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন মহল থেকে এসব বিষয়ে বারবার বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেও দেখা গেছে। বিভিন্ন মহলের আলোচনার ফলে দেশের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণের সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে শুধু এ দেশের সরকার-জনগণ এবং বিভিন্ন মহলেই আলোচনা সীমিত থাকেনি। এ বিষয়টি বর্তমানে আন্তর্জাতিক মহলেও বিশেষ আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণের ভোগান্তি নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন ও অন্যান্য আলোচনা এর প্রমাণ। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যে অন্যতম অরক্ষিত দেশ তাও সেসব আলোচনায় স্থান পেয়েছে। এসব আলোচনার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এসব আলোচনা সূত্রে সমগ্র বিশ্বের মানুষ এ বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হবে এবং বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণের জন্য অবদান রাখতে তারা আরও উš§ুখ হবে। এতসব আলোচনা ও বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের পরও বাস্তবতা হল বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলের বাঁধগুলো টেকসইভাবে নির্মিত হয়নি। অর্থাৎ সিডরের মতো আরেকটি প্রলয়ংকরী সামুদ্রিক ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হলে উপকূলীয় এলাকার বাঁধের বেশিরভাগই বিনষ্ট হয়ে যাবে। ফলে ওই এলাকার মানুষকে আবার অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হবে ওই এলাকার হতদরিদ্র বয়স্ক নারী-পুরুষ ও শিশুরা। বিভিন্ন কারণে উপকূলীয় এলাকার উলে¬খযোগ্যসংখ্যক মানুষ বংশপরম্পরায় হতদরিদ্র অবস্থায় দিনযাপন করছে। এসব মানুষ দীর্ঘ সময়ে সহায়-সম্বল বলতে যা কিছু জোগাড় করে বারবার সামুদ্রিক ঝড়ে তা বিনষ্ট হয়। এসব ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতেই তারা জীবনভর সংগ্রামে লিপ্ত থাকে।
সামুদ্রিক ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের পর উপকূলীয় এলাকার মানুষ সাময়িকভাবে বিভিন্ন মহল থেকে সহায়তা পায়। কিন্তু এসব সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। ফলে এসব দরিদ্র মানুষের জীবনে উলে¬খযোগ্য কোন পরিবর্তন আসে না। উপকূলীয় এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ইতিমধ্যে নিজেদের ভিটা ছেড়ে বিভিন্ন শহরে আশ্রয় নিয়েছে। যারা এখনও নানারকম দুর্ভোগকে সহ্য করে ওই এলাকায় বসবাস করছে তারাও নিজেদের ভিটা ছেড়ে শহরমুখী হওয়ার কথা ভাবছে। কারণ ওই দরিদ্র মানুষগুলোর মৌলিক চাহিদা পূরণের ন্যূনতম ব্যবস্থা ওই এলাকায় নেই। তীব্র পানির সংকটের বিষয়টি বিবেচনায় নিলেই স্পষ্ট হয় উপকূলীয় এলাকায় দরিদ্র মানুষ কত দুঃসহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছে।
সিডরসহ অন্যান্য সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবন এলাকার শত শত প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে কত প্রজাতির উদ্ভিদ বা প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়েছে, এ বিষয়ক বিস্তারিত কোন গবেষণা হয়েছে বলে জানা যায়নি। অথচ এটি অত্যন্ত জরুরি একটি কাজ। কারণ হাজার বছর ধরে যেসব উদ্ভিদ ও প্রাণী সুন্দরবন এলাকায় তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল, কেবল সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে সেসব প্রজাতির অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে প্রকৃতিতে সরাসরি এর নানারকম বিরূপ প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ প্রকৃতিতে বিদ্যমান প্রতিটি প্রজাতির উদ্ভিদ বা প্রাণীর ওপর আরও অনেক প্রজাতির অস্তিত্ব নির্ভর করে। উদাহরণ হিসেবে যে কোন একটি সাধারণ বৃক্ষের কথাই বলা যায়। ওই বৃক্ষটি সাধারণ চোখে হয়তো দেখা গেল কোন ফল দিচ্ছে না; অথচ এই বৃক্ষ অনেক প্রজাতির প্রাণীর আশ্রয় ও খাবার সরবরাহ করে ওই প্রাণীদের জীবন ধারণ ও বিকাশে অবদান রাখছে। অর্থাৎ প্রকৃতিতে বিদ্যমান যে কোন একটি উদ্ভিদ বা প্রাণীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেলে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়ে থাকে। অর্থাৎ ওই বৃক্ষ বা প্রাণীর ওপর নির্ভরশীল অন্য প্রাণীদের জীবন ধারণ হুমকির মুখে পড়ে।
বিভিন্ন সময়ে সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ কতটা সহায়তা পেয়েছে সে ইতিহাস বিশে¬ষণ না করে কেবল সাম্প্রতিক সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কি সাহায্য পেয়েছে সেদিকে দৃষ্টি দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাহায্যের জন্য সরকারি-বেসরকারি সাহায্যের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ক অনেক প্রকল্প এখনও চলছে। নতুন করে অনেক এনজিও উপকূলীয় এলাকার হতদরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য দেশে-বিদেশে ফান্ড সংগ্রহের চেষ্টা করছে। একসঙ্গে এত সংস্থা অব্যাহতভাবে কাজ করলেও উপকূলীয় এলাকার হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্যের কি পরিবর্তন হল সেদিকে দৃষ্টি দিলে হতাশার খবরই বেশি পাওয়া যায়। উপকূলীয় এলাকার হতদরিদ্র মানুষের কোনরকমে বেঁচে থাকার সংগ্রামের খবর মিডিয়ায় বারবার আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বস্ব হারানো জনগণ তাদের গৃহনির্মাণের জন্য অনুদান পেয়েছে, গৃহ তৈরিও হয়েছে। কিন্তু সেসব আবাস সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলায় সক্ষম নয়। নতুন করে সিডরের তীব্রতা নিয়ে কোন সামুদ্রিক ঝড় এলে নতুন তৈরিকৃত এসব আবাস নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তাই সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে নিজেদের সুরক্ষার জন্য এসব দরিদ্র মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রেই যেতে হবে। কিন্তু মহাবিপদ সংকেত পেয়েও নিজেদের ঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে রাজি নন, এমন মানুষের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। ভয়ানক নিয়তির কথা জেনেও ওসব মানুষ নিজেদের আবাস ছাড়তে রাজি না হওয়ার কারণ এসব দরিদ্র মানুষ বংশপরম্পরায় এমন বিত্তহীন জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে যে, নামমাত্র মূল্যের কিছু সামগ্রীর মায়া ত্যাগ করে তারা আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে রাজি হয় না। রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করছে বলেই তারা সামান্য সঞ্চয়কে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে। এ বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়েই উপকূলীয় এলাকার হতদরিদ্র মানুষের জীবনমানে পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। সামান্য সম্পদকে আঁকড়ে ধরে থাকার কারণে অতীতে অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবনমানে উলে¬খযোগ্য পরিবর্তন না এলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
সামুদ্রিক ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু মানুষ বিভিন্ন উৎসে প্রাপ্ত সাহায্যে মোটামুটি টেকসই গৃহনির্মাণে সক্ষম হলেও সেসব ভবনের মালিক ঋণের জালে এমনভাবে বন্দি হয়েছে যে, ঋণ শোধ করতে না পেরে তাদের অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কারণ টেকসই গৃহনির্মাণের শর্তে সাহায্যপ্রাপ্ত উলি¬খিত দরিদ্র মানুষগুলোকে উলে¬খযোগ্য অংকের অর্থ ঋণও করতে হয়েছে। কতদিন পর সেই ঋণ শোধ করতে সক্ষম হবেন তা তারা জানেন না। থাকার ঘর নিয়েই যাদের জীবনে এমন অনিশ্চয়তা যে, তাদের জীবনমান কত নিুমানের সহজেই অনুমান করা যায়। এরকম পরিবারের শিশুদের ভবিষ্যৎ যে তেমন সুখের হবে না তা বিস্তারিত না লিখলেও বোঝা যায়।
উপকূলীয় এলাকার হতদরিদ্র মানুষের জীবনমানে পরিবর্তন আনার জন্য দেশী-বিদেশী যেসব এনজিও কাজ করছে, সেসব সংস্থা কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছে তার জন্য মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত। কারণ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বর্তমানে আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে এখন যতটা উদ্বিগ্ন, তারা যদি বুঝতে পারে যে তাদের দেয়া অর্থ স্বচ্ছতার সঙ্গে খরচ হচ্ছে না তাহলে এক সময় তারা বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনে অবদান রাখতে যে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ বর্তমানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের প্রদেয় অর্থ স্বচ্ছতার সঙ্গে খরচ হচ্ছে কিনা সেদিকেও বিশেষ নজর দিয়ে থাকে। কাজেই আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত অনুদানগুলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারকে কঠোর নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে চলছে মহামন্দা। এ অবস্থায় উন্নত দেশগুলো আগামীতে উন্নয়নশীল দেশের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা স্বীকার করে অনুদান অব্যাহত রাখার ব্যাপারে কতটা আগ্রহী হবে, এটাও বিবেচনার বিষয়।

অতীতের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনের অভিজ্ঞতার কথা মনে রাখলে এটা সহজেই স্পষ্ট হয় যে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আগামীতে যে কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রাপ্য বুঝে নেয়ার জন্য কেবল সম্মেলন চলাকালীন বৈঠকই যথেষ্ট নয়। এর জন্য আগে থেকে বিশেষ সম্মেলনেরও প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরনের বিশেষ সম্মেলনের কথা আমি অতীতে আমার বহু প্রবন্ধে বারবার উলে¬খ করেছি। সার্ক শীর্ষ সম্মেলন এ অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য সে সুযোগটিই এনে দিয়েছিল। কিন্তু এবারের সার্র্ক সম্মেলনে সার্কভুক্ত দেশগুলো ডারবান সম্মেলন বিষয়ে বিশেষ কোন আলোচনা করেনি। অর্থাৎ ডারবান সম্মেলনে সার্কভুক্ত দেশগুলো দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কি অভিন্ন অবস্থান নেবে তা স্পষ্ট হয়নি।
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত এটা নিরূপণ করা অত্যন্ত জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের এমন কিছু ক্ষতি হয়েছে, যা কোনভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের স্বজনের এই ক্ষতি কোনভাবেই পূরণ হবে না। আর যেসব ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব সেগুলো নিরূপণ করার ক্ষেত্রেও যথাযথভাবে উদ্যোগ নেয়ার বিষয়টি দৃশ্যমান নয়।
উলে¬খিত আলোচনায় অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে কেবল সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ক্ষয়ক্ষতির একটি খণ্ডিত চিত্রই তুলে ধরা হল। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এদেশের জনসাধারণ কি ব্যাপক দুর্ভোগের শিকার তাও আলোচনা করা দরকার। এসব আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
৪.
জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে চরম দারিদ্র্যকে সমূলে উৎপাটন করা এবং ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়া। এ ক্ষেত্রে মানসম্মত শিক্ষার বিস্তার, নারীর ক্ষমতায়ন, বিভিন্ন জটিল রোগ-ব্যাধির বিরুদ্ধে জনগণকে লড়াই করতে সক্ষম করাÑ এসব লক্ষ্য অর্জনের বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মূল লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী হতদিরদ্র অনেক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা একেবারেই অপ্রতুল। বিশেষ করে যেসব দরিদ্র মানুষ বংশপরম্পরায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়, বাঘের সঙ্গে লড়াই করে সুন্দরবন থেকে সামান্য কিছু আয়-রোজগারের চেষ্টা করেÑ এসব মানুষের জীবনমানে কোন পরিবর্তন আসেনি।
উপকূলীয় এলাকার উর্বর ভূমিতে এক সময় বিভিন্ন রকম শস্য প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হতো। ২০০৭ সালে সিডরে উলে¬খিত এলাকার মাইলের পর মাইল উর্বর জমি লবণ পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ফলে সেগুলো স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। সিডরের পর সেসব এলাকার শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত উর্বর জমিগুলোর বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও অনাবাদি জমি হিসেবে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। গত কয়েক বছরের চেষ্টার পরও এখনও কোন কোন এলাকায় প্রায় ৫০% জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। সেখানে কিছু কিছু জায়গায় চিংড়ি চাষের চেষ্টা করা হলেও তা ওই এলাকার মধ্যবিত্ত, নিুমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের জীবনযাপনে ভূমিকা রাখতে পারছে না। আর হতদরিদ্র উলে¬খযোগ্যসংখ্যক মানুষ সিডরের পরপরই এলাকা ছেড়ে নিকটবর্তী কিংবা দূরবর্তী শহরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে নিজেদের ভিটাবাড়ি ও জমি আরও অরক্ষিত হয়ে পড়বেÑ এ আতংকে অনেক মধ্যবিত্ত পৈতৃক ভিটা বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে। উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার হতদরিদ্র মানুষ বংশপরম্পরায় কখনও কখনও সমুদ্রের প্রতিকূল আবহাওয়াকেও উপেক্ষা করে মাছ ধরার জন্য গভীর সমুদ্রে গমন করে। সমুদ্রের ভয়াবহতাকে তারা জয় করার চেষ্টা করলেও বংশপরম্পরায় তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। উপকূলীয় এলাকার যেসব মানুষ মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয় তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া দরকার। অতীতে বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়ার পরও কেন কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া গেল না, সে বিষয়েও গষেণা হওয়া দরকার।
উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী হতদরিদ্র মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তনে নানারকম উদ্যোগ নেয়ার পরও তাদের জীবনের তেমন কোন উলে¬খযোগ্য পরিবর্তন না আসার অন্যতম কারণ তারা কখনোই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়নি। যদি তারা শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ পেত তাহলে তারা স্বউদ্যোগে নিজেদের অনেক সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হতো। কাজেই এসব দরিদ্র মানুষের জীবনে উলে¬খযোগ্য পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার সুব্যবস্থাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নিতে হবে।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক যুগান্তর


মানবমুক্তির সাধনায় দুই মহীয়সী
বদিউর রহমান
মানুষ আর মানবতার মুক্তি সাধনায় আজীবন সংগ্রাম করে যারা আমাদের মানবমুক্তি তথা মানবতার পথ দেখিয়েছেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য দুই মহীয়সী, মনোরমা বসু আর সুফিয়া কামাল।
এই দু’জনকেই আমরা স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায়। মনোরমা বসুর জš§ ১৮ নভেম্বর আর সুফিয়া কামালের মৃত্যু ২০ নভেম্বর। জš§-মৃত্যুর মোহনায় এই দুই মহীয়সী আমাদের সামনে চলার শক্তি জোগান, নতুন পথের দিশা দেন; বর্তমান বাংলাদেশের প্রতিদিনের চলার পথে গভীর অমানিশা আর আঁধারের শত কুজ্ঝটিকা ছিন্ন করে নতুন প্রত্যয়ে উজ্জীবিত হবার সাহস জোগান।
মনোরমা বসু (১৮৯৭-১৯৮৬) আর সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯) প্রায় একই সময়ের মানুষ। বেঁচেও ছিলেন একই রকম, একজন ৮৯ বছর আর একজন ৮৮ বছর। একজন সাধারণ গরিব ঘরে জšে§ হয়ে উঠেছিলেন জমিদার গৃহিণী; আর একজন তো জমিদার কন্যা। দু’জনেরই জš§ একই জেলায়, বরিশালে। জীবনের অনেকটা সময়ও কাটিয়েছেন এরা বরিশাল শহরে। তবে ভিন্ন পরিবেশে।
জš§ এদের শহরে নয় গ্রামে; একজনের বানারীপাড়া থানার নরোত্তমপুর গ্রামে আর একজনের সদরের শায়েস্তাবাদ গ্রামে। লেখা-পড়া কারোরই তেমন হয়ে ওঠেনি; মনোরমার হয়নি কঠিন দারিদ্র্যের কারণে আর সুফিয়ার পারিবারিক রক্ষণশীলতার জন্যে। দু’জনেরই বাল্যবিবাহ; মনোরমার তের বছরে আর সুফিয়ার বারো বছরে। বিয়ের পর মনোরমা হন মনোরমা বসু; সুফিয়া প্রথমে সুফিয়া এন হোসেন এবং পরে সুফিয়া কামাল। মনোরমা বসু প্রথম সন্তানের মা হন ১৯১৩-তে ১৫ বছর বয়সে; সুফিয়া হন ১৯২৬-এ ঠিক ওই ১৫ বছর বয়সেই।
তাদের ব্যক্তি জীবনের এই মিলের ধারা অব্যাহত থাকে আজীবনের কর্মকাণ্ডে এবং আদর্শের ক্ষেত্রে; আর তা অব্যাহত রয়েছে আমৃত্যু। এরা কেউই নিজের বা সংসারে জীবিকার জন্য কোনো কাজ করেননি; কাজ করেছেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। কাকতালীয় হলেও সত্যি, দু’জনের আজীবনের এই কর্মকাণ্ডের সূচনা বা গ্রন্থিমোচন হয়েছিল একই বিন্দু থেকে। 

১৯২৫, স্বদেশী আন্দোলনে উš§াতাল সারাভারতবর্ষ। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ এবং বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে সবার আগে বরিশাল। নেতৃত্বে মহাÍা অশ্বিনীকুমার দত্ত। তার সঙ্গে অনেকে, ছিলেন চারণকবি মুকুন্দদাস। ১৯০৬-এ বরিশালে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন। যে সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ভারতবর্ষের জাতীযতাবাদী নেতৃবৃন্দ। ক্রমে বরিশাল হয়ে ওঠে অসহযোগ ও খেলাফত মহাÍা গান্ধী এবং মাওলানা মোহাম্মদ আলী বরিশাল আসেন বাংলা ১৩২৮ সনের ২২ ভাদ্র। মহাÍা গান্ধী দ্বিতীয়বার বরিশাল আসেন ১৯২৫-এর ১৪ জুন। মনোরমা বসু তখন ২৮ বছরের পাকা জমিদার গৃহিণী, চার সন্তানের জননী আর সুফিয়া এন হোসেন সদ্য বিবাহিতা বালিকা বধূ। হিসেবে বয়সের ফারাক যথেষ্ট; ২৮ আর ১৪। কিন্তু এরই মধ্যে লক্ষ্য স্থির। মহাÍাকে দেখার আগ্রহ বয়সের সীমা মানে না। ৪ সন্তানের জননী ২ বছর বয়সী ছোট সন্তানকে রেখে জমিদার গৃহিণী প্রায় ২২ মাইল পথ পারি দিয়ে বরিশাল যাবেন মহাÍাকে দেখতে। তার জন্য কত আয়োজন। সংসার সামলানো, পাড়ায় পাড়ায় যোগাযোগ করে মেয়ে জোগাড় করা; কারণ, যেতে হবে দলবেঁধে। অন্যদিকে বালিকা বধূ সুফিয়ার প্রস্তুতি আর এক রকম; গান্ধীজীর হাতে তুলে দিতে হবে নিজের হাতে চরকায় তোলা সুতা। যে যার মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারোর সঙ্গে কারোর যোগাযোগ নেই, দেখা নেই, চেনাজানা নেই। কিন্তু কোথায় যেন বিনে সুতার মালার মতো গাঁথা হতে থাকে এক মিলনমালা।
১৪ জুন ১৯২৫ মহাÍা গান্ধী খুলনার পথে বরিশাল আসেন স্টিমারযোগে। স্টিমার ঘাটে সংবর্ধনা জানান অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি শরৎ গুপ্ত এবং সম্পাদক সতীন্দ্রনাথ সেন। বিকেলে জনসভা। অসংখ্য মানুষের সমাবেশে মেয়েদের জন্য নির্ধারিত স্থানে যার যার মতো বসে জমিদার গৃহিণী মনোরমা বসু আর বালিকা বধূ সুফিয়া এন হোসেন। এত বড় সমাবেশে সকলের সঙ্গে মিশে জমিদার গৃহিণী মনোরম যেন সকলেরই একজন হয়ে ওঠেন। মহাÍা গান্ধী তার বক্তৃতার এক পর্যায় আন্দোলনÑতহবিলে সাহায্যের আহ্বান জানালেন। সঙ্গে সঙ্গে ছোটখাটো কালো এক মেয়ে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে থাকা অর্থাৎ পরে আসা স্বর্ণালঙ্কার দান করলেন আন্দোলন তহবিলে। ক্ষণিকের জন্য হলেও হাজারো দর্শক-স্রোতার দৃষ্টি মঞ্চ থেকে এবার এই বেঁটে মেয়েটির দিকে। তাকে দেখে অনেকে দান করলেন আন্দোলন তহবিলে। এই কালো মেয়েই জমিদার গৃহিণী মনোরমা বসু। আর সুফিয়া এন হোসেন মঞ্চে উঠে স্বয়ং মাহাÍাজীর হাতে তুলে দিলেন তার নিজ হাতে চরকায় কাটা সুতা। এ সুতার সূত্র ধরেই আজীবন পথ চলেছেন সুফিয়া কামাল।
অন্যদিকে এর ২০ বছর আগে আর এক সুতার বন্ধনের সূত্র ধরে পথ চলা শুরু করেছিলেন মনোরমা বসু। সেদিন ছিল ১৯০৫-এর ১৬ অক্টোবর বাংলা ৩০ আশ্বিন, বঙ্গভঙ্গ আইন পাসের দিন। প্রতিবাদে দেশব্যাপী জাতীয় আন্দোলনের ডাক। বঙ্গদর্শন-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘোষণা; ‘আগামী ৩০ আশ্বিন বাংলাদেশ আইনের দ্বারা খণ্ডিত হইবে। কিন্তু ঈশ্বর যে বাঙালিকে বিচ্ছিন্ন করে নাই, তাহাই বিশেষরূপে স্মরণ ও প্রচার করিবার জন্য সেই দিনকে আমরা বাঙালির রাখী-বন্ধনের দিন করিয়া পরস্পরের হাতে হরিদ্রা বর্ণের সুতা বাঁধিয়া দিব। রাখী বন্ধনের মন্ত্রটি এই; ভাই ভাই এক ঠাঁই।’ এই দিন বাঙালি পরিবার অ-রন্ধন পালন করে এবং উপবাসে চিত্তশুদ্ধি করে। কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে নগ্ন পদে শোভাযাত্রা বের হয়। কলকাতার বিভিন্ন এলাকা থেকে আরো অসংখ্য শোভাযাত্রা এসে মিলিত হয় ভাগীরথী নদী তীরে। সেই মিলন সমাবেশে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের হাতে স্বদেশী কার্পাস বা হলুদ ছোপানো রেশমের সুতা দিয়ে রাখীবন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ সমস্বরে প্রতিধ্বনিত হয় ভাগীরথীর তীর থেকে সারাবাংলায়। তারই ঢেউ এসে লাগে বরিশালের বানারীপাড়ার নরোত্তমপুর গ্রামে। এই গ্রামের দরিদ্র রায় বাড়ির ৮ বছরের কিশোরী মনোরমাও সেদিন হলুদ সুতার রাখী বেঁধে দীক্ষা নেয় স্বদেশী মন্ত্রে।  সেদিন মনোরমার কিশোরী মনে যে বীজ মন্ত্র রোপিত হয়েছিল তার সূত্র ধরেই আজীবন পথ চলেছেন মনোরমা রায় পরে মনোরমা বসু। ৩ বছরের মাথায় (১৯০৮) বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসি হলে মনোরমার মনে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এর ৩ বছর পর ১৯১১-তে মনোরমার বিয়ে হয় বাঁকাইর জমিদার বাড়ির বিপতœীক চিন্তাহরণ বসুর সঙ্গে। বিয়ের পর বেশ কয়েক বছর তিনি কাটান সংসার-কাজে, ছেলেমেয়েদের লালন পালনে। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট থাকার মেয়ে নন মনোরমা। তিনি চাইলেন জমিদার বাড়ির সকল বাধা অতিক্রম করে বাইরে বেরিয়ে আসতে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাÍ হতে। জমিদার গৃহিণী মনোরমা সকল সংকোচ দু’পায়ে ঠেলে বেরিয়ে পড়লেন জমিদার বাড়ির প্রাচীর ডিঙিয়ে। সংগঠিত করলেন গ্রামের মেয়ে আর কুল-বধূদের, গড়ে তুললেন মহিলা সমিতি। ইতোমধ্যে কারো  বৌদি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছেন তিনি। যে সময়ে বাঁকাই জমিদারবাড়ির কোনো মেয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন না। সেই সময় জমিদার গৃহিণী মনোরমা গ্রামে ঘুরে চাঁদা সংগ্রহ করেছেন মহিলার সমিতির জন্য । সেই চাঁদার টাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দুস্থ মেয়েদের জন্য সেলাইসহ অর্থকরী অন্যান্য ছোটখাটো কাজের কেন্দ্র। এভাবেই তার সংগঠন গড়ার কাজ শুরু হয়েছিল বাঁকাইর গ্রাম থেকে। ক্রমে তারই হাতে গড়া মহিলা সমিতির কাজের ধারা গেল বদলে। সেলাই ফোঁড়াইর স্থান দখল করে নিল চরকা আর তাঁত।
