Year-18 # Issue-44 # 18 December 2011

বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতির বীর সন্তানদের স্মরণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতির বীর সন্তানদের স্মরণ এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের মধ্যদিয়ে অসমাপ্ত দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়ে বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তি উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। গত শুক্রবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে  শেরে বাংলা নগরে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে (পুরনো বিমানবন্দর) ৩১ বার  তোপধ্বনির মধ্যদিয়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সূর্যোদয়ের পর সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের এই দিনে দুই যুগের পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এ দিনটি উদযাপনে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করেছে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। দিনটি উপলক্ষে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় হয়েছে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা। রাজধানী ঢাকা ও  দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলো জাতীয় পতাকা ও রঙ-বেরঙয়ের পতাকায় সজ্জিত করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধ মানুষের ঢল: জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভোর সাড়ে ৬টায় সাভার স্মৃতিসৌধে  পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ততোক্ষণে কনকনে শীতের মধ্যে কুয়াশা ঘেরা স্মৃতিসৌধের সামনে জড়ো হয় কয়েক হাজার মানুষ। তাদের হাতে পতাকা, কপালে পতাকা, পোশাকেও লাল-সবুজের প্রতীকী উপস্থিতি। ৬টা ৪০ এ স্মৃতিসৌধের বেদিমূলে ফুল দেন প্রধানমন্ত্রী। তিন বাহিনীর একটি  চৌকস দল গার্ডে  সালাম জানায়। শহীদদের স্মরণে বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর।
যাদের আত্মত্যাগে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামের এই স্বাধীন দেশের উৎপত্তি হয়েছে, কিছুটা সময় নীরবে দাঁড়িয়ে সেই শহীদদের স্মরণ করেন  শেখ হাসিনা। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান, কূটনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা এবং সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শ্রদ্ধা জানানোর পর আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে নেতাকর্মীদের নিয়ে আবারো ফুল দেন শেখ হাসিনা। পরে স্মৃতিসৌধের পরিদর্শক বইয়ে সই করেন। অসুস্থতার কারণে রাষ্ট্রপতি এ বছর স্মৃতিসৌধে যাননি। বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া স্মৃতিসৌধে পৌঁছান সাড়ে ৭টার দিকে। এর পরপরই নেতাকর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এমকে আনোয়ারসহ  জ্যেষ্ঠ নেতারা এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর  কোনো চেষ্টাই সফল হবে না। এবার বিজয়ের ৪০ বছরে আমাদের অঙ্গীকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এ মাটিতেই হবে এবং এই বিচারের রায়ও কার্যকর করা হবে। সরকার সাস্প্রদায়িকতামুক্ত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা জানানোর পরপরই জাতীয় স্মৃতিসৌধ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য খুলে  দেয়া হলে জনতার ঢল নামে। বিভিন্ন সংগঠন শহীদ  বেদীতে শ্রদ্ধা জানাতে থাকে একে একে। বিজয়ের আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ পরিণত হয় উৎসবের ময়দানে। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শহীদের স্মৃতির মিনার। আরো আয়োজন: বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নেয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা,  পোস্টার প্রদর্শনী ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দিবসটি উপলক্ষে পৃথক কর্মসূচি দেয়। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে উদযাপন করেছে বিজয়ের দিনটি।

১৪০টি গুদামের নির্মাণকাজ শেষ
সরকারি খাদ্যগুদামের ধারণক্ষমতা ২২ লাখ টনে উন্নীত হচ্ছে 
সিদ্দিকুর রহমান
নির্ধারিত সময়ের ১ বছর আগেই চলতি বছরের ডিসেম্বরে দেশের উত্তরাঞ্চলে ১৪০টি খাদ্য গুদামের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। এসব গুদাম আগামী বছরের প্রথম দিকেই খাদ্য মজুদের কাজে ব্যবহার করা যাবে। এসব গুদামের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১২ সালের শেষ নাগাদ। এছাড়া ৪শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশব্যাপী যে আরো ৩৩০টি নতুন খাদ্য গুদাম নির্মাণ ও সংস্কার  কাজ চলছে তার কাজও ২০১২ সালের মধ্যে শেষ হবে। আগামী বছরের মধ্যে সরকারিভাবে খাদ্যশস্য মজুদ ক্ষমতা ২২ লাখ টনে উন্নীত করতে সরকার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, আগামী বছর নাগাদ তা অর্জিত হবে। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে বলা হয়েছে। গত ৩ বছরে দেশের উত্তারাঞ্চলে খাদ্যশস্যের বাম্পার ফলন হয় কিন্তু গুদাম সংকটের কারণে সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্যশস্য মজুদ করতে পারেনি। নতুন খাদ্যগুদামগুলো চালু হলে খাদ্য মজুদের বিষয়ে আর কোনো সমস্যা হবে না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য গুদাম নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরলে প্রধানমন্ত্রী খাদ্য গুদাম নির্মাণ করে মজুদ ক্ষমতা বাড়ানোর নির্দেশ প্রদান করেন। নতুন খাদ্য গুদাম নির্মাণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শুধু রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে ১৩৭টি গুদাম নির্মিত হচ্ছে। এই ১৩৭টি গুদামের নির্মাণ কাজ শেষ হলে এসব গুদামের ধারণ ক্ষমতা হবে আড়াই লাখ মেট্রিক টন। এ ছাড়া আরো ৩শ’ গুদামের নির্মাণ কাজ শেষ হলে এসব গুদামের মোট ধারণ ক্ষমতা হবে প্রায় ৬ লাখ টন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অপর একটি সূত্রে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে বিভিন্ন ধরনের ৬২১টি খাদ্য গুদাম রয়েছে। এর মধ্যে ৬০৪টি এলএসডির ধারণ ক্ষমতা ৯ লাখ ৫১ হাজার ৯৬৭  টন। ১২টি সিএসডির ধারণ ক্ষমতা ২ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫০ টন। ৫টি সাইলোর ধারণ ক্ষমতা ২ লাখ ২৫ হাজার ৮শ’ টন। বর্তমানে দেশে সরকারি খাদ্য গুদামের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে কাগজে-কলমে ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ২১৭ টন। কিন্তু বাস্তবে ধারণ ক্ষমতা হলো প্রায় ১৩ লাখ টন। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর দেশে খাদ্য শস্যের বাম্পার ফলন সত্ত্বেও গুদাম সংকটের কারণে ১২ লাখ টনের বেশি খাদ্যশস্য মজুদ করতে পারেনি সরকার। চলতি বছরও দেশে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে এবার খাদ্য মজুদের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। সূত্রটি থেকে আরো বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের ১৪ দশমিক ২ মিলিয়ন হেক্টর জমির মধ্যে ৯ দশমিক ১ মিলিয়ন হেক্টর জমি আবাদযোগ্য। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ জমিতে ধান চাষ হয়। কিন্তু আবাসন, নগরায়ন, শিল্পায়নসহ জনসংখ্যার নানামুখী চাপের কারণে কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। অপরদিকে বাড়ছে খাদ্যশস্যের চাহিদা। এ অবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা  দেয়। খাদ্যশস্য মজুদ ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় খাদ্য নীতি যুগোপযোগী করা হয়েছে। সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, খাদ্য গুদামজাতকরণের উন্নত ব্যবস্থা, সুলভে কৃষি উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা, ন্যূনতম খাদ্যের মজুদ সংরক্ষণ, হতদরিদ্র ও বঞ্চিতদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা বেস্টনী গড়ে তোলার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদের জন্য একটি বড় সমস্যা হলো গুদাম সংকট। তাই খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্য গুদামের ধারণ ক্ষমতা আরো ৭ লাখ লাখ টন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সান্তাহারে জাইকার সহায়তায় ১ লাখ টন ধারণ ক্ষমতার একটি মাল্টিস্টোরেড গুদাম নির্মাণ করা হচ্ছে। এ গুদামে খাদ্য সংরক্ষণের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। মংলায় একটি জেটিসহ কংক্রিটের সাইলো নির্মাণেও জাপান সহায়তা দিচ্ছে। এ সাইরোর ধারণ ক্ষমতা হবে ৫০ হাজার টন। মন্ত্রী বলেন, মংলায় একটি জেটিসহ কংক্রিটের সাইলো নির্মাণেও জাপান সাহায়তা দিচ্ছে। ২০২০ সালের মধ্যে খাদ্যগুদামের ধারণক্ষমতা ৩০ লাখ টনে উন্নীত করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগামী ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৮ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার খাদ্যগুদাম ও সাইলো নির্মাণ করা হবে। এ জন্য বর্তমানে ৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে উন্নয়ন সহযোগীরা এগিয়ে এসেছে। মন্ত্রী আরো বলেন, চলতি অর্থবছরে সরকারিভাবে কোনো চাল আমদানি করার প্রয়োজন হবে না। সরকারি খাদ্যগুদামে পর্যাপ্ত চাল মজুদ রয়েছে। দেশে এখন কোনো ধরনের খাদ্য সমস্যা নেই। ভবিষ্যতেও খাদ্য নিয়ে সমস্যা হবে না।
বিএসসিতে অচলাবস্থা
মেরিটাইম ইনস্টিটিউটে নাবিক প্রশিক্ষণ বন্ধ 
নিজস্ব প্রতিবেদক
নাবিক তৈরির একমাত্র প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটে (এনএমআই) দীর্ঘ আড়াই বছর যাবৎ সকল প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। কারণ এখানে প্রিন্সিপাল নেই। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) কারিগরি পরিচালক (টিডি) প্রকৌশলী সাঈদউল্লাহ দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর এখানে প্রিন্সিপালের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকৌশলী সাঈদউল্লাহ বিএসসিতেও স্থায়ী পরিচালক নন। দীর্ঘ সাড়ে চার বছর কারিগরি পরিচালক পদে চলতি দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। এ কারণে দু’টি প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতেই তিনি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পদে একই কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করায় দু’টি সংস্থারই স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। নৌমন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ নাবিক তৈরির একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এনএমআই-এ দীর্ঘ আড়াই বছর যাবৎ সকল প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। দেশীয় ও বিদেশি পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজে নাবিকদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশিক্ষিত নাবিক সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছে শিপিং অফিস। কিন্তু এ ব্যাপারে এনএমআই’র মাথা-ব্যথা নেই। অথচ বাংলাদেশে দক্ষ নাবিক তৈরির জন্য জাপানের দেয়া ২৪ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক নৌ-সংস্থার কনভেনশনে যোগদানের লক্ষ্যে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সম্প্রতি লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগের আগে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, জনবল সংকটের কারণে একই ব্যক্তিকে দুটি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এক ব্যক্তি দুই স্থানে দায়িত্ব পালন করলে কাজের কিছুটা ক্ষতি হয়। তবে আমরা ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের জন্য একজন প্রিন্সিপাল খুঁজছি। উপযুক্ত লোক পেলেই দ্রুত নিয়োগ সম্পন্ন হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অব্যাহত লোকসানের বোঝাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনকে গতিশীল করার ওপর সরকার গুরুত্বারোপ করলেও এর দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত এ বাণিজ্যিক সংস্থাকে লাভজনক করতে এর কারিগরি বিভাগের ভূমিকাই মুখ্য। এই বিভাগের অধীনে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন একটি মেরিন ওয়ার্কশপ। কিন্তু এই বিভাগের পরিচালক অন্য প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকায় জাহাজ ও ওয়ার্কশপের তদারকি যথাযথভাবে করতে পারেন না। এ কারণে বিএসসি’র সব জাহাজ মেরামত করা হয় বিভিন্ন বেসরকারি ওয়ার্কশপে। এতে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ ব্যয় হয়। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি ওয়ার্কশপগুলোর সঙ্গে বিএসসির কারিগরি বিভাগের সখ্য রয়েছে। যে কারণে সংস্থার কোনো জাহাজ মেরামতের প্রয়োজন হলে সেটিকে নিজস্ব ওয়ার্কশপে না পাঠিয়ে লোক দেখানো দরপত্রের মাধ্যমে বেসরকারি ওয়ার্কশপে পাঠানো হয়। 

কাগজে কলমে আটকে আছে ভোক্তা অধিকার আইন
হাসান মাহামুদ রিপন
ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠায় গত ২০০৯ সালে দেশে একটি আইন প্রণয়ন করা হলেও এর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পরবর্তীতে এই আইনটি কার্যকর করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর গঠন করলেও সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় এর সুফল এখনো পৌঁছেনি। ফলে প্রতিনিয়তই প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারা। জানা গেছে, ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়ে আনাসহ বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ক্রেতারা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সঠিক দামে নির্ভেজাল পণ্য ক্রয় এবং তা ভোগ করার অধিকার একজন সাধারণ ভোক্তার রয়েছে। কিন্তু দেশের কোনো অঞ্চলের ভোক্তাই এই অধিকার আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে। বেশি মুনাফার আশায় পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছেন ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে খাদ্যে ভেজাল ছড়িয়ে পড়ায় জনস্বাস্থ্যও হুমকির মুখে। বাংলাদেশ ক্রেতা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান লায়ন মোহাম্মদ নুর ইসলাম এ ব্যাপারে বলেন, মূল্যস্ফীতি বর্তমানে একটি বিরাট সমস্যা। তবে তারচেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে, মানুষ তার কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে বেশি দামেও পণ্যটি সঠিক ওজনে কিনতে পারছেনা। এছাড়া পণ্যটি সঠিক মানসম্মত কিনা তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে মানুষকে আরো বেশি অসহায় করছে ভেজাল ও নকল পণ্য এবং একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর প্রতারণা। তিনি বলেন, জনগণকে এই অসহায়ত্বের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে ভোক্তা অধিকার আইনটি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি গৃহীত আইনটির পরিধি এবং ভোক্তাদের নিজের অধিকার সম্পর্কে আরো সচেতন করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে কাজগুলো করতে হবে। ক্রেতার অধিকার সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টিই হচ্ছে আমাদের মূল লক্ষ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভোক্তা অধিকার রক্ষায় দেশে এখনও দক্ষ ও শক্তিশালী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। অর্থনৈতিক ও বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচলিত আইনটি কার্যকর না হওয়ার কারণেই দেশে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা যায়নি। সূত্র মতে, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেশে ভোক্তা অধিকার রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে খাদ্য ও খাদ্য-বহির্ভূত পণ্য ও সেবা সামগ্রীর মূল্যস্ফীতি। কিন্তু গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে সাধারণ মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৭ শতাংশ। গত ২০১০-১১ অর্থবছরের একেবারে প্রথম দিকে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা হ্রাস পেলেও শেষ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে বেড়েই গেছে। এমনকি চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতি বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) সর্বশেষ, মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি অর্থবছরে প্রথম নয় মাসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৮ থেকে পৌনে ১০ শতাংশের ঘরে ওঠানামা করেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে যারা বসবাস করছেন তারাই সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েছেন। তাছাড়া বহির্বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় এর প্রভাবও দেশে পড়েছে। এতে করে ২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার সরকারি প্রচেষ্টা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গোপন টেন্ডারে কমিউটার ট্রেন লিজ
১৫ কোটি টাকা লোকসান হবে রেলওয়ের 
এইচআর সাগর