ওদিকে ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। তাদের মানুষ করতে হবে, লেখাপড়া শেখাতে হবে। স্থির করলেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে শহরে যেতে হবে। বসু পরিবার এসে ঘর বাঁধল বরিশাল শহরের কাউনিয়া সড়কে। অচিরেই মনোরমা বসু জড়িয়ে পড়লেন কংগ্রেসের মহিলা সমিতির কাজে। দেখতে দেখতে হয়ে উঠলেন কংগ্রেসের মহিলা সমিতির মধ্যমণি, সকলের প্রিয় মনোরমাদি। এর মধ্যে শুরু হয়ে গেল আইন অমান্য আন্দোলন। ১৯৩০-এ কংগ্রেসের একজন একনিষ্ঠ কর্মী তিনি। নেমে গেলেন জনতার কাতারে; আন্দোলনে, পিকেটিং-মিছিলে, লাটিচার্জের সামনের সবশেষে জেলে। শাস্তির মেয়াদ শেষে বেরিয়ে এলেন জেলখাটা স্বদেশী মেয়ে গৃহবধূ মনোরমা বসু। সংগঠনের চেতনা যার শিরায় শিরায়, তিনি কি চুপ করে বসে থাকতে পারেন? নিজের ঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে নিজের মেয়েসহ আরো পাঁচটি মেয়েকে নিয়ে পড়াতে বসে গেলেন মনোরমা। জমিদার গৃহিণী থেকে শিক্ষিকা। দেখতে দেখতে মেয়ের সংখ্যা বেড়ে গেল। মুষ্টি-ভিক্ষার ঘট বসানো হলো বাড়ি বাড়ি। এভাবে সংগৃহীত অর্থ আর মনোরমা বসুর গলার হার বিক্রি করা টাকার গড়ে তুললেন ‘মাতৃমন্দির’। টিনের চালা ঘরে শুরু হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৩৩-৩৪ এ এক নতুন দিগন্তের উšে§াচন হলো মাতৃমন্দির সমাজের নিষ্ঠুর বিধানে, ভাগ্যের অভিশাপে যে মেয়েরা সমাজ পরিত্যক্তা, তাদের নিয়ে গড়ে তুললেন আশ্রম, ‘মাতৃমন্দির আশ্রম’। কলঙ্কের ভয়ে যাদের কেউ স্থান দেয় না, পরম আদরে মাতৃøেহে তাদের কোলে টেনে নিলেন জমিদার গৃহিণী মনোরমা বসু। এরই মধ্যে রাজনৈতিক ইতিহাস এসেছে নতুন চেতনা, সমাজতন্ত্র ছাড়া শোষণের আবসান আর মানবতার মুক্তি সম্ভব নয়। মনোরমা বসুও ক্রমশ দীক্ষিত হলেন মানবমুক্তির সেই মহামন্ত্রে। একাÍ হলেন কাউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে।
১৯৪০ থেকে ১৯৪৭-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর সংকট মোকাবিলায় মাসিমা নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন নানা আন্দোলন ও সংগঠনের কাজে। ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর সময় ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কর্মকাণ্ডে আÍনিয়োগ করেছেন। খাদ্যবস্ত্রের দাবিতে দুস্থ বুভুক্ষু মেয়ে-পুরুষের মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। লঙ্গরখানা পরিচালনা করেছেন। ত্রাণসামগ্রী ও অর্থসংগ্রহ করেছেন, খাদ্যের কিউতে ও মেডিকেল রিলিফ কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবিকার কাজ করেছেন। আশ্রয়চ্যুতা মেয়েদের পুনর্বাসনের জন্য গড়ে তুলেছেন ‘নারীকল্যাণ ভবন’। তখন বরিশাল শহর ও আশপাশের গ্রামগুলো ছিল তার কর্মস্থল। দূরের গ্রামে গ্রামে কৃষক গৃহবধূ ও মেয়েদের সংগঠিত করার কাজও তিনি করেছেন। যুদ্ধোত্তরকালে সাম্র্যজ্যবাদবিরোধী প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে, সভা-মিছিল ধর্মঘট হরতাল সামনের সারিতে থেকেছেন ঋজু হয়ে। সাম্প্রদায়িক শান্তিরক্ষা আন্দোলন ও দাঙ্গাদুর্গতদের সেরায় সক্রিয় অংশ নিয়েছেন তিনি।
বরিশাল জেলা মহিলা আÍরক্ষা সমিতির সভানেত্রী, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও সংগঠনের দায়িত্ব তিনি সুষ্ঠুভাবে পালন করেছেন একই সঙ্গে। কাজের মধ্যে দিয়ে শ্রদ্ধা সম্ভাষণে হয়ে উঠেছেন সকলের মাসিমা। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ মাসিমাকে স্বস্তি দিতে পারেনি। ১৯৪৮-এর ৫ জুন বরিশালে খাদ্য আন্দোলন গ্রেফতার হয়ে হাজত বাস, এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং নিরাপত্তা বন্দীদশায় পর মুক্তি পেলেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পরে।
ইতোমধ্যে দেশ বিভাগ এবং সাম্প্রদায়িতায় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান এবং মুসলিম লীগ শাসনের দমনপীড়নে তার নিজের ঘর ও পরিবার ভেঙে যায়। জেল থেকে বেরিয়ে দেখলেন তার সাধের মাতৃমন্দির, আদর্শ বিদ্যালয়, অনাথ আশ্রম কোনোকিছুরই চিহ্নমাত্র নেই। প্রতিক্রিয়াশীল চক্র চরম আঘাত হেনেছে এসবের ওপর। দৃঢ় মনোবল নিয়ে আবার সব কিছু গুছিয়ে নিতে যখন কাজে নামলেন, ১৯৫৪-র ১০ মে মারা গেলেন তার স্বামী চিন্তাহরণ বসু। এর কিছুদিন পর ৯৩ ধারার গভর্নর শাসন জারি হলে আবার তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা। আর গ্রেফতারবরণ নয়, শুরু হলো পলাতক জীবন। দেড় বছরের পলাতক জীবনে আÍনিয়োগ করলেন গ্রামে গ্রামে বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষদের জীবনের সঙ্গে মিশে থেকে তাদের সংগঠিত করার কাজে।
প্রদেশে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার এর অন্যদের সঙ্গে মাসিমার ওপর থেকেও গ্রেফতারি পরোয়ানা উঠে গেলে আবার ফিরে এলেন গ্রাম থেকে বরিশাল শহরে। নিজের বাড়িতে। তার চেষ্টায় আবার গড়ে উঠলো ‘মাতৃমন্দির’ ও আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়। এবার মাসিমার নতুন উদ্যোগ, প্রতিষ্ঠা করলেন ‘পল্লীকল্যাণ অমৃত পাঠাগার (শহীদ অমৃত নাগের নামে) আর শিশুদের সংগঠিত করার জন্য ‘মুকুল মিলন খেলাঘর’। মাসিমা চিরজীবন সবশক্তি দিয়ে গড়ে তুলেছেন সংগঠনের পর সংগঠন। আর তার সঙ্গে এসেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে। ১৯৫৮-এর সামরিক শাসন জারির পর ১৯৬২ ও ৬৭-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে কখনো নিজেকে তিনি সরিয়ে রাখেননি। কখনো মহিলাদের সংগঠন, কখনো মিছিলের পুরোভাগে, আবার কখনো সভামঞ্চে মাসিমা ছিলেন সদাব্যস্ত। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে প্রগতিশীল প্রার্থীদের পক্ষে তিনি বহু দূর-দূরান্ত ঘুরে প্রচার চালিয়েছেন। ’৭১-এর মুক্তিমুদ্ধের সময়ে জুন মাসে ওপারে গিয়ে আÍনিয়োগ করেছেন মুক্তিমুদ্ধে স্বপক্ষে লোকবল ও সম্পদ সংগ্রহ এবং নারী সমাজকে সংগঠিত করার কাজে। স্বাধীনতার পরেই দেশে ফিরে এসে আবার তার সাধের মাতৃমন্দির প্রাথমিক বিদ্যালয়, অমৃত পাঠাগার, খেলাঘর ইত্যাদি পুনর্গঠনের কাজে নেমে পড়েছেন। গড়ে তুলেছেন নতুন সংগঠন ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’-এর বরিশাল জেলা শাখা। মৃতুর পূর্ব পর্যন্ত যতটুকু শারীরিক ও মানসিক কর্মক্ষমতা ছিল, তা সবই বিলিয়ে দিয়েছেন নানা সাংগঠনিক তৎপরতায়। প্রথম যৌবনে সংগঠন গড়ার কাজ শুরু করেছিলেন, আমরণ তিনি তার প্রিয় সংগঠনগুলোকে আঁকড়ে থেকেছেন। দীর্ঘ জীবনে তিনি বহু বিচিত্র সংগঠন গড়তে গিয়ে কখনো পিছু পা হননি ব্যর্থ হননি। ১৯০৫-এ রাখি বন্ধেনের হলুদ সুতার দীক্ষার পর দীর্ঘ প্রায় ৮০ বছর মনোরমা বসু কাজ করেছেন মানুষের মধ্যে মানুষের সঙ্গে। আর ১৯২৫-এ নিজের হাতে কাটা সুতা গান্ধীজীর হাতে তুলে দিয়ে সুফিয়া কামাল যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা থেকে তিনি এক দিনের জন্যও দূরে সরে যাননি। আমৃত্যু ধারণ করেছেন তার আদর্শ ‘মানুষের ভালোবাসি’। ১৪ বছর বয়সে সুফিয়া এন হোসেন যুক্ত হন বরিশাল মহিলা মাতৃমঙ্গলের সঙ্গে। মহিলা মাতৃমঙ্গলে তিনিই ছিলেন প্রথম এবং একমাত্র মুসলমান সদস্য। এর পরই তিনি স্বামীর সঙ্গে কলকাতা চলে যান।
কাজী নজরুল ইসলামের দুঃসময়ে তাকে সাহায্যের জন্য সওগাত সম্পাদককে চিঠি (১৯২৭) সালে আঞ্জুমানে খাওয়াতীন’র সদস্য হয়ে (১৯২৯) আÍমানবতার সেবায় আÍনিয়োগ ইন্ডিয়ান উইমেন্স ফেডারেশনে সদস্য হয়ে (১৯৩১) সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কলকাতা লেডি ব্রাবোন কলেজে আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা (১৯৪৬) মুকুল ফৌজ সংগঠকদের সঙ্গে কংগ্রেস এক্সজিবিশন পার্কে ‘রোকেয়া মেমোরিয়াল স্কুল’ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন সুফিয়া। তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত মুসলমানদের প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন কিছুদিন। এরই মধ্যে ঘটে এক বিপর্যয়। স্বামী নেহাল হোসেন মারা যান ১৯৩২-এ। এর সাত বছর পর বিয়ে করেন কামাল উদ্দিন খানকে (১৯৩৯)। পরিচিত হন সুফিয়া কামাল নামে। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর ঢাকা এসে প্রথমেই পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নেন (১৯৪৮)। পঞ্চাশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ত্রাণ কাজে আÍনিয়োগ করেন। ক্রমে ভাষা আন্দোলন এগিয়ে এলে সুফিয়া কামাল এর সঙ্গে যুক্ত হন। ঢাকায় মহিলাদের সংগঠিত করে মিছিলের আয়োজন করেন (১৯৫২)। এ বছরই পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ তে গড়ে তোলেন ‘ওয়ারি মহিলা সমিতি’; দায়িত্ব নেন সভাপতির। পরের বছর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ঢাকার রাজপথে মহিলাদের প্রথম ঘেরাও আন্দোলন সংগঠিত করে নেতৃত্ব দেন সুফিয়া কামাল। শিশু-কিশোরদের সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে ঢাকার তারাবাগে নিজ বাসভবন চত্বরে সভা আহ্বান করে গড়ে তোলেন শিশু সংগঠন ‘কচি কাঁচার  মেলা’ (১৯৫৬)। ১৯৬০-এ ঢাকায় গড়ে তোলেন ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত স্মৃতি কমিটি।’ এই সংগঠনের মাধ্যমেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রীনিবাসের নাম  রোকেয়া হল করার প্রস্তাব দেন। রবীন্দ্র জš§শতবর্ষ উৎযাপন কমিটি গঠন এবং এর সভাপতির দায়িত্ব নেন এ একই বছর। পরের বছর সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ প্রতিষ্ঠিত হলে সুফিয়া কামাল এর সভাপতির দায়িত্ব নেন। এ বছরই (১৯৬১) পাকিস্তান সরকার তাকে ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ পদক দেয়। ১৯৬৫ তে সুফিয়া কামাল ‘নারীকল্যাণ সংস্থা’ এবং ‘পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি’র সভাপতির দায়িত্ব নেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সুফিয়া কামাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের উদ্দেশ্যে গঠিত ‘মহিলা সংগ্রাম কমিটি’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং ঢাকায় মহিলা সমাবেশে সভপতিত্বে এবং মিছিলে নেতৃত্ব দেন। আইয়ুব সরকারের নিপীড়নের প্রতিবাদে তাকে দেয়া ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ পদক প্রত্যাখ্যান করেন (১৯৬৯) । ১৯৭০-এ ‘মহিলা পরিষদ’ গঠিত হলে তিনি এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু তিনি মহিলা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ বছরই তিনি ‘সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’র সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১-এর মার্চ মাসে ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে মহিলাদের সমাবেশ ও মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ঢাকার ধানমণ্ডির নিজ বাড়িতে থেকে সাধ্যমতো মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন। দেশ স্বাধীনের পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রথম জনসভায় সভাপতিত্ব এবং প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন সুফিয়া কামাল। ১৯৭২-এ ‘দুস্থ পুনর্বাসন সংস্থা’ গঠন করে এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সুফিয়া কামাল। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু নিহত হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এরপর স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৮২ তে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ গঠিত হলে তিনি এর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আজীবন এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮তে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হলে সুফিয়া কামাল এর সভাপতি হন।
১৯৯০-এ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কার্ফুর মধ্যে প্রতিবাদী মৌন মিছিলে নেতৃত্ব দেন সুফিয়া কামাল। আজীবন সংগ্রামী এই মহান মানুষটি মুহূর্তের জন্য প্রগতির পথ থেকে বিচ্যুত হননি; বরং সাহসের সঙ্গে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়েছেন সকল আচার, কলুষতা আর পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে। পথ দেখিয়েছেন সাহসের সঙ্গে সামনে চলার। সমাজ-সংগ্রামের হাজারো কাজের মধ্যে সুফিয়া কামাল লিখেছেন অজস্র। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫ লাখ। লেখার জন্য পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। দীর্ঘ দিনের বিপ্লব-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সুফিয়া কামাল ক্রমে সুফিয়া আপা, সুফিয়া খালা এবং শেষে কেবল ‘খালামম্মায় পরিণত হন। ১৯০৫-এর পর দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আবার যে দুই তরী একই ঘাটে ভিড়বে তা সেদিনকে বুঝেছিল? বাস্তবে এরকমটিই ঘটেছে। ১৯৩২-৩৩-এর দিকে মনোরমা বসু সোভিয়েত সুহƒদ সমিতি গঠন করে এর সভাপতি হন আর সুফিয়া কামাল পাক সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির সভাপতি হন ১৯৬৫তে ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ গঠিত হলে সুফিয়া কামাল হন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আর মনোরমা বসু বরিশাল জিলা শাখার সভাপতি। দু’জনই আমৃত্যু পালন করেছেন এই সভাপতির দায়িত্ব। এই দুই আপসহীন আজীবন সংগ্রামী মানবতাবাদী নেতার কথা স্মরণ করে আমরা গর্বিত হই, অহঙ্কারী হই। যে গর্ব করে অহংকার আমাদের সামনে চলার পথ দেখায়, ঋজু হয়ে দাঁড়াতে শেখায়, অন্ধকারের কুজ্ঝটিকা ভেদ করার আলো জোগায়। এই দুই আলোকবর্তিকার আলোর শিখায় বাংলার আঁধার একদিন ঘুচবেই। বাঙালি তার চিরায়ত মুক্ত মন আÍমনন নিয়ে সামনে এগোবে; মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে জগৎ সভায়। 

 সময়ের চাহিদায় আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় 
নিজস্ব প্রতিবেদক
উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবোজ্জল ইতিহাস। জ্ঞান বিতরণের এক মহীরুহ হিসেবে সকল সমাজে আজ এ বিদ্যায়তনটির ব্যাপক সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। কালের চাহিদায় আজকের এই বিশ্ববিদ্যালয়টির উত্থান পাঠশালা থেকে।
জন্ম ইতিহাস
১৮৬৮ সালে শিক্ষানুরাগী কিশোরী লাল রায় চৌধুরী তার বাবা জগন্নাথ রায় চৌধুরী তার নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
তখন এটা ঢাকাবাসীর কাছে জগন্নাথ বাবুর পাঠশালা বলেই সমধিক পরিচিতি লাভ করে। পরে একই অঞ্চলে পূর্বেই প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুল জগন্নাথ স্কুলের পরিচিতির সাথে একাতœ হয়ে যায়। অল্পদিনের মধ্যেই স্কুলটি ব্যাপক সুনাম অর্জন করে। পঞ্চম  বছরে পা রাখা এ বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ কলেজ হিসেবে যখন যাত্রা শুরু করে তখন তার ছাত্রসংখ্যা ছিল ৪৮। কিন্তু কলেজ দ্রুত উন্নতি লাভ করায় মাত্র পাঁচ বছরে, অর্থাৎ ১৮৮৯ সালে ছাত্রসংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯৬-এ। ১৯১০ সালের আগেই জগন্নাথ কলেজের ছাত্রসংখ্যা ৫০০-তে পৌঁছে এবং তখনই এ কলেজে আইএ, আইএসসি, বিএ পাস ছাড়াও ইংরেজি, দর্শন ও সংস্কৃতিতে অনার্স এবং ইংরেজিতে এমএ পড়ানো হতো। ব্রাহ্ম স্কুল থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের। পরে ব্রাহ্ম স্কুলটি বছর দশেক চলার পর তার বিলুপ্তি ঘটিয়ে জগন্নাথ স্কুলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। ১৮৬৮ সালে জগন্নাথ রায় চৌধুরী জগন্নাথ স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রথম ভারতীয় প্রিভি কাউন্সিলর স্যার কে জি গুপ্ত, ঢাকা কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম ভারতীয় প্রিন্সিপাল ড. পি কে রায়, পশ্চিমবঙ্গের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী ড. প্রফুল¬ চন্দ্র ঘোষ এবং বিখ্যাত রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান এ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। মরহুম আতাউর রহমান খান জগন্নাথ কলেজেরও ছাত্র ছিলেন। তাই স্কুলের প্রসারে অনুপ্রাণিত হয়ে জগন্নাথ রায় চৌধুরীর পুত্র কিশোরীলাল রায় চৌধুরী একে কলেজে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আইনের ক্লাস চালানোর সিদ্ধান্ত সহ কিশোরীলালের অনাথ বন্ধু মলি¬ক, বিখ্যাত আইনজীবী ত্রৈলোক্যনাথ বসু ও বিচারপতি সারদাচরণ মৈত্র এদের চেষ্টায় ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে জগন্নাথ স্কুলটিকে কলেজে রূপান্তর করা হয়।
১৮৮৭ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ স্কুল এবং কলেজ একই প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের অধীনে চলছিল। পরে শিক্ষা বিভাগের নির্দেশে পৃথকভাবে স্কুল( বর্তমানে পুরনো ঢাকার নর্থব্রক হল রোডের কেএল জুবিলী স্কুল) ও কলেজ পৃথক করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মাত্র ৪৮ জন শিক্ষাথী নিয়ে যাত্র শুরু করে জগন্নাথ কলেজ।
 ১৮৮৯ সালে ছাত্রসংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯৬-এ। ১৯১০ সালের আগেই জগন্নাথ কলেজের ছাত্রসংখ্যা ৫০০-তে পৌঁছে। যা তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে বিরাট। এই কলেজে তখন আইএ, আইএসসি, বিএ পাস ছাড়াও ইংরেজি, দর্শন ও সংস্কৃতিতে অনার্স এবং ইংরেজিতে এমএ পড়ানো হতো।
নিজের অন্যান্য জনকল্যাণ কাজের ব্যস্ততার কারণে এবং কলেজের কলেবর বাড়ার কারনে ১৯০৭ সালের ১ মার্চ একটি ট্রাস্ট দলিলের মাধ্যমে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে সেই বোর্ডের হাতে কলেজের ভার অর্পণ করেন।এ বোর্ডে কিশোরীলাল ছাড়াও অন্য যে দু'জন সদস্য ছিলেন তারাা হলেন রায় চন্দ্রকুমার দত্ত বাহাদুর এবং আনন্দ চন্দ্র রায়। ১৯০৯ সালের ৩ জুন কিশোরীলাল মৃত্যবরণ করলে নতুন করে ট্রাস্ট দলিল সম্পাদিত হয় ১৯০৯ সালের ২৪ আগস্ট। এই ট্রাস্টি বোর্ডের যারা সদস্য ছিলেন তারা হলেন রায় চন্দ্রকুমার বাহাদুর, আনন্দ চন্দ্র রায়, যশোদালাল চৌধুরী, কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ও দীনেশ চন্দ্র রায়। এ সময় কলেজকে আর্থিক সাহায্য করেন স্যার রবার্ট নাথান (ঢাকার কমিশনার), এইচ লি মেসুরিয়ার ও বোনাম কার্টার। তাদের আনুকূল্যে কলেজ এ সময় ৮০ হাজার টাকার অনুদান লাভ করে। এই অর্থ দ্বারা নির্মিত হয় জগন্নাথ কলেজের বর্তমান মূল প্রশাসনিক ভবনটি। এরপর ১৯৬৮ সালের আগপর্যন্ত বেসরকারি কলেজ হিসেবে উপমহাদেশে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে জগন্নাথ কলেজের। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার পূর্ববাংলার সবচেয়ে প্রাচীন এ বিদ্যাপীঠকে সরকারি কলেজের মর্যাদা দেয়। তারপর বহু পথপরিক্রমার পর ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে আইন পাস আর একই বছরের ২০ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে শতবর্ষের পুরনো এ বিদ্যাপীঠ পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।