গোপন দরপত্রের মাধ্যমে ঢাকা-জামালপুর রুটে ৫১/৫২নং কমিউটার ট্রেন লিজ দেয়া হয়েছে অর্ধেকেরও কম মূল্যে। আগে এটি লিজে পরিচালনার চুক্তি ছিল দৈনিক ১ লাখ ৭০ হাজার ৫শ’ টাকায়। সেখানে নতুন চুক্তি অনুযায়ী লিজ দেয়া হয়েছে দৈনিক মাত্র ৭০ হাজার টাকায়। ফলে ৪ বছরে সরকারকে প্রায় ১৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা লোকসান গুণতে হবে। এদিকে এ ঘটনায় দুইটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ মন্ত্রী, সচিব, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, রেলওয়ের মহাপরিচালক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবরে অভিযোগ দায়ের করেছে। কিন্তু রেলকর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয় নি।রেলওয়ে সূত্র এবং দায়ের করা অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ৫১/৫২নং জামালপুর কমিউটার ট্রেনটি পরিচালানর জন্য গোপন দরপত্রের মাধ্যমে গত ২৩ অক্টোবর ৪ বছরের জন্য কার্যাদেশ দেয় এলআর ট্রেডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে। এ প্রতিষ্ঠানটির মালিক সালাউদ্দিন রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপকসহ (পূর্ব) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে অনিয়মের মাধ্যমে দৈনিক মাত্র ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে কার্যাদেশ বাগিয়ে নেন। অথচ প্রায় ৩ বছর আগে এই প্রতিষ্ঠানটিই ট্রেনটি লিজ নেয়ার জন্য দরপত্রে দর দিয়েছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। যাত্রী ও ভাড়া বৃদ্ধি পেলেও অর্ধেকেরও কম দরে এ ট্রেনটি লিজ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ৫১/৫২নং জামালপুর কমিউটার ট্রেনটি রেলওয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ২০০২ সালের ১১ নভেম্বর থেকে ২০০৮ সালের ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত দৈনিক ৯৫ হাজার ৫শ’ টাকায় এমকে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কর্স পরিচালনা করে। এরপর চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার দু’মাস আগেই ট্রেনটি লিজ প্রদানের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রে ৭টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এমকে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কর্স দৈনিক ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, এসআর ট্রেডিং ১ লাখ ৬৮ হাজার এবং বান্না এন্টারপ্রাইজ ১ লাখ ৭০ হাজার ৫শ’ টাকা দর দেয়। সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে বান্না এন্টারপ্রাইজ কার্যাদেশ পেয়ে রেলওয়ের সঙ্গে চুক্তি মোতাবেক ট্রেন পরিচালনা শুরু করে। কিন্তু রেল বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর অসহযোগিতা যেমন-নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ২-৩ ঘণ্টা বিলম্বে স্টেশন ত্যাগ করানো, ২-৩ ঘণ্টা বিলম্বে গন্তব্যে পৌঁছানো, ইঞ্জিন বিকল করে বিলম্ব করা, লাইট, ফ্যান ও পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না করা ইত্যাদি কারণে যাত্রী চলাচল কমতে থাকায় লোকসানের মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। এই পরিস্থিতিতে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ২০১০ সালের ৩ জুন রেল বিভাগের কাছে ট্রেনটি হস্তান্তর করতে বাধ্য হয় লিজ গ্রহিতা। পরবর্তীতে রেল বিভাগ ট্রেনটি পরিচালনা করায় গত ১৭ মাসে বিপুল লোকসান হয় সরকারের। সূত্রমতে, গোপনে ট্রেনটি লিজ দেয়ায় সরকারের দৈনিক ১ লাখ টাকা হিসেবে বছরে প্রায় ৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা  লোকসান হবে। যা ৪ বছরে সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। মেসার্স এমকে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কর্স ও শান্তা ট্রের্ডাসহ কয়েকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সম্প্রতি ৫১/৫২ নং জামালপুর কমিউটার ট্রেন লিজে অনিয়মের বিষয়ে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন যোগাযোগমন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরে। এ ব্যাপারে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক (পূর্ব) হাবিবুর রহমান অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, গোপন নয়, প্রকাশ্যে ৩টি দৈনিক পত্রিকায় এই টেন্ডার আহ্বান করা হয় এবং নিয়ম অনুযায়ী আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলো দর জমা দেয়। এতে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি বলে। তিনি বলেন, দৈনিক এক লাখ ৭০ হাজার টাকায় ৫১/৫২নং জামালপুর কমিউটার ট্রেনটি পরিচালনার চুক্তি করে বান্না এন্টারপ্রাইজ লোকসানের মুখে পড়ে। এ জন্য তারা ট্রেনটি রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করে। তাই নতুনভাবে দরপত্র আহ্বান করে দৈনিক ৭০ হাজার টাকায় লিজ দেয়া হয়েছে এলআর ট্রেডিংকে। ট্রেন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত শান্তা ট্রেডার্সের মালিক মো. গোলাম রব জানান, ২০০৮ সালে ২৬ আগস্ট জামালপুর কমিউটার ট্রেন লিজ প্রদানের জন্য টেন্ডারে জালিয়াতি করার অভিযোগে এসআর ট্রেডিং-এর মালিক সালাউদ্দিনকে (রিপন) সর্তক করা হয়েছিল। এ ঘটনায় সেসময় রেলের সহকারী প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শামসুল আলমকেও তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। আবার সেই সালাউদ্দিনেরই মালিকানাধীন এলআর ট্রেডিং জালিয়াতির মাধ্যমেই এই ট্রেনটি পরিচালনার সুযোগ পায়। তিনি জানান, তথ্য অধিকার আইন-২০০৯-এর ৮ ধারা অনুযায়ী লিখিতভাবে ৫১/৫২ জামালপুর কমিউটার ট্রেনটি লিজ প্রদানের জন্য কোন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল, কত সিডিউল বিক্রয় করা হয়েছিল, টেন্ডার দাখিলের তারিখ ইত্যাদিসহ লিজ সংক্রান্ত তথ্য রেলওয়ের তথ্য কর্মকর্তার নিকট চাওয়া হয়েছিল। গত ২৪ অক্টোবর আবেদন করার পরেও অদ্যাবধি তথ্য পাওয়া যায়নি। বান্না এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার মো. তোফাজ্জাল হোসেন সুমন রেলওয়ের কর্মকর্তাদের মাসিক উৎকোচের বিনিময়ে গোপন টেন্ডারে ট্রেনটি লিজ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। নিয়ম থাকলেও উš§ুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। ফলে সরকারকে বিপুল পরিমাণ লোকসান গুণতে হচ্ছে। এভাবেই রেলওয়ের লোকসানের পাল্লা দিন দিন ভারী হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা ভালো নেই
বদরুল ইসলাম মাসুদ
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি সম্প্রতি কয়েকটি সভা-সমাবেশে বলেছেন, দেশের মানুষ ভালে আছে, দেশের অর্থনীতি ভালো আছে। আপনি আরো বলেছেন, দেশের সুশীল সমাজের কতিপয় মানুষ মিডিয়ার স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে টকশো-আলোচনা ও লেখার মাধ্যমে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে সহযোগিতা করছেন। এসব কথাও কিন্তু মিডিয়ার কল্যাণেই দেশবাসীর কাছে প্রচার/প্রকাশ হচ্ছে। এসব কথার অনেকগুলোই রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে। এসব কথার জবাব সাধারণ মানুষের কাছে তেমন একটা পাওয়া যাবে না। তবে আমরা যারা সাধারণ মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তারা বুঝি আমরা ভালো নেই, ভালো থাকার জন্য যা যা উপাদান প্রয়োজন তা আমাদের কাছে যথার্থ নেই। ফলে আমাদের অবস্থা কাহিল  থেকে কাহিলতর হচ্ছে। সাধারণ মানুষ যে ভালো নেই এর জন্য তেমন গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না, সাদা চোখ দিয়েই ঘুরে দেখলে খোলাসা হয়ে যায়। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা ক্রমশ বাড়ছে। সে অনুপাতে সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে না, অথচ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে শনৈ শনৈ। ফলে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র সাধারণ মানুষকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। সরকারি দলের অনেক নেতাই বলছেন, মানুষ এখন না খেয়ে মরছে না। এটা সারাদেশের সঠিক চিত্র হিসেবে মন্তব্য করা না গেলেও এটা বলা যায়, মানুষ ক্ষুধা থাকা সত্ত্বে¡ও পেট পুড়ে খেতে পারছে না, ভাতের পাতিলের দিকে চেয়ে, পরিবারের সদস্যদের কথা মাথায় রেখে ‘কম’ করে খেয়ে পেট পুড়ে পানি পান করে থাকছে। আর ‘স্বপ্ন’ দেখছে সন্তান বড় হলে একসময় হয়ত পেট পুড়ে খেতে পারবে, শান্তিতে থাকতে পারবে। কিন্তু এখন এই বর্তমানে দেশের সাধারণ মানুষ ভালো নেই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। দেশের অর্থনীতির চিত্রও তেমন ভালো নেই। নারী শিক্ষার বিস্তারের জন্য বিনা বেতন অধ্যয়নের সুযোগের কথা বলা হচ্ছে। এটা বৈষম্যযুক্ত এবং সরকারের কথার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। আমার ৫ বছরের সন্তান, চলতি বছর একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেজি ওয়ান (প্লে গ্র“প) ভর্তি হয়েছে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে। বই-খাতা-ইউনিফরম, ব্যাগ-জুতা কিনেছে প্রায় তিন হাজার টাকার। এখন ওর বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। ইতোমধ্যে ওর ডিসেম্বর পর্যন্ত বেতন-ফি পরিশোধ করে হিসেব কষে দেখা গেছে, পুরো বছরে ওকে ৬,৯৫০ টাকা স্কুলের জন্য দেয়া হয়েছে। বেতন সাতে তিনশ’, পরীক্ষার ফি দুইশ’ টাকা করে। নারী শিক্ষা বিনা বেতনে হলেও আমি এই পরিমাণ টাকা দিয়েছি। আমার মতো অনেকেই দিয়েছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারের বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ নেই। কিন্তু সরকারি- বিশেষ করে প্রাইমারী স্কুলগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থায় এতোই অনিয়ম ও অবহেলা যে, সেখানে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের ভর্তি করাতে আগ্রহ পায় না। শিক্ষা খাতে ভর্তুকির কথা বলা হচ্ছে, বেসরকারি প্রাইমারী স্কুলেও নারী শিক্ষার জন্য সে সুযোগ এখনো সৃষ্টি হয়নি। আমার কাছে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া আমার ভাইঝি একটি সরকারি কলেজে চলতি মৌসুমে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার কথা। কলেজে তার উপ-বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। নারীদের বিনা বেতনে অধ্যয়নের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু ভর্তি হতে তাকে দিতে হয়েছে দেড় হাজার টাকা, প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে নতুন করে ভর্তি হতে দিতে হয়েছে প্রায় দুই হাজার টাকা। টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ফরম ফিলাপ করতে আরো প্রায় দুই হাজার টাকা লাগবে বলে শোনা যাচ্ছে। এই হচ্ছে সরকারি কলেজের পরিস্থিতি। তাহলে বেসরকারি কলেজগুলোর পরিস্থিতি বর্ণনার প্রয়োজন নেই। জেনেছি, বছর শেষে আমার ভাইঝি উপ-বৃত্তি বাবদ প্রায় ১৩০০ টাকা পাবে, ফরম ফিলাপে প্রয়োজন দুই হাজার টাকা। দুই বছরে তার খাতা-কলম কিনতে টাকা লেগেছে। তাহলে কি নারী শিক্ষা ‘ফ্রি’ করা হলো? আমরা এভাবেই কথা ও কাজের মিল খুঁজে পাই না। সম্প্রতি টেস্ট পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে, ফরম ফিলআপের তারিখ দেয়া হয়েছে। কিন্তু উপ-বৃত্তির টাকা পাওয়ার নাম নেই। তাহলে নারী শিক্ষা কিভাবে এগুবে? ফরম ফিলআপের আগেই উপ-বৃত্তির টাকা শিক্ষার্থীদের হাতে  পৌঁছবেÑএটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়গুলো আপনাকেই খতিয়ে দেখতে হবে। আমাদের অনেক মন্ত্রী বিদেশ সফর নিয়ে এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল আর টয়লেট, চা-এর দোকান উদ্বোধনের ফিতা কেটে এসবের খবর নেয়ার সময় পান না...।
বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম তা বলাই বাহুল্য। মাসিক যে আয় হয় তা দিয়ে চলা অসম্ভব। কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানো হয়েছে। বিদ্যুতের ভর্তুকি কমানোয় ইউনিট প্রতি দাম বেড়েই চলছে। পরিবহন ভাড়া, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। বড় মানুষ বাজারে গিয়ে বাজার মূল্যকে ‘বেশি’ বলে মনে না করলেও আমাদের মতো সাধারণ মানুষ চাহিদামাফিক পণ্য কিনতে পারছেন না। সবজির মৌসুমেও দাম নাগালের বাইরে। তেল, আটা, চিনি এসব এখন সাধারণ মানুষের কাছে ‘দুর্লভ’ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সংসারে এসবের প্রয়োজন নিত্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের সফলতা আমাদের চোখে পড়ে না। উদ্বাস্তুদের ঘরে ফেরার কর্মসূচি কবে বাস্তবায়ন হবে, শীতার্তরা গরম কাপড় না পেয়ে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ধুঁকছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে, সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার গুণগতমান সন্তোষজনক না হওয়ায় ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানোর চাপ সামলাতে অভিভাবকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব, রাষ্ট্রে বৈষম্য দূর করার প্রত্যয় নিয়ে। এসব বাস্তবায়নের আপনার ডানে-বামে চৌকস লোকের বড় প্রয়োজন। তা না হলে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে আপনি বলে ফেলতে পারেন, “সাধারণ মানুষ ভালো আছে।” সত্যিকার অর্থে সাধারণ মানুষ ভালো নেই, পত্রিকার পাতা এবং তৃণমূলের দলীয় নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে খোঁজ নিলে সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা অনায়াসে বেরিয়ে আসবে, এটা দৃঢতার সঙ্গেই বলা যায়।

লেখক: সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী 

স্বাধীনতার চল্লিশ বছর: আমাদের দেশের বিভক্তি- বিভাজনের রাজনীতি ও সুশীল সমাজের ভূমিকা
মাহবুবুল আলম
আমরা যখন সগৌরবে আমাদের মহান স্বাধীনতা লাভের চল্লিশ দশক পালন করছি, তখন  আমরা ও আমাদের দেশ এক নেতিবাচক, স্বার্থপরতা ষড়যন্ত্রের কুটিল আবর্তে আতর্তিত হচ্ছি। স্বাধীনতা লাভের চল্লিশ বছরেও  আমরা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় এমন কোনো নজির স্থাপন করতে পারিনি; যা নিয়ে দেশকে সম্মিলিতভাবে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে নিয়ে যাওয়া যায়। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কাক্সিক্ষত যে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা ছিল, তা তো হয়নি বরং বলা যায় বিভক্তি আরো চরম রূপ লাভ করেছে। এর একদিকে স্বাধীনতার চেতনা ও এর ধারক-বাহক প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি আর অন্যদিকে বিজাতীয় ভাবধারায় বিশ্বাসী শক্তি। আইএসআইয়ের মদদপুষ্ট এই দ্বিতীয় শক্তি কখনো চায়নি বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল প্রগতিশীল রাজনীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক। তারা এদেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার আড়ালে অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে সব সময়ই স্বাগত জানিয়েছে। এ জন্য একটি দেশ স্বাধীনতার চার চারটি দশক পেরিয়ে এলেও বিভক্তির রাজনীতির যবনিকাপাত না হয়ে আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে।
১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও এমন বিভাজন দেখা দিয়েছিল। স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সারা দেশের সিংহভাগ মানুষ পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করলেও দেশের মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী শক্তি হিসেবে রাজাকার-আলবদর বাহিনী গঠন করে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। তারা শুধু যুদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে গণহত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা লাভের পথকে কঠিন করে তুলতে সব ধরনের চেষ্টা করেছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে এরা পরাজিত হলেও পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অস্থিতিশীল করে তাকে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐকমত্যে বিভাজনের সূত্রপাত করেন সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান। তিনি তার ‘মানি ইজ নো প্রোবলেম’ থিউরির মাধ্যমে টাকা পয়সা বিলিয়ে রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে  তোলেন। ’৭৩ সালের যে দালাল আইনের মাধ্যমে  যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১১ হাজার স্বাধীনতা বিরোধীর বিচার চলছিল; এর মধ্যে ৬শ’ বিচারাধীন আসামিসহ সবাইকে জিয়াউর রহমান মুক্ত করে দিয়েছিলেন দালাল আইন বাতিলের মাধ্যমে। যার সিংহভাগই পরবর্তীতে জিয়ার দল বিএনপিতে যোগদান করে বাংলাদেশে বিভাজনের রাজনীতির সূত্রপাত করেছিল। এর পরই বাংলাদেশের মানুষ দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। এর একটি বিএনপি, জামায়াত মৌলবাদী একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী আর আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য প্রতিশীল নিয়ে অন্য আরেকটি শিবির। যে বিভাজন বিরোধ চলছে ৭৫ পরবর্তী সময় থেকে। তাই একথাটি বললে অত্যুক্তি হবে না যে জাতিকে বিভাজনের বিষবৃক্ষটি নিজ হাতে রোপণ করে গেছেন সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা একটি লক্ষ্য করে আসছি বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক শাসনকে সর্বাগ্রে যে গোষ্ঠীটি স্বাগত জানিয়ে তারা হলো তথাকথিত সিভিল সোসাইটির একটি অংশ। কিন্তু দেশপ্রেমী গোষ্ঠীটি এদের কাছে নেহায়েতই পেরে ওঠে না কখনো। সেই তথাকথিত মুখচেনা গোষ্ঠীটি দেশে অগণতান্ত্রিক শাসনামলে উটপাখির মতো বালিতে মাথা গুজে রাখেন। জিয়ার আমল, এরশাদের আমল সর্বশেষ এক/এগারো পরবর্তী তিন ‘ম’-এর সেনাশাসিত জরুরি শাসনের সময় তেনারা বোবা সেজে বসেছিলেন। যারা রাজনীতি সচেতন একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন ওই সব অগণতান্ত্রিক শাসন অবসানের পর পর দেশে যখন গণতন্ত্রের বাতাস বইতে শুরু করেছে তখনই বালির ঢিবি থেকে মাতা তুলে গণতান্ত্রিক সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। এই গোষ্ঠীটির কেউ কেউ সেনাশাসক জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও তিন ‘ম’-এর উর্দী শাসনের উচ্ছিষ্টের ভাগিদারও হয়েছেন এখানে এদের নাম বলে বিরাগভাজন হতে চাই বলেই নাম বলা স্থগিত রাখলাম। ১৯৭৫-এ বিশ্বের ইতিহাসে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর কোনো প্রতিবাদ তো করেনইনি উপরন্তু বঙ্গবন্ধুর শাসনের সমালোচনায় সব সময় মুখর থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পথকে প্রশস্ত করতে সাহায্য করেছেন। এদের মধ্যে অনেকে আবার বঙ্গবন্ধুর হত্যা দিবসকে নাজাত দিবস হিসেবে পালন করেছেন।
বঙ্গবন্ধু হক্যার পর বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছিল, সে সময় আওয়ামী লীগ যাতে আর কোনোদিন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে না পারে তার জন্য আদাজল খেয়ে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে কালিমালিপ্ত করার জন্য মিথ্যা গুজবের ফানুস উড়িয়েছেন। শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি জিয়া ও তার ক্ষমতা গ্রহণের বেনিফিসিয়ারি এবং উচ্ছিষ্টভোগীরা। তাই তারা শুরুতেই শেখ হাসিনার নাম ভারতের সঙ্গে জড়িয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারে মেতে ওঠে। তারা তাদের পাকিস্তানি প্রভুদের মতো পুরনো কায়দায় শেখ হাসিনার আগমনের সঙ্গে তথাকথিত ভারতীয় সম্প্র্রসারণবাদী ভূত আবিষ্কারের কৌশলের আশ্রয় নিয়ে জনগণের মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির প্রয়াস চালায়। মার্চ মাসে সাপ্তাহিক মুক্তবাণী নামক একটি পত্রিকায় একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। সে রিপোর্টে বলা হয়, শেখ হাসিনার ভারতের তল্পিবাহক হিসেবে এ দেশের রাজনীতিতে ফিরে আসছে। ১৯৮১ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি বিএনপির কয়েক নেতা ‘রমনা গ্রীনে’ দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘শেখ হাসিনা বিদেশি শক্তির তল্পিবাহক। বিদেশি একটি শক্তি তাদের পারপাস সার্ভ করার জন্য শেখ হাসিনাকে এজেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। একই দিন ঢাকায় এক সমাবেশে তথ্যমন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরী বলেন, ‘বাকশালীরা ভারতের গোলাম।’ রেলমন্ত্রী আব্দুল আলীম বলেন, ‘বাকশালীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে বিদেশি সৈন্যদের সহযোগিতায় ক্ষমতায় বসতে চায়।’ সমবায়মন্ত্রী ক্যাপ্টেন হালিম বলেন, ‘যে দলের প্রধান দিল্লিতে সে দল কোনোদিন জনগণের কল্যাণ করতে পারে না।’ তেলমন্ত্রী কর্নেল আকবর হোসেন বলেন, ‘একাত্তরে আওয়ামী লীগ থিয়েটার রোড থেকে ২৫ বছরের জন্য দেশকে বন্ধক দিয়েছিল, তাদের নতুন নেত্রী পাঁচ বছর ধরে দিল্লিতে আছেন, আরেকবার সুযোগ পেলে দেশকে এক শ’ বছরের জন্য বন্ধক দেবে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের নেতারা দিল্লি থেকে নীল নকশা নিয়ে আসবেন।’