আগামীকাল মঙ্গলবার ২০ অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস। চার বছর আগে পথচলা শুরু হলেও জন্মদিনই পালন করা হয়নি প্রতিষ্ঠানটির। পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরুর পর সম্ভাব্য চারটি প্রতিষ্ঠা দিবস নিয়ে কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক এবং ছাত্রসংগঠনের নেতারা বিভক্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তী সময়ে চলতি বছরের ১৪ জুলাই সম্ভাব্য চারটি প্রতিষ্ঠা দিবস নিয়ে আলোচনার জন্য সিন্ডিকেটের এক সভা আহ্বান করা হয়। সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০ অক্টোবর সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আইন পাসের দিনটিই নির্ধারণ করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে। 

সংগঠন সমূহ
সাংবাদিক সমিতি, বাঁধন, বিএনসিসি, রোভার স্কাউট,রেঞ্জার, , উদীচি শিল্পী গোষ্ঠী, বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার, আবৃতি সংসদ, জবি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ডিবেটিং সোসাইটি, এছাড়াও ২৮টি বিভাগের নিজস্ব কিছু সংগঠন রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার
এ গ্রন্থাগারটির রয়েছে ঘটনা বহুল ইতিহাস। স্বাধীনতার আগে তৎকালীন জগন্নথ কলেজ থাকার সময়ে এটি সমুদ্ধশালী গ্রন্থাগার ছিলো। ১৯২১ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা ৫০ ভাগ বই দিয়ে সাজানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী কলেজ ক্যাস্পাসে ক্যাম্প গড়ে তোলে। তখন পাক সেনারা এ গ্রন্থাগারের বইকে লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করত বলে জানাযায়। সে সময় অনেক মূল্যেবান বই নষ্ট করে ফেলে পাকা সেনারা। ১৯৭৫ সালের হিসেব মতে গ্রন্থাগারে বই ছিলো প্রায় ৪০ হাজার। বিভিন্ন সময়ে কিছু বই খোয়া যাওয়ায় বর্তমানে গ্রন্থাগারে ১৯ হাজার বই রয়েছে। সর্বশেষ ২০০৬ সালে  ১১ নভেম্বর পুরাতন গ্রন্থাগার ভবন ভেঙ্গ ২০ তলা ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সে সময় দু’বছর গ্রন্থাগারের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ২০০৮ সালের অক্টোবরে নতুন ভবনের ৭ তলার কাজ শেষ হলে ৬ তলায় গ্রন্থাগারটি পুনরায় চালু করা হয়। গ্রন্থাগারটিকে সাজানো হয়েছে তিনটি ভাগে। কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের অধ্যায়নের জন্য একটি বড় কক্ষ রাখা হয়েছে। বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা। এছাড়াও খোলা হয়েছে একটি রেফারেন্স কক্ষ। তবে কলেজ থাকাকালী গ্রন্থাগারের যে বই ছিলো সেগুলো দিয়েই চলানো হচ্ছে গ্রন্থাগার। ২৩ হাজার শিক্ষার্থী থাকলেও বসার জন্য আসন রয়েছে ১শ ৩০ টি। অপরিবল্পিত ভাবে কক্ষগুলো তৈরী করায় বিদুৎ গেলে অন্ধকার হয়ে কক্ষগুলো। ফটোকপি মেশিন না থাকায় গুরুত্বপূণ কোন কিছু শিক্ষার্থীরা কপি করতে পারে না। প্রতিদিন সহস্রাধিক শিক্ষার্থী  গ্রন্থাগারে পড়াশুনা করতে গিয়েও প্রয়োজনীয় বই না পেয়ে ফিরে আসে।
জবিতে ২৩ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য দ্বিতলা বাস আটটি 

নিজস্ব প্রতিবেদক
জগন্ন্াথ বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার:জগন্নাথ ২৩ হাজার শিক্ষার্থীকে পরিবহন সুবিধার দেওয়ার জন্য মাত্র আটটি বাস রয়েছে । এই বাসগুলোর মোট আসন সংখ্যা মাত্র সাত শ কিন্তু ঝুকি নিয়ে প্রতিদিন ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি  শিক্ষার্থী যাতায়াত করেছেন। একারনে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ ককওে বলেন আমাদের অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে হল নেই ,সেখানে আবার পরিবহন সংকট এতে আমাদের অনেক সম্যাসা হয়,পরিবহন খাদেও জন্য প্রত্যেক বছর গুনতে হচ্ছে চার শত টাকা । অথচ অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে আসতে হয় পাবলিক বাসে এতে তারা অনেক সময় হরয়ানির শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায় ২৩ হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশন  বিআরটিসি থেকে  ২০০৮ সালের জুলাই মাসে চারটি এবং পরের বছর আরও চারটি দ্বিতলা বাস ভাড়া করে । প্রয়োজনের তুলনার অল্প সংখ্যক এই বাস দিয়ে মোট শিক্ষার্থীদের ৩ শতাংশ পরিকহন –সুবিধার পাচ্ছেন। অন্যদিকে প্রায় সাড়ে তিনশত শিক্ষকদেও জন্য মাত্র পাচটি বাস, যার দুটি আবার ২৫ বছরের পুরান্ েপ্রায় সময় মেরামতের উপর রাখতে হয়।  ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের মত শিক্ষকরাও পরিবহন সুবিধার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেনখোজ খবর  নিয়ে জানা যায় ,৮৫ সিটের একেকটি বাসে ১৫০ থেকে ২০০ শিক্ষার্থী উঠেছেন । প্রচন্ড গরমের মধ্যে তারা এক জনের ওপর অন্য জন বসে আসা যাওয়া করছে তারা । অন্য দিকে ছাত্রীদের  অবস্থা আরো খারাপ  কোন রকম বাসে উঠলে পেলেও সিট পায় না তারা । এতে প্রায় দেখা যায় বসাকে কেন্দ্র করে বেশ কযেকবার মারা মারি ঘটনা ঘঠে । গত এবছরে প্রায় ১০/১৫ বার মারা মারি হয় শুদু বসাকে কেন্দ্র করেমিরপুর থেকে আসা সাংবাদিকতার ছাত্র নাজমুল আরম ইনকিলাবকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠতে হলে যুদ্ধ করেতে হয় । বাসে উঠতে পারলেও আবার বসার সুযোগ নেই কোন রকমে ভাবে দাড়িয়ে থাকা যায় ।  নাম প্রকাসের অনিচ্ছুক এক প্রবিণ শিক্ষক জানান, বাস সংকটের কারেনে অনেক সময় আমরাও সঠিক সময়ে আসতে পারি না। অন্যদিকে ছাত্ররাও ঠিক সময়ে ক্লাস পরিক্ষা  অংশ গ্রহণ করতে পারছে না । এ ক্ষেতে বিশ্বদ্যিঅলয় প্রসাশন কার্যকয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন । এপ্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ মো. শওকত জাহাঙ্গীর বলেন , ছাত্রদেও কাছ তেকে আমরা যে টাকা পাই, তার চেয়ে তিন গুণ টাকা আমাদের  পরিবহন খাতে খরচ হচ্ছে। এতে আমরা অনেক সময় হিমশিম  খেতে হয় এই টাকা প্রসাশনের যোগার দিতে অনেক সমস্যার পড়তে হয়।  
বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, হল  নেই এমতাবস্থায় আবার পরিবহন সংকট এত খুবই কষ্ট হয় শিক্ষার্থীও শিক্ষকদের  জন্য । আশা করছি আগামী মাসে ও পরের মাসে আমরা আরো দুটি বাস আমরা কিনতে পারব। এতে অনেকাংশ পরিবহন সমস্যা সমাধান হবে বলে তিনি জানান।

শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ প্রয়োজন সঠিক পরিবেশ ও সঠিক প্রারম্ভিক শিক্ষা
ফাতেমা তুজ জোহরা  আশা
জাতিসংঘের সংগা ও বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় শিশুনীতি অনুসারে ১৮ বছর এর নিচের সকল মানব সন্তানকে শিশু বলা হয়। জšে§র পর থেকে একটি শিশুর যেমন বৃদ্ধি হয় তেমনি বিকাশও ঘটে। শিশুর বৃদ্ধি সঠিকভাবে  হচ্ছে কিনা সেটা যেমন বোঝা যায় তার ওজন, উচ্চতা, আকার-আয়তন, অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি দেখে তেমনি সঠিক বিকাশ হচ্ছে কিনা সেটা বোঝা যাবে তার মানসিক পরিপক্বতা, সক্ষমতা, চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি ও ভাবের আদান প্রদান , সূক্ষ্মপেশী ও স্থুলপেশীর সঞ্চালন দেখে। অর্থাৎ শিশুর বিকাশ হচ্ছে গুণগত ও পরিমাণগত প্রক্রিয়া। শিশুর বিকাশকে মনোবিজ্ঞানীরা কতগুলো ধাপে ভাগ করেছেন। প্রত্যেকটি ধাপের সঙ্গে শিশুর সংশ্লিষ্ট বয়সসীমা হচ্ছে প্রাক-বিদ্যালয় শিশু (২ বছর ৬ মাস ৫ বছর), মধ্যবর্তীকালীন শৈশব (৬-৮ বছর), বিলম্বিত শৈশব বা প্রাক-বয়ঃসন্ধিক্ষণ সময় (৯-১৩ বছর) ও বয়ঃসন্ধিক্ষণ (১৩-১৯ বছর)। শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ বলতে গর্ভাবস্থা থেকে ৮ বছর বয়সের মধ্যে শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি বুদ্ধির বা মানসিক বিকাশ, আবেগিক ও সামাজিক বিকাশ ভাষা ও যোগাযোগ দক্ষতা এবং নৈতিক বিকাশকে বোঝায়। আজ যে শিশু তার ওপরই নির্ভর করছে আগামী দিন। তাই শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে জš§ থেকে ৮ বছর বয়সের শিক্ষাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময়সীমাটাই শিশুর বিকাশকাল । মস্তিষ্ক আমাদের মানসিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। আর মানসিক বিকাশ নির্ভর করে মস্তিষ্কের বিকাশের ওপর। একটি শিশু যখন জš§গ্রহণ করে তখন তার মস্তিষ্কে কোটি কোটি কোষ থাকে। জšে§র পরে এই কোষের সংখ্যা আার বাড়ে না। একটি কোষের সঙ্গে  অন্য কোষের সংযোগ ছাড়া এই কোষগুলো একা একা কাজ করতে পারে না। শিশুর জšে§র প্রথম ৫ বছর বয়সের মধ্যেই মস্তিষ্কের কোষের  সংযোগ শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ গঠিত  হয় (শিশুর বিকাশে প্রারম্ভিক শিক্ষা, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী)। শিশুর সঙ্গে পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমেই এই সংযোগ স্থাপিত হয়। জšে§র পর থেকে  শিশুরা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের  মাধ্যমে শিখতে শুরু করে। তাই শিশুর সঙ্গে প্রতিনিয়ত পারস্পরিক ক্রিয়া ঘটাতে হবে যাতে সে পঞ্চ ইন্দ্রিয় ব্যবহার করার সুযোগ পায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা স্বাদ নিয়ে শেখে ১%, গন্ধ শুকে শেখে ২%, স্পর্শ করে শেখে ৩%, শুনে শেখে ১১% এবং দেখে শেখে ৮৩%। এ ছাড়া ও একটি শিশু খেলার ছলে, দেখে, শুনে, প্রশ্ন করে, আনন্দের মাধ্যমে, নির্দেশনা থেকে, সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, ছবি দেখে, অনুসন্ধান করে, অনুকরণ করে, কল্পনা করে, তুলনা করে, বারবার চেষ্টা করে, গান, ছড়া, কবিতা, গল্প বলার মাধ্যমে শিখে থাকে। আর তাই শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ সঠিকভাবে যাতে হয় সে জন্যে তাকে দেয়া প্রয়োজন সঠিক পরিবেশ ও সঠিক প্রারম্ভিক শিক্ষা। সঠিক প্রারম্ভিক শিক্ষার জন্য এর পাঠ পরিকল্পনাটাও হওয়া চাই শিশু উপযোগী।  যেমন শিশুদের প্রধানত খেলা, ছড়া, গল্প, ছবি আঁকা বই পড়াসহ নানারকম আনন্দদায়ক পরিবেশ দিতে হবে। এর ফলে শিশুর বিকাশ ঘটবে এবং শিখন ও দক্ষতা অর্জন হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন শিখন উপকরণ যেমন ব্লক, প্যাটার্ন ব্লক, কিউব, শেইপ ব্লক, পুতুল, হাঁড়িপাতিল, বল, পোস্টার, বই, খাতা, রং পেন্সিল দিতে হবে, যা ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর সামাজিক বিকাশ, আবেগিক বিকাশ, পেশীর সঞ্চালন ও নৈতিক বিকাশ ঘটবে। মোটকথা শিশুর বিকাশ সঠিকভাবে হওয়ার সুযোগ আমাদেরকেই তৈরি করে দিতে হবে। জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুরা যেভাবে দেখে ও শেখে, শিশুর ভবিষ্যত বুদ্ধিমত্তা, ব্যক্তিত্ব নৈতিকতা এবং সামাজিক আচার-আচরণ সেই সমস্ত বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। আর তাই আমাদের অঙ্গীকার হোক ”সকল শিশুর  প্রারম্ভিক বিকাশের জন্য সঠিক পরিবেশ ও সঠিক প্রারম্ভিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত  করা।”
ফাতেমা তুজ জোহরা  (আশা), ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনী, এমিনেন্স 

তিন বছরে এডিবি ৩০০ কোটি ডলার সাহায্য দেবে
নিজস্ব প্রতিবেদক
গত জুলাই মাসে এডিবি ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে কার্যক্রমের বিজনেস পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে।এতে বলা হয়েছে আগামী তিন বছরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশকে ৩০০ কোটি ডলার বা ২১ হাজার কোটি টাকা উন্নয়ন-সহায়তা দেবে। ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশকে প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলার বা সাত হাজার কোটি টাকার সহায়তা দেয়া হবে।  বাংলাদেশকে যে অর্থ দেয়া হবে এর প্রায় ১৬০ কোটি ডলার আসবে এশীয় উন্নয়ন তহবিল বা এডিএফ থেকে। আর ১২০ কোটি ডলার আসবে সাধারণ পুঁজির উৎস (অর্ডিনারি ক্যাপিটাল রিসোর্সেস বা ওসিআর) থেকে। তবে ওসিআরের এই ঋণ কঠিন শর্তের এবং সুদের হারও বেশি। এসব ঋণের সুদ নির্ধারিত হবে লন্ডনের  আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারের সুদের হারের (লাইবরের) ভিত্তিতে অর্থাৎ বাণিজ্যিকভাবে।
এসব ছাড়াও বছরে ৭৪ লাখ ডলারের মতো কারিগরি সহায়তা অনুদান হিসেবে দেবে এডিবি। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে এডিবির ঢাকা অফিস আগামী তিন বছরের কান্ট্রি বিজনেস প্ল্যান প্রনয়ণ করার কথা জানায়। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশকে প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলার বা সাত হাজার কোটি টাকার বেশি সহায়তা দেয়া হবে। এসবের বেশির ভাগ অর্থ সামাজিকখাত ও অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করা হবে।
এ ছাড়া ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কান্ট্রি পার্টনারশিপ স্ট্রাটেজি তৈরির কাজ চলছে। এটি বর্তমানে চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে বলে এডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়। এডিবি যেসব উন্নয়ন-সহায়তা দেবে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হচ্ছে পদ্মা সেতু নির্মাণ। এ সেতু নির্মাণে এডিবি ছাড়াও বিশ্বব্যাংকও জাপানি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা সহায়তা করবে। আগামী তিন বছরে এডিবি পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা ৪ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা দেবে। এর মধ্যে সহজ শর্তের ঋণ বা এডিএফ তহবিল থেকে আসবে মাত্র ৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৫৩২ কোটি টাকা।আর বাকি ৫৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার বা তিন হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা আসবে ওসিআর বা বাণিজ্যিক ঋণ থেকে। দ্বিতীয় বড় প্রকল্প হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি। এ কর্মসূচিতে এডিবি ৩০ কোটি ডলার বা দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এর বেশির ভাগই আসবে এডিএফ তহবিল থেকে। একই পরিমাণ অর্থ পাওয়া যাবে জ্বালানি দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পে। তবে এর পুরোটাই আসবে বাণিজ্যিক ঋণ বা ওসিআর তহবিল থেকে। এঅর্থ পাওয়া যাবে ২০১১ সালে। দেশের শহরতলি উন্নয়ন ও ট্রান্সপোর্ট করিডর প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক মোট বিনিয়োগ করবে ২৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা দুই হাজার ৬৫ কোটি টাকা। পুরো অর্থই আসবে সহজ শর্তের ঋণ বা এডিএফ তহবিল থেকে। এর মধ্যে ট্রান্সপোর্ট করিডর উন্নয়নে পাওয়া যাবে ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা এক হাজার ২২৫ কোটি টাকা। আর শহরতলি উন্নয়নে এডিবি দেবে ১২ কোটি ডলার বা ৮৪০ কোটি টাকা। ঢাকা শহরের সমান্বিত টেকসই যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এডিবি বিনিয়োগ করবে ১২ কোটি ৫০ লাখভ ডলার বা ৮৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ কোটি ডলার আসবে এডিএফ তহবিল থেকে আর বাকি দুই কোটি ৫০ লাখ ডলার আসবে ওসিআর থেকে। প্রসঙ্গত, বিগত কয়েক বছরে এডিবি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে যে ঋণ দিয়েছে, তার অর্ধেকই এসেছে চড়া সুদের তহবিল থেকে। প্রসঙ্গত, বিগত কয়েক বছরে এডিবি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে যে ঋণ দিয়েছে, তার অর্ধেকই এসেছে চড়া সুদের তহবিল থেকে।
এসব ঋণ ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে এবং আসলের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে এবং আসলের কিস্তি পরিশোধের ছাড় পাওয়া যাবে মাত্র পাঁচ বছর। ফলে, এডিবির ঋণগুলো কার্যত কঠিন শর্তের ঋণ হয়ে পড়ছে। ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত পঞ্জিকা ভচরে যে ঋণ দেয়া হবে এরও প্রায় ৪০ শতাংশ অর্থ আসবে ওসিআর থেকে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরচালক জায়েদ বখ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশি সাহায্য নেয়ার প্রতিযোগী দেশের সংখ্যা বাড়ার ফলে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কম সুদে ঋণ দেয়ার প্রবণতা এখন কিছুটা কম। তবে বাংলাদেশ বিদেশি সাহায্যের ওপর তার নির্ভরতা অনেকটা কমিয়ে আনতে পেরেছে। ফলে নিতান্ত প্রয়োজন না হলেযে উৎস থেকেই হোক কঠিন শর্তের ঋণ বা বেশি বাণিজ্যিঋণ না নেয়াই ভালো।’
গণপরিবহনব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় মানুষের ভোগান্তি বেড়েই চলেছে
মাসুদুর রহমান স্বপন
নতুন নতুন গাড়ির চাপে ঢাকার সড়ক ভরে গেলেও পুরনো গাড়ি উচ্ছেদ হচ্ছে না। রাস্তাও বাড়ছে না। ফলে যানজটে  নাকাল হচ্ছে নগরবাসাী। গণপরিবহনব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় মানুষের ভোগান্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। জানা গেছে, এ অবস্থায় নতুন গাড়ির নিবন্ধন কিছু দিনের জন্য বন্ধ রাখা হতে পারে। রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে পুরনো যানবাহন তুলে দেয়ার চেষ্টা করছে সরকার। নগরবিদরা মনে করছেন, সঠিক পরিকল্পনা না করে এবং প্রয়োজনীয় বিকল্প পরিবহন না নামিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণেই এমনটি হয়েছে। চরম ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। তবে ইতোমধ্যে সরকারের সঙ্গে একটি দফারফা  হয়েছে ট্রাকমালিকদের। এর আগে ২০০৬ ও ২০০৯ সালসহ বিভিন্ন সময় পুরনো গাড়ি উচ্ছেদের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঝপথে পিছু হটে যায় সরকার।
অভিযান শুরু হওয়ার পরপরই সব পুরনো গাড়ি সাময়িকভাবে রাস্তায় নামা বন্ধ করে দেয়া হয়, ফলে সাধারণ যাত্রীদের শিকার হতে হয় চরম ভোগান্তির।তারা অভিযোগ করছেন, বিকল্প পরিবহন না নামিয়ে এসব গাড়ি তুলে দিলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চলবে। বিকল্প যানবাহন বলতে আছে রিকশা এবং সিএনজি নামের অটোরিকশা। রাজধানীর ভিআইপি রোডসহ অধিকাংশ রুটে রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আছে আগে থেকেই। আর সিএনজি ড্রাইভারদের কাছে যাত্রীর ইচ্ছা নয়, তাদের কাছে নিজেদের সিদ্ধান্তই সব। পরিবহন সংকটের সময় সিএনজি চালকরা ইচ্ছেমতো ভাড়া চেয়ে নিচ্ছেন। তাই খুব কম মানুষই এদের কাছ থেকে সুবিধা পেয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে নগরবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সময়কে বলেন, ‘পুরনো গাড়ি রাজধানী থেকে তুলে নেয়া একটি ভালো কাজ। তবে অভিযান পরিচালনার আগে সরকারকে এর বিকল্প চিন্তা করেই এগুনো উচিত ছিল। আবার যে পুলিশ দিয়ে এ কাজ মন্ত্রণালয় করাচ্ছে তা কি ঠিক হচ্ছে? পুলিশের উচিত আগে নিজের ঘর ঠিক করা, এরপর জনসেবায় নামা। পুলিশের গাড়িই তো পুরনো।’ পুলিশ তেমন কোনো গাড়ি আটক করতে না পারলেও যাত্রীদের দুর্ভোগ মোটেও কম নেই। অভিযান চলাকালে রাস্তা থেকে গাড়ি কমে যাওয়ার বিষয়ে বাসমালিকদের সংগঠন  ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি’র মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের কারণে রাস্তায় অনেকেই বাস নামাননি। কিছু বাস নামালেও অভিযানের খবর পেয়ে রাস্তা থেকে ত্র“টিপূর্ন বাস তুলে নেন মালিকরা।’
গত বছর রাজধানীর যানজট নিরসন ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে ৬০ থেকে ৭০ হাজার যানবাহন রাস্তা থেকে তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চলাচলকারী ২০ বছরের পুরনো অথবা চলাচলের অনুপযোগী, ঝুঁকিপূর্ন, লক্কড়ঝক্কড় এসব যানবাহনের মধ্যে বাস-মিনিবাস ছাড়া ট্যাক্সিক্যাবও ছিল সেই তালিকায়। গত বছরের ৩১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এ লক্ষ্যে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। সে বছরের ২০ আগস্ট যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিআরটিএ ১৫ বছরের পুরনো সব ধরনের যানবাহনের ঢাকায় চলাচল নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করে। এ ধরনের গাড়ির ফিটনেস দেয়া বন্ধ করে বিআরটিএ। এসব যানবাহনের মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যবহƒত গাড়ি, বিশেষ করে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস,মোটরসাইকেল যুক্ত করায় এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ২০ বছরের পুরনো যানবাহন চিহ্নিত করার কাজ সে সময় শেষ না হলেও এ সংখ্যা ৬০থেকে ৭০ হাজারের কম নয় বলে জানায় বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে তখন ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের ডিসি শফিকুল রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অপারেশনের শুরু থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই ২০ বছরের পুরনো এ গাড়িগুলো তুলে দিতে সক্ষম হয়েছেন তারা। অবশ্য তার এমন বক্তব্যের পরে তখনই রাস্তায় পুরনো গাড়ি আছে বলে দাবি করেন একাধিক সরকারি কর্মকর্তা।