উপরে আলোচিত ব্যক্তিবর্গ জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীদের অপপ্রচারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জিয়া সমর্থক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নানা ধরনের অলীক কল্পকাহিনী প্রচার করতে থাকে। ২৭ ফেব্র“য়ারি খুনি চক্রের মুখপত্র সাপ্তাহিক ইত্তেহাদের এক রিপোর্টে বলা হয়Ñ ‘ইন্দিরার নীল নকশা এখন বাস্তবায়নের পথে। বাংলাদেশকে সিকিম বানানোর জন্যই শেখ হাসিনাকে দেশে পাঠানো হচ্ছে। আরো বলা হয়, ১৯৭৫-এর পর তারা দিল্লি¬ ও লন্ডনে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালায়। লন্ডনের জমে ওঠে দিল্লির সেবাদাসদের আড্ডা। তারাই আজ বাকশালী কমিটির ছত্রছায়ায় দেশে ফিরছে। সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে।’
সরকারি পত্রিকা ‘দৈনিক বাংলা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত সভানেত্রী ঘোষণা করায় ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় খুশির জোয়ার।’ জাতীয় সংবাদ প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করে। চরম আওয়ামী লীগ বিরোধী ও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মাওবাদীদের মুখপত্র এনায়েত  উল্লাহ খানের সাপ্তাহিক হলিডে ৮ মার্চ ১৯৮১ সাপ্তাহিক মুক্তবাণীর বরাত দিয়ে বলে যে, ‘আওয়ামী লীগের সভানেত্রী পদে শেখ হাসিনার নির্বাচন এবং তার দেশে ফেরার ব্যাপারটি ঢাকা ও দিল্লি কর্তৃপক্ষের মধ্যকার চুক্তি অনুসারে বহু আগেই স্থির করা হয়েছে বলে প্রচার করে। এ তো গেল জিয়ার অনুগ্রহভোগী ব্যক্তি ও পত্র-পত্রিকার অপপ্রচার।
শেখ হাসিনার দেশে ফিরার আয়োজনে জেনারেল জিয়ার কেমন রিএ্যাক্ট করেছিলেন সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করব। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরোক্ষ মদদদাতা ও বেনিফিসিয়ারি জেনারেল জিয়া ও সুশীল সমাজ নামধারী ওই গোষ্ঠীটি শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তনের আয়োজনের এতটাই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন যে, কিভাবে কোন্ কৌশলে শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তনকে ঠেকানো আর ঠেকাতে না পারলে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে ভারতের সেবাদাস হিসেবে প্রমাণ করে শেখ হাসিনকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশল অবলম্বন করে নানামুখী ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। সেই কৌশল ও নষ্ট রাজনীতির অংশ হিসেবেই ভারতের সম্প্রসারণবাদী নীতিকে সত্য প্রমাণের জন্য দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপকে কেন্দ্র করে ভারত বিরোধী প্রচারণা শুরু করে। যে দ্বীপটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত হরিয়া ভাঙ্গা ও রায়মঙ্গল নদীর মোহনায় চার বর্গমাইল আয়তনের এই দ্বীপটি ভারতীয় নিউমুর দ্বীপ নামে পরিচিত। এই দ্বীপকে উপলক্ষে করেই ভারতীয় আধিপত্যবাদকে আরো জোরালোভাবে প্রমাণের জন্য জিয়া সরকার ১৯৮১ সালের মে মাসে তালপট্টি এলাকায় তিনটি টহলদারী নৌযান পাঠায়। ১৭ মে ভারতীয় নৌবাহিনী বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে মোকাবিলা করে। এতে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হলে জিয়ার গোয়েবলস প্রশাসনযন্ত্র ও তাদের অনুগ্রহভোগী পত্র-পত্রিকা শেখ হাসিনার দেশে ফেরার সঙ্গে এ ঘটনাকে জড়িয়ে অপপ্রচার চালাতে থাকে।
উপরের আলোচনা থেকেই এই ধারণাটি স্পষ্ট হয় যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মূল বেনিফিসিয়ারি ও তার উচ্ছিষ্টভোগীরাই এ দেশে বিভক্তি আর বিভাজনের রাজনীতির স্রষ্টা। জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই দু’হাতে টাকা বিলিয়ে, রাজনীতিক, সাংবাদিক, পেশাজীবীদের কিনে নিয়ে বিভক্তির বিষবৃক্ষটি রোপণ করা হয়েছিল। সেই বিভক্তিই আমাদের বাঙালি জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয়নি। বিএনপি ক্ষমতায় থেকে যত অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনই চালাক না কেন না দেখার ভান করে অন্ধ সেজে বসে থাকে এবং না শোনার ভান করে বধিরের চরিত্রে নিপুণভাবে অভিনয় করে যান। কিন্তু এদের সমস্যা শুরু হয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই। তারা কিছুতেই আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় সহ্য করতে পারে না। তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য নানামুখী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন।
২০০১ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার সময়ও এরা মুখ বন্ধ করে থেকেছে। আবার ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ছত্রছায়ায় যখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় নৃশংস গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো, কিন্তু আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ দিল এমন ভয়াবহতম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময়ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি দাবিদার গোষ্ঠী একটি জোরালো প্রতিবাদও করেননি। ২০০৬ সালে নির্বচন পূর্ববর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের টালবাহানা ও ষড়যন্ত্রের কারণে জাতীয় নির্বাচনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টির সময়েও এরা একটি কথা বলেননি। বরং আকারে ইঙ্গিতে লগি-বৈঠার প্রতিরোধ আন্দোলনকেই দোষারোপ করেছেন। যেই না আন্দোলন সফল হলো এবং এক/এগারোতে তিন ‘ম’ সেনা সমর্থিত জরুরি জারি করে ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্র শুরু করল তখনই সেই সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিরা দলে দলে সেখানে গিয়ে ভিড় জমাতে শুরু করল এবং সেই জরুরি শাসন প্রলম্বিত করার নানা কুটিল পরামর্শ দিয়ে নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিল। তাদের পরামর্শেই শেখ হাসিনাকে অন্যায় ও অপমানজনকভাবে গ্রেফতার করে হেনস্থা করা শুরু করল, তখনো সেই সুশীল সমাজের ধ্বজাধারীরা পর্দার আড়ালে থেকে মুখ টিপে হেসেছিল। বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটির নাম ব্যবহার করে এখন যারা প্রতিনিয়ত সরকারকে নছিয়ত করে যাচ্ছেন এদের সম্মন্ধে অনেকেরই হয়ত ধারণা আছে। তবু এদের সম্মন্ধে এখানে কিছুটা আলোকপাত জরুরি বলে মনে করি। এদের মধ্যে ড. আকবর আলী খান, বিচারপতি আব্দুর রউফ, অধ্যাপক মোজাফফর আহম্মদ, ড. বদিউর রহমান, সাবেক আমলা আসাফদৌলা, মতিউর রহমান, মাহফুজ আনাম, আসিফ নজরুল, সাবেক বাসদ ছাত্রলীদের মাহমুদুর রহমান প্রমুখ ব্যক্তিরা সিভিল সোসাইটির নেমপ্লেট গায়ে লাগিয়ে নিরপেক্ষতার আড়ালে বিভিন্ন প্রাইভেট টিভি চ্যানেলকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রায় সকল কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে দিনরাত সমালোচনা করে বেড়াচ্ছেন। আর প্রাইভেট টিভি চ্যালেনগুলোও সস্তা জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্যে ওই কয়েক চেনা মুখকেই কুমিরের সাত বাচ্চা গল্পের মতো বার বার উপস্থাপন করছেন। শেখ হাসিনা অনেক সহনশীল বলেই এরা এভাবে যা তা করে বেড়াচ্ছেন।
দেশের সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজ দেশে দেশে যেভাবে দেশ গঠনমূলক ভূমিকায় অবদান রাখেন আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা সেভাবে দেশ গঠনে ভূমিকা কখনো রাখেননি। কাজেই আমাদের দেশের বিভাজন বা বিভক্তির রাজনীতি যা-ই বলি না কেন, তা জিইয়ে রাখতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন ওইসব চেনা সিভিল সোসাইটির ব্যক্তিরা। কেননা প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় থাকলে এরা সব সময়ই অস্বস্তিবোধ করেন। তাই পরিশেষে বলতে চাই যতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশের সুশীল সমাজ বা সিভিল সোসাইটি তকমাধারী ব্যক্তিদের মূল্যবোধ জাগ্রত না হবে ততদিন আমাদের রাজনীতিতে বিভাজন ও বিভক্তি চলতেই থাকবে।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের  ৪০ বছরে প্রত্যাশার বাংলাদেশ
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
সময়ের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এবার পুর্তি হলো স্বাধীনতার ৪০ বছর। ডিসেম্বর  বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় মাস। ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনার মাস। ডিসেম্বরকে ঘিরে তাই বাঙালি জাতির সুখ ও গর্বের শেষ নেই। বাঙালির  ইতিহাসে  দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা, ত্যাগ ও তিতিক্ষার সুদীর্ঘ পথ ধরে একাত্তরের ২৬ মার্চ শুরু হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের লাখো মুক্তিকামী মানুষ অংশ নেয় মহান সে মুক্তিযুদ্ধে। দেশের সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশসহ কৃষক, শ্রমিক, মজুর, ছাত্র-জনতা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। সেখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে অংশ নেয় মুক্তিযুদ্ধে। স্থাপন করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালা যুগিয়েছিল মুক্তির লড়াইয়ে অনন্ত প্রেরণা। একাত্তরের পঁচিশ মার্চের কালরাতে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। ঝাঁপিয়ে পড়ে দানবিক হিংস্রতা নিয়ে। শুরু করে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। ওরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় ঘরবাড়ি, হাটবাজার। লুটপাট করে মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ, বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। নরপিশাচদের নৃশংসতা থেকে রক্ষা পায়নি দেশের নারী, শিশুরাও। দীর্ঘ ন’মাস ধরে চলা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী এবং ওদের দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামসের উš§ত্ততার শিকার হন দেশের অগণিত স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হন। খুন, ধর্ষণের শিকার হয় দেশের আড়াই লক্ষাধিক নারী। গ্রাম বাংলার নদনদী, খালবিলে ভাসতে থাকে অগণিত লাশ। শিয়াল, কুকুর, শকুন ছিঁড়ে খায় বাংলার মানুষের গলিত দেহ। একাত্তরের পঁচিশ মার্চ থেকে শুরু করে  ষোলই  ডিসেম্বর বিজয় লাভের দিন পর্যন্ত চলে এ হত্যাযজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে চৌদ্দই ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী ওদের দোসরদের সহযোগিতায় চালায় এ দেশের  বুদ্ধিজীবী হত্যার সর্বশেষ নৃশংস অভিযান। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে দেশকে মেধাশূন্য করার নীলনক্সার অংশ হিসাবে ওরা  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পীসহ সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ শেষে নির্মম ভাবে হত্যা করে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মৃতদেহকে ওরা মিরপুর ও রায়ের বাজারে ফেলে রাখে। রাজধানী ছাড়াও সারা দেশব্যাপী চলে এ ধরনের বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ। ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে মহম্মদপুরের ঘাঁটিতে নির্মম অত্যাচার করে। হানাদার বাহিনীর হিংস্র থাবায় শহীদ হন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডঃ জিসি দেব, আলীম চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, সেলিনা পারভীন, ডঃ ফজলে রাব্বি, সন্তোষ ভট্টাচার্য, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমদ, ডাঃ আলীম চৌধুরী, আবুল খায়ের, ডাঃ গোলাম মর্তুজা, সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদ, আনম গোলাম মোস্তফা, আর. পি সাহা, রশীদুল হাসান, নতুন চন্দ্র সিংহ, ডঃ সাদেক, খন্দকার আবু তালেব, ডঃ মুক্তাদির, আলতাফ মাহমুদসহ বহু প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধির মানুষ। মানসিক ভারসাম্যহীন কথা সাহিত্যিক শহীদ সাবেরকে ওরা সংবাদ অফিসে পুড়িয়ে মারে। ওরা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করে দিতে শেষ চেষ্টায় মেতে ওঠে। কেননা ওরা বুঝে ফেলেছিল এ দেশ স্বাধীন হবে। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হত্যাযজ্ঞ দেখে সারা বিশ্বের বিবেক কেঁপে ওঠে। নিউইয়র্কের রেডিসন স্কোয়ারে মার্কিন পপ তারকা জর্জ হ্যারিসন ও ভারতীয় সুর সম্রাট রবিশঙ্কর কনসার্ট করে তহবিল সংগ্রহের অর্থ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দান করেন। দেশের লাখ লাখ সাধারণ মানুষ মাতৃভূমি রক্ষার শপথ নিয়ে ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। প্রায় এক কোটি শরনার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা দিতে শত চেষ্টা সত্বেও সেখানে দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। শরনার্থী শিবিরে প্রায় তিন লক্ষ শিশু অপুষ্টিতে মারা যায়। এ সব দেখে বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত হয়ে যায়। হাত বাড়ায় বাংলাদেশের অনেক বন্ধুপ্রতিম দেশ। মুক্তিযুদ্ধ আরো বেগবান হয়। ভারতের মিত্রবাহিনী ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সাহায্য করে। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নগর অবকাঠামো ধ্বংসস্ত’পে পরিণত হয়। গ্রামগঞ্জ, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, রেললাইন ভেঙ্গে, পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ  মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও  দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রমহারা হন। লাখ বাঙালির ত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আসে চুড়ান্ত বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পায় স্বাধীন, সার্বভৌম এক দেশ, বাংলাদেশ। স্বাধীনতা লাভের পর মাত্র পাঁচটি বছর যেতে না যেতে পঁচাত্তরের পনেরই আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। তারপর জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গণতন্ত্র থেকে দেশ দূরে সরে যায়।  একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর নারকীয় গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী কাজে সহায়তাকারীদের এতো বছর পরেও অভিযুক্ত করে বিচারকার্য স¤পন্ন করা যায়নি। হয়নি তাদের শাস্তি। পাশাপাশি দেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন উপেক্ষিত। লাঞ্ছনা, বঞ্চনার  শিকার হয়ে তাদের জীবনে নেমে এসেছে চরম হতাশা। তাদের কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ আজো বাস্তব রূপ নেয়নি। অবশেষে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ক’জনের শাস্তির রায় কার্যকর করা হয়েছে।  একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার  শুরু করেছে বর্তমান সরকার। বিজয়ের মাস উপলক্ষে এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার দাবিতে নানা কর্মসূিচ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল। পাশাপাশি জেলহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারেরও জোর দাবি উঠেছে সর্বত্র। এ সব দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে দেশব্যাপী নেওয়া হচ্ছে নানা কর্মসূচি। দেশের  প্রগতিশীল, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যুদ্ধাপরাধীসহ অন্যান্য হত্যার বিচারের দাবিতে হয়েছে সোচ্চার। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে  রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে  বাংলাদেশের  প্রতিটি শহরবন্দর, গ্রামগঞ্জে নৃশংস সব হত্যাকান্ডের বিচারের জোর দাবি উঠে আসছে। চৌদ্দই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ভাব গম্ভীর পরিবেশেও ছিল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের শাস্তি প্রদানের উচ্চকিত দাবি। মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের জনগণের বক্তব্য গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে যা দেশের কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ করছে। নতুন প্রজš§ আজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এবং ঘৃণ্য হত্যাকান্ড ও অপরাধের বিচারের দাবিতে মুখর।  একে আরো  বেগবান করতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস আরো বেশি করে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সমৃদ্ধ  নানা ধরনের বই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশজুড়ে গড়ে তুলতে হবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। মুক্তিযোদ্ধাদের দিতে হবে যথাযথ সম্মান। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে। যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ দেশে একদিন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, দেশের মুক্তিকামী মানুষ লাল-সবুজ বিজয় পতাকা ছিনিয়ে এনেছিল, তাকে সফল করে তুলতে হবে। গড়ে তুলতে হবে এক শোষণহীন, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। স্বাধীনতার চার দশকে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে অনেক।তবে রয়েছে বেশ কিছু অপূর্ণতা। সকল লোভ লালসার উর্ধ্বে থেকে, অমূল্য জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে যারা দেশকে স্বাধীন করেছিল, ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়, তাদের অসাধ্য কিছু থাকতে পারে না। তাই স্বপ্নের বাংলাদেশে একাত্তরের চেতনায় অর্থনৈতিক মুক্তি, আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একটি মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের সাহসী মুক্তিকামী মানুষ একদিন এ দেশকে আলোয় আলোয় ভরে তুলতে সক্ষম হবে-এ প্রত্যাশা আমাদের। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তির পূর্বক্ষণে ১৩ ডিসেম্বর ভোরবেলা চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী । আমার প্রথম জীবনের প্রিয় এ শিক্ষকের স্মৃতির উদ্দেশে বিনম্র শ্রদ্ধা
লেখক ঃ প্রাবন্ধিক ও গল্পকার

মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের  ৪০ বছরে প্রত্যাশার বাংলাদেশ