জানা যায়, এর আগেও রাজধানীতে একই ধরনের উচ্ছেদ অভিযান ২০০৬ ও ২০০৯ সালে পরিচালিত হয়। কিন্তু সেগুলোর ফলাফলও ছিল একই উরনো বাস সম্পর্কে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা শহরে তিন হাজার ৮১১টি ২০ বছরের বেশি পুরনো বাস এবং নয় হাজার ৯৬৭টি ২৫ বছরের বেশি পুরনো ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান রয়েছে। এসব বাস রাজধানীতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তবে ঢাকার বাইরে চলাচলে কোনো বাধা নেই।’
ঢাকায় দৈনিক গড়ে২২৭টি যানবাহন নিবন্ধিত হচ্ছে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ির (কার-মাইক্রো-জিপ) সংখ্যাই ৯৮। এরপরই মোটরসাইকেল যা প্রতিদিন নিবন্ধিত হচ্ছে ৮৮টি। বাসের নিবন্ধন খুবই কম, দৈনিক গড়ে মাত্র চারটি। বাকি ৩৫টি যানবাহনের মধ্যে রয়েছে ট্রাক, টেম্পো, পিকআপ ভ্যান ইত্যাদি। এ হিসাব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ২০০৯ সালের নিবন্ধন তালিকা থেকে নেয়া। বিআরটিএ’র কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ব্যক্তিগত গাড়ি নিবন্ধিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সিএনজিচালিত অটোরিকশার নিবন্ধন কয়েক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। গত বছর ১০টি ট্যাক্সিক্যাবের নিবন্ধন হয়, এর আগের দুই বছর বন্ধ ছিল। বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী, সংস্থার ঢাকা উত্তর (মিরপুর) ও দক্ষিণ (কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া) কার্যালয় থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত গাড়ির নিবন্ধন হয়েছে পাঁচ লাখ ২৭ হাজার ২৮৫টি। পুলিশের কাছে দেয়া তালিকা অনুযায়ী, ফিটনেসবিহীন পুরনো গাড়ির সংখ্যা ৮০ হাজার ৬১৫। এর মধ্যে ফিটনেসবিহীন ট্যাক্সিক্যাবের সংখ্যা তিন হাজার ৭৫৪। বিআরটিএ’র পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) তপনকুমার সরকার বাংলাদেশ সময়কে বলেন, তালিকায় থাকা যানবাহনগুলো যান্ত্রিকভাবে ত্র“টিপূর্ণ। এগুলো প্রায়ই রাস্তায় অকেজো হয়ে যানজট সৃষ্টি করছে। ত্র“টি থাকায় এগুলোতে দুর্ঘটনাও বেশি ঘটে। পুলিশ তালিকা ধরে এ গাড়িগুলো উচ্ছেদ করলে যানজট কমবে, দুর্ঘটনার ঝুঁকিও কমবে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাস্তায় চললেও এগুলো থেকে সরকার কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় গত বছরের আগস্টে ফিটনেসবিহীন পুরনো যানবাহন রাজধানী থেকে তুলে দেয়ার ঘোষনা দিয়েছিল। সর্বশেষ ১১ মে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, পুরনো গাড়ির তালিকা বিআরটিএ থেকে সরবরাহ করা হলে পুলিশের পক্ষে অভিযান চালানো সহজ হবে। তালিকা থেকে জানা গেছে, ঢাকার মিরপুর কার্যালয় থেকে নিবন্ধন দেয়া ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৭২ হাজার ২২৫টি। কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া কার্যালয়ে নিবন্ধন দেয়া ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা হলো আট হাজার ৩৯০টি। পরিবহনমালিক ও বিআরটিএ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফিটনেসবিহীন পুরনো গাড়ি কয়েক বছর পরপরই রং করা হয়। বাইরের অংশ চকচকে করার জন্য অনেক সময় পুরো বডিই বদলে পেলা হয়। রাজধানীর  কাজলা ও গাজীপুরের মৃধাবাড়ি এলাকায় পুরনো যানবাহনে রং করার বেশ কিছু কারখানা গড়ে উঠেছে। অনেক মিনিবাস রংও করা হয় না। রাজধানীতে চলাচলকারী বলাকা, তুরাগ, গুলশান সার্ভিস, আর্ক পরিবহন ও গাবতলী-চিটাগাং রোডে চলাচলকারী অধিকাংশ মিনিবাসের গায়ে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন।  কোনো বাসেই নির্দেশক বাতি নেই। বাসের প্রায় সব গ্লাসই ভাঙা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্রাপক ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক শামসুল হক বলেন, ফিটনেস সনদ দেয়ার সময় যানবাহনের ৩৩ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। তবে ঢাকার রাস্তায় যেসব যানবাহন চলে, এর বেশির ভাগই এ ৩৩ ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে পারবে না। পুলিশ ও বিআরটিএ’র ব্যর্থতার সুযোগে এগুলো চলছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে দুর্ঘটনা এবং যানজট বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পুরনো গাড়ি উচ্ছেদের অগ্রগতি সম্পর্কিত বৈঠকে পুলিশের প্রতিনিধি জানান, গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশ ১৮ হাজার ৯৮১টি মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি আটক করে যা পরে ছেড়ে দেয়া হয়। পুলিশের প্রতিনিধি ওই বৈঠকে স্বীকার করেন, ছেড়ে দেয়া গাড়ি আবারো ঢাকার রাস্তায় নেমে গেছে।
বিষাক্ত রং ও রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারে মানব শরীরে বিরূপ প্রভাব
পৃথিবীর উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানবজাতির জীবন ও জীবিকার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। সময়ের স্বল্পতা, সহজলভ্যতা, স্বল্পদাম ও সুবিধাজনক ব্যবহারের জন্য দৈনন্দিন সামগ্রির উন্নয়ন বেড়েই চলেছে। শিক্ষার উন্নয়ন ঘটলেও পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে তার সমতা এখনও ফিরে আসেনি। রাসায়নিক পদার্থের প্রসার পৃথিবীতে অনেক অসাধ্যকেও সাধন করেছে বটে, তবে এর ভূল ও মাত্রা বহির্ভূত ব্যবহার ও যথেচ্ছা ব্যবস্থাপনার কারনে মানবজীবনের তথা পৃথিবীর অনেক ক্ষতি সাধন হতে চলছে। নানা রং এর সমারহ ও সহজ ব্যবহার্যের জন্য যেমন ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে, তেমনি সে সকল জিনিসের নকল ও ভেজাল মিশ্রনের প্রবনতাও বেড়ে গেছে। ব্যবসায়িক দৃষ্টি ভঙ্গিতে পন্যের চমক বাড়াতে উৎপাদনকারীগন পন্যে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করছেন যা ক্রেতাদের বিশ্বাসের অগোচরে নিঃশব্দে তাদের শরীরের ক্ষতি সাধন করছে। খাদ্য, প্রসাধনী, ঔষধ, প¬াস্টিক সামগ্রি ও কৃষিজ উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর ব্যবহার চলছে। বিভিন্ন অবস্থান থেকে রাসায়নিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে এবং এতে রোগের জটিলতা দিনদিন বেড়েই চলছে। রাসায়নিক পদার্থ কখনই খাদ্য নয়; কাপড়ের রং খাদ্যে ব্যবহার করা যাবে না।; পপ্স জাতীয় কীটনাশক মায়ের দুধের ভিতর দিয়ে শিশুর শরীরে প্রবেশ করে, যা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ; আমদানীকৃত ফলমুলে রাসায়নিক পদার্থের প্রলেপ থাকে, যা না ধূয়ে খেলে শরীরের ক্ষতি করতে পারে।; মশার কয়েলে ব্যবহƒত ঙপঃধপযষড়ৎড় ফরঢ়ৎড়ঢ়ুষ বঃযবৎ  ফুসফুসে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।; ফরমালিন লিভার ও কিডনী নষ্টসহ এ্যাজমা রোগের সৃষ্টি করতে পারে।; নাইট্রোবেনজিন চর্ম ও ফুসফুসে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।; বিসফেনল এ হরমন তৈরীর গ্লান্ডসমূহের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।; পিভিসি, প্লাস্টিসাইজার মানব শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। পলিথিন ও প্লাস্টিক  প্যাকেটে তৈলাক্ত কোন খাবার রাখা যাবে না। পলিথিন বা প্লাস্টিক জাত দ্রব্যে ব্যবহƒত রাসায়নিক পদার্থ (প্লাস্টিসাইজার) মানুষের শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।; এবং রং ও রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাবারের ফলে গর্ভজাত একজন নারীর বিকলাঙ্গ বা অসুস্থ শিশু জšে§র ঝুকি বহন করে। এমনকি বিষাক্ত এই খাবার গ্রহনের ফলে একজন নারী মা হওয়ার ক্ষমতা পর্যন্ত হারাতে পারে।  নিরাপদ খাবারের জন্য খাদ্যের মান ও খাদ্যের নিরাপত্তা দুই-ই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ন। বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি ও অন্যদিকে ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য মানুষকে দিশেহারা করে তুলেছে। সারাবছরই চলতে থাকে নিম্নমান সম্পন্ন ও ভেজাল খাবার বিক্রি, রাস্তার ধারের খোলা খাবারে ধুলাবালি ও মশামাছির সংক্রমন, শাকসবজিতে বিষাক্ত কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার, প্রক্রিয়াজাত খাবারে মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল ও খাওয়ার অনুপযুক্ত রঙ এর ব্যবহার। যা শিশুসহ জনস্বাস্থ্যের জন্য এক মারাত্মক হুমকি। আমাদের প্রক্রিয়াজাত অনেক খাদ্যই নানান ভেজালের জন্য খাবারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমান বাজারে খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী খাবারের সাথে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশাচ্ছে। খাদ্যপ্রস্তুতকারীরা রং মিশ্রিত খাবারসহ ভেজাল খাবার সরবরাহ করে মানবাধিকার লংঘন করছে অন্যদিকে ভোক্তার সাথে প্রতারনা করছে। বিভিন্ন খাদ্যে ও পানীয় দ্রব্যে লোভনীয় বিজ্ঞাপনে আমাদের অবুঝ শিশুরা ক্ষতিকর বিভিন্ন খাবারের প্রতি ঝুকে পড়ে। অভিভাবকগন অনেক সময় না বুঝে অথবা শিশুদের বায়না মিটাতে গিয়ে এসকল খাবার কিনে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এসকল ভেজাল খাদ্যের বিষয়ে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে। শিশুদের এসকল খাবার গ্রহনে বিরত রাখতে হবে।  অন্যদিকে শিশুসহ সকলের জন্য মানসম্মত  এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও  বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করতে হবে। সারাদেশে কেমিক্যাল মেট্রোলজি বাস্তবায়ন করতে হবে। খাদ্যসহ প্রতিটি পন্যের মান নির্ধারণ করতে হবে। পন্যের মোড়কের গায়ে ব্যবহƒত রাসায়নিকের নাম ও তার পরিমান উল্লেখ করতে হবে। ক্রেতা ভোক্তাদের পন্যের মান ও গুনাগুন সমন্ধে ধারণা দিতে হবে। সকল খাদ্যে চটকদার বিষাক্ত রঙ ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং সেই সঙ্গে প্রতারনামূলক চটকদার বিজ্ঞাপন সম্পূর্নরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে।রাসায়নিক পদার্থ (ক্যালসিয়াম কার্বাইড) দিয়ে ফল পাকিয়ে তা বাজারজাত করা যাবে না। খাদ্য ও পানীয়ে ভেজাল বিরোধী সরকারী অভিযান নিয়মিতকরণ, জোরদার ও বি¯তৃত করতে হবে।অবিলম্বে ভোক্তা সংরক্ষণ আইন কার্যকর করতে হবে। খাদ্যের আদর্শমান নিয়ন্ত্রণে একটি স্বতন্ত্র রেগুলেটরি কমিশন গঠন এবং জাতীয়, বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে উচ্চমানের ল্যাবরেটরি স্থাপন করতে হবে।  খাদ্যের নিরাপত্তা রক্ষার্থে সংশিষ্ট সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং বাপাসহ সকল নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীদের সমন্বয় ঘটাতে হবে এবং জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নিতে হবে। ভেজাল খাদ্য সম্পর্কিত অভিযোগ জানানোর জন্য সরকারী অভিযোগ কেন্দ্র গঠন করতে হবে। ভেজাল খাদ্য ও ক্ষতিকর পন্য সামগ্রী সম্পর্কে সারা দেশব্যাপী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