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
সময়ের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এবার পুর্তি হলো স্বাধীনতার ৪০ বছর। ডিসেম্বর  বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় মাস। ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনার মাস। ডিসেম্বরকে ঘিরে তাই বাঙালি জাতির সুখ ও গর্বের শেষ নেই। বাঙালির  ইতিহাসে  দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা, ত্যাগ ও তিতিক্ষার সুদীর্ঘ পথ ধরে একাত্তরের ২৬ মার্চ শুরু হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের লাখো মুক্তিকামী মানুষ অংশ নেয় মহান সে মুক্তিযুদ্ধে। দেশের সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশসহ কৃষক, শ্রমিক, মজুর, ছাত্র-জনতা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। সেখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে অংশ নেয় মুক্তিযুদ্ধে। স্থাপন করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালা যুগিয়েছিল মুক্তির লড়াইয়ে অনন্ত প্রেরণা। একাত্তরের পঁচিশ মার্চের কালরাতে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। ঝাঁপিয়ে পড়ে দানবিক হিংস্রতা নিয়ে। শুরু করে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। ওরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় ঘরবাড়ি, হাটবাজার। লুটপাট করে মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ, বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। নরপিশাচদের নৃশংসতা থেকে রক্ষা পায়নি দেশের নারী, শিশুরাও। দীর্ঘ ন’মাস ধরে চলা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী এবং ওদের দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামসের উš§ত্ততার শিকার হন দেশের অগণিত স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হন। খুন, ধর্ষণের শিকার হয় দেশের আড়াই লক্ষাধিক নারী। গ্রাম বাংলার নদনদী, খালবিলে ভাসতে থাকে অগণিত লাশ। শিয়াল, কুকুর, শকুন ছিঁড়ে খায় বাংলার মানুষের গলিত দেহ। একাত্তরের পঁচিশ মার্চ থেকে শুরু করে  ষোলই  ডিসেম্বর বিজয় লাভের দিন পর্যন্ত চলে এ হত্যাযজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে চৌদ্দই ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী ওদের দোসরদের সহযোগিতায় চালায় এ দেশের  বুদ্ধিজীবী হত্যার সর্বশেষ নৃশংস অভিযান। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে দেশকে মেধাশূন্য করার নীলনক্সার অংশ হিসাবে ওরা  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পীসহ সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ শেষে নির্মম ভাবে হত্যা করে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মৃতদেহকে ওরা মিরপুর ও রায়ের বাজারে ফেলে রাখে। রাজধানী ছাড়াও সারা দেশব্যাপী চলে এ ধরনের বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ। ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে মহম্মদপুরের ঘাঁটিতে নির্মম অত্যাচার করে। হানাদার বাহিনীর হিংস্র থাবায় শহীদ হন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডঃ জিসি দেব, আলীম চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, সেলিনা পারভীন, ডঃ ফজলে রাব্বি, সন্তোষ ভট্টাচার্য, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমদ, ডাঃ আলীম চৌধুরী, আবুল খায়ের, ডাঃ গোলাম মর্তুজা, সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদ, আনম গোলাম মোস্তফা, আর. পি সাহা, রশীদুল হাসান, নতুন চন্দ্র সিংহ, ডঃ সাদেক, খন্দকার আবু তালেব, ডঃ মুক্তাদির, আলতাফ মাহমুদসহ বহু প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধির মানুষ। মানসিক ভারসাম্যহীন কথা সাহিত্যিক শহীদ সাবেরকে ওরা সংবাদ অফিসে পুড়িয়ে মারে। ওরা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করে দিতে শেষ চেষ্টায় মেতে ওঠে। কেননা ওরা বুঝে ফেলেছিল এ দেশ স্বাধীন হবে। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হত্যাযজ্ঞ দেখে সারা বিশ্বের বিবেক কেঁপে ওঠে। নিউইয়র্কের রেডিসন স্কোয়ারে মার্কিন পপ তারকা জর্জ হ্যারিসন ও ভারতীয় সুর সম্রাট রবিশঙ্কর কনসার্ট করে তহবিল সংগ্রহের অর্থ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দান করেন। দেশের লাখ লাখ সাধারণ মানুষ মাতৃভূমি রক্ষার শপথ নিয়ে ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। প্রায় এক কোটি শরনার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা দিতে শত চেষ্টা সত্বেও সেখানে দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। শরনার্থী শিবিরে প্রায় তিন লক্ষ শিশু অপুষ্টিতে মারা যায়। এ সব দেখে বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত হয়ে যায়। হাত বাড়ায় বাংলাদেশের অনেক বন্ধুপ্রতিম দেশ। মুক্তিযুদ্ধ আরো বেগবান হয়। ভারতের মিত্রবাহিনী ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সাহায্য করে। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নগর অবকাঠামো ধ্বংসস্ত’পে পরিণত হয়। গ্রামগঞ্জ, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, রেললাইন ভেঙ্গে, পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ  মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও  দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রমহারা হন। লাখ বাঙালির ত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আসে চুড়ান্ত বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পায় স্বাধীন, সার্বভৌম এক দেশ, বাংলাদেশ। স্বাধীনতা লাভের পর মাত্র পাঁচটি বছর যেতে না যেতে পঁচাত্তরের পনেরই আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। তারপর জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গণতন্ত্র থেকে দেশ দূরে সরে যায়।  একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর নারকীয় গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী কাজে সহায়তাকারীদের এতো বছর পরেও অভিযুক্ত করে বিচারকার্য স¤পন্ন করা যায়নি। হয়নি তাদের শাস্তি। পাশাপাশি দেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন উপেক্ষিত। লাঞ্ছনা, বঞ্চনার  শিকার হয়ে তাদের জীবনে নেমে এসেছে চরম হতাশা। তাদের কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ আজো বাস্তব রূপ নেয়নি। অবশেষে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ক’জনের শাস্তির রায় কার্যকর করা হয়েছে।  একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার  শুরু করেছে বর্তমান সরকার। বিজয়ের মাস উপলক্ষে এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার দাবিতে নানা কর্মসূিচ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল। পাশাপাশি জেলহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারেরও জোর দাবি উঠেছে সর্বত্র। এ সব দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে দেশব্যাপী নেওয়া হচ্ছে নানা কর্মসূচি। দেশের  প্রগতিশীল, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যুদ্ধাপরাধীসহ অন্যান্য হত্যার বিচারের দাবিতে হয়েছে সোচ্চার। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে  রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে  বাংলাদেশের  প্রতিটি শহরবন্দর, গ্রামগঞ্জে নৃশংস সব হত্যাকান্ডের বিচারের জোর দাবি উঠে আসছে। চৌদ্দই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ভাব গম্ভীর পরিবেশেও ছিল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের শাস্তি প্রদানের উচ্চকিত দাবি। মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের জনগণের বক্তব্য গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে যা দেশের কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ করছে। নতুন প্রজš§ আজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এবং ঘৃণ্য হত্যাকান্ড ও অপরাধের বিচারের দাবিতে মুখর।  একে আরো  বেগবান করতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস আরো বেশি করে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সমৃদ্ধ  নানা ধরনের বই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশজুড়ে গড়ে তুলতে হবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। মুক্তিযোদ্ধাদের দিতে হবে যথাযথ সম্মান। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে। যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ দেশে একদিন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, দেশের মুক্তিকামী মানুষ লাল-সবুজ বিজয় পতাকা ছিনিয়ে এনেছিল, তাকে সফল করে তুলতে হবে। গড়ে তুলতে হবে এক শোষণহীন, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। স্বাধীনতার চার দশকে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে অনেক।তবে রয়েছে বেশ কিছু অপূর্ণতা। সকল লোভ লালসার উর্ধ্বে থেকে, অমূল্য জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে যারা দেশকে স্বাধীন করেছিল, ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়, তাদের অসাধ্য কিছু থাকতে পারে না। তাই স্বপ্নের বাংলাদেশে একাত্তরের চেতনায় অর্থনৈতিক মুক্তি, আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একটি মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের সাহসী মুক্তিকামী মানুষ একদিন এ দেশকে আলোয় আলোয় ভরে তুলতে সক্ষম হবে-এ প্রত্যাশা আমাদের।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তির পূর্বক্ষণে ১৩ ডিসেম্বর ভোরবেলা চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী । আমার প্রথম জীবনের প্রিয় এ শিক্ষকের স্মৃতির উদ্দেশে বিনম্র শ্রদ্ধা
    লেখক ঃ প্রাবন্ধিক ও গল্পকার
সরিষার ভেতরের ভূত ছাড়াতে না পারলে অস্থিরতা কমবে না
মীর আব্দুল আলীম

পুঁজিবাজারের ইতিহাসে স্মরণীয় একটি বছর ২০১১। এ বছরের পুরো সময়জুড়েই পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক উত্থান-পতনের ঘটনা ঘটেছে। মহা ধসের ঘটনা ঘটেছে পুঁজিবাজারে। ৯৬ এর সেই খল নায়করাই কলকাঠি নাড়ছে এবারো। গত ১ বছরে ধসে যাওয়া বাজারকে আর সোজা করে দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। সরকার বাজার চাঙ্গা করতে ওই ধোঁকাবাজদের রেখেই চেষ্টা চালায় বলে কাজের কাজ কিছুই হয় না।  পরিতাপের বিষয় এখানেই যাদের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীরা কারসাজির আঙ্গুল তুলেছেন তাদের সর্বশেষ বৈঠকে রাখা এবং বিনিয়োগকারীদের কোনো প্রতিনিধিকে না রেখে শেয়ারবাজার দাঁড় করানোর চেষ্টা করায় প্রশ্ন উঠতেই থাকে। মূলত শেয়ারবাজারের কারসাজির সঙ্গে জড়িতরা বরাবরই রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। শেয়ারবাজার থেকে কমপক্ষে ১ লাখ কোটি টাকা লুট হয়েছে এবং এ লুটের অর্থের বড় অংশই দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে এমন অভিযোগও উঠেছে। শেয়ারবাজার ধসের পর থেকে ডলারের তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়ায় এ অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ মেলে। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেয়ারবাজার চাঙ্গা করতে পদক্ষেপ নেন। এতে আশার সঞ্চার হয় শেয়ারবাজারে। কিন্তু সবই মরীচিকা। শেয়ারবাজারে মহা ধসের বছরপূর্তিতেও ধস ঠেকানো যায়নি। নিঃস্ব হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। প্রণোদনা পর্যবসিত হচ্ছে প্রহসনে। ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্ট। ওইদিন ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৬৮ হাজার  কোটি টাকা। আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৪৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এক বছর পর ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর সাধারণ সূচক নেমে এসেছে ৫ হাজার ৫১ পয়েন্টে। বাজার মূলধন এসে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকায়। আর লেনদেন হয়েছে মাত্র ২২৩ কোটি টাকা। এক বছর আগে লেনদেনের শীর্ষে থাকা এবি ব্যাংকের একারই লেনদেন হয়েছিল ১৪০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। লেনদেনের শীর্ষে থাকা কোম্পানি ফুয়াং সিরামিকের লেনদেন হয়েছে মাত্র ৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পর বিনা প্রশ্নে কালো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর সমর্থনে কথিত বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে স্লোগান দিয়েছে। বাজারে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষও এটাকে সমর্থন দিয়েছে। তাহলে কী নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই থাকবে না? কালো টাকা মানে তো কর ফাঁকি দেয়া টাকা। একবার কর ফঁাঁকি দেয়া হবে। আরেকবার সেই ফাঁকিকে  বৈধতা দেয়া হবে। এভাবে চলা মানে তো দেশের সব মানুষকেই কালো টাকা বানাতে উৎসাহিত করা। এটা কোনোভাবেই সুস্থ ও টেকসই নীতি হতে পারে না। কালো টাকায় শেয়ারবাজার চাঙ্গা করার মানে হলো বেলুনকে অল্প সময়ের জন্য ফুলিয়ে তোলা। যে কোনো মুহূর্তে এটি চুপসে যাবে। ভাবনা ছিল কালো টাকার আর নানা আয়োজনে ক্ষণিকের জন্য হলেও বাজার ফুলে-ফেঁপে উঠবে। কিন্তু সবই গুড়েবালি। বাজার ফুলেও উঠল না আর চুপসানোরও সময় পেল না। আসলে কিছুতেই কিছু হবে না। বলা যায় সবই লোক দেখানো কারসাজি। সরকার সরর্ষের ভেতর ভূত রেখেই সব করতে চায়। ফটকাবাজদের  রেখেই শেয়ারবাজার সাজাতে চায়। তা কখনই সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই ধস নামে বাজারে। যতদিন মামদো ভূতদের ওই শেয়ারবাজার থেকে ঝেটিয়ে বিদায়ই করা না যায় ততদিনই শেয়ারবাজার চাঙ্গা হবার লক্ষণ নেই। শেয়ারবাজারের মন্দাবস্থা একদিনে হয়নি। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ন্ত্রকরা পেশাদার মনোভাব নিয়ে বাজার পরিচালনা করতে পারেননি, এটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেই উল্লেখ রয়েছে। বেআইনি না হলেও অনৈতিক কার্যকলাপই শেয়ারবাজারের এমন পরিস্থিতির পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে উল্লেখ করে কমিটি অধিক তদন্তের সুপারিশও করেছিল। এতদিনেও তাদের সে সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় আস্থার সংকট আরো প্রকট হয়েছে। সার্বিকভাবে শেয়ারবাজারের অবস্থা সঙ্গীন হয়েছে। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে, আইনি মোড়কে অনিয়মকে জায়েজ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের যে অর্থ লুট করা হয়েছে তার বিচার এবারো হবে না বলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন। তাদের অভিযোগ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সাধারণ বিনিয়োগকারীর অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিল। এবার ক্ষমতায় আসার পর পরিকল্পিতভাবে এবং আরো বড় আকারে তাদের অর্থ লুট করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালের হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় এবারো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তারা এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি পুঁজি এবং ক্ষমতার অধিকারী। শেয়ারবাজারের কারসাজির সঙ্গে জড়িতরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। শেয়ারবাজার থেকে কমপক্ষে ১ লাখ কোটি টাকা লুট হয়েছে এবং এ লুটের অর্থের বড় অংশই দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে বলে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে। শেয়ারবাজার ধসের পর থেকে ডলারের তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়ায় এ অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ মেলে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিচ্ছেন, কোনো কারণে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আশ্বাসও যদি স্থিতিশীলতা ফেরাতে ব্যর্থ হয় তাহলে তা শেয়ারবাজারে আগের চেয়ে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। শেয়ারবাজারের চাহিদামাফিক বিনিয়োগ করতে হলে ব্যাংকগুলোর অর্থপ্রবাহ তথা তারল্য সংকট দূর করার তাগিদ দিয়েছেন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীরা। একই সঙ্গে সংকট দূর করতে নগদ সংরক্ষণ হার (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ তারল্য হার (এসএলআর) কমানোসহ বিভিন্ন ছাড় দেয়ার প্রস্তাব করেছেন তারা। এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) জানিয়েছে, সংকটের মধ্যেও ব্যাংকগুলো বাজারে সাধ্যমতো বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। তবে বিনিয়োগযোগ্য অর্থ সংকটের কারণে ইচ্ছা থাকলেও শেয়ারবাজারে চাহিদামাফিক বিনিয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। কারণ খোদ সরকারই ব্যাংক ঋণনির্ভর হয়ে পড়েছে। কোনো দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকেই ঋণ বা অনুদানের ছাড় পাচ্ছে না। প্রতিদিনই ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে চলেছে সরকার। সরকারের এ ঋণের চাহিদা মেটানোর মতো নগদ অর্থ নেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে। সরকারের ঋণের চাহিদাকে প্রত্যাখ্যান করার আইনি অধিকারও নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের। সরকার চলতি অর্থবছরের সাড়ে চার মাসে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ করেছে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেয়া হয়েছে প্রায় পৌনে ১১ হাজার কোটি টাকা।