প্রসঙ্গ ড্যাপ
নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকার সুষ্ঠু নগরায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ৩রা এপ্রিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘ঢাকা মেট্রোপলিটান ডেভেলমেন্ট প্ল্যান’-এর আওতায় ‘স্ট্রাকচার প্ল্যান’ ও ‘আরবান এরিয়া প্ল্যান’ নামক দ’ুটি অংশকে ‘মাস্টার প্ল্যান’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তীতে দ্রুততম সময়ে উল্লেখিত প্ল্যানগুলোর আলোকে ‘ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান’ বা ‘ড্যাপ’ প্রণয়নের কথা থাকলেও সরকারি পর্যায়ে অনর্থক কালক্ষেপন করা হয়। ফলে মাস্টার প্ল্যানের সুপারিশকৃত ভূমি ব্যবস্থাপনার ব্যতয় ঘটিয়ে অপরিকল্পিত নগরায়ন চলতেই থাকে।
ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এর অধিবাসীদের ন্যুনতম মৌলিক চাহিদা যেমনঃ পানি, বিদ্যুৎ পয়ঃপ্রণালী, যাতায়াত, বিনোদন প্রভৃতির পূরণ ক্রমশই সঙ্কুচিত হচ্ছে। দেশের সকল অংশের সুষম উন্নয়ন ঘটিয়ে ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যার চাপ কমানোর ব্যবস্থা এবং এর ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নাগরিক সুবিধাসমূহ সম্প্রসারনের উদ্যোগ গ্রহন করা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে ঢাকা শহরকে বসবাসযোগ্য ও পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ পর্যায়ে ২০০৪ সালে ৪টি কন্সালটিং ফার্মের মাধ্যমে ‘ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান’ বা ‘ড্যাপ’ প্রণয়নে র কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু হাউজিং ও রিয়াল এষ্টেট ব্যবসার সাথে জড়িত একটি স্বার্থান্বেষী মহল ‘ড্যাপ’ প্রণয়ন কাজে শুরু থেকেই নানা উপায়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে এবং ডিএমডিপি-র ষ্ট্রাকচার প্ল্যানে চিহ্নিত প্লাবন ভূমি, উপ-প্লাবন ভূমি ও উচ্চমান সম্পন্ন কৃষিভূমিকে হাউজিং ও রিয়াল এষ্টেট ব্যবসার জন্য বৈধতা দানের অপচেষ্টা চালায়। ফলশ্র“তিতে একটি পক্ষপাতদুষ্ট ও অসাঞ্জস্যপূর্ণ খসড়া ‘ড্যাপ’ প্রণীত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে এ খসড়া ‘ড্যাপ’ তড়িঘড়ি চুড়ান্তকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় প্রণীত‘ড্যাপ’ -এর চূড়ান্তকরণে বাধাপ্রদান করে উপরোক্ত সংগঠনগুলো। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবি যেমন- নগর পরিকল্পনাবিদ, নগর গবেষক, স্থপতি ও পরিবেশ  কর্মীদের নজরে প্রস্তাবিত খসড়া ‘ড্যাপ’ এ নিম্নলিখিত অসামঞ্জস্যগুলো ধরা পড়ে যা পরিকল্পিত নগরায়নে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে ঃ ভূমি ব্যবহারে অনেক ক্ষেত্রেই মূল মাষ্টার প্ল্যানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিলের জন্য পরিবেশ ও জনস্বার্থকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়, যেমন: অনেক ক্ষেত্রেই ‘উচ্চমান সম্পন্ন কৃষি জমি’ হিসেবে চিহ্নিত ভূমিসমূহসহ ঢাকা নগরীর ভবিষ্যতের জন্যে অত্যন্ত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ ‘বন্যা প্রবাহ এলাকা’ ও ‘জলাশয়’ সমূহকে ‘আবাসন বা হাউজিং’ হিসেবে দেখানো; প্রণীত মানচিত্রে ব্যাপক কারিগরি অশুদ্ধতা যা পরবর্তীতে জটিলতার উদ্ভব ঘটাতে পারে; নগরায়নে ‘ভূমি ব্যবহারের’ জন্য কোন নির্দিষ্ট ‘মানদণ্ড’ নির্ধারণ না করে পরিকল্পনা প্রণয়নের চেষ্টা করা; নগরী ও তার নদী-খালগুলোকে ভারী শিল্পবর্জ্যরে দূষণ থেকে মুক্ত রাখার কোন প্রস্তাবনা না রাখা; এবং প্রস্তাবনায় ‘উš§ুক্ত স্থান’ হিসেবে কেবলমাত্র ০.১৩ ভাগ ভূমির প্রস্তাব অথবা উচ্চবিত্তদের ২৭ ভাগ ভূমি বরাদ্দের বিপরীতে নিুবিত্তদের জন্য মাত্র ০.২৭ ভাগ জমির ব্যবহার বরাদ্দের মাধ্যমে অসম বণ্টনকে উৎসাহিত করা।
উপরোক্ত অসামঞ্জস্যতাগুলো সংশোধনের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষিতে বিগত ২৩ ডিসেম্বর, ২০০৮ সরকার অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠন, নগর পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ, গবেষণা কেন্দ্র ও পরিবেশবাদী সংঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি পর্যালোচনা বা  ‘রিভিউ কমিটি’ গঠন করে। প্রায় ছয় মাস ব্যাপী কার্যক্রম শেষে উক্ত রিভিউ কমিটি সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা ও রাজউকের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনাপূর্বক ০৭ জুন ২০০৯ তারিখে প্রস্তাবিত ‘ড্যাপ’ -এর সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ রিপোর্ট প্রদান করে। সিদ্ধান্ত ছিল যে, এ রিপোর্ট অনুযায়ী সংশোধন ও পরিশীলনের পর‘ড্যাপ’ চুড়ান্তকরণ করে দ্রুততম সময়ে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
পরবর্তীতে কন্সালটেন্টদের সংশোধিত রিপোর্ট পেশের পর তা পর্যালোচনার জন্য বর্তমান নির্বাচিত সরকার গত ০৩ মার্চ ২০১০ তারিখে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির কার্যপরিধি ছিল নিম্নরূপ:১) রিভিউ কমিটির সুপারিশসমূহ বাস্তবতার আলোকে‘ড্যাপ’ সন্নিবেশিত হয়েছে কিনা তা পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান;  ২) এলাকাভিত্তিক অনুমিত জনসংখ্যার ঘনত্ব নির্ধারণের সুপারিশ প্রদান; এবং ৩) ভূমি ব্যবহারের  বিষয়ে প্রাপ্ত  অন্যান্য  মতামত ও প্রস্তাবনাসমূহ  প্রচলিত বিধিবিধান ও  বাস্তবতার প্রেক্ষিতে যাচাইকরণ ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান। 
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে এক মাসের জন্য গঠিত এ কমিটি দ্রুততম সময়ে সুনির্দিষ্টভাবে বিভিন্ন জটিলতা নিরসনে দিক নির্দেশনা দিয়ে গত ২৬ মার্চ ২০১০ এ রিপোর্ট দাখিল করে এবং এক মাসের মধ্যে (খসড়া জনসমক্ষে প্রকাশের আইনগত বাধ্যবাধকতা সাপেক্ষে) ‘ড্যাপ’ চুড়ান্তকরণ ও    বাস্তবায়নের ঘোষণা প্রদানের জন্য সরকারকে বিশেষ অনুরোধ জানায়। উল্লেখ্য রিভিউ কমিটি তার সকল পর্যালোচনায় ও বিবেচনায় ‘ষ্ট্রাক্চার প্ল্যানে’ সুনির্দিষ্ট ও ঢাকা মহানগরীর অস্তিত্বের স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘বন্যা প্রবাহ’ বা ‘প্লাবন অঞ্চল’ সুরক্ষার বিষয়টি আপোষহীনভাবে নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে। কমিটি শুধুমাত্র হাউজিং নয় বরং সুষম ভূমি ব্যবহারের প্রয়োজনে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা ও বিনোদন কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় আনুপাতিক ভূমি-ব্যবহার বরাদ্দ নিশ্চিত করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরামর্শ প্রদান করেছে। সেই সাথে নদী ও জলাশয়গুলো শিল্প ও বর্জ্য দূষণ থেকে মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি নির্ধারণ-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিশ্চিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা প্রদান করে। বর্তমানে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানা গেছে।
‘ড্যাপ’ চূড়ান্তকরণের এ সন্ধিক্ষনে নগরীর জলাশয়, খাল ও প্লাবন অঞ্চলের বিশাল অংশ দখলকারী ভূমি দস্যুদের পক্ষালম্বন করে সাম্প্রতিক সময়ে সংশোধিত‘ড্যাপ’ বিষয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক তথ্য বিজ্ঞাপন আকারে প্রচার করা হচ্ছে । সেই সাথে কয়েকজন সংসদ সদস্যকে এ বিষয়ে তাদের ব্যবসায়ীক হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিকে ব্যবহারের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। এ জাতীয় হীন ও উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার বিপরীতে অবিলম্বে‘ড্যাপ’ চূড়ান্তকরণে এবং এর বাস্তবায়নের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য জোর দাবী জানান এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশু দিক নির্দেশনা কামনা করেন। সেই সাথে এ ধরনের অপপ্রচারনায় লিপ্তদের কঠোর হস্তে নিবৃত করার জন্য অনুরোধ জানান। তারা বলেন, একটি পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে‘ড্যাপ’ চূড়ান্তকরণ ও বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই
বাপার সম্মানিত সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এর সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে মুলবক্তব্য রাখেন বাপা’র যুগ্নসম্পাদক ও নগরায়ন সুশাসন কমিটির সদস্য সচিব স্থপতি ইকবাল হাবিব। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বাস্থই-র সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বিআইপি- সহসভাপতি পরিকল্পনাবিদ মোঃ শওকত আলী খান। এছাড়াও সিইউএস-র সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নুরুল ইসলাম নাজেম সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।