গত বছরের ৬ ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা স্টক এক্সেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ সূচক পড়েছে প্রায় ৩৮৫০ পয়েন্ট। একই সময়ের মধ্যে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ৩২৫০ কোটি টাকা থেকে ২০০ কোটি টাকার কাছাকাছি নেমে এসেছে। এ সময়ের মধ্যে বাজারে আইপিওর মাধ্যমে নতুন আসা কোম্পানি এবং পুরনো কোম্পানিগুলোর রাইট ও বোনাস শেয়ার যোগ হওয়ার পরও ডিএসইর বাজার মূলধন (তালিকাভুক্ত সকল শেয়ারের বাজার মূল্যের যোগফল) কমেছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। ডিএসই থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত সকল কোম্পানির শেয়ারের দর ও আয়ের (পিই) অনুপাতের গড় ছিল ১৪.৫১। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে এ গড় ২৩.৫৮-এ দাঁড়ায়। ২০০৮ সাল শেষে পিই অনুপাত ১৮.৪২-এ নেমে আসে। বাজারের ঊর্ধ্বগতির ফলে ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পিই অনুপাত দাঁড়ায় ২৫.৬৫-এ। ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর বাজার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় পিই অনুপাত ২৯.১৬-এ উঠে যায়। সেখান থেকেই বাজারের পতন শুরু হয়। এ বছরের জুন মাসে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর গড় পিই দাঁড়ায় ১৬.৫৫-এ। জুলাই মাসে বাজার কিছুটা চাঙ্গা ছিল। ফলে ওই মাস শেষে বাজারের গড় পিই ১৭.৫৩-এ ওঠে। কিন্তু সাড়ে চার মাস ধরে ধারাবাহিক পতনের ফলে বর্তমানে বাজারের গড় পিই অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১৩.৫০-এ। সেই হিসেবে বলা যায়, ২০০৯-১০ সালে ব্যাপকভাবে ফুলে-ফেঁপে ওঠা শেয়ারবাজার এখন ২০০৬-এর পর্যায়ে নেমে এসেছে। নানা জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে দেশের পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা বা গতিময়তা ফেরানোর জন্য বেশ কিছু প্রণোদনাগুচ্ছ ঘোষণা করা হলো গত ২৩ নভেম্বর, ২০১১। সরকারের পক্ষে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা (এসইসি) এসব প্রণোদনা ঘোষণা করে। এরই জের ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকও কিছু বিধিবিধানে শিথিলতা এনেছে। মানুষকে অযথা আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। শেয়ারবাজারকে ঘিরে যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা রয়েছে, সেটিকে আরো প্রলম্বিত করা হচ্ছে। এতে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আরো বেগ পেতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে বাধ্য করানো হলে তা হবে আরো ক্ষতিকর। শেয়ারবাজার কেন, যে কোনো বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেয়াই কাম্য। এটি তাদের জন্য আরো বড় বোঝা হয়ে যেতে পারে। এটা ঠিক হবে না। এখন জোর আলোচনা চলছে এসব প্রণোদনা কিভাবে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একটা বিষয় স্পষ্ট যে তাৎক্ষণিকভাবে এর কোনো প্রভাব পড়বে না, পড়া সম্ভবও নয়। ধীরে ধীরে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে অনেক ‘যদি’ বাস্তবায়ন বা কার্যকর হওয়ার পর। এসব প্রণোদনা দেয়া হয়েছে নানাবিধ চাপ ও দাবির মুখে। রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করা এক  শ্রেণীর বিনিয়োগকারী ও কারবারি, বাজারের বড় বড় ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং শেয়ারবাজার থেকে সুবিধাভোগী বিভিন্ন পক্ষ মিলে এসব চাপ ও দাবি তুলেছে যার অনেকটাই  যৌক্তিক নয়। তার পরও সরকারকে এই চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছে নিজেদের ক্রমাগত ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতার কারণে। এটাই এসব প্রণোদনার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। এর মধ্য দিয়ে এ রকম একটি বার্তাও দেয়া হয়েছে যে পুঁজিবাজারে সমস্যা হলেই সরকার এগিয়ে আসবে, নানা ছাড় ও সুবিধা দেবে। কোনো সন্দেহ নেই, আগামীতেও বাজারের বড় দরপতন হলে আবার ছাড় দেয়ার দাবি উঠবে। কথিত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সামনে রেখে বড় ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ফায়দা লুটতে চাইবে।  দেশের সচেতন মহলের চোখ ফাঁকি দিয়ে শেয়ারবাজারের কোটি কোটি টাকা লুট করে নিল গুটিকয়েক লোক। আজ তারা ধরাছেঁাঁয়ার বাইরে। রাস্তায় রাস্তায় সমাবেশ, মিছিল-মিটিং আর মানববন্ধন করেও কোনো আশা মেলে না ক্ষতিগ্রস্তদের। সরকারের আশার বাণী আজ মরীচিকার মতো মনে হয় এদের কাছে। সরকারের উচিৎ এখনই শেয়ারবাজারের একটা বিহিত করা। শেয়ারবাজার পতনের পেছনে যারা জড়িত তাদের শনাক্ত করে উপযুক্ত বিচার করা। ক্ষতিগ্রস্তরা যেন আবার আশার আলো দেখতে পায়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট


যুদ্ধাপরাধীদের বিচার: ৪০তম বিজয় দিবসে আমাদের প্রত্যাশা
অরুণ ব্যানার্জী
ডিসেম্বর মাস। বিজয়ের মাস। বাঙালি জাতির আÍোপলব্ধির মাস। মানসপটে ভাসছে টুকরো টুকরো স্মৃতি। অনেক মুখ। যার কিছু ঝাপসা হয়ে গেছে। আর কিছু স্মৃতিতে অমলিন। অনেক কথা। অনেক অকথিত কাহিনী। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আমাদের অনেককে উš§থিত করে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক পীড়ন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালিদের তেজদীপ্ত প্রতিবাদ। ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক-বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ অংশ নিয়েছে এ যুদ্ধে। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সংবাদ সমীক্ষা’ কিংবা ‘সংবাদ পরিক্রমা’ আমাদের শত্র“ হননে অনুপ্রাণিত করেছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘চরমপত্র’ খ্যাত এম আর আক্তার মুকুলের কণ্ঠ সংবলিত কথিকা আমাদের শুনিয়েছে আশার বাণী। পাকিস্তানি দালাল রাজনীতিবিদ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পরিবেশন করে তাদের মুখোশ উšে§াচিত করেছেন সাংবাদিক আমির হোসেন। খ্যাতিমান সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য শুধু সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলায় কলম ধরেননি; কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ ‘যুগান্তর’ ও ‘বসুমতী’ পত্রিকায় লিখেছেন। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে পারদর্শী লিয়াকত আলী খান, গোলাম মোহাম্মদ, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, ইস্কান্দার মীর্জা, মাহমুদ আলী, আইয়ুব খান, ফকা চৌধুরী জুলফিকার আলী ভুট্টো, মোনেম খান, গোলাম আযমসহ অনেক রাজনীতিবিদের অতীত কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি তার শক্তিমান কলমকে রূপান্তরিত করেছেন রাইফেলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তর প্রদেশ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় ট্রেনিং নিয়েছেন। ট্রেনিং নিয়েছেন বাংলাদেশের বনে- জঙ্গলে। গ্রামের অভাবী মানুষ তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। করেছেন খাদ্য ও রসদ সরবরাহ। বাংলাদেশের মানুষ বর্বর খানসেনা ও তাদের দোসরদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে। হয়েছে ধর্ষিতা। জীবন বাঁচাবার তাগিদে এক কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ও বর্মায় (মিয়ানমারে)। ইচ্ছা করলেই তো অস্বীকার করা যাবে না এসব শরণার্থীর অবর্ণনীয় এমনকি অসহনীয় জীবন ধারণের কথা। অস্বীকার করা যাবে না ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক টালীর সেদিনের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য সংবলিত রিপোর্টের কথা। আমাদের সেই দুর্দিনের মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি কিংবা ব্রিটিশ এমপি জন স্টোন হাউজের ভূমিকা বিস্তৃত হওয়ার নয়। ভারতের গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা আমাদের মনের মণিকোঠায় আজো অমলিন।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ আকস্মিকভাবে হয়নি। এর পেছনে ছাত্র, সাংস্কৃতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, কৃষক, শ্রমিক তথা সর্বস্তরের মানুষের ভূমিকা রয়েছে। ’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত রয়েছে অনেক রক্তক্ষয় নির্যাতনের কাহিনী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তাই পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনের ফসল। একজন মেজরের ঘোষণায় রূপকথার মতো হঠাৎ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। পাকিস্তানের জল্লাদরূপী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার পার্টনার ইন ক্রাইম (চধৎঃহবৎ রহ পৎরসব) হচ্ছেন লারকানার নবাব জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের গণহত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী। তাকে মদদ দিয়েছেন জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামে ইসলাম, কিছু ছদ্মবেশী বামপন্থি, বিভ্রান্ত আওয়ামী লীগার ও ভাসানী ন্যাপসহ কিছু ছদ্মবেশী প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের নেতাকর্মীরা একাত্তরে গণহত্যায় উদ্যোগী হয়েছে। এরা নারী নির্যাতনে অংশ নিয়েছে। অনেক অবিবাহিতা ও বিবাহিতা যুবতীকে ধর্ষণ করেছে। বহু অমুসলিম নর-নারী, যুবক-যুবতীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক করেছে ধর্মান্তরিত। বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। লুণ্ঠন করেছে সম্পদ। পাক হানাদার বাহিনীকে এরা পথ দেখিয়েছে। এমনকি নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞে তথা সব রকম অমানবিক দুষ্কর্মে এরা পাক বাহিনীকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছে। বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নিমিত্তে দালাল আইনের আওতায় গঠন করেন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। ২৮ মার্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধাপরাধীদের ও দালালসহ মুক্তিযুদ্ধকালে হত্যাকারী, ধর্ষক, অগ্নিসংযোগকারী ও সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের বিচারের জন্য ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠনের গেজেট প্রকাশ করা হয়। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে ’৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৪শ’ ৭১ জন ঘাতক দালালকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে ২ হাজার ৮শ’ ১৮ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষে দেয়া হয় ফাইনাল রিপোর্ট। আর ১৬ হাজার আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এদের মধ্যে ৭শ’ ৫২ জন যুদ্ধাপরাধী ও দালালকে বিচার করে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়। এদের মধ্যে অনেক আসামিকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ট্রাইব্যুনালে বিচারের ব্যাপারে অন্য কোনো কোর্টে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না এই মর্মে একটি আইন করা হয়। বিভিন্ন কারণে বঙ্গবন্ধু  ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বিশেষ শর্তে এই আইনের আওতায় গ্রেফতারকৃতদের এক অংশের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। ওই সাধারণ ক্ষমার ঘোষণায় বলা হয় যাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, গৃহে অগ্নিসংযোগের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তারা এর আওতায় আসবে না। সাধারণ ক্ষমার আওতায় প্রায় ২৬ হাজার অভিযুক্ত মুক্তি পায়। কিন্তু বাকি ১১ হাজারের বেশি অভিযুক্ত মুক্তি পায়নি। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার ফরমানবলে দালাল আইনটি বাতিল করে দেন। তবে দালাল আইনে যাদের বিচার হয়েছিল এবং উচ্চ আদালতে আপিল শুনানি হয়েছিল তাদের মামলা বাতিল হবে না বলে ওই সামরিক ফরমানে বলা হয়। কিন্তু জিয়াউর রহমান সরকার তার ঘৃণ্য রাজনীতির স্বার্থে সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন সব মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেন। উল্লেখ্য, খোন্দকার মোশতাক ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট রক্ত পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে দালাল আইনটি স্থগিত ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তার অনুগত সংসদে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে সামরিক আইনের অধীনে প্রণীত সকল ফরমান ও আদেশকে বৈধতা দেয়া হয়। তিনি সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করেন। তাতে যুদ্ধাপরাধে যুক্ত ছিল যেসব ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল তারা অধিকার পায় রাজনৈতিক দল গঠনের। ওটাই ৫ম সংশোধনীর আওতায় বৈধতা দেয়া হয়। এই সুযোগে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দল আÍপ্রকাশ করে। আর সেই বিষবৃক্ষের ফল ধর্মীয় জঙ্গিবাদ।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিডিআর বাহিনী, উপদেষ্টা পরিষদ পরবর্তীতে মন্ত্রিপরিষদে পাকিস্তানপন্থি, যুদ্ধাপরাধীদের ঠাঁই দিয়েছিলেন বিশেষ মর্যাদায়। ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী জলসায় স্লে­াগান ওঠে; ‘তাওয়াব ভাই, তাওয়াব ভাই চাঁদ তারা পতাকা চাই’ (ইত্তেফাক, ৮ মার্চ, ১৯৭৬) সেদিনের বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এমএজি তাওয়াবের বদান্যতায় এই জলসা ছিল রাজাকার-আলবদর-আলশামস তথা জামায়াত ও স্বাধীনতার বিরোধীদের প্রথম সমাবেশ। ওই মজলিসে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। ওই দাবিতে বলা হয়; দেশের পতাকা বদলাতে হবে। নতুন জাতীয় সঙ্গীত চালু করতে হবে। দেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করতে হবে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের শহীদ মিনার  গুঁড়িয়ে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত রাজাকারদের স্মরণে মিনার নির্মাণ করতে হবে। এসব দাবি দাওয়ার ফলশ্র“তিতে যুদ্ধাপরাধী শাহ আজিজ প্রধানমন্ত্রিত্বের আসন অলঙ্কৃত করেন। যুদ্ধাপরাধী মশিউর রহমান যাদু মিঞা, আব্দুল আলীম, মাওলানা মান্নান প্রমুখ তার সরকারের মন্ত্রিত্ব পান। এরই রেশ ধরে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করে চিহ্নিত পাকিস্তানপন্থি যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে। গোলাম আযম নাগরিকত্ব পায়। জামায়াতে ইসলামী বেগম জিয়ার ৪ দলীয় জোটের সরকারের আমলে ক্ষমতায় পার্টনার হয়। তার গুণধর পুত্র যুবরাজ তারেক রহমান বলেন; জামায়াত-বিএনপি পরস্পর ভাই ভাই। বেগম খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের রোড মার্চের নামে নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানাবেন কিংবা তারা কোনো অপরাধ করেনি বা ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা অথবা আন্তর্জাতিক মানসম্মত বিচার ব্যবস্থা নয় এমন প্রশ্ন তুলবেনÑ তাতে বিস্মিত হবার কি আছে?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বর্তমান সময়ের দাবি। আন্তর্জাতিক জনমতও এর পক্ষে। মহাজোট সরকারের এটা নির্বাচনী ইস্তেহারের অঙ্গ। তরুণ প্রজšে§র ভোটাররা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে চায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ছিল মিত্রবাহিনীতে। পক্ষান্তরে অপশক্তিতে ছিল জার্মান, জাপান ও ইতালি। ১৯৪৫ সালে বিজয়ী মিত্রশক্তি গণহত্যার বিরুদ্ধে গঠন করেন নুরেনবার্গ ট্রায়াল। এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য বিচার ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে এ বিচার ব্যবস্থা প্রথম বিচার প্রক্রিয়া। নুরেনবার্গ ট্রায়ালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণহত্যার দায়ে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট ৩০ জনকে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়। ১৯৪৫ সালের ২০ নভেম্বর বিশ্বে গণহত্যার বিরুদ্ধে গঠিত আন্তর্জাতিক আদালতে ২৫ ঘণ্টাব্যাপী রায় প্রদানের মাধ্যমে এ শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল। এ বিচারে গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনাকেই মূল অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ বিচারে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর কোনো প্রয়োজন হয়নি। প্রত্যক্ষ সাক্ষী-প্রমাণের চেয়ে সংবাদ দালিলিক তথ্যাদি, ছবি, উড়পঁসবহঃধৎু ও চলচ্চিত্রকে মুখ্য প্রমাণপত্র হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নুরেনবার্গ ট্রাইব্যুনালে হিটলারের মন্ত্রিসভার সদস্য হারমান গোয়েরিংয়ের মৃত্যু দণ্ডাদেশ হয়েছিল। তিনি বিচারের সময় আদালতে দাঁড়িয়ে নাৎসী বাহিনীর গণহত্যা ও বর্বরতা সম্পর্কে দম্ভোক্তি করে বলেছিলেন, ‘এটি ফুটবল খেলার মাঠে জয়-পরাজয়ের মতো।’ অবশ্য গোয়েরিং ফাঁসির জন্য নির্ধারিত তারিখের আগের রাতে আÍগ্লানিতে দগ্ধ হয়ে আÍহত্যা করেন। নুরেনবার্গ ট্রায়াল ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আদালত ও বড় বিচার ব্যবস্থা। এই বিচারে খুনিরা সবাই গণহত্যার কথা বেমালুমভাবে অস্বীকার করে। এর মধ্যে অচউইজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে লেফটেনেন্ট কর্নেল রুডলফ এস, এন্ডট্রান্স কার্ডিন্যান্ড ওয়েস কমপক্ষে সাড়ে ৩ লাখ লোককে হত্যা করে। যদিও আদালতে তিনি প্রথমে গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরে অবশ্য তিনি স্বীকার করেন আড়াই লাখ লোককে তারা হত্যা করেছিল। নুরেনবাগ ট্রায়ালে এ পর্যন্ত যাদের যখন সন্ধান পাওয়া গেছে তাদের তখনই বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিই হচ্ছে জনগণের প্রত্যাশা। ১৯৯২ সালে ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এরপর একই বছর ১৫  ফেব্র“য়ারি গোলাম আযম ও তার দোসরদের বিচার এবং জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি।’ এতে ৭২টি রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের প্রতিনিধি ছিল। ওই বছর ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শহীদ জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় গণআদালত। এতে অনুষ্ঠিত হয় গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার। তাকে ১০টি অভিযোগে অপরাধী বলে শনাক্ত করা হয়। প্রতিটি অপরাধই মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। ’৯০-এর দশকে বসনিয়া, রুয়ান্ডা, পূর্ব তিমুরসহ বিভিন্ন দেশে গণহত্যার বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ভিয়েতনামে চলছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম। কম্পুচিয়ায় গণহত্যা তদন্ত ও বিচার কাজ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মোল্যা, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী ও বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমকে বিচারের আওতা থেকে নিষ্কৃতি দেয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে ১৯৭৩ সালে ২০ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন প্রণয়ন (১৯৭৩ সালের ১৯ নং, আইন) করা হয়। এতে ঐতিহাসিক নুরেনবার্গ ট্রাইব্যুনালে বিচারিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ২ জন আইনজীবীর সহযোগিতা নেয়া হয়। ২০০৯ সালে ১৪ জুলাই আইনটি সংশোধনী করে যুগোপযোগী করা হয়েছে। এতে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ রাখা হয়েছে। তথ্য-উপাত্ত ছাড়াও চাক্ষুস স্বীকার সাক্ষ্য দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। বর্তমান যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল অবশ্যই স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানসম্মত। বেগম খালেদা জিয়া যতই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আন্দোলনের হুঙ্কার তুলুন না কেনÑ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে হবেÑ এটাই ৪০তম বিজয় দিবসে আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট 


বিজয়ের ৪০ বছর  এবং ’৭১-এর সেই দিন
রহিম আব্দুর রহিম  

৩৯ বছর পেরিয়ে ৪০-এ পা। ১৯৭১ সাল। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার বছর। পাকিস্তানি শাসন-শোষণের কব্জা থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে সেদিন বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে লড়েছে। ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা। দীর্ঘ ৯টি মাস এ জন্য জাতিকে লড়তে হয়েছে এক শক্তিশালী ও বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ৯ মাসের এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে কয়েক লাখ মানুষ আত্মহুতি দিয়েছে। অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে দেশের সম্পদের।     এই যুদ্ধে শুধু যে লড়াকুরা প্রাণ হারিয়েছেন তাই নয়, প্রাণ হারিয়েছেন যারা এই যুদ্ধকে সমর্থন করেছেন। যত্রতত্র মানুষ জীবন হারিয়েছে হানাদার বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার-আলবদর নামের ঘাতকবাহিনীর হাতে। অগণিত মানুষের জীবনের বিনিময়ে বাঙালি জাতি তাদের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের আত্মহুতির মাস হিসেবে পুরো ডিসেম্বর মাসকে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শহীদদের মাজার, মিনার ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়।     স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ লোক মারা গেছেন। এ যুদ্ধে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, পুলিশ, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ অনেকেরই প্রাণহানি ঘটেছে। তাদের অধিকাংশই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবু তাদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। তাদের কারো নাম ইতিহাসে গ্রন্থিত হয়েছে, আবার কারো নাম সুরের ভুবনে পল্লবিত হচ্ছে। ‘হয়তবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না, বড় বড় লোকদের ভিড়েÑ জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে তোমাদের কথা কেউ কবে নাÑ হে বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা তোমাদের এই ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না।’ জনপ্রিয় এই দেশাত্মবোধক গানের কলিতে তাদের প্রতি শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতার বাণী প্রকাশ করা হয়েছে। এই স্বাধীন দেশে জš§গ্রহণ করে, নবপ্রজš§ আবারো সুরের ভুবনে বিমোহিত হচ্ছেÑ ‘জš§ আমার ধন্য হলাম মাগো- কেমন করে আকুল হয়েÑ আমায় তুমি ডাকো’ এই গানের ভুবনের প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় মহা মনীষীদের আত্মাহুতি নির্মম কাহিনী নিয়েই আমাদের আজকের প্রতিবেদন। এক হিসেব অনুযায়ী দেখা যায়, পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আগেই ৩৬০ জন বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিকদের হত্যা করে পরিকল্পিতভাবে। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, লে. জে. নিয়াজী আত্মসমর্পণের আগেই অত্যন্ত পরিকল্পিত ও নৃশংসভাবে বুদ্ধিজীবী ও অন্যদের হত্যা করেছিল। অবশ্য কিছু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল ২৫ মার্চে বা মার্চ-এপ্রিলে।  যে সব বুদ্ধিজীবী ১৯৭১ সালে নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, এ এন এম মনিরুজ্জামান, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, আবদুল মুকতাদির, এস এম রাশীদুল হাসান, ড. এন এম ফয়জুল মহী, ফজলুর রহমান খান, ড. সিরাজুল হক খান, ড. এম এ খায়ের, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, নিজামুদ্দিন আহমদ, শহীদ সাবের, সেলিনা পারভীন, আলতাফ মাহমুদ, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, মেহেরুন্নেসা, ডা. ফজলে রাব্বী, আব্দুল আলীম চৌধুরী, দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ ও শামস ইরানী। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, এ এন এম মুনিরুজ্জামান ২৫ মার্চ অর্থাৎ পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর প্রথম আক্রমণেই তারা নিহত হন। জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ২৫ মার্চ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আলতাফ মাহমুদ মারা যান আগস্টে। যিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সহযোগী হিসেবে অনন্য অবদান রেখেছেন। তার বাড়িতে অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যায়, এ থেকে বোঝা যায় যে, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বতোভাবে সহযোগিতা দান করেছেন।    
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় আরো রয়েছেন অনীল চন্দ্র মল্লিক, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, অমল কৃষ্ণ সোম, আজাহারুল হক, আতাউর রহমান, আনোয়ারা পাশা, আনোয়ারুল আজীম, আবদুস সোবাহান-১, আবদুস সোবাহান-২, আবদুর রউফ সরদার, আবদুর রহমান, আব্দুল আহাদ, আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার, আব্দুল গনি, আব্দুল গফুর, আব্দুল জলিল, আব্দুল জব্বার, আব্দুল মমিন, আব্দুল মান্নান ভূঁঁইয়া, আবু তালেব, আবুল বাসার, আবুল কালাম আজাদ, আ কা মোঃ শামসুদ্দিন, আবু সাঈদ, আবু হেনা শামসুদ্দোহা, আবদুস সাত্তার, আবুল খায়ের, আমির উদ্দীন, আলতাফ হোসেন ইজারাদার, আলতাফ, হোসেন, আলমগীর, আশরাফুল ইসলাম ভুঁইয়া, এ এন এম মনিরুজ্জামান, এ এফ এম জিয়াউর রহমান, এ কে এম নূরুল হক, এ কে এম বদিউজ্জামান মণ্ডল, এ কে এম লুৎফর রহমান, এ কে এম সিদ্দীক, এ কে এম সামসউদ্দিন, এ টি এ জাফর আলম, এম এইচ চৌধুরী, এম এ এম ফয়জুল মহী, এম নূর হোসেন, এম হামুদুর রহমান, এস এম ইসমাইল হোসেন, এস এম ফজলুল হক, এস এম সাইফুল ইসলাম, এস এম মান্নান (লাডু ভাই), কছিম উদ্দিন আহম্মদ, কবির উদ্দিন, কাজী আবদুল মালেক, কাজী আবুল কাশেম-১, কাজী ওবায়দুল হক, কামিনী কুমার চক্রবর্তী, কালাচাঁদ রায়, খালেদ রশীদ, মোঃ ইলাহী বক্স, গিয়াস উদ্দিন আহাম্মদ, গোবিন্দ চন্দ্র বিশ্বাস, গোলাম মহিউদ্দিন আহমদ, গোলাম রহমান, গোলাম সারওয়ার, গোলাম হোসেন, চিত্ত রঞ্জন রায়, চিশতী শাহ হেলালুর রহমান, জিকারুল হক, ছমির উদ্দিন মণ্ডল, জহির রায়হান, জহিরুল ইসলাম, জিতেন্দ্র লাল দত্ত, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, তসলিম উদ্দিন আহমদ, তারাকান্ত ভৌমিক,  দেবেশ চন্দ্র চৌধুরী, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, নাওশাদ আলী তরফদার, নিজামুদ্দিন আহমদ, নিত্যানন্দ পাল, নতুন চন্দ্র সিংহ, নূরুল আমিন খান, প্রফুল্ল চন্দ্র বিশ্বাস, ফজলুর রব, ফেরদৌস দৌলা বাবলু, বদিউজ্জামান মণ্ডল, ধীরেন্দ্রনাথ সরকার, মজিবর রহমান, মকসুদ আহমদ, মনিভূষণ চক্রবর্তী, মতিউর রহমান, মনোরঞ্জন, মশিউর রহমান, মহসিন আলী দেওয়ান, মহিউদ্দীন হায়দার, মামুন মাহমুদ, মায়াময় ব্যানার্জী, মাশুকুর রহমান, মাহমুদ হোসেন আখন্দ, মিজানুর রহমান সাইফ, মীর আবদুল মুক্তাদির, মেহেরুন্নেসা, মোঃ আবদুল বারী মিয়া, মোঃ আমিন উদ্দিন, মোঃ আরজ আলী, মোঃ খবির উদ্দিন মিয়া, মোঃ তসলিম উদ্দিন, মোঃ নজরুল ইসলাম, মোঃ মনসুর আলী মল্লিক, মোঃ মোমিনুল হক, মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন, মোঃ মোসলেম উদ্দিন মিয়া, মোঃ রোস্তম আলী, মোঃ শহর আলী, মোঃ সেকান্দর আলী, মোয়াজ্জেম হোসেন, মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, মোহাম্মদ মোর্তাজ, মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মোহাম্মদ শামসুজ্জামান, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, রণদা প্রসাদ সাহা, রফিকুল ইসলাম, রবি বসাক, রমনী কান্ত নন্দী, রাখাল চন্দ্র দাস, রামকৃষ্ণ অধিকারী, রাশীদুল হাসান, রেজাউন নবী, রেবতী কান্ত সান্যাল, ললিত কুমার বল, লুৎফুন্নাহার (হেলেনা), শফিকুর রহমান ভূঁইয়া, শরাফত আলী, শশাঙ্ক পাল, শহীদ সায়ের, শহীদুল্লাহ কায়সার, শামসুজ্জামান, সামসুদ্দোহা, শামসুল হক, শামসুল হক খান, শাহ আবদুল মজিদ, শাহ মোহাম্মদ সোলায়মান, শিবাজী মোহন চৌধুরী, শেখ আবদুস সালাম, শেখ মাহতাব উদ্দিন, শেখ হাবিবুর রহমান, শৈলেন্দ কুমার সেন, সন্তোষ কুমার দাস, সাদত আলী, সায়ীদুল হাসান, সিরাজুদ্দিন হোসেন, সিরাজুল হক খান, সুনাহার আলী, সুনীল বরণ চক্রবর্তী, সুখরঞ্জন সমাদ্দার, সুধীর কুমার ঘোষ, সুলেমান খান, সেলিনা পারভীন, সৈয়দ আবদুল হাই, সৈয়দ নজমুল হক, হাবিবুর রহমান, হরিনাথ দে, হাসিময় হাজরা, হেমচন্দ্র বসাক (বলাই), রশীদ সরকার, গোলকার হোসেন তালুকদার, আবদুর রহিম খান, আয়েশা বেদৌরা চৌধুরী, হুমায়ুন কবির, কায়সার উদ্দিন, গোলাম মুর্তজা, হাফিজ উদ্দিন খান, জাহাঙ্গীর, মিহির কুমার সেন, সালেহ আহমদ, সুনীল চন্দ্র শর্মা, মকবুল আহমদ, এনামুল হক ও লেঃ কঃ জাহাঙ্গীর। ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় যারা শহীদ হন তারা হলেন সিরাজুদ্দিন হোসেন ১০ ডিসেম্বর, এম এ মান্নান এ আকতার ১০ ডিসেম্বর, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, ১১ ডিসেম্বর  সৈয়দ নজমুল হক ১১ ডিসেম্বর। ১৪ ডিসেম্বর যে সব বুদ্ধিজীবী গ্রেফতার হন তারা হলেন ডা. আমিনুদ্দিন আহমদ, ডা. আজহারুল হক, ড. হুমায়ুন কবীর, ডা. ফজলে রাব্বী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, আনোয়ার পাশা, রশিদুল হাসান, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ। ১৫ ডিসেম্বর যে সব বুদ্ধিজীবী গ্রেফতার হন তারা হলেন শামসুর রহমান ওরফে শামস ইরানী, ড. আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। বিশাল তালিকায় বুদ্ধিজীবীদের নাম রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের হত্যা কাহিনী উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। উল্লেখযোগ্য কয়েক বুদ্ধিজীবীর নির্মম হত্যা কাহিনী বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে যা নিচে বর্ণনা করা হলো। ২৫ মার্চের গভীর রাতে ড. জিসি দেব ঘুমিয়েছেন। গভীর রাত। হঠাৎ দরজায় বুটের লাথি। দরজা খুলে দিলেন জিসি দেব। দরজা খোলামাত্র খুনিরা প্রবেশ করল কক্ষে, ইতর ভাষায় অশ্রাব্য গালি দিল ড. জিসি দেবকে। শয়তানরা তার গালে প্রচণ্ড এক চপেটাঘাত করে। তার অপরাধ তিনি দরজা খুলতে দেরি করেছেন। এরপর প্রশ্ন করে অস্ত্রশস্ত্র গোলা-বারুদ কোথায় আছে? বুকে ঠেকিয়ে রেখেছে বেয়নেট। গুলির শব্দে বাড়ি প্রকম্পিত। উš§ত্ত পশুদের উল্লাসে বাড়িতে আতঙ্ক। মুহূর্তে খুঁচিয়ে শেষ করে দেয়া হয় ড. জিসি দেবকে। প্রাণহীন দেহ রক্ত স্রোতের মধ্যে পড়ে থাকে। শয়তানরা উল্লাস করে চলে যায়। অভিনেতা, গায়ক, সুরকার আলতাফ মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয় ৩০ আগস্ট। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’Ñএই বিখ্যাত গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদ। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে। আচমকা দরজায় করাঘাত। আতঙ্কে কম্পিত মন অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। দরজা খুলতেই চোখে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি জিপ দাঁড়িয়ে। হানাদার বাহিনীর সেনারা ঘিরে ফেলেছে তার আউটার সার্কুলার রোডের বাড়িটি। এ সময় পাকিস্তানি সৈনিকদের সঙ্গে দু’জন বাঙালি যুবক ছিল, যারা আলতাফ মাহমুদকে চিনিয়ে দেয়। আলতাফ মাহমুদকে ওই দুই যুবক চিনিয়ে দেয়া মাত্র, পাঞ্জাবী খান সেনারা মাহমুদের দু’হাত কষে ধরে ফেলে। তার ওপর চলে উপর্যুপরি অবর্ণনীয় অত্যাচার। নিয়ে যাওয়া হয় তাকে অজানার উদ্দেশ্যে। ধারণা করা হয়, ৩ সেপ্টেম্বর তাকে হত্যা করা হয়েছে। তার লাশের কোনো হাদিস পাওয়া যায়নি। ১৯৬/৩-এর শান্তিবাগ বাসা থেকে ৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। এ বাসাটি তার নিজস্ব নয়। তিনি থাকতেন ছোট ভাইদের বাসায়। নিখোঁজ হবার দিন, দুপুর বারোটার দিকে তিনি গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পরনে ছিল ড্রেসিং গাউন, হাতে লুঙ্গি, গেঞ্জি, তোয়ালে। টেবিলে তার জন্য খাবার প্রস্তুত। গোসল সেরেই তিনি খেতে বসবেন। ঠিক ওই মুহূর্তে ছাই রঙের প্যান্ট পরিহিত, মুখে বিভিন্ন রঙের রুমাল বাঁধা, হাতে অস্ত্র নিয়ে ৮/৯ যুবক, কাদা মাখানো একটি বাস নিয়ে হাজির হয় তার বাসায়। যুবকরা জোর করে প্রবেশ করে ওই বাড়িতে। বিকেলের মধ্যে তাকে ফিরিয়ে দেবে বলে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। এখন আছেন শহীদদের তালিকায়। তরুণ সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফাকে হত্যা করা হয় ১ ডিসেম্বর। তাকে গ্রেফতার করা হয়, তার বাসা থেকে। মোস্তফা তার স্ত্রী ঝর্ণা মোস্তফার কোল থেকে সবেমাত্র ৯ মাসের শিশু সন্তান অভিকে কোলে নিয়ে পাঁয়চারী করছিলেন। এরই মাঝে তার বাসায় উপস্থিত হয় হানাদার বাহিনীর তিন জল্লাদ। তারা মোস্তফাকে বাইরে ডেকে এনে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। বাচ্চাকে নামিয়ে রেখে তাদের সঙ্গে তিনি বেরিয়ে যান। এরপর আর তিনি ফিরে আসেননি। সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমদকে ধরে নিয়ে যায় আলবদরা। তিনি ছিলেন বিবিসি ও অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-এর সংবাদদাতা। ১১ ডিসেম্বর তাকে হত্যা করা হয়। তার অপরাধ ছিল, বিবিসির এক রিপোর্ট বলা হয়েছিল, জেনারেল নিয়াজী পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছেন। এই সংবাদে নিয়াজী ব্যক্তিগতভাবে বিবিসির প্রতিনিধির ওপর ক্ষিপ্ত হন। তিনি নিজেই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসে নিজাম উদ্দীনকে খোঁজেন। তাকে না পেয়ে তিনি চলে যান। পরে আলবদররা তাকে ধরে নিয়ে জেনারেল নিয়াজীর নির্দেশই হত্যা  করে। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ১৪ ডিসেম্বর, স্নান সেরে মার কাছে খাবার চেয়েছিলেন মাত্র। সে সময় ঢাকার সেন্ট্রাল রোডে অধ্যাপকের   পৈত্রিক বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে আলবদর সদস্যরা। অধ্যাপক চৌধুরীকে জানায়, কমান্ডার আপনাকে কিছুক্ষণের জন্য ডাকছেন। এখনই ফিরে আসবেন। এই বলে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি গায়, এলোমেলো চুল নিয়েই তিনি বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন। পশুরা তাকে হত্যা করে। তিনি আর ফিরে আসেননি। আনোয়ারা পাশা থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারের ৩০ নং বিল্ডিংয়ে। ১৪ ডিসেম্বর তার বাসায় আসেন আলবদরের সদস্যরা। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পে। সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। শামসুর রহমান ওরফে শামস ইরানী ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায় গ্রেফতার হন। কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর লোকেরা তার রায় সাহেব বাজারস্থ বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। রাতেই তাকে হত্যা করা হয়। তার লাশ পাওয়া যায় রায়ের বাজার ইটাখোলাস্থ বধ্যভূমিতে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার কিভাবে বাসা থেকে গ্রেফতার হন  সে বর্ণনা দিয়েছেন তার স্ত্রী পান্না কায়ছার। ‘মুক্তিযুদ্ধ আগে ও পরে’ গ্রন্থে। ১২ ডিসেম্বর চারটা পর্যন্ত কাফ্যু ছিল না।... ওকে জিজ্ঞেস করলামÑ তোমরা কি নিয়ে তর্ক করছ? বলেছিল আমাকে বাসা থেকে চলে যেতে। সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রধান নবীকভ ওর খুব বন্ধু ছিলেন। উনি খবর পাঠিয়েছেন সোভিয়েত দূতাবাসে আশ্রয় নিতে। চারদিকে গুপ্ত হত্যা চলছে। কথাটা শুনেই আমার মনে পড়ল ১০ তারিখে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার হত্যাকাণ্ডের কথা। এরপর আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম, তুমি আর দেরি কর না, আজই চলে যাও।’ তারপর পান্না কায়সার চাচা শ্বশুরকে অনুরোধ করেন তিনি যেন শহীদুল্লাহ কায়সারকে অন্যত্র সরে যেতে বলেন। চাচাও কায়সারকে বোঝান। ‘ঠিক হলো পরদিন (১৩ ডিসেম্বর) শহীদুল্লাহ বাসা থেকে সরে যাবে। একাই যাবে।’ শহীদুল্লাহ বের হয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসেন। তিনি আর যাননি। ১৪ ডিসেম্বর ‘রাজাকাররা ভেতরে ঢুকেই সবাইকে আটকে ফেলেছে। যার জন্য ওদের উপরে আসতে দেরি হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর ৩-৪ জন লোক টপটপ করে উপরে উঠে এলো। ওদের সবাইর মুখ কালো কাপড়ে বাঁধা। ব্লাক আউটের কারণে ঘরে মোমবাতি জ্বলছিল। রাজাকাররা শহীদুল্লাহর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কি? শহীদুল্লাহ ওর নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে কুকুরগুলো ওর হাতটা ধরে টান দিয়ে বলল, চলুন আমাদের সঙ্গে। আমার চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে ননদ সাহানা দৌড়ে বারান্দার বাতিটা জ্বালিয়ে দিল। ইতোমধ্যে ওকে ওরা টানতে টানতে সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। আমিও এক হাত ধরে ওকে টেনে ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ঘাতকরা বেয়নেটের নল দিয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। আমি ছিঁটকে পড়ে গেলাম। একপর্যায়ে বেবী ওর এক হাত দিয়ে ওদের একজনের মুখের কালো কাপড়টা টান দিয়ে খুলে ফেলল আর অমনি আলোতে লোকটার চেহারা দেখে ফেললাম। ওরা টানতে টানতে ওকে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যাবার সময় শহীদুল্লাহ আরো জোরে বোনের হাতটা ধরে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেননি। এভাবেই বাসা থেকে তিনি ধরা পড়েন। রাজাকাররা যখন গেটে ধাক্কাধাক্কি করছিল তখন শহীদুল্লাহ কায়সার ভেবেছিলেন মুক্তিবাহিনীর লোকেরা বুঝি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।’
সাংবাদিক সৈয়দ নজমুল হক ছিলেন পিপিআইএর ঢাকা অফিসের চীফ রিপোর্টার। তাকে ঘাতকরা ধরে নিয়ে যায় ১১ ডিসেম্বর ভোর ৪টায়। হঠাৎ নজমুল হক বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করেন। কারণ তার বাসার ছাদ হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ছে। এর মাঝে ঘাতকরা এসে তাকে হত্যা করে। বিজ্ঞান গবেষণাগারে সিনিয়র রিসার্চ কর্মকর্তা ড. আমিনুদ্দিন আহমদকে আলবদররা তার বাসভবন থেকে ১৪ ডিসেম্বর ধরে নিয়ে হত্যা করে। তার লাশ পাওয়া যায়নি। ১৫ ডিসেম্বর ড. আজাহারুল হক ও ড. হুমায়ুন কবির তাদের কর্মস্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে বদর বাহিনী তাদের ধরে নিয়ে যায়। নটর ডেম কলেজ সংলগ্ন পোলের কাছে তাদের লাশ পাওয়া যায়। ১০ ডিসেম্বর রাতে আলবদর বাহিনীর লোকেরা এম এ মান্নান ও এম এ আকতারের পুরানা পল্টনস্থ বাসভবনে হামলা করে। তাদের দু’জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের দু’জনের বিকৃত লাশ পাওয়া যায় রায়ের বাজারে। চিকিৎসক ডা. ফজলে রাব্বিকে ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে রাজাকার-আলবদর ও আর্মির লোকেরা তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। এ সম্পর্কে তার স্ত্রী ডা. জাহানারা রাব্বি লিখেছেনÑ ‘এসে দেখলাম তিনি ওদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করেছেন। চারদিক থেকে ৫-৭ জন সশস্ত্র সৈন্য তাকে ঘিরে আছে। আমি দৌড়ে গিয়ে বাধা দিতে চেষ্টা করলাম। ‘হল্ট’ বলে দু’জন এগিয়ে এসে আমার বুকে বন্দুকের নল চেপে ধরল। আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি দেখলাম পেছন থেকে তিনি মাথা উঁচু করে হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন। গাড়িটা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল। ওরা আমার বুক থেকে বন্দুক নামাল। তখন বেলা ৪টা ১৫ মিনিট। ১৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাত তিনটায় লালমাটিয়া ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে ট্রাক তুলে তাদের রায়ের বাজারের ইটখোলায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই খুন করা হয়।’ ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেনকে হত্যা করা হয় ১১ ডিসেম্বর। ১০ ডিসেম্বর রাত তখন প্রায় দশটা। চামেলীবাগের বাসায় টেলিভিশন দেখছিলেন। ভালো লাগছে না। তাই হারিকেনের অস্পষ্ট আলোতে লুডু খেলতে  বসেছেন ছেলেদের সঙ্গে। এক মনে খেলছেন। স্ত্রী নূরজাহান বেগমের শরীর অসুস্থ। ছোট ছোট বাচ্চা তিনটিও ঘুমিয়ে পড়ল। ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে থেকে কে যেন দরজায় মৃদু আঘাত করল। ঘরের প্রতিটি প্রাণী সচকিত হলো আঘাতের শব্দে। ওরা কেউ সাহস করে খুলে দিল না দরজা। দেখতে চেষ্টা করল না যে, এত রাতে এভাবে কে এলো। পাঁচ মিনিট পর আবার। কিন্তু হতবিহ্বল ওরা শুধু অসহায়ভাবে বসে থাকলেন। সিরাজুদ্দিন সাহেব শেষবারের আঘাতের সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। পিতার সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়েছেন দ্বিতীয় পুত্র শাহিন। এগিয়ে গেল সে দরজার কাছে। কিন্তু কাছে কোথাও গুলি ছোড়ার শব্দে দরজা না খুলেই দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। কেটে গেল আর পাঁচ মিনিট। দরজা খুলে দিলেন। বারান্দাটা তখন ফাঁকা। হয়ত নিঃশব্দে আঁধারে গা ডুবিয়ে তাকে সাবধান করতে আরো কেউ এসেছিল। ব্যর্থ হয়েই ফিরে গেছে তারা। দরজাতে শেষবার আঘাত পড়েছিল রাত সাড়ে তিনটার কাছাকাছি। ভারি বুটের লাথি। ভেতরে ঢুকে আলবদররা দেরি করল না। অবকাশ দিল না কাউকে কিছু বলার। একটা গামছা এনে শক্ত করে বেঁধে ফেলল সিরাজ সাহেবের চোখ দুটি। তারপর শুধু লুঙ্গি পরনে আর গেঞ্জি গায়ে প্রচণ্ড শীতের মাঝে থরথর কম্পমান তার শীর্ণ দেহটি মিলিয়ে গেল ওদের সঙ্গে ব্লাক আউটের কালো আঁধারের মাঝে।
    প্রতি বছর  ডিসেম্বর এলেই বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস পালন এবং বিজয়ের সুরে আমরা বিমোহিত থাকি। সময়ের ব্যবধানে শুধু মনে পরে এই শহীদ মনীষীদের কথা। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি ১৯৭১ সালের ঘাতকরা কেউ গ্রেফতার হয়েছে, কাউকে গ্রেফতার করার প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমান সরকারের সদইচ্ছায় এই অপরাধীদের বিচার দ্রুত হবে বলে সবার বিশ্বাস। সম্প্রতি প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বিদেশ সফরকালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিষ্পন্ন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তার এই আহ্বান বর্তমান সরকারের বিচার প্রক্রিয়াকে যথেষ্ট সমর্থন হিসেবে পরিগণিত হওয়ারই কথা।     এর আগের প্রতিটি দিবসে শুধু বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিচারণ এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দিবসের সমাপ্তি করা হয়েছে। চলতি ডিসেম্বর, বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তি, আমরা কলঙ্কের দ্রষ্টা পাপীদের  শেষ দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় রইলাম। 

রাশিয়ার রাজনৈতিক অশান্তি এবং পুতিনের ভবিষ্যত্প্রশ্ন
ড. ইশা মোহাম্মদ
সোভিয়েত ইউনিয়নেই বলে রাশিয়া হারাবে অনেক কিছুই। পুতিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। রাশিয়াই পারে একমাত্র রুখে দিতে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে বিশ্বব্যাপী মার্কিন শোষণ-নির্যাতন বন্ধ করে দিতে পারে রাশিয়াই। সেটা বুঝেই রাশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে চায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। পুতিন বিজয়ী হলে, আর একবার প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। এটাই হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদীদের  জন্য ভয়ের কথা। কারণ পুতিন ছাড়া ইরানের পক্ষে সরাসরি আর  কেউ যুদ্ধে অংশ নেবে না। চীন কখনই প্রত্যক্ষভাবে কোনো দেশের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয় না। ভিয়েতনাম যুদ্ধে, কালুচিয়ার যুদ্ধে চীন অংশগ্রহণ করে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। যার ফলে চীনের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা চীনের সমাজজীবনে দারুণ প্রভাব ফেলেছে। এখন চীন নিজ দেশের সার্বিক উন্নয়নে ব্যস্ত।  অন্য দেশের সার্বিক উন্নয়ন এবং সার্বভৌমত্বের জন্য নিজের জীবন উ
ত্সর্গ করবে না। কিন্তু রাশিয়া করবে। যদি রাশিয়ায় পুতিনের মতো নেতা থাকে তবে রাশিয়া অবশ্যই মার্কিনীদের বিপক্ষে দাঁড়াবে। যাদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে তাদের স্বার্থে নয়Ñ রাশিয়ার নিজস্ব স্বার্থে। রাশিয়া এখন আর কমিউনিস্ট নেই। ধনতন্ত্রী হয়ে গেছে। ধনতন্ত্রী রাশিয়া মার্কিনীদের যতই বিশ্বব্যাপী মুনাফা সন্ধান করে। মধ্যপ্রাচ্য রাশিয়ার জন্য একটি মুনাফার আকর। কিন্তু মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্য গেড়ে বসেছে। প্রায় সব ক’টি দেশই এখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের করতলগত। যে সব দেশ মার্কিনীরা কব্জা করেছে, সে সব দেশে, বিশেষত মিসর, ইরাক এবং লিবিয়াতে রাশিয়ার স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে তার অবস্থান নতুন করে তৈরি করতে চায়। ইরান ইস্যুকে সে জন্য কাজে লাগাতে চায়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনোমতেই ইরান আক্রমণ করতে সাহস পাচ্ছে না। ইরানে পারমাণবিক অস্ত্র আছে, সে জন্য নয়Ñ ইরানের সঙ্গে রাশিয়াকেও আক্রমণ করতে হবে। এত বড় ঝুঁকি মার্কিনীরা এখন নেবে না। তাদের ভয় অন্য খানে। মধ্যপ্রাচ্যে নয়Ñ খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই হামলা হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমি হবে রণক্ষেত্র। এটি তাদের কাম্য নয়। তারা একটি সীমিত পারমাণবিক যুদ্ধ করতে চায়। রণক্ষেত্র হবে মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সশরীরে উপস্থিতি সে পরিকল্পনার পথে বড় বাধা। রাশিয়া আক্রান্ত হোক তা মার্কিনীরা চায় না। কারণ প্রতিঘাতে মার্কিনীরাও আক্রান্ত হবে। যে কোনো মার্কিন সরকার রিপাবলিকান কিংবা ডেমোক্র্যাট, নিজ ভূখণ্ডে যুদ্ধ চায় না। তাদের দেশের জনমতও ওই রকম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা অনেকটা স্বার্থপর গোছের। সে দেশের অধিকাংশ মানুষ তাদের দেশের মাটিতে  পারমাণবিক যুদ্ধ হোক তা চায় না। কিন্তু অন্য দেশের ভূখণ্ডে যুদ্ধ হলে তাদের খুব একটা আপত্তি নেই। মার্কিন সরকার জনমতের বিরুদ্ধে যাবে না। তাই পারমাণবিক যুদ্ধের ব্যাপারে তারা খুবই সাবধান। সীমিত পারমাণবিক যুদ্ধ তারা করবেইÑ কিন্তু অন্য কোনো দেশের ভূখণ্ডে। সেই সাবধানতার অংশ হিসেবেই রাশিয়াকে তারা গুরুত্ব দেয়। তাদের ধারণা হয়েছেÑ রাশিয়ার ক্ষমতায় পুতিন থাকলে ইরান আক্রমণ করা যাবে না। কিংবা উত্তর কোরিয়াকেও আক্রমণ করা যাবে না। কিন্তু পুতিন ক্ষমতায় না থাকলে অবস্থা ভিন্নরকম হবে। এই বিষয় সমীকরণকে গুরুত্ব দিয়ে রাশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টায় মেতেছে সাম্রাজ্যবাদীরা। রাশিয়াকে আচ্ছামতো শিক্ষা দেয়া হয়ত মার্কিনীদের পক্ষে সম্ভব হতো ন্যাটোর সহায়তা নিয়ে। কিন্তু বনেদী ধনতন্ত্রী ইউরোপ এখন মন্দা মোকাবেলায় পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের দেশের জনগণ ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়েছে সামরিক ব্যয়ের কারণে তাদের আরাম আয়েশে বিঘœ সৃষ্টি হওয়ার কারণে। তারা অন্যত্র যুদ্ধের কারণে ঘরে বসে কষ্ট ভোগ করতে চায় না। এখন মন্দার ধাক্কা চলছে। বনেদী ধনতন্ত্রী  ইউরোপ মন্দা মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে। তাদের ঋণ বাড়ছেই। জনজীবন অতিষ্ঠ হওয়ার পথে। এখন তারা যুদ্ধে জড়িয়ে নিজেদেরকে নতুন করে বিপদে ফেলতে চায় না। লিবিয়ায় আক্রমণ করে তারা প্রভূত ধন সম্পদ পাবেÑ এমন লোভও দেখানো হয়েছিল। কিন্তু এখন সাধারণ মানুষ লিবিয়াতে ন্যাটোর সংশ্লিষ্টতাকে ঘৃণার চোখে দেখছে। এহেন পরিস্থিতিতে মার্কিনীরা একা একা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে যাবে কি করে? যেখানে তার নিজ ভূখণ্ড আক্রান্ত হওয়ার ভয় আছে?
উপায় একটাইÑ মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল আক্রান্ত হবে না, এমন নিশ্চয়তার জন্য তারা ইরানে আক্রমণ করতে চাচ্ছে। কিন্তু রাশিয়ার নিষ্কৃয়তা নিশ্চিত না হয়ে আক্রমণ করবে না। রাশিয়ার পুতিন ইরানের হয়ে লড়বে। তাই নির্বাচনের  সুযোগ নিয়ে পুতিনকে  সরিয়ে দেয়ার একটা সুযোগ নিতে চায়। পুতিন জয়লাভ করেছে। যদি এই জয়কে গণবিক্ষোভে বানচাল করা যায় তবে হয়ত পুনরায় নির্বাচনে পুতিন আসবে না। এ রকম একটা উদ্ভট ভাবনা থেকে সাম্রাজ্যবাদ রাশিয়াতে উস্কানি দিয়ে বিক্ষোভে চেষ্টা করছে। রাশিয়ায় মধ্যপ্রন্থী কোনো নেতাকে ক্ষমতায় বসানো গেলে মার্কিনীরা নিশ্চিত হতে পারে, কিন্তু তেমন কোনো মধ্যপন্থী নেতাকে রাশিয়ার জনমতে প্রভাবশালী গণসংগঠন এবং রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সমর্থন করবে না।  তারা কমিউনিস্ট সরকার গঠন করতে চায়। যেমন সরকার আবার সাম্রাজ্যবাদীরা চায় না। রাশিয়ায় বর্তমানে ত্রিশঙ্কু অবস্থা চলছে। সাম্রাজ্যবাদ লাইন করতে চাচ্ছে। তাতে লুম্পেন বুর্জোয়ারা ধরা পড়েছে। পুতিন নতুন একটি জাতীয়তাবাদী শ্রেণী গঠন এবং তার সমর্থন নিয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে চাচ্ছে। আর কমিউনিস্ট পুরানো ধরনের সোভিয়েত তৈরি করতে চাচ্ছে। জাতীয়তাবাদী ও কমিউনিস্টদের মধ্যকার শ্রেণীদ্বন্দ্বই মার্কিনীরা পুঁজি করতে চায় তাদের নাশকতার জন্য। সোভিয়েত কেন পুনর্বার প্রতিষ্ঠিত হবে? এটাই এখন সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে বড় প্রশ্ন? কিন্তু পৃথিবীময় যে সাম্রাজ্যবাদী অত্যাচার-অনাচার আগ্রাসন চলছে, তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় যে একটাই তা বিশ্বের প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক এবং দার্শনিকতা বুঝে গেছে। হিসেব একটাই। সোভিয়েত থাকতে সাম্রাজ্যবাদ কোথাও সশরীরে আক্রমণ করেনি। কেবলমাত্র ভিয়েতনাম। কিন্তু সেখানে মারাÍকভাবে মার খেয়ে লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। আজকের দুনিয়ার সোভিয়েত থাকলে ইরাক, লিবিয়া, আক্রান্ত হতো না। পৃথিবীব্যাপী সোর উঠেছে, সোভিয়েত চাই। রাশিয়া ধনতন্ত্র চাই না। রাশিয়ার মানুষ সোভিয়েত চায় কি-না তা এখন বিশ্বের নির্যাতিতরা ভাবছে না। তারা মনে করে মার্কিনীরা যেহেতু সোভিয়েতকে ভয় পায়Ñ তাই সোভিয়েতকেই পুনরায় বাস্তবে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু রাশিয়ার বাস্তব পরিস্থিতি ওই একইভাবে  উচ্চারিত হয় না। রাশিয়া এখন কোনোমতেই পুরানো সোভিয়েতে ফিরতে পারবে না। যা পারে, তা হচ্ছে জাতীয় বুর্জোয়ারা  কমিউনিস্টদের সঙ্গে নিয়ে পূর্বতন সোভিয়েত এর ভৌগোলিক সীমাকে একটি অভিন্ন কাঠামোগত স্থিত করা। এই নতুন কাঠামোগত স্থিতি অসংখ্য ভিন্নমতের একটি অবৈরিমূলক বিচরণক্ষেত্র হতে পারে। নিয়ত প্রবৃদ্ধির কারণে এবং প্রয়োজনে ওই নতুন ধরনের আশ্চর্য সম্ভাবনায় বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরি করবে, যা সাম্রাজ্যবাদকে কোণঠাসা করতে পারবে। তৃতীয় বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের জন্য তা হচ্ছে এক ধরনের শাস্তি। পুতিন যদি টিকে থাকতে চায় এবং রাশিয়াব্যাপী তার জনসমর্থন অব্যাহত থাকে কমিউনিস্টদের সঙ্গে ঐক্য গঠন করতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনকে উ
ত্সাহ দিতে হবে। বিশ্বব্যাপী গণনিপীড়নের বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদী সমাজের আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সরকার চায় না। তারা নিজ দেশের উত্পাদনের সমবণ্টন চায়। ওয়ালস্ট্রীট দখল করার আন্দোলন অনেকটা সেই কথাই বলেছে। কিন্তু বর্তমান ধনতান্ত্রিক কাঠামোকে বাঁচিয়ে রেখে তা সম্ভব নয়Ñ সেটি তারা বুঝছে না। বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলন যদি জোরদার হয় এবং কমিনটার্ন যদি আÍপ্রকাশ করে নতুন আঙ্গিকে, কিংবা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে যদি রাশিয়া যোগদান করে এটিকে কমিউনিস্ট এবং জাতীয়তাবাদীদের ঐক্য গঠনের আন্তর্জাতিক মঞ্চে পরিণত করতে পারে তবে বিশ্বব্যাপী যে অশান্তি তৈরি করেছে সাম্রাজ্যবাদ তার নিরসন হতে পারে। পুতিনের প্রতি অনেকেই আশার চোখে তাকিয়ে আছে। যদি পুতিন স্বৈরতন্ত্রী না হয় এবং জনগণের মনোবাঞ্ছা বুঝে কমিউনিস্টদের সঙ্গে ঐক্য সাধন করতে পারে তবে বিশ্বব্যাপী জনকল্যাণমুখী একটি রাজনৈতিক ভাবগত অস্তিত্ব তৈরি হবে, যা হবে আগ্রামী প্রজšে§র জন্য একটি আলোক দিশারী। সম্ভবত ক্রান্তিকালীনে রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে তার ধারণা আছে এবং তিনি স্বাভাবিকভাবেই সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারবেন। 
অস্তিত্ব সংকটের কবলে ভাষা
মযহারুল ইসলাম বাবলা
বাংলাদেশের প্রান্তজুড়ে দেশব্যাপী আমরা অনায়াসে মাত্র একটি ভাষায় সবাই সবার সঙ্গে কথা বলে থাকি। দ্বিতীয় বা বিকল্প ভাষার প্রয়োজন হয় না। তবে দেশের সকল অঞ্চলের নিজস্ব আঞ্চলিক কথ্য ভাষা আছে। যার একটির সঙ্গে অপরটির মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা রাষ্ট্রীয় ভাষাও। একমাত্র বাংলা ভাষা আঞ্চলিক সব ভাষার সীমা ডিঙ্গিয়ে সবার কাছেই যেমন বোধগম্য তেমনি বলার ক্ষেত্রেও সবাই বলে থাকি। বাংলা ভাষা বলতে ও বুঝতে অক্ষম তেমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের নিকট প্রতিবেশী বৃহৎ ভারতে যা অসম্ভব। বিশাল ভারতের স্বীকৃত ভাষা প্রায় সাতাশটি। হিন্দি বলয়ের প্রদেশ ব্যতীত প্রায় প্রদেশের নিজস্ব প্রাদেশিক ভাষা আছে। রাষ্ট্রীয় হিন্দি ভাষা অনেক প্রদেশের প্রাদেশিক ভাষাকে পর্যন্ত অতিক্রম করতে পারেনি। পায়নি রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা পর্যন্ত। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে তো নয়ই। দক্ষিণের চার রাজ্য কেরালা, কর্ণাটক, তামিলনাড়–, অন্ধ্র প্রদেশ ঘুরে সেখানে রাষ্ট্রীয় হিন্দি ভাষার প্রচলন দেখিনি। ওই চার প্রদেশের মালায়ালম, কানাড়া, তেলেগু এবং তামিল ভাষার বিকল্প ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিন্দি নয়, ইংরেজি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন দুশ’ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের ঘেরাটোপের নানা দৃষ্টান্ত এখনো বিদ্যমান। ভাষার ক্ষেত্রে  যেমন, তেমনি আইন-কানুন, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, শাসক শ্রেণীর শাসন-শোষণ প্রায় সবই। রাষ্ট্রীয় হিন্দি ভাষাকে দক্ষিণের মানুষরা কেবল প্রত্যাখ্যানই করেনি। রীতিমতো অবজ্ঞা-ঘৃণার দৃষ্টিতেই দেখে থাকে। তাই দক্ষিণে হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির ঠাঁই নেই। সেখানকার সমৃদ্ধ স্বীকৃত প্রাদেশিক ভাষার ওপরই তারা নির্ভরশীল। বিকল্প একমাত্র ভাষাটি  ইংরেজি। যা প্রবলভাবে সেখানের সকলের মুখে মুখে ফেরে। ভারতের স্বীকৃত প্রাদেশিক ভাষার পাশাপাশি অস্বীকৃত প্রচুর কথ্য আঞ্চলিক ভাষা আছে। যার সংখ্যা নিরূপণ অসম্ভব। প্রতিটি প্রদেশেই আছে অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা। যেগুলো স্থানীয়ভাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহƒত হতো। তবে সেগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে চলেছে। একে একে হারিয়েও যাচ্ছে। আঞ্চলিক ভাষাগুলোর বিলুিপ্ততে বিশ্বয়ানের তোপ এবং সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠায় হিন্দি-ইংরেজি ভাষা নির্ভরতা। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং রাষ্ট্রভাষাও। দেশজুড়ে স্বীকৃত এই বাংলা ভাষার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার প্রচলনও আছে। তবে আঞ্চলিক ভাষা কেবলই কথ্য ভাষা। বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বর্ণমালা নেই বলেই লিখিত হবার উপায় নেই। আঞ্চলিক ভাষাগুলোর কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল নেই। এক অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা অপর অঞ্চলের মানুষের পক্ষে বুঝা অসাধ্য-অসম্ভব। প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষা স্বতন্ত্র এবং স্বকীয়। আমাদের এই বৈচিত্র্যপূর্ণ কথ্য আঞ্চলিক ভাষায় ভাটির টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ক্রমেই আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন সংকুচিত হয়ে আসছে। এক সময় পিতা-মাতারা নিজ নিজ সন্তানদের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও এখনকার পিতা-মাতারা তা করেন না। শুদ্ধ প্রমিথ বাংলায় কথা বলে থাকেন। এতে নতুন প্রজšে§র মুখে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এছাড়া আছে বিশ্বায়নের প্রকোপ। সব মিলিয়ে আমাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ আঞ্চলিক ভাষা এখন হুমকির মুখে। ক্রমেই মানুষের মুখ থেকে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে বৈচিত্র্যপূর্ণ আঞ্চলিক ভাষাসমূহ। হুমকির মুখে থাকা ভাষার এক মানচিত্র আছে ইউনেস্কোতে। সম্প্রতি অন লাইনে ইউনেস্কোর তৃতীয় সংস্করণে দেখা গেছে দু’হাজার পাঁচশত আশিটি ভাষা এখন হুমকির কবলে। একে একে লুপ্ত হবার পথে। ইউনেস্কোর আশংকা অধিক ভাষা হারাবে ভারতে। ওই তালিকায় ১৯৬টি ভাষাকে অধিক বিপন্নগ্রস্ত বলে আশংকা প্রকাশ করেছে। ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রচুর ভাষা এরই মধ্যে হারিয়ে যাবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। শঙ্কার বিষয় এই তালিকায় বাংলাদেশেরও নাম আছে। আমাদের গ্রাম বাংলা থেকে শিক্ষার প্রয়োজনে যে ব্যক্তিটি শহরে পা রাখে। শিক্ষা শেষে তার আর গ্রামে ফিরে যাওয়া হয় না। জীবিকার জন্য তাকে শহরেই স্থায়ী হতে হয়। হয় তার শ্রেণী উত্তোরণও। তার অতীতের পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কারণে এবং শহুরে পারিবারিক নতুন জীবনে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের উপায় থাকে না। গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অগণিত মানুষ  স্রেফ জীবিকার তাগিদে শহরমুখো হয়ে আঞ্চলিক ভাষার বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়ে। তাদের মুখে থেকেও ক্রমেই হারিয়ে যায় আঞ্চলিক ভাষা। প্রযুক্তির কারণে গ্রাম এবং শহরের দূরত্ব কমে আসায় আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারেও ভাটির টান পড়েছে। এরূপ নানাবিধ কারণে আমাদের আঞ্চলিক ভাষা হুমকির মুখে। ভাষার দখলদারিত্বের পেছনে অর্থনৈতিক বিষয়টির যুক্ততাকেও অস্বীকার করা যাবে না। এক্ষেত্রে এটাও অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্কৃতি প্রকাশের মাধ্যম ভাষা। সংস্কৃতিগত পরিবর্তনে প্রকাশের পরিবর্তন ঘটে বলেই ভাষা ব্যবহারের পরিবর্তন ঘটে চলেছে। অথচ আঞ্চলিক ভাষার নানা উপাদানে মাতৃভাষা সমৃদ্ধ হবার পথটি আমরা ক্রমশ হারিয়ে চলেছি। যার ক্ষতি পূরণ হবার নয়। একমাত্র ভাষার জন্য জীবন দেয়া জাতি বিশ্বে বিরল। আমরা আমাদের মাতৃভাষার রক্ষায় লড়াই-সংগ্রাম করেছি। যে বাংলা ভাষা রক্ষায় আমাদের ত্যাগ ও আত্মদান। সেই ভাষাও কিন্তু নানা সঙ্গত কারণে হুমকি মুক্ত নয়। দেশ স্বাধীন হয়েছে অজস্র আত্মত্যাগের বিনিময়ে। স্বাধীন দেশে বাংলা ভাষা যতটা হুমকির মুখে, পরাধীন দেশেও কিন্তু অতটা হুমকির মুখে ছিল না। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করা হয়েছে অথচ রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্র ভাষার ব্যবহার নেই। রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিচার বিভাগ স্বাধীনতার সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পরেও রাষ্ট্র ভাষার ব্যবহার সেখানে নেই। ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলের ধারাবাহিকতাই নির্লজ্জভাবে অটুট রয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রচুর প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার পর্যন্ত নেই। আমাদের ত্রিমুখী শিক্ষাক্রম, মাধ্যমিক, আরবি ভাষা নির্ভর পশ্চাৎপদ মাদ্রাসা শিক্ষা এবং সমাজের বিত্তবান ও সুবিধাভোগী মধ্যবিত্তদের ইংরেজি ভাষা নির্ভর শিক্ষাক্রম। যা শ্রেণী বিভাজনের ন্যায় সমাজ ও রাষ্ট্রে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। আমাদের বৈষম্যপূর্ণ সমাজে শিক্ষাক্রমও বৈষম্যপূর্ণ। গরিব ঘরের সন্তানেরা যুক্ত হয় মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাক্রমে। সুবিধাভোগী শ্রেণীর সন্তানরা ইংরেজি ভাষা নির্ভর শিক্ষাক্রমে। একমাত্র দেশের সংখ্যাগরিষ্ট নিম্নমধ্যবিত্ত ও সাধারণের সন্তানেরাই কেবল বাংলা ভাষা নির্ভর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে যুক্ত। অথচ আমাদের শিক্ষাক্রম একমুখী এবং মাতৃভাষাকেন্দ্রিক হবে, সেটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের  মৌলিক চেতনার অন্তর্গত। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আমাদের  সেই লক্ষ্য অর্জনে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থায় এর থেকে উত্তোরণের উপায় নেই। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা বাস্তবায়নেই তা সম্ভবপর হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় আশা করা দুরাশার শামিল বলে মনে করি। প্রতিটি ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন দর্শন ও সংস্কৃতি। ভাষার বিলুপ্তিতে জ্ঞানের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব অনিবার্য। একমাত্র ভাষা ব্যতীত আত্মপ্রকাশের অন্য কোন বিকল্প পথ নেই। বিশ্বের অধিক ভাষার লিখিত রূপ নেই বলেই এসব ভাষা মানুষের মুখে মুখেই বেঁচে থাকে। এর ব্যবহার বন্ধ হওয়া মানেই নিশ্চিত বিলুপ্তি। এ সব ভাষার সঙ্গে বিলুপ্তি অনিবার্য সামাজিক ঐতিহ্য, লোকজ সংস্কৃতি-সম্পদ। সভ্যতার বিকাশ ও বিশ্বের বৈচিত্র অনুসঙ্গ রক্ষায় বর্ণমালাহীন কথ্য আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা অপরিহার্য। বিজ্ঞানের প্রতিটি সৃষ্টি মানুষের কল্যাণের জন্য, সত্য। তবে সেই সৃষ্টির ইতি-নেতি উভয়ের প্রভাব লক্ষণীয়। ডিশ চ্যানেলের ইতিবাচক দিকটি কারো পক্ষে অস্বীকারের উপায় নেই। তাই বলে নেতির দিকটিও উপেক্ষা করা যাবে না। বিদেশী ভাষার বিশেষ করে হিন্দি ভাষার চ্যানেলগুলোর নানা প্রভাব আমাদের সমাজ-জীবনে ভয়ানক মাত্রায় বিস্তার করে চলেছে। তরুণ প্রজšে§র ক্ষেত্রে তো বটেই। পাকিস্তানি শাসকেরা নানাভাবে আমাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপাতে চেয়ে ব্যর্থ হলেও, ডিশ চ্যানেলের কারণে হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতি আমাদের ওপর চরমভাবে ভর করেছে। বাংলাদেশের ডিশ দেখা কেউ হিন্দি ভাষা জানে না-বুঝে না, তেমন ব্যক্তির সন্ধান বোধকরি পাওয়া যাবে না। আমাদের সমাজ জীবনে জগদ্দল পাথরের ন্যায় হিন্দি ভাষা ক্রমেই চেপে বসেছে। আমাদের বাংলা ভাষার দেশীয় চ্যানেলগুলো পর্যন্ত হিন্দি চ্যানেলগুলোর অনুকরণে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে। হিন্দি স্টেজ অনুষ্ঠানগুলোর আদলে আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলোর স্টেজ অনুষ্ঠানে কেবল ভাষার ভিন্নতা ছাড়া সবই প্রায় অভিন্ন। পাশাপাশি হিন্দি অনুষ্ঠানের রিমেকও আমরা আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলোতে দেখে থাকি। কলকাতার বাংলা চ্যানেলগুলোতে হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির বেপরোয়া অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তাদের পক্ষে হিন্দি উপেক্ষা করার উপায় নেই। যেহেতু হিন্দি তাদের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এমনটি নিশ্চয় আমরা আশা করি না। বাস্তবতা হচ্ছে এই হিন্দি চ্যানেলের দৌরাত্ম্যে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি বিকাশে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি  হয়েছে। এই সংস্কৃতি আগ্রাসন প্রতিহত করতে না পারলে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা অসম্ভব হয়ে উঠবে। আর তার  ােরত দিতে হবে পুরো জাতিকে। 

ভবিষ্যত সমাজতন্ত্রেরই
মনির তালুকদার
এ বছরের ৭ নভেম্বর উদযাপিত হয়েছে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ৯৪তম বার্ষিকী হিসেবে। ৭৪ বছরের অস্তিত্বের পর ১৯৯১ সালে ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই বিপর্যয়ের বিংশতিতম বর্ষ এ বছরেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের দু’দশককে যেভাবে স্মরণ করা হচ্ছে তার ধরণ ও বিষয়বস্তু কিন্তু নয়ের দশকের তুলনায় আলাদা। কারণ সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়কে পুঁজিবাদের চূড়ান্ত বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সে সময় দাবি করা হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের সমাপ্তি সূচিত হচ্ছে এবং এরপর মানবজাতির ভবিষ্য
হলো উদারনৈতিক পুঁজিবাদের স্থায়ী অধ্যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ২০ বছর কেটে গেছে। মধ্যবর্তী এই সময়ের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে, এই সিদ্ধান্তেই আসতে হবে যে, সমাজতন্ত্রের মতাদর্শের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে সাধারণ মানুষ যে সুযোগ সুবিধা পেতেন, তার প্রায় সবগুলোই বর্তমান পুঁজিবাদী রূপ দেশে বেড়ে নেয়অ হয়েছে। ফলে সেখানে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ বাড়ছে। চলতি বছর ৭ নভেম্বর মস্কোতে যে সমাবেশ হয়েছে তা নজিরবিহীন। তাই রুশ দেশে এখন নতুন করে কমিউনিস্ট পার্টি পুনর্গঠন হচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণে উদ্ভুত দ্বন্দ্ব বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থায় বিরাজমান চারটি প্রধান দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। সংযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পতনের মধ্যদিয়েই এই দ্বন্দ্ব¡ বাস্তবতা লাভ করেছিল। একে আজ অস্বীকার করা বা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। যদিও বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা গভীর মন্দার ও শ্রমের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব তীক্ষè ও তীব্র হচ্ছে, তা সত্ত্বেও পুঁজিবাদী থেকে সমাজবাদী ব্যবস্থায় উত্তরণের প্রশ্নে বিরাজমান প্রধান দ্বন্দ্বটিকে অস্বীকার বা গুরুত্বহীন করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বরং বলা যায় পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্বের যথার্থ যুক্তিগ্রাহ্য সমাধানে সেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাই সামনে চলে আসছে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয় এবং পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধারক ও বাহকদের মধ্যে সীমাহীন উল্লাস ফেটে পড়তে দেখা গেছে। শুধু উল্লাস ব্যক্ত করার মধ্যে দিয়েই পুঁজিবাদের অনুসারীরা যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন তা কিন্তু নয়। বরং কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই বিপর্যয়কে সত্যতা এবং অবশ্যম্ভাবীতাকে নস্যাৎ করে দেয়ার চেষ্টা করেছে এবং আজও পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকেরা সেই ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের নিজেদের মতো করে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে বলবার চেষ্টা করছে যে মার্কসবাদ লেনিনবাদ একটি মৃত দর্শন। সমাজতন্ত্র অপ্রাসঙ্গিক এবং এর কোনো ভবিষ্যৎ সর্বোৎকৃষ্ট, শ্রেষ্ঠ, অপরিবর্তনীয় এবং চিরন্তন। অথচ এরাই বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় জটিল মন্দাজনিত সমস্যার নিখাদ দগদগে ক্ষতকে অস্বীকার করতে পারছে না। যদিও চেষ্টা করছে এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসবার নানা পন্থা উদঘাটনের কিন্তু তা পুঁজিবাদকে আরো গভীর সমস্যায় নিমজ্জিত করছে। এটাই স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার অভ্যন্তরেই এর সসমস্যার মূল কারণগুলো নিহিত রয়েছে। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার মূল কথা ও লক্ষ্য হচ্ছে মুনাফা। মুনাফার ভিত্তি হচ্ছে, যে সামাজিক শ্রমের বিনিময়ে পণ্য উ
পাদন করা হয়, উপাদনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমদানকারী শক্তিকে সেই শ্রমের ন্যায্য মূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা। এক কথায় উদ্বুত্ত শ্রম বা পণ্যের উদ্বুত্ত মুল্য আÍসাৎ করেই পুঁজির অর্জন এবং ওই মুনাফা ব্যক্তিপুঁজির স্ফীতি ঘটায়। রাষ্ট্রের অর্থাৎ জনগণের এতে কোনো লাভালাভের সুযোগ নেই। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পুঁজি, পরিকল্পনা এবং বাজারের উপর রাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রকৃত অর্থে পুঁজি ও বাজারই রাষ্ট্রের অর্থ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত ও পর্যায়ক্রমে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থনীতিই রাষ্ট্রীয় রাজনীতি বা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে, এটাই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বা মুখ্য বৈশিষ্ট্য। সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাদী শক্তি ব্যবস্থার পান্ডা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিশ্বায়নের স্লোগানের আড়ালে নতুন বিশ্ব অর্থ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভোর। পরিস্থিতি সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে। একটি সময়ে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রভাবে চলে যায়। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে পৃথিবীর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তেমনভাবে উন্নত বা অগ্রসরমান কোনো রাষ্ট্রে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তন কিন্তু সে সময়ে হয়নি। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। মহামতি কার্ল মার্কস তার বিশ্লেষণ থেকে ওই সম্ভাবনার বিষয়টি ভেবেছিলেন যে, উন্নত ও অগ্রসরমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, পুঁজিবাদের মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে শোষিত শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তন হবে, তার পরিবর্তে তুলনামূলকভাবে অনুন্নত সোভিয়েত রাশিয়া সহ পূর্ব ইউরোপেও অনুরূপ তুলনামূলকভাবে অনুন্নত বা পিছিয়ে থাকা অবস্থা সম্পন্ন এলাকাতেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তন হয়েছিল। এতে অগ্রসরমান বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বস্তুগতভাবে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত সেদিন হয়নি। কারণ সেভাবে তার এলাকা সংকুচিত হয়নি। যদিও নবীন, অর্থ ব্যবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি তাদের প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছিল। তাদেরকে এক নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। যার পরিণতিতে নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে এবং জনগণের দৃষ্টি সমাজতন্ত্রের বিপরীতে ঘুরিয়ে দিতে, নিজেদের স্বার্থ ও মুনাফা লোলুপতা খানিকটা সংবরণ করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু সমাজ কল্যাণকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বাধ্য হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয় এবং সোভিয়েত রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের পূর্বতন বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ও পরিব্যাপ্ত হয়। স্বাভাবিকভাবেই এতে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার সুবিধা হয়ে যায়। বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য সাম্রাজ্যবাদের দিকে হেলে পড়ে। এই সমস্ত সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে বিশ্ব পুঁজিবাদ সকল ক্ষেত্রেই সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বা সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের লালসায় সারা পৃথিবী জুড়ে বাধা বন্ধনহীনভাবে দাপিয়ে বেড়াবার চেষ্টা করেছে। মুনাফাশিকারী বিশ্ব পুঁজির সামনে কোন বাধাকেই সহ্য বা গ্রাহ্য করতে বিশ্ব পুঁজির ধারক বাহকরা রাজি নয়। যেখানেই বাধা বা প্রতিবাদ সেখানেই যুদ্ধ বিগ্রহ, আগ্রাসন, অর্থনৈতিক অবরোধ, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটিয়ে নিজেদের বংশবদদের বসাবার চেষ্টা। গোটা বিশ্ব আজ যা প্রত্যক্ষ করছে। কিন্তু এত সবকিছু সত্ত্বেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একটা সমস্যা থেকে বেরোতে গিয়ে আরেক সমস্যার জলে গড়িয়ে যাচ্ছে এ থেকে থেকে স্থায়ীভাবে উত্তরণের ধ্বংস সাধনের মধ্যদিয়ে কেবলমাত্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যারা নির্দয়ভাবে শোষিত, বঞ্চিত রিক্ত নিস্ব হচ্ছেন- তারা মুক্তি পেতে পারেন। অপরদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, চলমান পর্যায়ে বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য সামাজ্যবাদের দিকে হেলে পড়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র শক্তি সমূহকে এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন যে হতে হয়েছে এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও মন্দাজনিত অর্থনৈতিক সমস্যার যে আগুনে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দগ্ধ হচ্ছে সে আগুনের ছোঁয়া থেকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাসমূহ বহুলাংশে নিজেদের দূরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে। একই গতি বা হারে সম্ভব না হলেও সাধারণভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ধারা, জনজীবন যাত্রায় ক্রমোন্নতির ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে। এই সাফল্যকে অস্বীকার করার সাধ্যকারো নেই। এটাই স্বাভাবিক। কারণ এ ব্যবস্থা পুঁজিবাদী আর্থ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনীতিকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। এই ব্যবস্থায় রাজার আছে কিন্তু রাষ্ট্র তাকে নিয়ন্ত্রণ তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। পুঁজির দৌরাÍ্যরে সুযোগ এখানে নিয়ন্ত্রিত। উদ্বৃত্ত শ্রম, মূল্য বা মুনাফা এখানে ব্যক্তি পুঁজির স্ফীতির সহায়ক নয়। এর সমুদয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্র সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের উন্নয়নে, অগ্রগতিকে জনস্বার্থে তার বিনিময় ঘটায় বা ব্যবহার করে। পরিণতিতে উৎপাদিকা শক্তির শোষিত হবার, বঞ্চিত হবার কিংবা এর ক্রমাগত বিকাশ ধারা বাধা প্রাপ্ত হবার সুযোগ বা সম্ভাবনাগুলো এই ব্যবস্থার অভ্যান্তরেই বিনষ্ট করে দেয়া হয়। তাই মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থারই অনুকূলে এই সত্য সমাজতন্ত্রের শত্র“ পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের ধারক বাহকরা জেনে বুঝেই নিরন্তর অন্তঃসার শূন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জয়ডংকা এবং শঙ্কা ও ভীতি থেকে সমাজবাদের কল্পিত মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে। কিন্তু এভাবে কি পুঁতি গন্ধময় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্বরূপ এবং সমাজবাদী ব্যবস্থার স্বর্ণ সম্ভাবনাকে ঢেকে রাখা যাবে? এর অর্থ কিন্তু এটাও নয় যে, যেহেতু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বারবার মন্দার সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে এবং এ থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না তাই আপনাআপনি পতন ঘটবে এবং পরিণতিতে আপনাআপনি সমাজবাদী ব্যবস্থার অভ্যুদয় হবে। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা অন্যরকম। পুঁজিবাদ এর আগেও এরকম সমস্যায় পড়েছিল। কিন্তু এ থেকে বেরও হয়ে এসেছে। যদিও সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে পারেনি বা শোষণ ও মুনাফা ভিত্তিক এই অর্থ ব্যবস্থায় এটা সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসানে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শ্রেণী সচেতনতা বৃদ্ধির ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় জনগণকে ব্যাপকভাবে সুসংগঠিত করা। নিরবচ্ছিন্ন ধারায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন, শ্রেণী ও বিপ্লবী সংগ্রামের আঘাতে আঘাতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিতকে জর্জরিত করা। বর্তমান বিশ্ব জনশক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন সাধন করা এবং মানুষের শোষণ মুক্তির পথকে উš§ুক্ত ও অবারিত করা।